আজ ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ শনিবার | ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এখন সময়- দুপুর ১২:২৯

আজ ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ শনিবার | ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রফেসর ড. নাজমুদ্দীন এরবাকান: ব্যক্তিত্ব ও ইসলামি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা

ভূমিকা
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দীন এরবাকান বা নেজমেদ্দীন এরবাকান (তুর্কি: ঘবপসবঃঃরহ ঊৎনধশধহ) হলেন একজন শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, শিল্পউদ্যোক্তা, রাজনীতিক, তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বইসলামি আন্দোলনের অন্যতম তাত্তি¡ক ও আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি ছিলেন গোটা বিশ্বে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন, তুরস্কে শিল্পবিপ্লবের নায়ক এবং ইসলামি আন্দোলনের সিপাহসালার। তিনি ১৯৬৯ সালে মিল্লি গুরুশ (গরষষর এস্খৎহৃş) বা জাতীয় ভিশন প্রবর্তনের মাধ্যমে তুরস্কে ইসলামি ধারার রাজনীতির প্রবর্তন করেন, তিনি ১৯৯৬Ñ১৯৯৭ সালে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও তুরস্ক এই আটটি উন্নয়নশীল মুসলিম দেশ নিয়ে ডি-৮ (উ-৮ ড়ৎ উবাবষড়ঢ়রহম ঊরমযঃ) গঠিত হয়েছিল। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় সাহায্য প্রেরণকারী আলোচিত তুর্কি এনজিও আইএইচএইচ (ঐঁসধহরঃধৎরধহ জবষরবভ ঋড়ঁহফধঃরড়হ)-এর প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।
তুরস্ক ছিল গৌরবময় মুসলিম খিলাফতের কেন্দ্রস্থল। ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া তিন মহাদেশজুড়ে এর বিস্তৃতি ছিল। এটি ছিল মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির প্রতীক, ক্রুসেডার ও ইসলামবিরোধী ইহুদি-খ্রিস্টান অপশক্তির জন্য আতঙ্ক এবং মুসলমানদের পবিত্র ভ‚মি ও ইসলামি বিশ্বের প্রতিটি ইঞ্ঝি জমির হেফাযতকারী প্রতিষ্ঠান। ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি উগুজ গোত্রের কায়ী বংশের আমির গাযী উসমান (রহ.) এর বুনিয়াদ রেখেছিলেন। তাঁর প্রতি স¤^ন্ধিত খিলাফতে উসমানিয়া (১৫১৭Ñ১৯২৪ খ্রি.) ৪০৭ বছর মুসলমানদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আনজাম দিয়েছে। যা ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট মোস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে গ্রান্ড ন্যাশনাল অ্যাসে¤^লি কর্তৃক খিলাফত বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
মোস্তাফা কামালের নেতৃত্বে খিলাফত বিলুপ্ত হয়, শরীয়ত নিষিদ্ধ হয়, শরীয়তের ওলামায়ে কেরাম নির্বাসিত হন, ইসলামের প্রচারক পীর-মাশায়েখ ও তাঁদের খানেকা নিষিদ্ধ হয়, মাদরাসা ও দীনী দরসেগাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সীমিতভাবে মসজিদ ব্যবস্থাপনা চালু থাকলেও আরবি আযানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, মসজিদে যাতায়তকারীদের গতিবিধিতে নজরদারি করা হয়, মসজিদগামী নওজোয়ানদেরকে হয়রানি ও বিপদের সম্মুখীন করা হয় এবং বড় ও ঐতিহ্যবাহী মসজিদসমূহ বন্ধ কিংবা জাদুঘরে পরিণত করা হয়। মা-বোনদের পর্দাপ্রথা সম্পূর্ণ ওঠিয়ে দেওয়া হয়, তার পরিবর্তে বাধ্যতামূলকভাবে পশ্চিমা স্টাইলে জিন্স, শর্ট প্যান্ট-শার্ট ও হাপ প্যান্ট পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়। ইসলামি গৌরব, উসমানি ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সাহিত্য থেকে তুর্কি জাতির সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে উসমানি হরফের পরিবর্তে ল্যাটিন বর্ণে তুর্কি ভাষার সংস্কার করা হয়।
ধর্মকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অন্তরায় হিসেবে ধরে নিয়ে তুরস্ক থেকে ইসলাম ও উসমানি ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ বিতাড়নের সব বন্দোবস্ত করা হলেও তুরস্কের তৎকালীন সেক্যুলার, ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলাম বিদ্বেষী নেতৃবৃন্দ তুরস্কের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালের ২৩ জুলাই মিত্র ও সহযোগী শক্তির সাথে তুরস্কের লোজানচুক্তি (ঞৎধরঃল্ক ফব খধঁংধহহব) নামে খ্যাত চুক্তি ¯^াক্ষরিত হয়েছিল। এ-চুক্তির কিছু গোপন ধারার মাধ্যমে তুরস্কের হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয়, জাতি হিসেবে তুরস্ককে ইউরোপ তার গোলামে পরিণত করে। এসব ধারা অনুযায়ী তুরস্ক তার ভ‚খণ্ডে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে তেল-গ্যাস ও কোনো ধরনের খনিজ-সম্পদ আহরণ করতে পারবে না, কোনো গবেষণাকর্মও পরিচালনা কিংবা অনুসন্ধানও করতে পারবে না, এমনকি কোনো তুর্কি কোম্পানিও দেশের বাইরে এককভাবে বা যৌথভাবে এ ধরনের কাজ অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তুরস্ক তার প্রয়োজনীয় যাবতীয় তেল-গ্যাস দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে বাধ্য থাকবে। চুক্তিতে ইস্তানবুল বন্দর ও বরপরাস নদীকে আন্তর্জাতিক মালিকানা বলে ¯^ীকৃত হয় এবং এই বন্দর নদী দিয়ে চলাচলকারী জাহাজ থেকে তুরস্ক কোনো মাসুল উসুল করতে পারবে না।
রাজনীতিক নেতৃত্ব, আমলা ও প্রশাসন সর্বত্র দুর্নীতি ঝেঁকে বসেছিল। সিন্ডেকেট দ্বারা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো। তুরস্কের তখনকার অর্থনীতি কৃষি, পশুপালন ও রাখালিনির্ভর হয়ে পড়েছিল, এর বাইরে জনগণের কোনো কাজ ছিল না। ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কারখানা ও উৎপাদনমুখী বাণিজ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমলা ও ব্যবসায়ী সিন্ডেকেট বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কল-কারখানা প্রতিষ্ঠা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নে জাতিকে পঙ্গু করে রেখে দেশকে সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর করে রাখা হয়। এতে করে রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে, দেশ তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয় এবং তুরস্ক ইউরোপের ‘রুগ্ণ মানুষ’ হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করে। একসময় যেজাতি পুরো মুসলিমবিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তিন মহাদেশজুড়ে শাসনক্ষমতা বিস্তৃত করেছিল এবং বিশ্বের এক সুপার পাওয়ার ছিল সেই তুরস্ক দীন-ধর্মহীনতার এক মহাফিতনার শিকার হয়ে আর ক্ষুধা-দ্রারিদ্রতা, দীনহীনতা ও অর্থনীতিক পশ্চাৎপতার কারণে ভবিষ্যতে পুনর্বার বিশ্বনেতৃত্ব হাসিলের ¯^প্ন দেখবে দূরে থাক, বরং অনিশ্চিত আগামী নিয়ে চরম হতাশায় হাবুড়াবু খাচ্ছিল।
এই অবস্থায় মুসলমানদের আধ্যাত্মিক উন্নতি, অর্থনৈতিক ¯^াবল¤ি^তা ও ইসলামিক ইউনিয়ন গড়ে তোলার পরম লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে আসেন প্রফেসর ড. নাজমুদ্দীন এরবাকান। তিনি বিশ্বনেতৃত্ব নিয়ে হতাশ মুসলমানদের মাঝে আত্মবিশ্বাসের বীজ বুনে দেন। আধ্যাত্মিক উন্নতি, অর্থনীতিক ¯^াবল¤ি^তা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্প-বাণিজ্যে উৎকর্ষতা অর্জনের মাধ্যমে হারানো শক্তি ফিরিয়ে আনতে মুসমিলবিশ্বকে মন্ত্রণা দেন এবং বিশ্বনেতৃত্বের জন্য একটি ইসলামিক ইউনিয়ন গড়ে তোলার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি ছিলেন সফল নেতৃত্ব, মুসলমানদের এমন সংকটকালে যে সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের পরিচয় তিনি দিয়েছেন তা হানাদার মোঙ্গল বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সুলতান সাইফুদ্দীন কুতুয এবং তুর্কি উসমানী জাতির পিতা আরতুগ্রæল ইবনে সুলাইমান শাহের সাথে তুলনীয়।
আনাতোলিয়ায় আরুগ্রæল মোঙ্গলবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি একটি ¯^াধীন তুর্কি সালতানতের ¯^প্ন দেখতেন, যার প্রাতিষ্ঠানিক বুনিয়াদ রেখেছিলেন তাঁরই সুযোগ্য সন্তান মহাবীর গাজী উসমান বে। অন্যদিকে বাগদাদের কসাই হালাকু খানের বাহিনী যখন মিসর আক্রমণে অগ্রসর হয় ফিলিস্তিনের আইনে জালুতে প্রথমবারের মতো তাদেরকে যিনি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করেছিলেন তিনি হলেন সেনাপতি রুকুনুদ্দীন বাইবার্স। তাঁর পেছনে মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন মামুলক সুলতান সাইফুদ্দীন কুতুয। তুরস্কে ইসলামের রাজনীতিক যে পুনর্জাগরণ এর সফল বাস্তবায়নকারী যদি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়িব এরদোয়ান হয়ে থাকেন তাহলে এর ¯^প্নদ্রষ্টা, নির্দেশক ও আধ্যাত্মিক রাহবর হলেন প্রফেসর ড. নাজমুদ্দীর এরবাকান। এরবাকানের ব্যক্তিত্ব স্পেনবিজয়ী তারিক ইবনে যিয়াদের পৃষ্ঠপোষক মহাবীর মুসা ইবনে নুসাইরের সাথেও সাদৃশ্যপূর্ণ। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁরা সকলে মহাবীর ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া হিকমত, কৌশল, বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে জাতিকে একটি বিজয়ী শক্তিতে পরিণত করতে তাঁর এক মহাসংগ্রামীর প্রতিচ্ছবি হচ্ছেন নাজমুদ্দীন এরবাকান।

ব্যক্তিত্ব
ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ১৯২৬ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্কের সিনপ শহরের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাহমুদ সাবরী এরবাকান একজন সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি বিভিন্ন শহরে বদলি হন। তিনি কায়সেরি শহরে প্রাথমিক শি¶া, ইস্তানবুলে মাধ্যমিক শি¶া এবং ইস্তানবুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি রেকর্ডসংখ্যক না¤^ার পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫১ সালে তিনি জার্মানির অধপযবহ ঞবপযহরপধষ টহরাবৎংরঃু থেকে চযউ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৪Ñ১৯৫৫ সালে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশি¶ণ গ্রহণ করার জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে প্রথম ৬ মাস এবং পরবর্তী ৬ মাস লেফটেনেন্ট হিসেবে কাজ করেন।
সামরিক প্রশি¶ণ শেষ করে তিনি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং গুমুশ মোটর নামে একটি ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তুরস্কের ইতিহাসে এটিই সর্বপ্রথম দেশীয় কোনো ইঞ্জিন কোম্পানি। এটি অনেক বড় সংগ্রাম ছিল তাঁর জীবনে এবং এজন্য অভ্যন্তরীণ ইহুদি লবির ষড়যন্ত্রের শিকার হন। তার ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার সময় তিনি দেখতে পান যে দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাগণ যাতে কোনোভাবেই অগ্রসর হতে না পারে এজন্য ঞযব টহরড়হ ড়ভ ঈযধসনবৎং ধহফ ঈড়সসড়ফরঃু বীপযধহমব ড়ভ ঞঁৎশবু এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে প¶পাতদুষ্ট আচরণ করে যাচ্ছিল। তা অবসানে তিনি এ প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেন এবং অল্পসময়ের মধ্যে এর সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি হওয়ার পরপরই সেখানে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে গুরুত্ব দেন যার কারণে অল্পসময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক শক্তির বলে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন।
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দীন এরবাকান কোনিয়া থেকে ¯^তন্ত্রভাবে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হন। তিনি অল্পসময়ের মধ্যেই একজন সুবক্তা হিসেবে সুপরিচিত লাভ করেন। এর পাশাপাশি সমগ্র তুরস্কে ইসলাম ও বিজ্ঞান বিষয়ে কনফারেন্স করতে আর¤^ করেন এবং তাঁর শি¶ক প্রখ্যাত আলেমে দীন যাহিদ আহমদ কতকু ও অন্যান্য যুগ শ্রেষ্ঠ আলেমদের পরামর্শে গঠন করেন মিল্লি গুরুশ ঘোষণার মাধ্যমে তুরস্কে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামি আন্দোলনের সূচনা করেন। মিল্লি গুরুশ ঘোষণার পরেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মিল্লি নিজাম পার্টি, কিন্তু এই দলটিকে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর তিনি গঠন করেন মিল্লি সালামাত পার্টি, দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৪৮টি আসন লাভ করে এবং কোয়ালিশনের মাধ্যমে শর্তভিত্তিক সরকার গঠন করে। এরবাকান সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী (অর্থনীতি বিষয়ক) মনোনীত হন এবং তার দল থেকে শিল্প, শি¶া ও ¯^রাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব লাভ করেন।
তার এ কোয়ালিশন সরকারের সময় ৬ হাজার মুসলিমকে মুক্ত করে দেওয়া, সাইপ্রাসকে গ্রিসমুক্ত করে তুর্কিশ সাইপ্রাস গঠন, মাদরাসা শি¶ার দ্বার উন্মুক্তকরণ, ৫ সহস্রাধিক কুরআন কোর্স চালু করা, মাদরাসার ছাত্রদের উচ্চ শি¶ার সুযোগ দেওয়া, সাইদ বদিউযযমান নুরসীর রিসালায়ই নুরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রতাহার, সেনানিবাসসহ সকল সরকারি অফিস আদালতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা, ইসলামি বই-পুস্তক প্রকাশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, অশ্লীলতা-বেহায়াপনা দূর করার ল¶ে আইন করাসহ অনেক কাজ করেন। ১৯৭৪Ñ১৯৭৮ সময়ের মধ্যে তিনি বিমান তৈরির কারখানাসহ ২৭০টি ভারি শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই উদ্যম দেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অন্য দলকে তার সাথে কোয়ালিশন ছিন্ন করতে বাধ্য করে। এরপর ৬ সেপ্টে¤^র ১৯৮০ সালে তুরস্কের কোনিয়ায় কুদস দিবসের সমাবেশ পালনের অভিযোগে ১৯৮০ সালের ১২ সেপ্টে¤^র সামরিক শাসকগণ ক্যু করে এ পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে। সেই সাথে এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ এবং তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করে।
১৯৮৩ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তি লাভের পর দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে দিয়ে তিনি রেফাহ পার্টি গঠন করেন। ১৯৮৭ সালে ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের ওপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ওঠে গেলে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং রেফাহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর রেফাহ পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৯৪ সালের স্থানীয় মেয়র নির্বাচনে ইস্তানবুল শহরে দলের তরুণ নেতা এরদোগান বিজয় লাভ করেন। এরপর নতুন উদ্যমে ‘ন্যায়ভিত্তিক সমাজ’ এ স্লোগান নিয়ে ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। কিন্তু এ সরকার মাত্র ১১ মাস ¶মতায় টিকেছিল। এক সামরিক অভ্যুথানের মাধ্যমে তাঁকে ¶মতাচ্যুত করা হয়। তাঁর এই এগারো মাসের শাসনামলে ডি-৮ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুদের হারকে কমিয়ে আনেন। এই অল্পসময়ের ৩৩ বিলিয়ন ডলার ¶তির হাত থেকে দেশকে র¶া করেন। সকলের বেতন তিনি ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেন। কোনো কোনো ¶েত্রে ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করেন। জনগণের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হন। শিল্পায়নে গতি ফিরিয়ে এনে পাঁচ বছরের মধ্যে তুরস্ককে জাপান ও জার্মানির শিল্পায়নকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন, মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে কমন মার্কেট চালু করেন।
তাঁর এসব উত্তরোত্তর সফলতায় ইহুদিপন্থীরা রেফাহ পার্টিকে বন্ধ করার ল¶্যে সকল প্রকার প্রপাগাণ্ডা চালায় ও তাঁর পার্টি শরীয়ত কায়েম করবে এ অভিযোগে তাঁকে সরানোর জন্য সেনাবাহিনীর হস্ত¶েপ কামনা করে। এভাবে রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি নাজমুদ্দিন এরবাকানকেও রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর মিল্লি গুরুসের অপর নেতা রেজাই কুতানের মাধ্যমে ফযীলত পার্টি গঠন করা হয়, পরে এটিও নিষিদ্ধ করা হয়। জেল থেকে বের হয়ে ২০০১ সালের ২০ জুলাই সাদাত পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে দলের তরুণ প্রজন্ম এরদোগান ও আবদুল্লাহ গুলের নেতৃত্বে একে পার্টি গঠিত। দল বিভক্ত হলেও এরবাকান একেপি ও সাদাত উভয় পার্টির তাত্তি¡ক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এ কারণে এরবাকানের বিরুদ্ধে বাম ও সেক্যুলারদের অভিযোগ ছিল, তিনি দুই পার্টি দিয়ে দেশ চালাচ্ছেন। এক পার্টি দেশ শাসন করছে, আর অন্য পার্টি সামাজিক কাজ ও ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত। পরবর্তীতে সাদাত পার্টিতে নেতৃত্ব নিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হলে ৮৪ বছর বয়সে ২০১০ সালে এরবাকান সাদাত পার্টির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ অবস্থায় ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইস্তানবুলে অনুষ্ঠিত তাঁর জানাজায় ব্যাপক লোক সমাগম হয়। তার ২ ছাত্র তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়িব এরদোগান এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল লাশের খাটিয়া ধরে তাঁর লাশ বহন করেন এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভ‚ষিত করেন।

ইসলামি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা
১৯৬৯ সালে তিনি মিল্লি গুরুশ (গরষষর এস্খৎহৃş) নামে একটি ইশতিহার প্রচার করেন। এর মূল উদ্দেশ্যসমূহ হচ্ছে,
১. আধ্যাত্মিক উন্নতি: ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া জাতিকে পুনরায় ইসলামের দিকে আহŸান ও তাদেরকে যোগ্য মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলা। বিশেষ করে যুবকদের মাঝে ইসলামের প্রচার ও প্রসার করা।
২. অর্থনৈতিকভাবে ¯^াবল¤ি^তা: আমেরিকা-ইউরোপ ও রাশিয়ার অনুকরণ না করে ¯^তন্ত্রভাবে শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নতি করে নতুন এক তুরস্ক গঠন।
৩. ইসলামি ইউনিয়ন গড়ে তোলা এবং মুসলিম বিশ্বকে একই প্লাট ফরমে নিয়ে এসে সকল সম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করা।
মিল্লি গুরুশ (গরষষর এস্খৎহৃş) অর্থাৎ জাতীয় ভিশন। ‘জাতীয়’ বলতে কি? তুর্কি জাতি, না মুসলিম মিল্লাত! ব্যাপারটি এখানে উহ্য। বস্তুত তিনি খিলাফত পুনরুদ্ধারের আকাক্সক্ষা-আশা করতেন, আর সেই লক্ষ্য-প্রসারী একটি ভিশন জাতির সামনে উপস্থাপন করে গেছেন। আজকে নাজমুদ্দীন আরবাকান নেই, তাঁর মিল্লি নিজাম পার্টি, মিল্লি সালামত পার্টি, রেফাহ পার্টি ও ফযিলত পার্টি একের পর এক নিষিদ্ধ হয়। ২০০১ সালে ২০ জুলাই সাআদত পার্টি গঠিত হয়, পরে সেটি ভেঙে যায়, ফলে একে পার্টির সৃষ্টি হয়। পরপর পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া এবং নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্ধ দেখা দিলেও তুর্কি জাতি উপর্যুক্ত মিল্লি গুরুশ থেকে বিচ্যুত হয়নি। এটি এখন কোনো দল বা রাজনীতিক পার্টির ভিশন নয়, এটি পুরো তুর্কি জাতির ভিশন এবং তাঁদেরই জাতীয় জীবনের চ‚ড়ান্ত লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
ড. নাজমুদ্দীন এরবাকান ও রজব তাইয়েব এরদুগানের পার্টি ভিন্ন, পরিধি-পরিচিতও ভিন্ন। কিন্তু লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিক থেকে ড. নাজমুদ্দীন আরবাকানের মিল্লি গুরুশই ধারণ করেন এরদুগান এবং এরবাকানই এরদুগানের রাজনীতিক অভিভাবক। তুরস্কে এরদুগান বারবার বিজয়ী হয়ে চলছেন, এটি তাঁর কারামতি নয়, এটি তুর্কি জাতির কৃতৃত্ব। তাঁরা তাঁদের মিল্লি গুরুশ হাসিলে এরদুগানকেই এখনও পর্যন্ত যোগ্য নেতা মনে করেন। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে,
১. আরবাকানের মিল্লি গুরুশে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’, ‘ইসলামি হুকুমত’, ‘ইসলামি শাসন’, ‘শরীয়া আইন’ কিংবা ‘ইসলাম কায়েম’ জাতীয় কোনো লক্ষ্য স্পষ্ট বিবৃত হয়নি। কারণÑ
(ক) রাজনীতিতে দীনের চেয়ে দেশের গুরুত্ব বেশি; দেশের ¯^াধীনতা, সংহতি, ¯^ামল¤ি^তা, সমৃদ্ধি, উন্নতি এবং শক্তিশালী করা ইত্যাদি।
ক্স মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাযি.) দুষ্কৃতিকারীদের হাতে শাহাদতবরণ করলেন। নবমনোনীত খলীফা হযরত আলী (রাযি.)-এর কাছে এর জন্য কিসাস দাবি করা হলো। হযরত আলী (রাযি.) খিলাফতের ঐক্য, সংহতি ও স্থিতিশিলতার প্রতিই গুরুত্ব দিলেন। আকীদাতুত তাহাওয়ীর ব্যাখ্যাতা ইমাম ইবনে আবিল ইয্য (রহ.) বলেন, وَالْحَقُّ مَعَ عَلِيٍّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ। (শরহুল আকাদাতিত তাহাবিয়া, পৃ. ৪৯৩)
ক্স ইসলামে চুরির অপরাধে হস্তকর্তনের বিধান নাযিলের পূর্বে যাকাতের বিধান নাযিল করেছে। আগে দারিদ্রতা বিমোচনের কথা বলেছে।
মন্তব্য: (১) আজকে বিভিন্ন সংগঠন (কথিত গণতান্ত্রিক, জিহাদী কিংবা বিপ্লবী) তাঁদের নিজ¯^ পন্থায় ইসলামি হুকুমতের দাবি তুলেছেন। কিন্তু ইসলামি হুকুমত বলতে বিষয়টি আসলে কি তা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তাঁদের কাছে সাধারণ ইসলামি হুকুমত বলতে ইসলামের দণ্ডবিধির বাস্তবায়ন। বস্তুত মানুষকে শাস্তি দেওয়া ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। শাস্তি দেওয়ার আগে অপরাধের কার্যকারণসমূহ সমাজ থেকে বিদূরিত করার কর্মসূচি দিয়েছে ইসলাম। কাজেই অর্থনৈতিক মুক্তির কর্মসূচি পালন না করে শুধু শরীয়ত কায়েমের দাবি বাস্তবসম্মত নয় এবং আজকের ইসলামপন্থার বড় দুর্বলতা এখানেই। (২) আমাদের সামনে দু’ধরনের সংশয় উপস্থাপিত হচ্ছে, যথাÑ ১. ভোটে ইসলামি হুকুমত আসবে কি? ২. গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করার পর ইসলাম কায়েম না করায় এরদুগানরা কাফির হয়ে যায়নি? ইসলামি হুকুমতের তাৎপর্য না বোঝার কারণেই এই সংশয় আমাদের সামনে এসেছ। শরীয়া প্রতিষ্ঠার আগে দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নতি এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে।
(খ) তাঁরা ইসলামকে ধারণ করেছেন জীবনে, অন্তরে। আচার-আচরণ, আনুষ্ঠানিকতা কিংবা বেশ-ভুষায় নয়।
মন্তব্য: ২ জুলাই ২০১৮ প্রথম আলো প্রতিবেদন করেছে, ‘হঠাৎ আলোচনায় ইসলামী আন্দোলন।’ প্রতিবেদনটি অনেক শঙ্কা নিয়ে পড়ছিলাম, না জানি তারা একথাও লিখে কিনা যে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একটি ‘ধর্মভিত্তিক’, ‘মৌলবাদী’, ‘¯^াধীনতা বিরোধী’, ‘প্রগতি বিরোধী’ কিংবা ‘জঙ্গিবাদী’ দল এবং ‘দলটি ক্ষমতায় গেলে দেশ অন্ধকার যুগে ফিরে যাবে, নারীরা দাসীতে পরিণত হবে।’ অনুরূপ প্রতিবেদন নিউজ ২৪-এও এসেছে। আমি মনে করি, ইসলামী আন্দোলন ধর্মভিত্তিক দল বটে, কিন্তু সেইভাবে প্রচারিত হওয়া নয়, বরং প্রচারিত হওয়া উচিত ইনসাফ ও উন্নয়নপন্থি দল হিসেবে, দুর্নীতিমুক্ত, সৎ ও শান্তিবাদী দল হিসেবে। এভাবেই ইসলামী আন্দোলনের প্রতি মানুষের আস্থা, ভালবাসা ও নির্ভরতা তৈরি হতে হবে এবং দলের গণভিত্তি রচিত হতে হবে।
(গ) ইসলামি রাষ্ট্র নয়, বরং খিলাফতই হচ্ছে ইসলামের রাজনীতির চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য। অঞ্চলভিত্তিক জাতি রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট সীমানায় শরীয়া শাসন কায়েমের যে দাবি সেটা ইসলামের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হতে পারে। চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য মোটেও নয়, মূলত বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের খিলাফত হচ্ছে ইসলামি আন্দোলনের চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য।
মন্তব্য: (১) প্রচলিত ইসলামপন্থার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণেও কিছুটা অষ্পষ্টতা আছে। দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হিসেবে আমাদের ম্যানেপেস্টো ও প্রচারপত্রে যে ধারণা দেওয়া হয় তা মাত্রই আঞ্চলিক, জাতি-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। এর বাইরে ইসলামের আন্তর্জাতিক, সার্বজনীন ও বিশ্বমানবিক রাষ্ট্রদর্শনের সবক কর্মিদের তেমন একটা দেওয়া হয় না। যদি সে সবক দেওয়া হতো তাহলে ইসলামপন্থার লোকজন বিভিন্ন ছোট ছোট ইস্যুতে কিংবা মাসআলা-মাসায়িল কেন্দ্রিক তর্ক-বিতর্ক ও পারস্পরিক ঝগড়াতে আস্ত-ব্যস্ত থাকার কথা ছিল না। জাতিরাষ্ট্রের দেওয়াল ভেদ করে যেখানে একই উম্মাহ গঠনের ¯^প্নে বিভোর থাকার কথা মুসলমানদের সেখানে একই রাষ্ট্রের ভেতর বিভিন্ন দল, গ্রæপ ও বলয়ে মুসলমানরা বিভক্ত। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা।
(২) মত-পথ-ফেরকায় যতো মতবিরোধই হোক না কেন ইসলামপন্থার মাঝে সাধারণ সৌজন্যতার সম্পর্ক অবশ্যই থাকা দরকার। শুধু তা-ই নয়, উত্তরোত্তর এই সম্পর্কের উন্নতি জরুরি, পরস্পর কাছাকাছি আসার, একসঙ্গে বসার জন্য উপলক্ষ তৈরি করা প্রয়োজন। পরমতসহিষ্ণুতা, তাদের আবেগের জায়গায় শ্রদ্ধা, যথাসম্ভব বিতর্ক এড়িয়ে চলা এবং যতোটুকু মতবিরোধকে অ্যাকাডেমিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
(৩) ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একটি ঐক্যকামী সংগঠন; এটি ছিল জোট, সংগঠনের নীতি-আদর্শের সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করে অন্যান্য ইসলামি দলও এই জোটে শরীক হতে পারতো। নীতিমালায় এ বিষয়ক একটি ¯^তন্ত্র ধারাও সন্নিবেশিত ছিল। ধারাটি পুনরুজ্জীবিত হলে দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে। ব্যাক্তিগত পর্যায়ে যেমন ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো হয় তেমনিভাবে দল, সমাজ, গোষ্ঠী ও গোত্র এবং পুরো একটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকেও ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আহŸান জানানো যেতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদীনা রাষ্ট্র কায়েম করে কায়সার-কিসরার প্রতি ইসলামের আহŸান পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। জোট-রাজনীতির এ যুগে জোটনীতি বজায় থাকলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সমগ্র ইসলামপন্থার অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারতো। দলগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধ-মীমাংসা, কর্মিদের প্রশিক্ষণ এবং সার্বিক সহযোগিতায় ইসলামী আন্দোলন এগিয়ে আসতে পারে। এটি ইসলামি ঐক্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
২. তুরস্কে পরিবর্তন আসছে। ‘আসছে’ অর্থাৎ ধীরে আসছে। এখানে পরিবর্তন মানে ক্ষমতার পালাবদল নয় এবং এই পরিবর্তন সশস্ত্রও নয়। এই পরিবর্তন জনগণের মধ্য থেকে এসেছে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। ইসলামের মুবাল্লিগ আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখের প্রচেষ্টায় জন-মানুষের মাঝে ঈমানি চেতনার সৃষ্টি হয়েছে এবং আমল-আখলাক উন্নতির জযবা তৈরি হয়েছে। অপরদিকে ইসলামি রাজনীতিক দলগুলোর চেষ্টায় তুর্কি জাতি ইসলামের রাজনৈতিক উত্থানের ¯^প্ন দেখতে শুরু করেছে। এটি একটি সামগ্রমিক পরিবর্তন। যেটাকে আমরা সমাজ বিপ্লব বলে থাকি।
বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এই সমাজ বিপ্লবের নীতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে আল-হামদু লিল্লাহ। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সমস্যা হচ্ছে, ধারাবাহিকতা বজায় না থাকা, হঠাৎই খেই হারিয়ে ফেলে দলগুলো। খেই হারানো এই ¯^ভাব শতাব্দীর প্রাচীন ইসলামি দলে যেমন আছে তেমনিভাবে শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত-জ্ঞানী ও ক্যাডারভিত্তিক দলেও এই ¯^ভাব লক্ষণীয়। ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে লেজুড়বৃত্তির যে চর্চা হয়ে এসেছে সেকথা আজকে তাদের অনেকই অকপটে ¯^ীকার করেন। অনিচ্ছা সত্তে¡ও বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের রাজনীতিক অবস্থানের যৌক্তিকতাকে ¯^ীকৃতি প্রদান করছেন। এই অবস্থান চিরই বজায় রাখতে হবে।
অন্যদিকে একটি বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে সমগ্র ইসলামপন্থার মাঝে কোনো সমš^য় নেই। ইসলামের খণ্ডাংশ নিয়ে একেকটি নিজ¯^ নিয়মে চলছে এবং এর তাদের বাইরের ইসলামি কর্মসূচিগুলোকে অহেতুক জ্ঞান করছে। এই সমস্যা তুর্কি ইসলামপন্থায় অনেকটাই নেই। ফলে একজন মুসলমান উদাহরণত তাবলীগে গিয়ে ঈমান-আমল দোরস্ত করে অতুটুতেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, তিনি ইসলামের অন্যান্য শাখা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে গিয়ে অর্জন করে নেন। সেখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পারস্পরিক সহযোগী, বিরোধী নয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা ভিন্ন। এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের পরস্পরবিরোধী অবস্থানকে সমš^য়, সহযোগী এবং সহগামী পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। এই কাজটার জন্য ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া করার জন্য দীর্ঘস্থায়ী পলিসি গ্রহণ করতে হবে।
৩. ‘পরিবেশ’ ও ‘সফলতা’ দুটো বিষয় আছে। এ দুটো বিষয়ের কয়েক দফা স্তর আছে। তুরস্কের জনগণ পরিবেশের যে স্তর অতিক্রম করছে বর্তমানে তা আমরা অতিক্রম করেছি ব্রিটিশ আমলে। আরবি নিষিদ্ধ হওয়া, আরবিতে আযান ব্যান হওয়া এবং উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দেওয়ার যে পরিবেশ তুর্কিরা অতিক্রম করেছে সে ধরনে পরিবেশ উপমহাদেশের মুসলমানরা ব্রিটিশ আমলেও অতিক্রম করেনি।
পক্ষান্তরে এমন একটা কঠিন পরিস্থিতি-পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটে সফলতার যে স্তর অতিক্রম করছে সেটা আমরা ব্রিটিশ থেকে ¯^াধীনতা লাভের পোন শতাব্দী পরও অর্জন করতে পারিনি। তুরস্কে সফলতার সবটুকুই জনগণের, একইভাবে বাংলাদেশে ইসলামপন্থর ব্যর্থতার অনেকটাই এদেশের মানুষর। এদেশের মানুষের কাছে ইসলাম একটি আচারনির্ভর ধর্ম। অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবাধিকার, শান্তি-নিরাপত্তা ও আইনের শাসন এবং রাজনীতিক শক্তি হিসেবে ইসলামের কোনো তাৎপর্য এই দেশের জনগণ ধারণ করে না, তারা ইসলামকে সেইভাবে মোটেও বোঝে না।
এদেশের মানুষ অত্যন্ত আবেগী এবং অনুকরণপ্রিয়ও বটে। এরদুগান-মাহাথিরের সফলতায় বিপুল উচ্ছ¡াস প্রকাশ করে। কিন্তু কোনো শিক্ষাই তাঁদের আন্দোলন-সংগ্রামমুখর জীবন থেকে গ্রহণ করে না। এরদুগানদের কথা আসলেই দু’দলের ভিন্নধর্মী অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাই। যথাÑ ১. একদল যারা এরদুগানের দাড়ি মুণ্ডানো ও স্যুট-টাই পরা ছবি দেখিয়ে তাদেরও পক্ষে দাড়ি মুণ্ডানোর বৈধতা খুঁজে। ২. দ্বিতীয় আরেকটি দল শুধু একই ছবি দেখিয়ে তাঁকে সম্পূর্ণই বাতিল ঘোষণা করে। এখানে পরিবেশবোধ এবং সফলতার ধারণা এই উভয়টির ধারে-কাছেও কেউ নেই। এটা উদ্বেগজনক। নতুবা এরদুগান-মাহাথির কোনো মডেল নন, আমাদের মডেল পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম, সলফে সালেহীন ও আইয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন।
৪. প্রফেসর ড. নাজমুদ্দীন এরবাকানের সংগ্রামী জীবনের এক বড় অভিজ্ঞতা হচ্ছে, রাজনীতিক দল গঠন, একের পর এক দলগুলো নিষিদ্ধ হওয়া এবং পুর্নবার নিত্য-নতুন নামে সংগঠিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। ১৯৬৯ সালে মিল্লি গুরুশ ঘোষণার পর মিল্লি নিজাম পার্টি গঠন করেন, দলটি মাত্র একবছরের ব্যবধানে নিষিদ্ধ হয়। ১৯৭২ সালে গঠন করেন মিল্লি সালামত পার্টি, দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৪৮টি আসন লাভ করে এবং কোয়ালিশনে সরকার গঠনে সক্ষম হয়। ১৯৮০ সালের ৬ সেপ্টে¤^র এক সামরিক অভ‚্যত্থানে সরকারের পতন হয়, মিল্লি সালামত পার্টিসহ সকল রাজনীতিক দল নিষিদ্ধ হয়, এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয় এবং গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করা হয়। ১৯৮৩ সালে রাজনীতিক নিষেধজ্ঞা ওঠে গেলে তিনি নতুন দল গঠন করেন, দলটি ১৯৯৬ সালে ‘ন্যায়ভিত্তিক সমাজ’ প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে জাতীয় নির্বাচনে জয় লাভ করে। দুঃখজনকভাবে মাত্র এগারো মাসের মাথায় তিনি এবারও সামরিক অভ‚্যত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং তিনি ও তাঁর দল রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হয়। ১৯৯৮ সালে গঠিত ফযিলত পার্টি যা খুব অল্পসময়ের মধ্যেই নিষিদ্ধ হয়। ২০০১ সালে গঠিত হয় সাদাত পার্টি, তবে মিল্লি গুরুশের অনুসারী তরুণ নেতৃবৃন্দ গঠন করেন একে পার্টি। বস্তুত এতে মিল্লি গুরুশ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, সাদাত পার্টি মূলধারার ইসলামি আন্দোলন হিসেবে এবং একে পার্টি তার রাজনীতিক শাখা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
মিল্লি নিজাম পার্টি (১৯৭০Ñ১৯৭১ খ্রি.), মিল্লি সালামত পার্টি (১৯৭২Ñ১৯৮২ খ্রি.), রেফাহ পার্টি (১৯৮৩Ñ১৯৯৮ খ্রি.), ফযিলত পার্টি (১৯৯৮Ñ২০০১ খ্রি.), সাদাত পার্টি (২০০১ খ্রি.) ও জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি-একেপি (২০০১ খ্রি.) তুরস্কে একের পর এক গঠিত হয় এবং নতুনভাবে তাঁরা জাতির সামনে আভির্‚ত হন। তুরস্কের এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামি দল ও আন্দোলনসমূহের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। ১৯৭১ সালের ¯^াধীনতার মহান সংগ্রামে বিতর্কিত ভ‚মিকার পর ¯^াধীন বাংলাদেশে জামায়াত নামে রাজনীতি করার অপরিহার্য ছিল না। তুরস্কে একেপি সর্বশেষ বাহ্যিকভাবে নীতি-আদর্শের প্রশ্নেও ছাড় দিয়েছে, সংবিধানের সেক্যুলারিজমের সাথে আপোস করেছে এবং জাতির জনক হিসেবে মোস্তাফা কামালকে মেনে নিয়েছে। বস্তুত তাঁরা আদর্শকে ধারণ করেছেন অন্তরে, বাস্তবতা বিবেচনায় ইসলামি, দীনী ও ধর্মীয় লেভেল, স্লোগান ও দাবি-দাওয়া আড়ালে রেখেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতিতে এমন বাস্তবতাকে ¯^ীকার দূরে থাক, সামান্য দলের নাম ও কথিত আকাবের-আসলাফের নামে কথিত ঐতিহ্যপ্রীতি থেকেও বেরিয়ে আসার মানসিকতা অনেকের মধ্যে নেই। দলের প্রাচীনত্ব, মুরব্বিয়ানা ও ইলমি মর্যাদার ইগো এখানে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা যায়।
৫. প্রফেসর ড. নাজমুদ্দীন এরবাকান ছিলেন একেপি ও সাদাত উভয় পার্টির তাত্তি¡ক নেতা। এজন্য তাঁর বিরুদ্ধে বাম ও সেক্যুলারদের অভিযোগ ছিল, তিনি দুই পার্টি দিয়ে দেশ চালাচ্ছেন। এক পার্টি দেশ শাসন করছে, আর অন্য পার্টি সামাজিক কাজ ও ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত। বস্তুত তুরস্কে দীনী দাওয়াত, ইসলামের প্রচার-প্রসার, সমাজ সংস্কার, মানুষের ইসলাহ, ইসলামের বিপ্লবী বয়ান নির্মাণ, জনশক্তি গঠন ও জনমত তৈরি এসব আঞ্জাম দেওয়া হয় বিভিন্ন ফোরাম থেকে। আর ভোটের রাজনীতি হয় ¯^তন্ত্র মঞ্চ থেকে। একে পার্টি স্রেফ ভোটের রাজনীতি করে, অন্যদিকে তার যুব, মহিলা ও শ্রমিক প্রভৃতি সংগঠন জনমত তৈরি ও জনশক্তি গঠনের কাজ করে।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনেও এমনটি লক্ষ করা যায়। সেখানে আরএসএস (রাষ্ট্রীয় ¯^য়ংসেবক সংঘ) হচ্ছে মাতৃসংগঠন; রাজনীতি, শিক্ষা, ছাত্র, শিক্ষক, অহিন্দু, আদিবাসী, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও সংবাদপত্রসহ সর্বক্ষেত্রে এর শাখা রয়েছে, যাকে একত্রে সংঘপরিবার বলা হয়। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) হচ্ছে অনুরূপ একটি শাখা, যারা ভোটের রাজনীতির কাজটা আনজাম দিয়ে থাকে। হিন্দুত্ববাদের বিপ্লবী দর্শন নির্মাণ, তার পক্ষে জনমত গঠন ও ক্যাডার তৈরির কাজ করে সংঘপরিবারের অন্যান্য শাখাসমূহ, বিজেপি সেখানে স্রেফ ভোটের রাজনীতিটা করে প্রফেশনাল তরিকায়, তার আদলও অনেকটা সেক্যুলার।
তুরস্ক ও ভারতীয় রাজনীতির অভিজ্ঞতার আলোকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কাজের সুবিধার্থে নিজেদেরকে তিনটে মৌলিক শাখায় বিভক্ত করে নিতে পারে। (১) আধ্যাত্মিক শাখা: বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি। এই শাখার কাজ হবে, দীনী দাওয়াত, ইসলামি শিক্ষার প্রসার ও মানুষের আত্মশুদ্ধি। এজন্য সারাদেশে ওয়ায মাহফিল, হালকায়ে যিকির, মাসিক ইজতিমা, মসজিদ-মকতব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিই হবে তার কাজ। এসব ক্ষেত্রে রাজনীতিক লক্ষ্য ও কর্মসূচি উহ্য থাকবে, এখান থেকে কোনো রাজনীতিক বয়ানও প্রচারিত হবে না।
(২) বিপ্লবী শাখা: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন, ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন ও ইসলামী যুব আন্দোলন প্রভৃতি সংগঠনসমূহ হবে এর অঙ্গসংগঠন। এসব সংগঠনসমূহ স্তর ও বিষয়সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ইসলামের বিপ্লবী আদর্শের প্রচার করবে, জনমত গঠন করবে এবং জনশক্তি তৈরি করবে। তবে রাজনীতিকভাবে ইসলামের অপ্রয়োগ কিংবা ধর্মীয় ভাবাবেগের অপব্যবহার এড়াতে ভোটের রাজনীতিতে ধর্মীয় ব্যানার, স্লোগান ও প্রতীক ব্যবহার করবে না। তাঁদের ভ‚মিকা হবে অনেকটা দলনিরপেক্ষ। যেন আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সকল রাজনীতিক দলই তাদের লক্ষ্য, আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনীতিক দলসমূহের কাছে ইসলামের রাজনীতিক ও বিপ্লবী আদর্শের দাওয়াত পৌঁছানোর কাজ করছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
(৩) নির্বাচনী শাখা: ভোটের রাজনীতির জন্য ও নির্বাচনী কর্মসূচি আঞ্জাম দেওয়ার জন্য ¯^তন্ত্র একটি শাখা গঠিত হতে হবে। যা ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, জাতি, ফিরকা, মাযহাব ও তরীকা নিরপেক্ষ হবে। অনেকটা সেক্যুলার আদলে গঠিত হবে। বাহ্যত কোনো ধর্মীয় অ্যাজেন্ডা থাকবে না, ভোটের রাজনীতিতে ধর্মীয় ভাবাবেগের ব্যবহার হবে না, ধর্মের নামে ভোট ভিক্ষে হবে না। এতে থাককে উন্নয়ন, সুশাসন ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি। সৎ নেতৃত্ব, দেশের উন্নয়ন ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অনুসরণই হবে এই শাখার উদ্দেশ্য। এর অবকাঠামো গঠিত হবে তিনটি অঙ্গে। যথাÑ (ক) পার্লামেন্টারি বোর্ড, (খ) আসনভিত্তিক যৌথ কমিটি ও (গ) ভোট সেন্টারকেন্দ্রিক সমš^য় কমিটি।
২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। ভোটের রাজনীতিতে নির্বাচনের পূর্বে বা পরে একজন প্রার্থীর সাথে জনগণের যে রকম সম্পর্ক ও ঘনিষ্টতা বা তাদের ওপর প্রার্থীর ব্যক্তিমর্যাদা ও প্রভাব থাকার কথা তা ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীদের ক্ষেত্রে খুব একটা লক্ষণীয় নয়। এর প্রধান কারণ দলীয়ভাবে প্রার্থীদেরকে পরিকল্পিত কর্মসূচি দিয়ে মাঠ পরিচর্চার কাজে নিয়োজিত না করা। এক্ষেত্রে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৩০০ আসনের প্রার্থীদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করতে পারে। বোর্ডের একজন মুখপত্র হবেন, তিনি দুই বা সংসদের মেয়াদ অনুযায়ী পাঁচ বছরের জন্য মনোনীত হতে পারেন। বোর্ডের সদস্যবর্গ বছরে একাধিকবার মিলিত হয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ, ভোটের রাজনীতির উপযোগী কর্মসূচি অবল¤^ন এবং কর্মসূচির সার্বিক অগ্রগতি বিষয়ে আলোচনা করবেন।
বোর্ডসদস্যদের প্রত্যেকের রুটিন কাজের মধ্যে অন্যতম হবে, আসনভিত্তিক যৌথ কমিটি গঠন করা। যা থানা/উপজেলা বা নগর-পৌরসভাসমূহের বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন, ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন ও ইসলামী যুব আন্দোলনের প্রতিনিধি এবং সুধী-শুভাকাক্সক্ষী মানসিকতার গণ্যমান্য মানুষের সমš^য়ে গঠিত হবে। সংগঠনসমূহের কাজের তদারকি, কমিটি না থাকলে কমিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ, পুনর্গঠন, সম্প্রসারণ, শাখা বৃদ্ধি, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন পরিচালনা, নির্বাচন কমিশনের সাথে যোগাযোগ, ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ, আসন-ইউপি ও ওয়ার্ডভিত্তিক ভোটর তালিকা সংরক্ষণ এবং ভোটকেন্দ্রের হিসাব, সমš^য় কমিটি গঠন ও কমিটির সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদিই হবে এই যৌথ কমিটির নিয়মিত কাজ। সংসদ সদস্য প্রার্থী এই যৌথ কমিটির সভাপতি হবেন।
আসনভিত্তিক যৌথ কমিটি প্রতিটি ভোট কেন্দ্রভিত্তিক স্থায়ী সমš^য় কমিটি গঠন করবে। আধ্যাত্মিক ও বিপ্লবী শাখার প্রতিটি সংগঠনের প্রতিনিধি সমš^য় কমিটির সদস হবেন, স্থানীয় ও গণ্যমান্য মানুষও কমিটিতে সদস্য হতে পারবেন। সদস্যবর্গ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে সভাপতি নির্বাচিত করবে। ওই কেন্দ্রের নির্বাচন পরিচালানার যাবতীয় কাজ এই কমিটির ওপর ন্যস্ত থাকবে। তবে শুধু নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই এর কাজ বেড়ে যাবে তা নয়, বছরের সবটা সময়েই এর কাজ থাকবে। তাদের কাজগুলো হবে,
ক্স ভোটারদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ, পরিচয় ও সম্পর্ক বৃদ্ধি।
ক্স তালিকায় থাকা ভোটারদেরকে দলের সদস্য করা এবং দলকে ভোট দেওয়ার জন্য কাজ করা।
ক্স দলের উন্নয়ন কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ভোটারদেরকে জানানো।
ক্স নির্বাচনী কেন্দ্রের অধীন এলাকায় জনগণের সমস্যার কথা শোনা এবং সমাধানের চেষ্টা করা। বিশেষত কোনো সাহায্য প্রার্থী থাকলে তাকে সাহায্য করা।
ক্স সমš^য় কমিটি প্রতি মাসে কমপক্ষে অন্তত দু’বার সভা করবে, কাজের অগ্রগতি মূল্যায়ন করবে এবং প্রতিমাসে আসনভিত্তিক যৌথ কমিটির বরাবর প্রতিবেদন পাঠাবে।
ক্স ভোটার তালিকা সংরক্ষণ এবং হালনাগাদ হলে তাও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করবে। এক্ষেত্রে (ক) ভোটার স্থান্তরের প্রয়োজন হলে তাকে সহায়তা করা, (খ) কেন্দ্রের অধীন এলাকায় কেউ নতুন এলে তাকে এখানকার ভোটার বানানো, (গ) প্রথমবার ভোটার হওয়াদের তথ্য সংগ্রহ এবং তাদের দলীয় প্রার্থীর ভোটার বানানো, (ঘ) বয়স্ক ও অক্ষম ভোটারদের তালিকা তৈরি, (ঙ) ভোটার স্লিপ বাড়ি বাড়ি বিতরণ করা।
ক্স নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক অ্যাজেন্ড সরবরাহ, তাঁদের প্রশিক্ষণ এবং যাবতীয় ব্যবস্থানা করা। এজন্য অ্যাজেন্ট সংখ্যার অনুপাতে একজন মূল ও একজন অপেক্ষমান (মূল ব্যক্তি অসুস্থ কিংবা অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে) দু’জন করে সদস্য প্রস্তুত রাখবে।

লেখক : মু. সগির আহমদ চৌধুরী

তথ্যঋণ
১. ড. নাজমুদ্দীন এরবাকান, দাওয়াম (আমার সংগ্রাম), মেধা বিকাশ প্রকাশন, ঢাকা, বাংলাদেশ (প্রথম প্রকাশ: ২০১৬ খ্রি.)
২. ড. রাগিব আস-সিরজানী, অটোমান থেকে বর্তমান: ক্যারিশম্যাটিক এরদোগান, কালান্তর প্রকাশনী, সিলেট, বাংলাদেশ (প্রথম প্রকাশ: ২০১৯)
৩. হাফিজুর রহমান, আমার দেখা তুরস্ক: বিশ্বব্যবস্থার নতুন শক্তি তুর্কি জাতির ভেতর-বাহির, গার্ডিয়ান পাবলিকেশন, ঢাকা, বাংলাদেশ (প্রথম প্রকাশ: ২০১৯)
৪. www.wikipedia.org (আরবি, ফারসি, উরদু, ইংরেজি ও বাংলার সংশ্লিষ্ট পাতাসমূহ)

1 thought on “প্রফেসর ড. নাজমুদ্দীন এরবাকান: ব্যক্তিত্ব ও ইসলামি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা”

Leave a Comment

লগইন অথবা নিবন্ধন করুন

লগইন
নিবন্ধন