আজ ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার | ১৮ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

এখন সময়- দুপুর ১২:৪২

আজ ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার | ১৮ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে ভোটের জোট ও জোটের রাজনীতি

বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় রাজনীতিতে জোটের ধারণা দারুণ জনপ্রিয়। ইউরোপের উন্নত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলসমূহও এখন জোটমুখী। কোনো কোনো ¶েত্রে জোট গঠন ব্যতীত ¶মতার সমীকরণও সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং তা অপরিহার্যও বটে। উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিতে জোটের প্রবণতা শুরু হয়েছে গত শতকের শেষ দুই দশকে। বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রচর্চা পুরোপুরি শুরু হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই এখানে জোট-রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে।
বিশ্বব্যাপী রাজনীতিতে জোটবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে একক কোনো নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার কারণে। মানুষ এখন একক কোনো নেতৃত্বে বা দলের প্রতি আস্থাশীল নয়। রাজনৈতিক নেতাদের চারিত্রিক স্খলন, শঠতা ও চাতুর্য তাদেরকে গণমানুষ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। তাদের নেতৃত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে।
গণতান্ত্রিক সমাজে একক নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতার আরেকটি কারণ সেখানে বহুত্ববাদী ধারণার প্রসার। এটাকে গণতান্ত্রিক সমাজের অপরিহার্য পরিণতিও বলা যায়। গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষের মতপ্রকাশের যে অবাধ ¯^াধীনতা রয়েছে, তারই পরিণতিতে সেখানে ডান, বাম ও মধ্যপন্থার সাথে সাথে অতি ডান, অতি বাম ও চরমপন্থার বিকাশ ঘটছে। যা একক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে তৈরি করছে ¶ুদ্র ¶ুদ্র দল ও নেতৃত্ব। গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকি¯^রূপ গড়ে ওঠা এ রাজনৈতিক বিভক্তিই জোটবদ্ধ রাজনীতিকে জনপ্রিয় করে তুলছে।
¯^াধীন বাংলাদেশে জোটবদ্ধ রাজনীতির স‚চনা হয় ¯ৈ^রাচারি শাসক এরশাদের আমলে। এরশাদের ¯ৈ^রতন্ত্র থেকে দেশকে মুক্ত করতে এ দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ প্রায় সবাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে। য‚থবদ্ধ আন্দোলনে এরশাদের পতন নিশ্চিত হওয়ার পরপরই শুরু হয় ¶মতায় যাওয়ার লড়াই। দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমমনা রাজনৈতিক দল নিয়ে আপন আপন বলয় তৈরি করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫ দল নিয়ে এবং বিএনপি ৭ দল নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জোটপ্রবণতা কমলেও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা আবার ফিরে আসে। এরপর থেকে ক্রমশই রাজনৈতিক জোটগুলো সংখ্যার মহড়ায় পরিণত হচ্ছে। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জাতীয় পার্টি, জামায়াত ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট গঠন করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি গঠন করে ২০ দলীয় জোট। আর এবার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ গঠন করেছেন ৫৮ দলীয় জোট।
১৪ দলীয়, ২০ দলীয় ও ৫৮ দলীয় জোট বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোট-রাজনীতির অসারতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। কারণ, এসব জোটের অধিকাংশ দলই নামসর্ব¯^ ও ব্যক্তিনির্ভর। একদিকে যেমন ভোট-বাস্তবতায় প্রায় ম‚ল্যহীন এ দলগুলো বড় দলের সঙ্গে জোট করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়ার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে বড় দল তাদেরকে জোটবদ্ধ করে তালিকা দীর্ঘ করছে।
বিবেচ্য বিষয় হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোটের জোট ও জোটের রাজনীতির যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তার ফলাফল কি? উন্নত দেশের রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে এর পার্থক্যটা কোথায়?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক জোট ও তার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বড় দলের প্রতি ছোট দলের দাসত্ব ও লেজুরবৃত্তিই বড় হয়ে দেখা দেয়। জোটবদ্ধ ছোট দল যতোদিন জোটে থাকে, ততোদিন বড় দলের সিদ্ধান্তে ‘জি হুজুর’ বলেই থাকতে হয়। আর যদি কখনো বড় দলের সঙ্গে ‘বনিবনা’ না হয় এবং জোটত্যাগ করতে চায় তবে দল ভাঙ্গনের মুখোমুখি হয়। এটা সাধারণ দল ও ইসলামি ধারা উভয়ের ক্ষেত্রেই সত্য।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোটের ভালো-মন্দ উভয় দিকের প্রধান দৃষ্টান্ত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি। গণ আন্দোলনে পতিত এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে আছে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। দেশের প্রধান দুটি দল এরশাদের বিরুদ্ধে যূথবদ্ধ আন্দোলন করলেও ¶মতার সিঁড়ি হিসেবে এরশাদকে ব্যবহার করতে কসুর করেনি কেউ। বিশেষত আওয়ামী লীগ যতোবার সরকার গঠন করেছে এরশাদের সমর্থনেই করেছে। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক মহলের কাছে জাতীয় পার্টিই আওয়ামী লীগের মুখ র¶া করেছে।
বিপরীতে এরশাদের জাতীয় পার্টি বার বার ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। প্রথমবার দলের মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আওয়ামী লীগের মন্ত্রীসভায় থাকার জন্য দল ভাঙ্গেন। বিএনপির মন্ত্রীসভায় থাকার জন্য অপর মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জু আবারও দলের গলায় ছুরি চালান। দলের অখণ্ডতা র¶ার জন্য এবারও এরশাদকে ‘জি হুজুর’ করেই মহাজোট সরকারকে সমর্থন দিয়ে যেতে হচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে যতোবারই এরশাদ মহাজোট ছাড়া চিন্তা করেছে ততোবারই তার দলের অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়েছে।
ইসলামী ধারার দলগুলোর মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোটই কেবল জোটবদ্ধ হয়ে ¶মতার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। চারদলীয় জোটের গুরুত্বপ‚র্ণ অংশিদার হিসেবে দলটি জাতীয় সংসদ পর্যন্ত পৌঁছার সুযোগ পায়। কিন্তু মন্ত্রীসভায় সুযোগ পাওয়ার আগেই দলে বিভক্তি দেখা দেয়। শাইখুল হাদিস আল্লাামা আজিজুল হক রহ. ও মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. এর নেতৃত্বে ভাগ হয়ে যায় ইসলামী ঐক্যজোট। বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও দু’বার ভাঙ্গনের মুখোমুখি হতে হয় দলটিকে এবং তাও হয়েছে জোটে থাকা ও না থাকার প্রশ্নে। বর্তমানে ইসলামী ঐক্যজোট ভিন্ন ভিন্ন নামে চার ভাগে বিভক্ত।
এক সময় ইসলামী ঐক্যজোট ইসলামি ধারার দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম থাকলেও এখন তা নিছক দলে পরিণত হয়েছে। ¯^াভাবিকভাবে রাজনৈতিক পরিধিও সংকীর্ণ হয়ে এসেছে দলটির।
পশ্চাত্যের রাজনৈতিক জোটগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের রাজনৈতিক জোটের মৌলিক পার্থক্য এখানেই। পশ্চিমা বিশ্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক মনোভবের কারণে বড় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলেও ছোটদলের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ে না। ¶মতার মোহে রাজনৈতিক নেতারাও দলীয় সিদ্ধান্ত উপে¶া করে না। দলের গলায় ছুরিও চালায় না। রাতারাতি দলবদলের প্রবণতাও সেখানে কম।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক জোটের এমন করুণ পরিণতির প্রধান কারণ হলো, বড় দলের কর্তৃত্ববাদী মনোভাব এবং ছোটদলের রাজনৈতিক অসহায়ত্ব। এখানে বড় দল ও ছোটদলের মাঝে কাঠামোগত পার্থক্য প্রায় রাত-দিনের। বড় দলগুলো এই রাজনৈতিক দুর্বলতার ষোল আনা সুযোগই সব সময় গ্রহণ করে। হুমকি-ধমকি ও প্রলোভনে ছোটদলের নেতাদের ঘায়েল করতে তারা কখনো ভুল করে না।
আদর্শিক ও ইসলামি সংগঠনগুলোর জন্য রাজনৈতিক জোট আরও বেশি বিব্রতকর। সাধারণ ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসলামি সংগঠনের ল¶্য, উদ্দেশ্য, কর্মপন্থা ও নেতাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সবকিছুতে ভীষণ দ‚রত্ব রয়েছে। সুতরাং কোনো একপ¶ের ছাড় দেয়া ব্যতীত দীর্ঘদিন এক সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু ইসলামি দলগুলোই তুলনাম‚লকভাবে কিছুটা দুর্বল; তাই তাদেরই আদর্শিক বিসর্জনের তিক্ততা হজম করতে হয়। গত দুই দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্তত তাই বলে।
এছাড়াও বড় দলগুলোর লুটপাট, দুর্নীতি, অন্যায় ও অবিচারের দায়ও তাদের বহন করতে হয় ¶েত্র বিশেষ। সাধারণ মানুষের সাদা চোখে তারা হয়ে ওঠেন অন্যায়ের সহায়ক শক্তি। অন্য দশটি দলের মতো ¶মতায় প্রলুব্ধ।
বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দাবি বাংলাদেশের মানুষ দিনদিন ইসলামি অনুশাসনের প্রতি ঝুঁকছে। তবে প্রভাব কমছে ইসলামি রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের। এর একটি কারণ হতে পারে লেজুরবৃত্তির রাজনীতি ও বড় দলের নানান অপকর্মের দায়। ভিন্ন মতাদর্শী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ সহযাত্রা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে অন্যদের আদর্শিক পার্থক্যও ম্লান করে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে ইসলামি দলগুলোও তাদের শরিক দলের মতো ¶মতার জন্য রাজনীতি করেন। সুতরাং আদর্শিক মূল্যবোধের ধারক হিসেবে সমাজে তাদের যে প্রভাব ছিলো তা হ্রাস পাচ্ছে।
একইভাবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ গত এক দশকে রাজনৈতিকভাবে যে সাফল্য পেয়েছে তার অন্যতম কারণ ¯^তন্ত্র রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা এবং আদর্শিক অবস্থান অ¶ুণœ রাখা। এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ ইসলামি দলগুলোকে যতোটা না ¶মতায় দেখতে চায়; তার চেয়ে বেশি প্রত্যাশা করে তাদের রাজনৈতিক ‘সতীত্ব’ যেনো র¶া পায়।
তাহলে কি ইসলামি দলগুলো ¶মতামুখী হবে না? যদি ¶মতায় না যায় তাহলে তাদের ¯^প্ন ও আদর্শ বাস্তবায়ন করবে কিভাবে? আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের ‘ভোটের রাজনীতিতে ধর্ম, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি’ নামক প্রতিবেদনে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যেতে পারে।
প্রতিবেদনে প্রতিবেদক প্রথমেই ¯^ীকার করেছেন বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতিতে ধর্ম, বিশেষত ইসলাম বড় ফ্যাক্ট। এরপর তিনি ইসলামি ভোটব্যাংক দখলের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের হজ, উমরা, টুপি, তাসবিহ, নামাজ ও মাজারে গমনসহ নানান কসরতের কথা তুলে ধরেছেন। এর অর্থ হলো, নানা কসরতের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো ইসলামি ভোটব্যাংক দখল করলেও ইসলামি রাজনীতিবিদরা তা থেকে উপকৃত হতে পারছেন না। না হলে তারা ভোট পান না কেনো?
তাই ইসলামি দলগুলোর কাজ হবে অন্যের হাতে নিজের ভোটব্যাংক তুলে না দিয়ে আস্থাশীল নেতৃত্ব গড়ে তুলে তা থেকে উপকৃত হওয়া। যা একই সঙ্গে তাদের আদর্শিক সংগ্রাম ও ¯^প্ন বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।

লেখক : আতাউর রহমান খসরু
তরুণ লেখক, গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

Leave a Comment

লগইন অথবা নিবন্ধন করুন

লগইন
নিবন্ধন