বিশ্বের সমৃদ্ধতম সভ্যতাগুলোর একটি হচ্ছে মুসলিম সভ্যতা। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এই সভ্যতার উৎপত্তি হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে যুক্তির উপর ভিত্তি করে। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও বেশি আলোচনার লক্ষ্যে আমরা নতুন এই ধারাবাহিকের আয়োজন করেছি। এই ধারাবাহিকে মুসলিম সভ্যতার বিকাশ, চড়াই-উৎরাই এবং এ সভ্যতা বিকাশের পথ-পরিক্রমা সম্পর্কে আলোচনা স্থান পাবে।
প্রথম পর্ব
ইসলাম ধর্ম বিশ্বকে এমন এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে যা গোটা মানব জাতি বিশেষ করে মুসলমানদের চীর ঋণী করে রেখেছে। কিন্তু সমৃদ্ধ এই মুসলিম সভ্যতার অবদান সম্পর্কে বর্তমান তরুণ সমাজ খুব একটা অবহিত নয়। এ কারণে তরুণ সমাজসহ বিশ্বের জ্ঞান অন্বেষীদের জন্য মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে তুলে ধরার অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। নিজের অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাও প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নিজের পূর্বসুরীরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে কোন পর্যায়ে এবং কোন অবস্থানে ছিলেন, সে সম্পর্কে জানতে পারলে সামনের দিকে পথচলা আরও সহজতর হয়। এছাড়া, নিজের অতীত সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞান নয়া প্রজন্মের মানুষের ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতি গঠনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপনিবেশবাদীরা গত দুই শতাব্দী ধরে সব সময় বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠী বিশেষকরে মুসলমানদের মৌলিকত্ব, মর্যাদা ও কর্মক্ষমতাকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। উপনিবেশবাদী পাশ্চাত্য, বিশ্ববাসীকে এটা বুঝানোর চেষ্টা করছে যে, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকে ধারন করা ছাড়া অন্যদের আর কোন উপায় নেই।
প্রাচ্যের দেশগুলোর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করার পেছনে পাশ্চাত্যের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, প্রাচ্যের দেশ ও জাতিগুলোর নানা অর্জনকে অস্বীকার করে তাদের সব উন্নয়ন, অগ্রগতি ও অর্জনকে নিজেদের অর্জন হিসেবে তুলে ধরা। পাশাপাশি মুসলমানদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ঠেকানোও তাদের অশুভ উদ্দেশ্যের অংশ। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাফিয়ী সার্বেস্তানি মনে করেন, পশ্চিমারা বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে উন্নত প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এবং এখন তারা এই প্রযুক্তি ও শক্তি দিয়ে গোটা বিশ্বে নিজেদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। পাশ্চাত্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে পাচ্যের উপর নিজেদের রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
পাশ্চাত্য নিজেদের ভূখণ্ডকে মানব সভ্যতার লালন ক্ষেত্র হিসেবে তুলে ধরার পাশাপাশি অন্যদের উপর নিজেদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তাদের এসব অপতৎপরতা মোকাবেলার জন্যে ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংঘাতের তত্ত্ব প্রদানকারী মার্কিন তাত্ত্বিক স্যামুয়েল হান্টিংটন এটা স্বীকার করেছেন যে, পাশ্চাত্য, বিশ্বকে নয়া সমাজ ব্যবস্থার দিকে পরিচালিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন সভ্যতার মানুষকে পাশ্চাত্যপন্থী হিসেবে গড়ে তুলছে। তার মতে, এর ফলে তারা নিজেদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও অভ্যাস ত্যাগ করে পাশ্চাত্যকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করছে।
বর্তমানে পশ্চিমারা মুসলিম সভ্যতার উন্নতি ও উৎকর্ষ বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে রাজনৈতিক আধিপত্য সুসংহত করার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকেই পাশ্চাত্য বিশ্বের নেতৃত্ব পুরোপুরি করায়ত্ত করার নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে। কোন কোন দেশ ও জাতি এ ধরনের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি না হওয়ায় পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করার কৌশল বেছে নেয়। বিশেষকরে তারা মুসলিম দেশগুলোতে সুকৌশলে ও ক্রমান্বয়ে পশ্চিমা-সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। তারা এটা ভালো করেই জানে যে, সাংস্কৃতিক প্রভাব থাকলে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সহজতর হয়। মার্কিন গবেষক ও লেখক এডওয়ার্ড বার্মান বলেছেন, পশ্চিমারা, গণযোগাযোগ মাধ্যম, মিডিয়া এবং রকফেলার,কার্নেগি ও ফোর্ডের মতো বাহ্যত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উন্নয়নশীল সমাজে বিশেষ ধরনের চিন্তা-বিশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা এর মাধ্যমে বিশ্ব পরিস্থিতি ও জীবন সম্পর্কে মানুষের বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করছে।
আমরা নতুন এই ধারাবাহিকে মূলত মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করবো। কাজেই এখানে সংক্ষেপে মুসলিম সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হবার কারণ এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা দরকার। মুসলিম সভ্যতা গড়ে উঠার ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুসলিম সভ্যতা হচ্ছে জীবন্ত ও গতিময় এক সভ্যতা এবং এই সভ্যতা সময়ের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। আর এ ধরনের গতিময় সভ্যতা যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। মুসলিম সভ্যতাও শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নানা ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও এমনকি বারবার বিজাতীয় আগ্রাসনের শিকার হবার পরও কখনোই পাশ্চাত্যের কাছে নতিস্বীকার করেনি। তাছাড়া, ইরানি, মিশরীয় ও আরব সংস্কৃতির মতো বিভিন্ন স্থানীয় সংস্কৃতিকে টিকে থাকার সুযোগ দেবার কারণে মুসলিম সভ্যতা ক্রমেই সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে সমৃদ্ধ হয়েছে। অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতা সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে ধ্বংস করে সকল সংস্কৃতিকে একীভুত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে এটা সুস্পষ্ট যে, এখানে সকল সংস্কৃতিই গুরুত্ব পেয়েছে এবং স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছে। মুসলিম সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রেও এই বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মার্কিন ইতিহাসবিদ উইল ডোরান্ট সভ্যতা ও সভ্য সমাজের সংজ্ঞা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন,” সভ্যতা হলো সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা, যা সামাজিক শৃঙ্খলা, আইনী শাসন ও তুলনামূলক জনকল্যাণের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব লাভ করে। সভ্যতা হচ্ছে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সমুন্নিতর ফসল। আর যে সমাজ, সামাজিক শৃঙ্খলা সাধন করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধির কথা ভাবে, সেই সমাজই সভ্য সমাজ।”
এটা নিশ্চিত যে, মুসলিম সভ্যতার গতিময়তার একটি কারণ হলো বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে মেনে নেয়া বা স্বীকৃতি দেয়া। মুসলিম সভ্যতায় জাতিগত বৈষম্যের কোন স্থান নেই এবং এটি কোন বিশেষ জাতি-শ্রেনীর সাথে সম্পর্কিত নয়। ইসলাম হচ্ছে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধর্ম এবং ইসলাম এটা প্রমাণ করেছে যে, এই ধর্ম মানুষকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে পরিচালিত করতে পারে।
মুসলিম সভ্যতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, কুসংস্কার ও গোঁড়ামি থেকে দূরে থাকা। আরব বিশ্বে ইসলামের দাওয়াতী কাজ যখন শুরু হয় তখন সেখানকার মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। ইসলাম ধর্ম; জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ভিত্তিক যে শিক্ষা মানুষকে দিয়েছে,তা অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের শিকল ভেঙ্গে ফেলতে সাহায্য করেছে। ইসলামী শিক্ষা, মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব জাগ্রত করার পাশাপাশি প্রাথমিক যুগেই সমুজ্জল মুসলিম সভ্যতা গড়ে উঠার ও তা বিকশিত হবার ক্ষেত্র তৈরী করেছিল। উইল ডোরান্ট তার সভ্যতার ইতিহাস শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, মুসলিম সভ্যতার মতো এত বিস্ময়কর সভ্যতা আর দ্বিতীয়টি নেই। ইসলাম যদি গতিময় না হতো এবং অন্যান্য সংস্কৃতিকে বিলীন করার চেষ্টা চালাতো তাহলে মুসলিম সভ্যতা আরব ভূখন্ডের গন্ডি পেরোতে সক্ষম হতোনা। এসব গুণাবলীর কারণেই ইসলাম এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে অন্যান্য সভ্যতাকে আকৃষ্ট করে বিশাল এক সভ্যতায় পরিণত হতে সক্ষম হয়েছিল।
পবিত্র চিন্তা-চেতনার উপর ভিত্তি করেই মুসলিম সভ্যতা গড়ে উঠেছে। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে পার্থিব জীবন ও ধর্মের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। ইসলাম মানুষের বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিককেই গুরুত্ব দেয়। ধর্ম হচ্ছে মানুষের পূর্ণতা ও উন্নতি সাধনের মাধ্যম এবং জ্ঞান ও বিবেকের সাথেও এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মুসলিম সমাজ-বিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বিশ্বাস করতেন, মানুষের ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিকগুলোর সাথে তার মানবিক দিকগুলোর সংযোগের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী সভ্যতা গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য, মুসলিম সভ্যতা অতীত সভ্যতাগুলোর নেতিবাচক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকগুলোকে সব সময় প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ইতিবাচক দিকগুলোকে লালন করে পূর্ণতা লাভ করেছে এবং বিকশিত হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্ব
গত আসরে আমরা বলেছি, মানব সভ্যতায় ইসলাম ধর্মের অনস্বীকার্য ভূমিকা রয়েছে। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিজাতীয়রা মুসলিম সভ্যতার অর্জনগুলোকে উপেক্ষা করে মুসলমানদের নানা আবিস্কার ও অর্জনকে নিজেদের বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। গত পর্বে আমরা মুসলিম সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবার মূল উপাদানগুলোর কোন কোনটি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, ইসলাম ধর্ম বিভিন্ন সংস্কৃতি ও জাতির অস্তিত্বকে মেনে নিয়েছে এবং গোঁড়ামি ও কুসংস্কারমুক্ত থাকার পাশাপাশি ধর্ম ও পার্থিব বিষয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে। এ পর্বে আমরা মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির চড়াই-উৎরাইয়ের নানা কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো।
মুসলিম সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা অন্যতম। লেবাননের খ্রীষ্টান লেখক জর্জি যেইদান বলেছেন, মদিনায় প্রবেশের পর রাসূল (সা.)’র প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিলো, মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে সেখানে আগত মক্কী মুসলমানদের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই চুক্তিটিই ছিলো মুসলিম ঐক্যের প্রথম ভিত্তি,যা রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। জর্জি যেইদানের মতে, প্রথম থেকেই মুসলমানরা নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং এর ভিত্তিতে মুসলিম সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছে। ধর্ম ও নৈতিকতার সঙ্গে সভ্যতা ও সংস্কৃতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখতে এ দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমান যুগের বেশিরভাগ চিন্তাবিদ এ ব্যাপারে একমত যে, পশ্চিমা সভ্যতায় বিজ্ঞান ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটলেও নীতি ও আদর্শ এবং চারিত্র্যিক ক্ষেত্রে সেরকম কোন উন্নতি বা উৎকর্ষ অর্জিত হয়নি। এমনকি দিনদিনই এ অবস্থার অবনতি হচ্ছে। অনেক চিন্তাবিদের মতে, নৈতিক ও চারিত্যিঅবক দিকটি উপেক্ষিত হবার কারণে সৃষ্ট অবক্ষয়ের কারণেই পশ্চিমা সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতায় পরিণত হয়েছে।
পশ্চিমা সংস্কৃতির পতনের কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের নানা মত ব্যক্ত করেছেন। পাশ্চাত্যে রেনেসাঁর পর যেসব চিন্তাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে হিউম্যানিজম, লিবারেলিজম ও সেক্যুলারিজম-এই তিনটি মতবাদের উপর ভিত্তিশীল। হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদে মানুষ স্বাধীন এক অস্তিত্ব। এ মতবাদ অনুযায়ী, ঐশী দিক নির্দেশনার কোন প্রয়োজন মানুষের নেই। এছাড়াও পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি লিবারেলিজম বা উদার নৈতিকতাবাদের ওপর বিশ্বাসের কারণে এবং ব্যক্তি স্বার্থকে সব কিছুর উর্ধ্বে স্থান দেয়ায়, নৈতিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিকতাকে প্রত্যাখ্যান করছে। নৈতিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিকতা প্রত্যাখ্যান করার কারণে পশ্চিমা সমাজে বিশৃংখলা ও উচ্ছৃংখলতা বেড়ে চলেছে। পশ্চিমা সভ্যতার অপর ভিত্তিটি হলো, সেকুলারিজম বা ইহলৌকিকতাবাদ ও ধর্মহীনতা। এই মতবাদ রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের গুরুত্বকে অস্বীকার করে।
বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোর সমাজে হিউম্যানিজম, সেক্যুলারিজম ও লিবারেলিজমের প্রভাব সুস্পষ্ট। মার্কিন লেখক বুকানান জে.পেট্রিক এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কারণে পশ্চিমা সভ্যতায় ধর্মপরায়ন ও সম্মানিত ব্যক্তিদের উপর চরম দুর্দশা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, আর এ কারণেই এই সভ্যতা অগ্রহণযোগ্য ও ঘৃণ্য। পাশ্চাত্য সভ্যতার পেছনে যে আইডিওলোজি বা জ্ঞান-তত্ত্ব কাজ করছে তা মানব প্রকৃতির সাথেও সাংঘর্ষিক। পাশ্চাত্যে নৈতিক অবক্ষয় ও মানব জীবন থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করাও পাশ্চাত্য সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু হবার একটা অন্যতম কারণ। মি. বুকানানা তার বইয়ে লিখেছেন, ১৯৮৩ সালে হোয়াইট হাউস যখন চিকিৎসা সংকট নিয়ে আলোচনায় মশগুল ছিলো, ঠিক সে সময় এইডস রোগে ছ’শ জন মার্কিনী মারা গেছে। সমকামীরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং প্রকৃতিও মানুষকে চরম শাস্তি দিচ্ছে। বর্তমানে লাখ লাখ মানুষ এইডস বা এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চরম সংকটে দিনাতিপাত করছে।
মার্কিন এ লেখকের মতে, পশ্চিমা সমাজে গর্ভপাত,তালাক ও আত্মহত্যা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি সন্তান লাভে তাদের আগ্রহ নেই। মাদকসেবীর সংখ্যাও দিনদিনই বাড়ছে। নারী ও বয়স্কদের সাথে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। এছাড়া অবাধ যৌনাচার বেড়ে গেছে। আর এ সবই প্রমাণ করে পশ্চিমা সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু।
মার্কিন এই লেখক পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাবকে হেরোইনের ভয়াবহ প্রভাবের সাথে তুলনা করেছেন। হেরোইন যেমন প্রথমে মানুষকে দৃশ্যত প্রশান্তি দিলেও ক্রমেই মানবদেহকে বিকল করে দিয়ে মাদকসেবীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তেমনি পশ্চিমা সভ্যতাও বাহ্যত আকর্ষনীয় হলেও এর চূড়ান্ত ফল বিষময়। আরেক বিখ্যাত মার্কিন লেখক কেনেথ মিনং তার নিউ স্ট্যান্ডার্ড শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, পশ্চিমা সভ্যতা নীতি-নৈতিকতা থেকে অনেক খানি দূরে সরে গেছে, কাজেই পশ্চিমা সভ্যতাকে শ্রেষ্ঠতর বলা যাবে না।
যে সমাজের মানুষ নীতি-নৈতিকতা মেনে চলে এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতি অনুরাগী সে সমাজের স্থায়ীত্ব ও গতিময়তাও থাকে বেশী। ইরানের বিখ্যাত লেখক ড: বেলায়াতি তাঁর এক বইয়ে লিখেছেন, কোন সমাজ যদি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় সভ্য হবার পরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়, তাহলে ওই সভ্যতা ক্রমেই দূর্বল হয়ে পড়ে। চূড়ান্ত পর্যায়ে তা বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতার পথে ধাবিত হয় এবং ওই সমাজের সভ্যতার ভিত্তি ধসে পড়ে। ফলে সভ্যতা তার গতি হারিয়ে ফেলে। কারণ লক্ষ্যহীন সভ্যতার কারণে লাগামহীনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা ছড়িয়ে পড়ে। তবে মুসলিম সভ্যতা সব সময় নীতি-নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, ঐক্য এবং আইন মেনে চলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
সমাজের অন্য অনেক কিছুর মতো সভ্যতার ক্ষেত্রেও চড়াই-উৎরাই থাকে। কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন,প্রত্যেক সভ্যতাকেই বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়েই সভ্যতা এগিয়ে চলে।
নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে দারুনভাবে সহায়তা করতে পারে। কোন সমাজ সভ্য ও সংস্কৃতিবান হবার পরও যদি ধর্মীয় ও নৈতিক দিককে উপেক্ষা করে তাহলে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হলো, আন্দালুস বা বর্তমান স্পেনে মুসলমানদের ভয়াবহ পরিণতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামী নীতি-আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতা থেকে দূরে সরে যাওয়াসহ আরও কিছু কারণে স্পেনে মুসলমানদের পতন ঘটেছিল। এ কারণেই ইসলাম ধর্ম আধ্যাত্মিকতা ও নীতি-নৈতিকতার উপর সব সময় গুরুত্ব আরোপ করেছে। মুসলিম ইতিহাসে এসেছে, মক্কা থেকে মদীনায় রাসূলের হিজরতের একটা কারণ ছিলো, মক্কার বিরূপ পরিবেশ থেকে দূরে গিয়ে নতুন পরিবেশে নীতি-নৈতিকতা লালন করা ও তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।
অজ্ঞতা, স্বেচ্ছাচার ও দুর্নীতির কারণেও একটি সভ্যতায় ধস নামে। মার্কিন ইতিহাসবিদ উইল ডোরান্টের মতে, জ্ঞান ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে সভ্যতা দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলিম সমাজ বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুনের দৃষ্টিতেও স্বেচ্ছাচার, স্বৈরাচার ও দূর্নীতি সভ্যতার পতনের কারণ। অন্য যেসব বিষয় সভ্যতার পতন নিশ্চিত করে তাহলো সমাজে অনৈক্য ও হানাহানি ছড়িয়ে পড়া। ইরানের বিশিষ্ট লেখক ও ঐতিহাসিক আব্দুল হোসেন যার্রিনকুব বলেছেন, সভ্যতার টিকে থাকার জন্য ঐক্য ও সংহতি জরুরি। তিনি মনে করেন, অনারবদের উপর আরবদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে উমাইয়ারা যে চুক্তি করেছিল, তা মদীনায় রাসূলের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার উন্নত ভিত্তিকে ক্রমেই নড়বড়ে করে ফেলে। মুসলিম সভ্যতার ভিত্তি সে সময় থেকেই দূর্বল হতে থাকে বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, মুসলিম সভ্যতা দূর্বল হবার পেছনে দূর্নীতি ও বিলাসিতাও একটি বড় কারণ। যার্রিনকুব বলেছেন, তৎকালীন শাম বা বর্তমান সিরিয়ায় বনী উমাইয়াদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই মুসলিম সভ্যতা দূর্বল হতে থাকে।
বিজাতীয় শত্রুদের আক্রমনও সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে দুর্বল করার ক্ষেত্র তৈরী করতে পারে। শত্রুরা অতীতেও বহুবার মুসলিম দেশগুলোতে হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে মোংগলীয় ও ক্রুসেডারদের হামলা অন্যতম। কিন্তু সুখের কথা হলো, মুসলমানরা এসব যুদ্ধে হেরে যায়নি এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তারা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। সব মিলিয়ে, আমরা যদি মুসলিম দেশগুলোর চড়াই-উৎরাইয়ের ইতিহাস সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখবো, মুসলমানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। স্বয়ং রাসূল (সা.) এ ধারার সূচনা করে গেছেন।
তৃতীয় পর্ব
গত আসরে আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সভ্যতার পতনের নানা কারণ এবং বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতার অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এছাড়া, মুসলিম সভ্যতা নানা প্রতিকূলতার মাঝেও কীভাবে টিকে থাকলো সে বিষয়টিও আমরা তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতা হিউম্যানিজম, লিবারেলিজম ও সেক্যুলারিজম এই তিন মতবাদের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এবং এসব মতবাদে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়না। যাইহোক, আজকের আসরে আমরা মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি গঠনে নবী-রাসূলদের ভূমিকা বিশেষকরে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)’র ভূমিকা নিয়ে খানিকটা আলোচনা করবো।
মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি গঠনে নবী-রাসূলরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। নবী-রাসূলগণ যুগে যুগে মানব জাতিকে সৎ পথের দিকে আহ্বানের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহতায়ালা সূরা নাহ্লের ৩৬ নম্বর আয়াতে সমাজে নবী-রাসূল পাঠানোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, “আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি। তোমরা আল্লাহর উপাসনা করো এবং শয়তানকে বর্জন করো।”
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)’র আগেও আল্লাহতায়ালা পবিত্র মক্কা শহরে কয়েক জন নবী পাঠিয়েছেন। ইব্রাহিম (আ:) তাদের মধ্যে অন্যতম। ইব্রাহিম (আ:)’র আর্বিভাবের পর আরবদের কেউ কেউ একত্ববাদের ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ইব্রাহিম (আ:)’র ইন্তেকালের পর অধিকাংশ আরব এই একত্ববাদী ধর্মের সাথে মূর্তিপূজার কুসংস্কার ও বিশ্বাসের মিশ্রন ঘটায়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, ইব্রাহিম (আ:)’র সময় থেকে শুরু করে ইসলাম ধর্মের আর্বিভাবের আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ আরবই ইব্রাহিম (আ:)’র ধর্মের কিছু রীতি নীতি মেনে চলার পাশাপাশি মূর্তি পুজাও করতো।
তবে আরবদের মধ্যে এমন কিছু মানুষও ছিলেন যারা মূর্তিপুজা করতেন না এবং মানুষকে মূর্তি পুজা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাতেন। যারা মূর্তিপুজা না করে ইব্রাহিম (আ:)’র ধর্মের প্রতি অটল ছিলেন,তাদের মধ্যে আব্দুল মোত্তালেব অন্যতম।
বিষয়টি আরো স্পষ্ট করার জন্য আরব ভূখন্ডের ইতিহাস নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক। ঐতিহাসিকরা আরব ইতিহাসকে তিন ভাগে বিভক্ত করে থাকেন। প্রথমত: জাহিলিয়াতপূর্ব প্রাচীন যুগ, দ্বিতীয়ত: জাহিলিয়াত যুগ এবং জাহিলিয়াত পরবর্তী যুগ। ইসলাম আর্বিভাবের পর জাহিলিয়াত বা অজ্ঞতা যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় ইসলামি যুগ এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য জাতির মতো আরবরাও ইসলামপূর্ব যুগে কবিতা ও সাহিত্যের মতো কোন কোন ক্ষেত্রে পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলো। শুধু বিশেষ মহলেই নয় কবিতা ও সাহিত্যের প্রতি সাধারণ মানুষজনেরও ব্যাপক ঝোঁক ছিলো। বেদুঈন আরবরা নতুন নতুন কবিতা শুনতে কবিদের কাছে আসতেন এবং একসঙ্গে বসে কবিতা আবৃত্তি শুনতেন।
আরবের বাজারগুলোতেই কবি ও শ্রোতাদের বেশি সমাগম ঘটতো। সে সময় যে গোত্রে শক্তিমান ও সৃষ্টিশীল কবির জন্ম হতো সে গোত্রের মানুষ ওই কবিকে নিয়ে গর্ব করতো এবং তার জন্য সম্মানসূচক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। জাহেলি যুগে একজন কবি ইচ্ছে করলেই একজন সাধারণ মানুষকেও প্রশংসার মাধ্যমে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করতে পারতেন এবং একজন সম্মানী ব্যক্তিকে ব্যঙ্গ করে অথবা তার বিষয়ে দূর্নাম রটিয়ে তাকে অপমান করতে পারতেন। কবির ইশারায় একজন সম্মানী ব্যক্তিও সমাজে তুচ্ছ ব্যক্তিতে পরিণত হতেন। জাহেলি পরিবেশ কবিদের ওপরও প্রভাব ফেলেছিল। সে সময়কার বেশিরভাগ আরব কবিতায় তৎকালীন সমাজের মানুষের জীবনপ্রণালীর চিত্র অংকিত হয়েছে। কবিতাগুলোতে আরব মরুপ্রান্তর, তাবু, তলোয়ার, নানা ধরনের খেলা, মানুষের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা এবং আচার-আচরণ চিত্রায়িত হয়েছে।
ইসলামপূর্ব যুগকে জাহেলি যুগ বলা হয়, কারণ সে সময় সমাজে অজ্ঞতা ও বর্বরতা প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো। আরব উপদ্বীপে কোন আইন-কানুন ও রীতি-নীতি ছিলো না। এছাড়া, আরবে তখন কোন নবী-রাসূলও ছিলেন না যারা আল্লাহর নির্দেশে মানুষকে সৎ পথে পরিচালিত করতে পারেন। কারণ বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)’র আবির্ভাবের আগে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত আরবে কোন নবী-রাসূল আসেননি। এছাড়া, আরব উপদ্বীপের উত্তরের বেশিরভাগ অঞ্চল বিশেষকরে হিজায অঞ্চলটি ছিলো শুষ্ক ও রুক্ষ এবং ইসলামপূর্ব যুগে বেশিরভাগ আরবের বাস ছিলো মরু এলাকায়। মরু অঞ্চলের মানুষজন পানির সন্ধানে একেক সময় একেক দিকে ছুটে যেতেন। এ অবস্থা তাদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিয়েছিলো। কঠিন ও রুক্ষ পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে অনেকেই তাদের মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো ভুলে গিয়েছিল।
এ কারণে সে সময়ের ইতিহাস যুদ্ধের নানা ঘটনায় ভরপুর। বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীর মধ্যে পশু ও চারণভূমির আধিপত্য নিয়ে যুদ্ধ হতো এবং একে অপরের এলাকায় লুটতরাজ চালাতো। গোত্রপ্রীতি ও কুসংস্কার ছিলো সে সময়ের আরবদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তারা সামান্য কারণে বড় বড় যুদ্ধের জন্ম দিতো,যা কখনো কখনো বছরের পর বছর ধরে চলতো। জাহেলি যুগের আরবরা নারীদের কোন গুরুত্বই দিতো না। নারীরা মানুষ হিসেবেই গণ্য হতো না। তারা কন্যা সন্তানকে অপমানের বোঝা বলে মনে করতো। কখনো কখনো এই অপমান থেকে রক্ষা পেতে কন্যা শিশুদের জীবন্ত কবর দিতো। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকারকে তারা অস্বীকার করতো। এমনকি স্বয়ং নারীদেরকেই উত্তরাধিকার সম্পত্তি ও পণ্য বলে গণ্য করতো।
পবিত্র কোরআনের সূরা নাহলের ৫৮ ও ৫৯ নম্বর আয়াতে সে সময়কার নারীদের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ওদের কাউকে যখন কন্যা-সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখমন্ডল কালো হয়ে যায় এবং ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তাকে যে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে,তার কারণে সে নিজ গোত্র অথবা সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আত্মগোপন করে এবং সে এটা ভাবতে থাকে যে, এই অপমানের পর নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে না কি নিজেকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে? বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন,যখন আরবের মানুষ অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে পুরোপুরি নিমজ্জিত। তিনি এ ধরনের একটি সমাজ থেকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কল্যাণের বার্তা পৌছেঁ দেয়ার দায়িত্ব পান। এখানে উল্লেখ্য, সে সময়কার বিশ্ব রাজনীতিতে আরবদের কোন গুরুত্বই ছিলো না, কোন অবস্থানই ছিলোনা। কিন্তু বিশ্বনবী, তাঁর মিশন এবং তার শিক্ষা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আরব ভূখন্ডে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করেন।
নবীজীর পথনির্দেশনায় মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতায় এক বিপ্লব সংঘটিত হয়। রাসূল (সা.) নব্যুওয়ত লাভের পর ১৩ বছর মক্কায় ইসলামের মূল নীতি ও শিক্ষা প্রচার করেন। কিন্তু রাসূল(সা.) মক্কায় অবস্থানকালে নানা কারণে ইসলামি রাষ্ট্র ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠার পরিবেশ তৈরী করা সম্ভব হয়নি। হয়তো এর বড় কারণ ছিলো, মক্কার গোত্র ও গোষ্ঠি ভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। গোত্রভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে ব্যাপক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিশ্বনবী (সাঃ) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। মক্কার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পদমর্যাদা ও সম্মান কখনোই যোগ্যতা ও সাহসিকতার ভিত্তিতে ছিল না বরং কে কোন গোত্রের ও কোন বংশের তার ভিত্তিতেই ব্যক্তির মর্যাদা নির্ধারিত হতো। এছাড়া, মক্কার ভৌগলিক অবস্থানও বিশ্বে প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উপযোগী ছিলো না। কিন্তু মদিনায় হিজরতের পর রাসূল (সা.) সেই উপযুক্ত পরিবেশ পান।
চতুর্থ পর্ব
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সর্বশেষ ঐশী ধর্ম তথা ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি ১৩ বছর ধরে মক্কা অঞ্চলে ইসলামের বাণী জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু অল্প সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এ ছাড়াও শত্রু দের ব্যাপক বিদ্বেষী আচরণের কারণে তিনি সেখানে অনুকূল পরিবেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের সুযোগ পাননি। ফলে (সাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় মুসলমানদের হিজরত বা অভিবাসন শুরু হয়।
মদীনা বা ইয়াসরিব ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য নিরাপদ স্থান। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এ বিষয়টি বুঝতে পেরে মুসলমানদেরকে মদীনায় হিজরত করতে বলেন। নবী হিসেবে দায়িত্ব লাভের ১৪তম বছরের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার অথবা এর সামান্য কিছু আগে বা পরে রাসূল (সাঃ) মদীনায় প্রবেশ করেন। মক্কা থেকে মদীনার উপকণ্ঠে ক্বুবা নামক স্থানে আসতে তাঁর সময় লেগেছিল নয় দিন। ক্বুবায় তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অবস্থান করেন। এ সময় সেখানে নির্মিত হয়েছিল ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ। কয়েকদিন পর মক্কা থেকে মহানবী (সাঃ)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত আলীও রাসূল (সাঃ)”র সাথে মিলিত হন। এরপর তাঁরা একইসাথে মদীনায় প্রবেশ করেন।
ইয়াসরেব বা মদীনা ছিল দুটি বড় ইহুদি গোত্রের সম্মিলন-স্থল। এ ছাড়াও কয়েকটি মোহাজির গোত্র এ অঞ্চলে বসবাস করত। আওস ও খাজরাজ ছিল এসব মোহাজির গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোত্র। এসব গোত্রের আবাসস্থল হবার কারণে মদীনার লোকজনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে এক ধরনের নির্লিপ্ত ভাব বা নিস্ক্রিয়তা দেখা যেত। ফলে এখানে নতুন ধর্ম বিকশিত হবার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এ জন্যই মক্কার তুলনায় মদীনা বা ইয়াসরেব শহরে ইসলাম ধর্ম বিকশিত হবার পথ বেশী উন্মোচিত হয়েছিল। এখানকার অ-ইহুদি আরব গোত্রগুলো ইহুদিদের কাছ থেকে আল্লাহ, ওহী বা ঐশী প্রত্যাদেশ, বিচার বা পুনরুত্থান দিবস, বেহশত ও দোযখ প্রভৃতি বিষয়ে ধারণা পেয়েছিল। এ ছাড়াও পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত আওস ও খাজরাজ গোত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে নতুন মিত্র শক্তির বলে পরস্পরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সূবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। তাই দেখা যায় এ দুটি গোত্র কেবল একে-অপরের আগে নয়, এমনকি ইহুদিদেরও আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসে।
মদীনায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)”র প্রবেশের দিনটি ছিল শুক্রবার। তাঁর ইমামতিতে সেদিনই প্রথম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জুমার নামাজের খোতবায় মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপনের পর তিনি জনগণকে খোদাভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন, সৎ কর্ম ও আল্লাহর পথে জিহাদের আহ্বান জানান। জুমার নামাজ আদায়ের পর তিনি শহরের ভেতরে প্রবেশ করেন। মদীনার জনগণ তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানায়। এ সময় থেকে রাসূল (সাঃ)’র সাহাবায়ে কেরাম মুহাজির ও আনসার হিসেবে পরিচিত হন। যারা মক্কা থেকে হিজরত করে ইয়াসরেবে আসেন তাদের বলা হত মুহাজির। আর মদীনার স্থানীয় সাহাবীদের বলা হত আনসার বা সাহায্যকারী। ইয়াসরেবে মহানবী (সাঃ)’র আগমনের সুবাদে এই শহরের নাম রাখা হয় মদীনাতুননবী বা রাসূলের শহর ।
এভাবে দেখা যায়, ইসলাম ধর্ম মক্কায় যাত্রা শুরু করলেও মদীনা হয়ে পড়ে এ ধর্ম বিকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র। মদীনায় জনগণ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মুসলমানদের সংখ্যা দর্শনীয়ভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বনবী (সাঃ) একটি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এই সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তিনটি ভিত্তি ছিল। মসজিদ নির্মাণ, মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর।
এভাবে মহানবী (সাঃ) আরবদের মধ্যে শত শত বছর ধরে প্রচলিত জাহেলী যুগের গোত্রীয় বিদ্বেষের অবসান ঘটান। ইসলামী সমাজ বা উম্মাহ গঠনে তাঁর প্রচেষ্টার ফলে ধর্মই মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ও বন্ধন বা যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়। গোত্রীয় বন্ধনের যে ধারা আরবদের মধ্যে জাহেলিয়াত বা কুসংস্কার ও গোত্রীয় নানা কূ-প্রথা সৃষ্টি করেছিল তা ইসলামী সমাজ গঠনের ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এভাবে জাহেলী চিন্তা-চেতনার অবসান ঘটায় মদীনার মুসলমানরা ইসলাম প্রচারের জন্য প্রস্তুত হয়।
বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণের আলোকে বলা যায়, হিজরতের প্রথম দিন থেকেই সভ্যতা গড়ে তোলার লক্ষণগুলো ইসলামে স্পষ্ট হয়ে উঠে। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের মাধ্যমে মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ে উঠে। এভাবে মহানবী (সাঃ)”র ওয়াদা বাস্তবে রূপ নেয়। মদীনায় মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর ছিল তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি। এই সংবিধানের মাধ্যমে নাগরিকদের সামাজিক অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এমনকি এতে ইহুদিদের নাগরিক ও সামজিক অধিকারকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। এই সংবিধান অনুযায়ী মুসলমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা লাভ করে। এভাবে হিজরতের সুবাদে ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে সামাজিক ন্যায়বিচার ও জনমত বা জন সমর্থনের আলোকে একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠে এবং ইসলামী চিন্তাধারা বাস্তবায়নের পথ সূচিত হয়। মক্কায় বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন একজন সাধারণ নাগরিক, কিন্তু মদীনায় তিনিই হন প্রথম ইসলামী সরকারের প্রধান দায়িত্বশীল।
মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের ছিল ভৌগোলিক সীমানা ও অঞ্চল বা ভূখণ্ড, জনগণ, সার্বভৌমত্ব বা স্বাধীনতা ও প্রশাসন। এ ছাড়াও ছিল আইনের শাসন। অন্য কথায় সে রাষ্ট্রে আইনের দৃষ্টিতে ছিল সবাই সমান। কারো ব্যাপারে কোনো বৈষম্য ছিল না। সে যুগে এমন ব্যবস্থা ছিল নজিরবিহীন। তাই তা সব যুগের জন্য আদর্শে পরিণত হয়। দেখা গেছে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মুসলিম জাহানের খলিফা আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) আদালতে তাঁর অধিকার ত্যাগ করেছেন। বিবাদী ইহুদি খলিফার মনোনীত কাজীর এ ধরনের অবিশ্বাস্য রায়ে ও রায়ের প্রতি খলিফার শ্রদ্ধায় বিমুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
মদীনা সনদ প্রণয়ন ছিল বিশ্বনবী (সাঃ)”র ইসলামী রাষ্ট্রের আরেক মহান কীর্তি। এতে নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকারের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরই আলোকে সব কিছু ত্যাগ করে কেবল ঈমান নিয়ে আসা মুহাজিরদের নিরাপত্তা বিধান ও সহায়-সম্পদের ক্ষেত্রে আনসারদের সহযোগীতা ছিল অকল্পনীয়। মদীনার স্থানীয় ও বহিরাগত মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করে দেয়া ছিল মহানবী (সাঃ)র এক বড় সাফল্য। এর আগে সম্পর্কের মাপকাঠি ছিল গোত্রীয় পরিচয়। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের মুমিনদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সীসা ঢালা প্রাচীরের মত দৃঢ় ঐক্য।
পঞ্চম পর্ব
ইসলামের নবী (সা) এর মৌলিক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ছিল মসজিদ নির্মাণ করা। ইসলামী হুকুমাতের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে মসিজদ প্রতিষ্ঠা করতেন তিনি। আসলে এমন একটি প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনা নির্মাণ করার প্রয়োজন পড়েছিল যা একদিকে হবে মুসলমানদের ইবাদাতের স্থান, অপরদিকে হবে রাজনৈতিক, বিচার, প্রশিক্ষণ এমনকি সামরিক দিকসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র। যাই হোক মসজিদের গুরুত্ব এবং এর ভূমিকা নিয়ে আজকের আসরে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো।
প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে মসজিদ ছিল নামায পড়া, জ্ঞানার্জন, বিচারকার্য পরিচালনা এবং হুকুমাতের কেন্দ্র। এছাড়াও মসজিদে বায়তুল মাল, যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমতের মালামাল ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হতো। এমনকি যুদ্ধবন্দী এবং কারাবন্দীদেরকেও মসজিদে রাখা হতো। অর্থাৎ সামাজিক এবং রাজনৈতিক সকল কার্য পরিচালনার কেন্দ্র ছিল মসজিদ। এদিক থেকে বিচার করলে বলতেই হবে যে মদিনায় নয়া ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে মসজিদের ভূমিকা ছিল মৌলিক এবং অপরিসীম। মসজিদের ভূমিকা এবং কর্মকাণ্ড সম্পের্ক সম্ভবত বলা যায় সে সময় ইমান এবং জ্ঞানের মধ্যকার গভীরতম যে বন্ধনগুলো গড়ে উঠেছিল তা মসজিদ থেকেই গড়ে উঠেছে। ইসলামের হুকুম-আহকাম, ইসলাম পরিচিতিমূলক বক্তব্য মসজিদে দেওয়া হতো, ইসলামী শিক্ষা এমনকি লেখা এবং পড়ার মতো বিষয়গুলোও মসজিদেই শিক্ষা দেওয়া হতো। পরবর্তীকালে যখন ইসলামী হুকুমাত এবং আদালত বা বিচার বিভাগকে মসজিদ থেকে পৃথক করা হলো তখনো সেগুলো ছিলো মসজিদের প্রতিবেশীসুলভ অর্থাৎ মসজিদ সংলগ্ন রেখেই সেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিলো। সাম্প্রতিক শতাব্দিগুলোতেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শহরের জামে মসজিদের পাশেই গড়ে তোলার প্রচলন ছিলো।
নবী আকরাম (সা) এর অন্যতম মৌলিক একটি দায়িত্ব ছিলো দ্বীনের আকিদা-বিশ্বাসের প্রচার-প্রসার। সন্দেহাতীতভাবে তার জন্যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক ও বিচার বিভাগীয় কাঠামোর প্রয়োজন ছিলো। এই কাজগুলো বা গুরুদায়িত্বগুলো সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেওয়ার জন্যে নবীজী সুযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। এদের অনেকেই যাকাত এবং সদকা সঞ্চয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন, অনেকেই আবার সামজিক দায়িত্বগুলো পালন করতেন। মদিনার সরকারের প্রশাসনিক বিভাগ ছিল খুবই সাদামাটা তবে সামগ্রিক এবং পূর্ণাঙ্গ। অনেকেই আবার ভিন্ন ভিন্ন আরো কিছু দায়িত্বে নিয়েঅজিত ছিলেন, যেমনঃ চুক্তিপত্র সম্পাদনের কাজ, সম্মতি পত্র লেখালেখি এবং সংরক্ষণের কাজ, আয়কর হিসাব এবং আদায়ের কাজ, যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমতের হিসাব নিকাশের কাজ এমনকি কেউ কেউ কোরআনের আয়াত লেখালেখির কাজেও নিয়োজিত ছিলেন।
পানির উৎসগুলো এবং ভূমিগুলো যা বিভিন্ন ব্যক্তি এবং গোত্রকে দেওয়া হতো সেগুলোর তালিকা তৈরি করা এবং তাদের জন্যে ভূমির মালিকানা স্বত্ত বা দলিল লেখার দায়িত্বও কারো কারো ওপর দিয়েছিলেন।
আরবদের মাঝে এটা ছিলো একেবারেই নতুন একটি রীতি। কেননা আরবদের মাঝে আবহমান মতানৈক্য ও দ্বন্দ্বের অন্যতম একটি কারণ ছিলো ভূমি, পুকুর এবং জলাশয়ের মালিকানা নিয়ে। নবীজী সেইসব প্রাচীন দ্বন্দ্ব সংঘাত বন্ধের লক্ষ্যে যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন তা ছিলো এক কথায় ঐতিহাসিক এক পদক্ষেপ।
পয়গাম্বর (সা) ইহুদি খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন গোত্রের সাথে চুক্তি বা সন্ধিপত্র করেছিলেন। এইসব চুক্তিপত্রের কথা স্থান কাল পাত্রভেদে এবং মুসলমানদের শক্তিমত্তার অবস্থাভেদে বিভিন্ন রকম ছিলো। কখনো কখনো চুক্তিপত্রের অবস্থা বা পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন।উদাহরণস্বরূপ হুদাইবিয়ার সন্ধির কথা বলা যায়। হুদাইবিয়ার সন্ধিটি হয়েছিলো মক্কার মুশরিকদের সাথে। ঐ চুক্তিতে মুশরিকদের দেওয়া শর্তগুলো মেনে নেওয়ায় মুসলমানদের অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, এমনকি কেউ কেউ বিরক্তও হয়েছিলেন। সে কারণে মুসলমানদের কেউ কেউ ঐ চুক্তির ব্যাপারে আপত্তি পর্যন্ত করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে নবীজীর জীবনকালে কূটনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার অন্যতম প্রধান ও সফল একটি উদাহরণ ছিলো এই হুদাইবিয়ার সন্ধি। এই চুক্তির ফলে মদিনার নয়া সরকার যেমন দৃঢ়তা ও মজবুতি পেয়েছিলো সেইসাথে নবীজীর লক্ষ্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নও সহজতর হয়েছিলো।
রাষ্ট্রীয় এইসব কাজের পাশাপাশি রাসূলে খোদা (সা) বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ, প্রতিবেশী সরকারসহ বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহদেরকে চিঠি লিখেছিলেন। তখনকার দিনে ইরানের বাদশাহ, রোমান সম্রাট, মিশরের সুলতান, ইয়েমেনের শাসক, ইথিওপিয়ার বাদশাসহ আরো অনেক বাদশাকেই চিঠি লিখেছিলেন রাসূলে খোদা (সা)। এইসব চিঠির মূল বিষয় ছিলো পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করা এবং এক আল্লাহর আনুগত্য মেনে নেওয়া তথা তৌহিদের দাওয়াত প্রদান। ইতিহাসবিদ এবং লেখকদের অনেকেরই মতে এইসব চিঠি ছিলো নবীজীর পররাষ্ট্রনীতিরই অংশ। নবীজী এই দাওয়াতকে এবং কূটনীতিকে যুদ্ধ এবং সহিংসতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর সাহাবিরা যদি কাউকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার আগে আটক করতেন তাহলে নবীজী তাদেরকে মুক্ত করে দিতেন।
নবীজীর পরবর্তী পদক্ষেপ ছিলো ইসলামের পরিধি বিস্তার করা এবং মুসলমানদের সীমান্তে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আরব্য উপদ্বীপের রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরেও বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াত পৌছেঁ গিয়েছিলো। মার্কিন ইতিহাসবিদ বিল ডুরান্ট ইসলামী শাসন ব্যবস্থার সাংগঠনিক কাঠামোয় নবীজীর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী ভূমিকার কথা স্বীকার করে বলেছেন, সই সময় নবীজী কেবল মুসলমানদেরই নেতা ছিলেন না বরং মদীনা শহরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঐ শহরের বিচারকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
ইরানের বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক আব্দুল হাসান যাররিন কুব বলেছেনঃ ‘বিশেষ করে মদিনায় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশেষত কেবলা পরিবর্তনের পর থেকে রমযান মাসের রোযা পালন, নামায এবং যাকাতে ফেতরার মতো বিধানগুলোর ব্যাপারে কোরআনের আয়াত নাযিল হয়। এইভাবে এই বিধানগুলো বিধিবদ্ধ হয়।’
যাররিন কুবের মতে, ইসলামের আরো কিছু বিধান আরবদের জীবন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলো এবং তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো। এসব বিধানের মধ্যে রয়েছেঃ কেসাস, দিয়া বা রক্তমূল্য, জেহাদ, গনিমত বণ্টন, উত্তরাধিকারের বিধান, মদ হারামের ঘোষণা, হজ্জ্বের বিধান ইত্যাদি। তবে সবকিছুর দায়িত্ব নবীজীর ওপর থাকলেও তিনি তাঁর সাহাবিদের সাথে সবসময় পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করতেন। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর ব্যাপারে তিনি কৌশল নির্ধারণের জন্যে একটি সামরিক পরিষদ গঠন করতেন এবং সবার মতামত চাইতেন। ওহুদের যুদ্ধে তিনি ভিন্ন মত পোষণ করা সত্ত্বেও সাহাবিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকেই গ্রহণ করেছিলেন। এভাবেব বিভিন্ন দেশ জয় করার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন। ইসলামের সাথে যেসব সংস্কৃতি সাংঘর্ষিক ছিল না,সেগুলোকে ইসলাম গ্রহণ করে নেয়। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এসবের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ষষ্ঠ পর্ব
পাঠক! গত আসরে আমরা বলেছিলাম পয়গাম্বর (সা) মদিনায় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় কীভাবে প্রশাসনিক, সামরিক, বিচারিক প্রভৃতি বিভাগ চালু করেছেন এবং ধীরে ধীরে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি কীভাবে বিকাশ লাভ করে। আজকের আসরে আমরা তারই ধারাবাহিকতায় আরো কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।
জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা এমন একটি অনুষঙ্গ যা ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একথা বলাটা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মেই জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে এতো বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। কোরআন এবং হাদিসের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্ববর্গ বা অলি-আওলিয়াগণ কেবল মুসলমানদেরকেই নন বরং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীসহ সকল মানুষকেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জনের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। অন্ধবিশ্বাসী ঈমান অর্থাৎ জ্ঞান-প্রজ্ঞাবিহীন ঈমান আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। জ্ঞান-বুদ্ধি এমন এক উপাদান যা আমাদেরকে আল্লাহকে চেনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। আসলে আল্লাহকে চেনার এবং আল্লাহর একত্বকে উপলব্ধি করার গুরুত্বপূর্ণ উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা আম্বিয়ার ৬৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো খোদার প্রতি বিশ্বাস রাখা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে দূরে সরে যাবার লক্ষণ বলে ইঙ্গিত করে বলেছেন, “তোমাদের এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতিত যাদের উপাসনা করো তাদের ওপর ধিক্কার! আচ্ছা,তোমরা কি চিন্তা করো না! ( অর্থাৎ তোমাদের কি জ্ঞান-বুদ্ধি নেই?)”
ইসলাম মূর্খ লোকদেরকে ভৎর্সনা করে। মূর্খতা মানে কেবল অশিক্ষা নয়। আমরা এমন অনেক জ্ঞানী-গুণী লোককেও দেখতে পাই যারা সত্যের ব্যাপারে অন্ধ এবং অজ্ঞ। তারা আসলে শিক্ষিত বটে কিন্তু এ অর্থে যে,তারা বাইরের জগত সম্পর্কেই বেশি জানে,তাদের স্মৃতিটা জ্ঞাত বিষয়সমূহের একটি ভাণ্ডার ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবনের মৌলিক বিষয়-আশয় সম্পর্কে তারা চিন্তা-ভাবনা করে না বলে সঠিক পথের সন্ধান পায় না। মানবেতিহাস পরিক্রমায় দেখা গেছে দ্বীন এবং জ্ঞানকে যারা সাংঘর্ষিক দৃষ্টিতে দেখেছেন পরবর্তীকালে ইসলামে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সু-উচ্চ অবস্থান দেখে তারা হতবাক হয়ে গেছেন। ঐশী এই ধর্মের ইতিহাসে তো নয়ই এমনকি ইসলামী চিন্তা-চেতনা বা কর্মতৎপরতায়ও জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার মাঝে কোনোরকম দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয় না। জাবের ইবনে হাইয়্যান, মুহাম্মাদ্ইবনে মূসা খাওয়ারেযমি, মুহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়া রাযি, ফারাবি, ইবনে হিশাম, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ প্রমুখের মতো আরো বহু মুসলিম মনীষীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভই প্রমাণ করে যে ইসলাম জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার মাঝে গভীর সমন্বয়ের পক্ষপাতী।
ইসলামে সবসময়ই জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং আধ্যাত্মিকতার সমন্বিত কল্যাণের প্রতি মনযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সর্বপ্রথম যে সূরাটি নাযিল হয়েছে তার প্রাথমিক আয়াতগুলোতেও জ্ঞানার্জনের প্রতি ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছেঃ “পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে। পড়ো সেই প্রভুর নামে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহাদয়ালু। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন সেইসব-যা সে জানতো না। ”
কোরআনের সর্বপ্রথম এই আয়াতগুলো নাযিল হবার সময়কালের প্রতি একটু মনোযোগী হলে আয়াতগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করা যাবে। যখন এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় সে সময় মক্কা এবং হেজাজে লিখতে পড়তে জানা লোকের সংখ্যা একর্থে ছিল না বললেই চলে। যৎসামান্য পড়তে জানা বা লিখতে জানা লোকের সংখ্যা সমগ্র মক্কায় ছিলো বিশ জনেরও কম। অথচ সে সময় মক্কা ছিলো হেজাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ইবাদাত-উপাসনার মূল কেন্দ্র। এরকম পরিস্থিতিতে পড়ালেখার ব্যাপারে প্রত্যয় ঘোষণা করা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞানার্জন এবং প্রজ্ঞা লাভের কতো বেশি গুরুত্ব রয়েছে।
তদুপরি রাসূলে খোদা (সা) জ্ঞানার্জনকে সবার জন্যে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। মদিনায় তিনি চেষ্টা করেছেন জ্ঞান বা শিক্ষা বিস্তারের সুযোগ সুবিধাগুলোকে সবার জন্যে সমানভাবে উন্মুক্ত করে দিতে। যাতে সর্বশ্রেণীর মানুষই আল্লাহ প্রদত্ত মেধার বিকাশ ঘটিয়ে নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী জ্ঞানী হয়ে উঠতে পারে। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় লাভের পর মুশরিকদের একটি দলকে বন্দী করে নিয়ে আসা হয়। বন্দীদের মাঝে কতিপয় শিক্ষিতও ছিলেন। নবীজী ঘোষণা করেছিলেন বন্দীগণ দশজন মুসলমানকে পড়ালেখা শেখানোর বিনিময়ে মুক্তি পেতে পারে। নবীজীর এই পদক্ষেপের ফলে বহু মুসলমান পড়ালেখা শেখার সুযোগ পায়। যায়েদ ইবনে সাবেত ছিলেন বন্দীদের মাধ্যমে শিক্ষা লাভকারীদের একজন। এভাবে তৎকালীন সমাজে জ্ঞানার্জনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবও পড়েছিলো।
ইতিহাসের দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যাবে, ইসলামী সভ্যতার যুগে মুসলিম বিশ্বে বিচিত্র জ্ঞানের প্রসার লাভ ঘটেছিলো। মুসলমানরা কেবল ইসলামী জ্ঞান বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানই নয় বরং সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখারও গোড়াপত্তন করেন অর্থাৎ জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় মুসলমানদের মাধ্যমেই সৃষ্ট এবং বিকশিত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব বিষয়ে পাঠ দান করা হতো। ধর্মীয় এবং জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্রগুলোতে বড়ো বড়ো গ্রন্থাগারও স্থাপিত হয়েছিলো। জ্ঞানের চর্চা এবং ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষা তখন সমন্বিতভাবে অগ্রসর হয়েছিলো। অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুর্তজা মোতাহহারি (রহ) জ্ঞান এবং বিশ্বাস সংক্রান্ত বিতর্কে খ্রিষ্টিয় দৃষ্টিভঙ্গির ভ্রান্তির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, খ্রিষ্টিয় এই ভুল চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইউরোপীয় সভ্যতার ইতিহাসে ঈমান এবং জ্ঞান আলাদা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞান এবং বিশ্বাস সবসময় পরস্পরের পরিপূরক ছিলো-চাই বিকাশের সময়ই হোক কিংবা অবক্ষয়ের যুগে। তাঁর মতে জ্ঞান এবং ঈমান সমন্বিতভাবে মানুষকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে কোরআনের বিভিন্ন স্থানে জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আয়াত নাযিল হয়েছে। কোরআনে বিভিন্ন প্রসঙ্গে জ্ঞান শব্দটি অন্তত আশি বার এসেছে।
জ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে পরিসমাপ্তি টানবো আজকের আলোচনা। একদিন রাসূলের সাহাবিদেরই একজন নবীজীর কাছে জানতে চাইলেনঃ হে রাসূলে খোদা! মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন অনুষ্ঠান আর জ্ঞানীর আসর-এ দুয়ের মধ্যে কোন্টি আপনার কাছে বেশি প্রিয়? নবীজী জবাবে বললেনঃ লাশ দাফন করার জন্যে যদি কেউ থাকে তাহলে একজন আলেমের মজলিসে উপস্থিত হওয়াটা এক হাজার লাশ দাফন, হাজার রোগী দেখতে যাওয়া, হাজার রাত্রি ইবাদাত করা, হাজার দিন রোযা রাখা, ফকির মিসকিনদেরকে হাজার দিরহাম সদকা দেওয়া, হাজার বার হজ্জ্ব করা এবং হাজার বার জান্এবং মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার চেয়ে উত্তম। তোমরা কি জানো না কেবল জ্ঞানের মাধ্যমেই আল্লাহর ইবাদাত বা আনুগত্য করা যায়? দুনিয়া এবং আখেরাতের কল্যাণ নিহিত রয়েছে জ্ঞানের মধ্যে আর দুনিয়া এবং আখেরাতের অমঙ্গল নিহিত রয়েছে মূর্খতার মধ্যে।
৭ম পর্ব
মুসলিম সভ্যতা বিকাশের প্রসঙ্গ এলেই ভাষা লিপিবদ্ধ করার ইতিহাস এবং লেখ্য রূপের সাথে মুসলমানদের পরিচিত হওয়ার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। কাগজ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে কোন কিছু লিখে রাখার বিষয়টি অনেক সহজসাধ্য হয়। কোন কোন প্রাচ্যবিদের মতে, কাগজ আবিস্কৃত না হলে মুসলমানদের প্রাথমিক যুগের সংস্কৃতি এত বেশি বিস্তার ও সমৃদ্ধি লাভ করতে পারতো না। আজকের পর্বে আমরা ভাষার লেখ্য রূপের বিস্তার এবং ইসলামি সভ্যতায় এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করবো।
ইসলাম আবির্ভাবের পর এই ধর্মের সুস্পষ্ট বার্তা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। ভাষার লেখ্য রূপ এই বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আরবি ভাষার লেখ্য রূপের ইতিহাসের একটা বড় অংশই পবিত্র কোরানের সাথে সম্পর্কিত। মুসলমানদের সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ় রাখার ক্ষেত্রেও ভাষার লেখ্য রূপ এবং লেখার ধরণ অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। এ কারণে মুসলমানরা যে দেশ, জাতি ও ভাষারই হোক না কেন, ঐশী গ্রন্থ কোরআনকে অভিন্ন ভাষা ও স্টাইলে তেলাওয়াত করে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ়, এটি তারই প্রমাণ।
ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী, জাহেলি যুগে খুব অল্প সংখ্যক আরব, ভাষার লেখ্য রূপ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কারণ সে সময় আরব অঞ্চলের মানুষের জীবন-ব্যবস্থাই এমন ছিলো যে, তারা কোন কিছু লিখে রাখার প্রয়োজনবোধ করতো না। ওই সময় আরব সমাজে মূলত ভাষার শ্রুতি রূপটিই চালু ছিলো। বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীগুলোর গর্ব করার মতো বিষয়গুলো তা কবিতাই হোক আর গল্পই হোক,তা মৌখিক পরম্পরায় উত্তরসূরিদের কাছে পৌঁছে যেতো। তবে পুরনো যে সব কবিতা পাথরে খোদাই করা অবস্থায় ছিলো, সেসব থেকে লেখ্য রূপ ও লেখার সরঞ্জামগুলোর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বলা হয়, অতীতে ওই এলাকায় যে লিপি চালু ছিলো, তা ছিলো অনেকটাই নাবাতি লিপির মতো। মুসলিম গবেষক ও গ্রন্থ বিশেষজ্ঞ ইবনে নাদিম তার ‘আল ফেহরেস্ত’ গ্রন্থে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর দাদা আব্দুল মোত্তালিবের হস্তলিপির কথা উল্লেখ করেছেন। আব্বাসীয় খলিফা মামুনের কোষাগারে ওই লিপি সংরক্ষণ করা হতো।
ইসলাম আবির্ভাবের পরপরই কেরানের যে ক্ষুদ্র অংশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, তা থেকেও প্রমাণিত হয়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে লেখ্য রূপ বা লিপির সাথে আরবদের প্রাথমিক একটা পরিচিতি ছিলো। পবিত্র কোরানে মুসলমানদেরকে লেনদেনের বিষয়টি লিখে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারার ২৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “”হে বিশ্বাসিগণ, যখন একে অন্যের সাথে কোন নির্দিষ্টকালের জন্য ধারের আদান-প্রদান করবে, তখন তা লিখে রাখো এবং তোমাদের মধ্যে কোন লেখক যেন তা ন্যায়ভাবে লিখে দেয়”।”
ওই আয়াত অনুযায়ী, মুসলমানদের দায়িত্ব হলো, আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ককে লিখিত ও দালিলিক রূপ দেয়া। রাসূলের হাদিসে বিভিন্ন বিষয় লিখে রাখতে বলা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমার জ্ঞান ও শিক্ষা লিপিবদ্ধ করো। রাসূল (সা.)’র কয়েক জন বিশেষ কাতেব বা লিপিকার ছিলেন, যারা কোরানের আয়াত লিখে রাখতেন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় চুক্তি ও চিঠিপত্র লিখতেন। পবিত্র কোরানের ওহী যারা লিখে রাখতেন,তাদের মধ্যে হযরত আলী (আ.)”র ছিলেন অন্যতম।
আরবে যেহেতু চামড়ার দাম ছিলো চড়া, সে কারণে কাতেব বা লিপিকাররা তা নিয়মিত ও ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করতে পারতো না। ইতিহাসেও এসেছে, আব্দুল মোত্তালেবও সে সময় চামড়ায় লিখতেন। চামড়ার স্থায়ীত্ব যেহেতু বেশি, সে কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি লিখে রাখার ক্ষেত্রে তা ব্যবহৃত হতো। চামড়ায় লেখার গুরুত্ব, বনী আব্বাসীয়দের শাসনামলের মাঝ সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। বিভিন্ন চুক্তি, গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ ও চিঠিপত্র চামড়ায় লিখা হতো। রাসূলের সহধর্মিনী উম্মে সালমা বলেছেন, রাসূল (সা.) আমার কাছে চামড়া চেয়ে নিলেন । সে সময় আলী(আ:)ও সেখানে ছিলেন। রাসূল বলছিলেন আর আলী (আ.) লিখছিলেন। আলী (আ.) এমন ভাবে লিখলেন যে, চামড়ার দুই পাশ এবং কিনারাগুলোও পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। আরবরা অন্যান্য জিনিস যেমন গৃহপালিত বিভিন্ন পশু যেমন উট ও ভেড়ার হাড়, খেজুড় গাছের শুষ্ক বাকল, এমনকি খেজুড়ের শুষ্ক পাতা এবং কাপড়, লেখার জন্য ব্যবহার করতো।
হিজরী প্রথম শতাব্দির প্রথমার্ধের বিভিন্ন ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সে সময় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান হতো। সে সময়কার চিঠির মধ্যে আলী (আ.)”র চিঠি-সমগ্র অন্যতম। বিখ্যাত নাহজুল বালাগার একটি অংশে আলী (আ.)”র চিঠি স্থান পেয়েছে। আশেপাশের সভ্যতাগুলোর সাথে মুসলমানদের পরিচিতিও লেখার উপকরণকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। মিশর ও সিরিয়া জয় করার পর মুসলমানরা প্যাপিরাসের সাথে পরিচিত হয় এবং এর পরই প্যাপিরাসে লেখা শুরু করে। উমাইয়াদের খেলাফতের পুরো সময়টায় এবং আব্বাসীয়দের খেলাফতের প্রথম দিকে ইরাক,মিশর ও সিরিয়ায় প্যাপিরাসে খেলার প্রচলন ছিলো। ইতিহাসে এসেছে, আব্বাসীয় খলিফা মনসুর তার এক প্রতিনিধিকে কোষাগারে মজুদকৃত প্যাপিরাস বিক্রি করে দেয়ার নির্দেশ দেন যাতে এর ফলে কোষাগারের স্থান সংকটের সমাধান হয় এবং সরকারি বাজেটে কিছু অর্থ যোগ হয়। কিন্তু এর অল্প সময় পরই তিনি ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং প্রয়োজনের কারণে এর বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দেন।
হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দির প্রথমার্ধের শেষ দিকে কাগজ, প্যাপিরাস ও চামড়ার স্থান দখল করে নেয়। কাগজ তৈরী এবং কাগজ শিল্পের বিস্তারে মুসলমানদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। ইতিহাসে এসেছে, হিজরী প্রায় ১৩৪ সনের দিকে বর্তমান উজবেকিস্তানের উত্তরে মুসলিম সেনা কমান্ডার যিয়াদ বিন সালেহ’র নেতৃত্বে তুর্কি ও চীনা আমিরদের সাথে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে যিয়াদ বিন সালেহ, চীন দেশীয় কয়েকজনকে বন্দি করেন। এসব বন্দী কাগজ তৈরির কৌশল সম্পর্কে জানতেন। তাদেরকে তিনি সমরখন্দে নিয়ে যান। ওই সব বন্দীদের মাধ্যমে কাগজ শিল্প সমৃদ্ধি লাভ করে এবং অন্যান্য মুসলিম এলাকাতেও তা ছড়িয়ে পড়ে। মান সম্পন্ন ও সস্তা হবার কারণে সমরখন্দের কাগজের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
এরপর মুসলমানরা ওই সব চীনা বন্দির কাছ থেকে কাগজ তৈরির কৌশল শিখে নেয় এবং এই শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ করে। মুসলমানরা পরবর্তীতে তুলা এবং অন্যান্য উদ্ভিদ থেকে কাগজ তৈরি করতে সক্ষম হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে কয়েক ধরনের কাগজ বাজারে আসে। আল ফেহরেস্ত গ্রন্থে গবেষক ইবনে নাদিম কয়েক ধরনের কাগজের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন। এসব কাগজ আবার বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।
এভাবে আস্তে আস্তে কাগজ শিল্প ইরাক, মিশর, সিরিয়া, মরক্কো, বর্তমান স্পেন ও ইরানের মতো মুসলিম ভূখন্ডগুলোতে বিস্তার লাভ করে এবং ঐসব এলাকাতেও কাগজ তৈরি হতে থাকে। খলিফা হারুনুর রশিদের ইরানি বংশোদ্ভুত মন্ত্রী ফজল বিন ইয়াহিয়া বারমেকি বাগদাদে কাগজ শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন। বাগদাদের কয়েক কেন্দ্রে কাগজ তৈরি হতো। এরপর আস্তে আস্তে বাগদাদের কাগজের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং সবচেয়ে ভালো কাগজ হিসেবে সমাদৃত হতে থাকে।
ঐতিহাসিকরা বলেছেন, বাগদাদের কাগজ এতটাই মানসম্পন্ন ছিলো যে, তা পবিত্র কোরআন লেখার কাজেও ব্যবহার হতো। হিজরী পঞ্চম শতাব্দিতে কাগজ শিল্প ইরাক থেকে সিরিয়ায় যায় এবং ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। দামেস্ক তথা সিরিয়ায় তৈরি কাগজও পরবর্তীতে সুনাম অর্জন করে এবং সিরিয়ার তৈরি কাগজ, পূর্ব ইউরোপে রপ্তানি করা হতো। মিশরে তুলনামূলক বিলম্বে কাগজ শিল্পের বিকাশ ঘটলেও সেখানকার কাগজও মানসম্পন্ন ছিলো বলে ঐতিহাসিক সনদে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুসলিম বিশ্বের পশ্চিমে অর্থাৎ উত্তর আফিকা, স্পেন ও সিলিলিতেও কাগজের মিল ছিলো এবং সেখান থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোতে কাগজ রপ্তানি করা হতো। ইতিহাসে পাওয়া যায়, হিজরী সপ্তম শতকে ইরানে কাগজ তৈরি হতো।
এভাবেই মুসলমানরা লেখালেখি এবং সংস্কৃতি বিনিময়ের অন্যতম প্রধান উপাদান কাগজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এবং এর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মিশর ও স্পেনের মাধ্যমে এই শিল্প ইউরোপে প্রবেশ করে এবং ১২৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ইতালিতে, ১৩৪৮ সালে ফ্রান্সে, ১৩৯০ খ্রীষ্টাব্দে জার্মানিতে ও ১৪৯৫ সালে বৃটেনে কাগজ মিল প্রতিষ্ঠিত হয়।
৮ম পর্ব
ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রচলিত ভাষার শ্রুতি ও লেখ্য রূপ নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, মুসলমানরা কোরানের আয়াত লিখে রাখতে এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তা-চেতনা অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে ভাষার লেখ্য রূপকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে ও একই লক্ষ্যে কাগজ শিল্পের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করে। আর কাগজ শিল্প তৎকালীন মুসলিম ভূখন্ড স্পেন ও মিশরের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইউরোপে প্রথম কাগজ মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং বিজ্ঞানীদের গুরুত্ব নিয়েই আজকের আসরে আমরা আলোচনা করা হবে।
এ কথা সবাই জানে যে, বিশ্ব সভ্যতার বিকাশে মুসলমানদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। পাশাপাশি মুসলিম সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করতে অন্যান্য সভ্যতার ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে গ্রীক, ভারতীয় ও পারস্য সভ্যতার কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। যেমন দর্শন ও যুক্তিবিদ্যাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গ্রীক সভ্যতার ভূমিকা রয়েছে। মুসলমানরা সাধারণত প্রাচীন সিরিয়ো ও ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত বই-পুস্তকের মাধ্যমে গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়েছেন। আর গ্রিক ভাষা থেকে বিভিন্ন বই অনুবাদের কাজটি করতেন ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কয়েক জন খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী। এদের কেউ কেউ অবশ্য পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কেউ কেউ আবার বই অনুবাদ করতেন মুসলিম খলিফাদের কাছ থেকে আর্থিক পুরস্কারের আশায়। গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটা অংশ আলেকজান্দ্রিয়া শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে পৌঁছেছে।
মুসলমানরা গণিত, জ্যোতিষ শাস্ত্র, চিকিৎসা ও প্রকৃতি বিজ্ঞানকে বিকশিত করার ক্ষেত্রেও গ্রিক বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছে। তারা টলেমীয় গণিতের সাথে পরিচিত হয় এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রের সংস্পর্শে আসে। এছাড়াও টলেমিয় জিওগ্রাফির সহযোগিতায় মুসলমানরা ভৌগলিক ম্যাপ তৈরি করতে সক্ষম হয়। মুসলমানরা গ্রিক চিকিৎসাশাস্ত্র থেকেও উপকৃত হয়েছে। বিশেষকরে গ্রিক মনিষী গ্যালেনাস ও হিপোক্রেটিসের বইগুলো থেকে মুসলমানরা অনেক তথ্য নিয়েছেন। জাবের ইবনে হাইয়ানের বইয়ে ওই সব মনীষীর বিভিন্ন গ্রন্থ ও লেখা থেকে উপকৃত হবার কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে মুসলমানরা ভিন্ন ভাষা থেকে অনুদিত বইয়ের চেয়ে গ্রিক চিকিৎসা শাস্ত্রবিদদের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শের মাধ্যমে এই শাস্ত্রের সঙ্গে বেশি পরিচিত হয়েছেন।
দামেস্ক মুসলিম খেলাফতের রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত হবার পর গ্রিক বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মুসলমানদের যোগাযোগ সহজ হয়। বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ ফুয়াদ সাজগিন এ বিষয়ে লিখেছেন, মুয়াবিয়াকে বিষ সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার জন্য তার প্রাসাদে ‘অসল’ নামের একজন চিকিৎসক ছিলেন। এছাড়াও আবুল হাকাম নামের আরো একজন খ্রিষ্টান চিকিৎসকও মুয়াবিয়ার প্রাসাদে চিকিৎসা কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ ফুয়াদ সাজগিনের গবেষণা অনুযায়ী, তৃতীয় হিজরীর প্রথমার্ধে গ্রিস থেকে মুসলিম বিশ্বে চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান ও তথ্যের সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।
ইতালীয় প্রাচ্যবিদ আলদুমিয়েলি লিখেছেন, মুসলিম সভ্যতায় ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাবও বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। ১৫৪ হিজরিতে কয়েকজন ভারতীয় বিজ্ঞানী আব্বাসিয় খলিফা মনসুরের কাছে আসেন। এর মধ্যে বিশিষ্ট জ্যোতিষবিদ মন্কাও ছিলেন। তিনি ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান বিশেষকরে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ ব্রক্ষ্মগুপ্তের এস্ট্রনমিক্যাল চার্ট বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। খলিফা মনসুর ওই জ্যোতিশাস্ত্রবিদকে তার দরবারের কিছু লোকজনকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার আহ্বান জানায়। এরপর ব্রক্ষ্মগুপ্তের গ্রন্থটিকেও আরবি ভাষায় অনুবাদ করার নির্দেশ দেন। মংকার দেয়া শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে ভারতীয় জ্যোতিবিজ্ঞান চর্চা খলিফা মামুনের শাসনামল পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। সে সময় মুসলিম জ্যোতির্বিদ ইব্রাহিম ফারাযিকে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখার এবং নক্ষত্র কেন্ত্রিক বর্ষ গণনা সংক্রান্ত বই লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আবু রায়হান বিরুনি তার লেখা বইয়ে বহু বার ফারাযির বইকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানও ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে উপকৃত হয়েছে। ইবনে নাদিম তার আল-ফেহরেস্ত গ্রন্থে চিকিৎসা বিষয়ক ১২ টি ভারতীয় বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। এসব বই আব্বাসিয়দের শাসনামলের প্রথম দিকে অনুদিত হয়েছে। মুসলমানরা ভেষজ, খনিজ ও প্রাণিজ ওষুধের সঙ্গে পরিচিত হতে অনেক ক্ষেত্রেই ভারতীয় চিকিৎসাবিদদের লেখা বই পড়তেন।
এবার ইরান তথা পারস্য সভ্যতা প্রসঙ্গে আসছি। ইসলামপূর্ব যুগে ইরানের খসরু আনুশিরাভানের সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির লক্ষ্যে ব্যাপক তৎপরতা চালানো হয়। বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে এই সাফল্যের কেন্দ্রস্থল ছিল তৎকালীন ইরানের জুন্দি শাপুর শহর। এই শহররিট বর্তমান ইরানের শুশতার ও দেযফুল শহরের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিল। সে সময় ওই শহরে কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তখন সিরিয়ো খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বিজ্ঞানী ও অধ্যাপকদের এসব স্কুলে আমন্ত্রণ জানানো হতো। ওই সময় এক দল বিজ্ঞানীর সহযোগিতায় গ্রিক, সিরিয়ো ও সাংস্কৃত ভাষা থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলো পাহলভি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। জুন্দি শাপুরের অনুবাদকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে কাজ করেছেন। জুন্দি শাপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্ভবত চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওরফা থেকে বিতাড়িত হবার পর কনস্টানিনোপলের বিজ্ঞানীরা জুন্দিশাপুরে বসতি গড়েন এবং তারা গ্রিক ভাষা থেকে প্রাচীন সিরিয়ো ভাষায় অনুদিত বিভিন্ন বই সঙ্গে করে এখানে নিয়ে আসেন। এছাড়া, গ্রীসের অনেক নির্বাসিত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বও এখানে এসে দর্শন শাস্ত্র পড়াতে থাকেন এবং এদের অনেকেই পরে এরিস্টটল ও প্লেটোর বই পাহলাভি ভাষায় অনুবাদ করেন।
এর পরের ইতিহাস হলো, ইরানিরা ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইরান ইসলামি ভূখন্ডের অংশে পরিণত হয়। অনেক ইরানি বই ও প্রবন্ধ ফার্সি থেকে আরবিতে অনুদিত হয়। আব্বাসিয় শাসনামলের পরে পাহলাভি থেকে আরবিতে যেসব বই ও প্রবন্ধ অনুবাদ করা হয়েছিল,তার বেশির ভাগই ছিলো, সাহিত্য ও ইতিহাস সম্পর্কে। আব্বাসিয়দের আমলে পাহলাভি ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদের নবযুগ শুরু হয়। এসব বই আব্বাসিয় খলিফার দরবারের প্রভাবশালী ইরানিদের সহযোগিতায় অনুদিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বারমেকি পরিবারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই পরিবার ইরানি মনিষীদের বাগদাদে নিয়ে যাওয়া এবং ইরানি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই অনুবাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ওই সময় জ্যোতি শাস্ত্র বিষয়ক তথ্যাবলীই বেশি বেশি ইরান থেকে মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। বড় বড় চিকিৎসাবিদকে সে সময় ইরানের জুন্দিশাপুর থেকে বাগদাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিশিষ্ট মুসলিম গবেষক ও বই বিশারদ ইবনে নাদিম লিখেছেন, বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ নুবাখত ও তার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ বই পাহলাভি থেকে আরবিতে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন।
৯ম পর্ব
আজ আমরা অনুবাদ আন্দোলন বা যুগের দিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করবো। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির গঠন ও বিকাশে এই অনুবাদ যুগের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। কীভাবে অনুবাদের ধারা ইসলামী সভ্যতার গঠনে অবদান রেখেছে তা নিশ্চয়ই একটা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ ইসলামের নয়া হুকুমাতকে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার স্বার্থে এবং শত্রুদের ওপর বিজয় সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যেই মনোনিবেশ করেছিল বেশি। তবে এক্ষেত্রে মুসলমানদের দৃষ্টি ছিল কোরআনের আদেশ-নির্দেশ এবং শিক্ষাগুলোর দিকে। এছাড়াও ব্যাকরণ, বিজয়ের ইতিহাস, ফিকাহ বা ইসলামী নীতিমালা এবং এ জাতীয় অপরাপর জ্ঞান-বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোর প্রতি মুসলমানদের সচেতন দৃষ্টি ছিল। ধীরে ধীরে বিজয়ের ঘনঘটা স্তিমিত হয়ে এলো আর ইসলামী শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থিতিশীল হলো। মুসলমানরা তাই ইসলামী শিক্ষাগুলো বিস্তারের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে ভালোই সুযোগ পেলো। আব্বাসীয় খলিফাদের কারো কারো অনুপ্রেরণামূলক নীতি এবং বায়তুল মালের অঢেল সম্পদের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা এবার আস্তে আস্তে শিল্প-কলকারখানা ও বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকতে থাকে, ইতোপূর্বে যা ছিল অমুসলিমদের হাতে। যাই শিল্প ও জ্ঞানের দিকে মনোনিবেশ করার ফলে মুসলমানদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটতে শুরু করে।
ইসলামের ঐশী জ্ঞান তথা কোরআনের জ্ঞানের বরকতে যারা চিন্তা-চেতনার উঁচুমার্গে পৌঁছেছেন, তারা বিভিন্ন জাতির ঐতিহ্য, সভ্যতা, কৃষ্টি-কালচার, চিন্তাধারা ইত্যাদি বিষয়ে জানার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন মনে করেন মুসলমানদের এই আগ্রহের মূল উৎস হচ্ছে কোরআনের সেইসব আয়াত এবং সেইসব হাদিস যেগুলোতে মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। তো অন্যান্য দেশ ও জাতির সভ্যতা ও জ্ঞান সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করার স্বার্থেই অনুবাদের আশ্রয় নেওয়া হয়। অনুবাদের মাধ্যমে অপরাপর জাতির জ্ঞান ও শিল্পকর্মগুলোকে অর্জন করার এই পদক্ষেপ সেই সময়ের জন্যে অসম্ভব দূরদর্শী এবং চিন্তা-চেতনাগত উৎকর্ষের পরিচায়ক ছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান পিপাসু এবং জ্ঞানীগুণী মনীষীগণ এই অনুবাদকর্মে এতো বেশি উৎসাহী ও কর্মতৎপর হয়ে উঠেছিলেন যে পরবর্তীকালে ঐ সময়টাকে ইতিহাসে ‘অনুবাদের যুগ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
অনুবাদ যুগের উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের একটি উদাহরণ হলো ফেহরেস্ত বা নির্ঘণ্ট। এটি লিখেছিলেন ইবনে নাদিম। এই গ্রন্থটি পূর্ববর্তীদের জ্ঞানচর্চার ছোট্ট একটি নমুনামাত্র। হিজরী চতুর্থ শতাব্দি পর্যন্ত সময়কালের মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান চর্চার যে ধারা বহমান ছিল তারই ক্ষুদ্র একটি উদাহরণ লক্ষ্য করা যাবে এই গ্রন্থ-দর্পণে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ ও জাতির সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে খুব কম গ্রন্থই লেখা হয়েছে যে গ্রন্থে এই নির্ঘণ্টের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়নি। ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আরো কয়েকটি উৎস হলো আখবারুল উলামা এবং তাবাকাতুল আতবা গ্রন্থ দু’টি। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস এবং এই সভ্যতা বিকাশের কারণ নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তারা এই গ্রন্থ দু’টি থেকে বহু উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। উমাইয়া শাসনামলে গ্রিক এবং সুরিয়ানী ভাষার বহু মূল্যবান গ্রন্থও আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। চিকিৎসা বিষয়ক এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে কোন্নাশ। উমাইয়া শাসক প্রথম মারওয়ানের সময় এটি অনূদিত হয়েছিল। তবে উমাইয়া শাসনামলে অনূদিত কর্মের বেশিরভাগই ছিল প্রশাসনিক, বিচারিক, রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক দলিল-দস্তাবেজ। এগুলো অনারবদের সাথে বিভিন্ন রকম যোগাযোগ বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল।
আসলে অনুবাদ আন্দোলন বলতে যা বোঝায়, বিশেষ করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক বিভিন্ন গ্রন্থ ব্যাপক পরিমাণে অনুবাদ হবার কাজটি শুরু হয় আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনামল থেকে। জ্ঞানের এই আন্দোলন তথা অনুবাদের এই ধারা অন্তত দুই শ’ বছর অব্যাহত ছিল। আব্বাসীয় শাসকদের মধ্য থেকে দ্বিতীয় খলিফা মানসুর ভিন্ন দেশ, বিদেশী সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বই পুস্তক অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি অবদান রেখেছেন। তাঁর শাসনামলে অনুবাদকর্ম ব্যাপক উৎকর্ষ লাভ করেছিল। বহু ইতিহাসবিদ মানসুরকে অনুবাদকর্ম বা অনুবাদের ধারার স্থপতি বলে মনে করেন এবং তাদের মতে এই ধারা বিকাশে খলিফা মানসুরের ভূমিকাই ছিল সবার আগে উল্লেখ করার মতো। মানসুর দাভানিকি বাগদাদকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। তিনি জ্যাতির্বিজ্ঞানীদেরকে তাঁর দরবারে নিয়ে এসেছিলেন এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য শাসকও তাঁর ঐ কাজকে অনুসরণ করেছিল। খলিফা মানসুর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সাথে পরামর্শ না করে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে সাধারণত হাত দিতেন না।
সেই যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞানে ইরানী মনীষীদের জ্ঞান এতো বেশি ছিল যে, খলিফা মানসুর একদল ইরানী জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অবশ্য জেেযাতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের আগ্রহ জাগার পেছনে আগ্রহ বা প্রেরণা জুগিয়েছিল আলকোরআন। কেননা কোরআন মুসলমানদেরকে আল্লাহর সৃষ্টিজগত বিশেষ করে আকাশ, যমিন, চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুসলমানদের নামায আদায় করা, হজ্জ্ব করা, রোযা রাখা, ক্বেবলার দিক নির্নয় করা, হত্যা নিষিদ্ধ হারাম মাসগুলোর মর্যাদা রক্ষা করা ইত্যাদি বিচিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করার সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিবীড় সম্পর্ক রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি মুসলমানদের আগ্রহ ছিল বেশি।
অনুবাদ যুগে সবচেয়ে খ্যাতিমান জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ ছিলেন নওবাখ্তের খান্দানের। এই খান্দানটি পরবর্তীকালে মুসলমান হয়েছিল এবং আরো পরে শিয়া মাযহাবের অনুসরণ করেছিল। এই খান্দানটি দীর্ঘ সময় ধরে আব্বাসীয় শাসকদের দরবারে ছিল এবং তাদের মধ্য থেকে অনেক সরকারী কর্মকর্তা, অনেক বক্তা এবং বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানী বেরিয়ে এসেছিল। আব্বাসীয় খলিফাদের আহ্বানে এই খান্দানের বহু বিজ্ঞ বিজ্ঞ মনীষী বিশেষ করে নওবাখ্ত এবং তার ছেলে আবু সাহ্ল গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। অবশ্য তাঁরা অনুবাদ শেষে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজস্ব লেখায় নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিও ব্যক্ত করতেন। নওবাখত ছাড়া অপর বিখ্যাত ইরানী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশিষ্ট শিয়া মনীষী মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম ফাযারির নামটি অনুবাদকদের নামের তালিকায় উজ্জ্বল স্থান করে নিয়েছে। তার পিতা ইব্রাহিম প্রথম মুসলমান যিনি গ্রহ-নক্ষত্রের্উচ্চতা ও গতিবিধি নির্ণায়ক যন্ত্র এস্ট্রোলেইব থৈরি করেছিলেন। তাঁর আরেকটি বিখ্যাত বইয়ের নাম েেহাল ‘সেন্দ হেন্দে কাবির’। আব্বাসীয় খলিফা মামুনের শাসনকাল পর্যন্ত এই গ্রন্থটিই ছিল নক্ষত্র বিষয়ক বিদ্যার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ।
খলিফা মানসুরের বিশিষ্ট চিকিৎসক জার্জিসও গ্রিক এবং সুরিয়ানী ভাষার চিকিৎসা বিষয়ক বেশ কিছু বই অনুবাদ করেন। মানসুরের শাসনকা্েই ইরানের বিখ্যাত লেখক ইবনে মোকাফফে আরবি ভাষা থেকে সাহিত্য গ্রন্থ কালিলা ও দিমোনা অনুবাদ করেছিলেন। যুক্তিবিদ্যার অনেক বইও তিনি অনুবাদ করেছিলেন। খলিফা মানসুরের সময় থেকে বিভিন্ন ধর্মের মাঝে বাহাস বা সংলাপের সূত্রপাত হয়েছিল। সংলাপের এই ধারা মানসুরের ছেলে মাহদি আব্বাসীর সময় আরো বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। সংলাপের যুক্তিপূর্ণতার জন্যে এবং গ্রহণযোগ্যতার জন্যে মাহদির সময় এরিস্টটলের বইও অনুবাদ করা হয়েছিল। এভাবেই অনুবাদের মধ্য দিয়ে ইসলামী সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।
১০ম পর্ব
আব্বাসীয় শাসনামলে বিশেষ করে খলিফা মানসুরের সময় প্রচুর শিল্পকর্ম অনুবাদ হয়েছিল। এই অনুবাদের ধারা ইসলামী সভ্যতার গঠন ও বিকাশে ব্যাপক অবদান রেখেছিল। তবে খলিফা মানসুরের সময় ছাড়াও অনুবাদের ক্ষেত্রে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছিল। আজকের পর্বে আমরা সেদিকে খানিকটা নজর দেওয়ার চেষ্টা করবো।
আব্বাসীয় পঞ্চম খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনামলেও জ্ঞান ও বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে এবং বিদেশী শিল্প ও সাহিত্যকর্ম অনুবাদ করার ক্ষেত্রে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে। খলিফা হারুনের মন্ত্রী ইয়াহিয়া বিন খালেদ বারমাকি গ্রিক সাহিত্য ও শিল্পকর্ম নিয়ে চর্চা, পড়ালেখা কিংবা অনুবাদকারীদেরকে ব্যাপক সাহায্য সহযোগিতা করতেন। ইয়াহিয়া কোনো একজনকে রোমান সাম্রাজ্যে পাঠিয়েছিলেন গ্রিক লিপির অনুলিপিগুলো কিনে আনার জন্যে। এরফলে গ্রিসের মূল্যবান গ্রন্থগুলো বাগদাদে আসার পথ সুগম হয়। সুরিয়ানী, ইরানী, ভারতীয় চিকিৎসক এবং বিজ্ঞ মনীষীদের বাগদাদে আসা-যাওয়ার ফলে জনসাধারণের দৃষ্টি পড়ে বিদেশী বিভিন্ন জ্ঞান, বিদ্যা, বিদেশীদের গ্রন্থ ইত্যাদির ওপর এবং সেইসাথে তারা বিদেশী শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায়ও এগিয়ে আসে। এই বিজ্ঞ মনীষীগণ আরবি ভাষার সাথে পরিচিত হবার সুবাদে জনগণের সাথে মেলামেশা করেন এবং সেই সুযোগে তাঁরা জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। ইতিহাসের অন্যান্য বিজয়ীদের আচরণের বিপরীতে মুসলিম শাসকরা বিভিন্ন শহর বা অঞ্চল বিজয় করার পর তাঁদের গ্রন্থাগারগুলোকে বাগদাদে স্থানান্তর করে যাতে মূল্যবান শিল্প ও সাহিত্যকর্মগুলোকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা যায়।
খলিফা হারুনুর রশিদ আঙ্কারা, আমরিয়া এবং রোমের অন্যান্য শহর জয় করার পর ইউনানী চিকিৎসা সংক্রান্ত তাদের বহু গ্রন্থ বাগদাদে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি ওই গ্রন্থগুলোকে ইউহান্না বিন মাসভিয়া সুরিয়ানী নামের নিজস্ব এক চিকিৎসককে দিয়েছেন আরবি ভাষায় অনুবাদ করার জন্যে। হারুনের সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক গ্রন্থও অনূদিত হয়েছিল। নওবাখ্ত খান্দানের বিখ্যাত মনীষী ফায্ল ইবনে নওবাখ্ত জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক বহু গ্রন্থ পাহলাভি থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। এ কারণে হারুন তার গ্রন্থাগারের দায়িত্ব তার ওপরই অর্পন করেন। মুসলিম পণ্ডিতগণ এইসব গ্রন্থের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন এবং গ্রন্থগুলোর বিষয়-প্রকরণ সম্পর্কে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত ব্যক্ত করেন। তাঁরা নিজেরাই ছিলেন সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী, সে কারণে তাঁরা নিজেরাই নতুন নতুন বই রচনায় হাত দেন।
সাসানীয় শাসনামলের একটি ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি হলো বায়তুল হিকমাহ। সাসানীয় শাসনামলে বিভিন্ন তথ্য ও দলিল দস্তাবেজ সংরক্ষণাগার ছিল এটি। ইরানের বিভিন্ন গল্প-কাহিনী, যুদ্ধ এবং ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য এই বাইতুল হিকমায় সংরক্ষণ করা হতো। মানসুর আব্বাসীর সময় অনুবাদের ক্ষেত্রে ব্যাপক তৎপরতা ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী এই বাইতুল হিকমাহ’কে সংরক্ষণ এবং তার বিস্তারের ব্যবস্থা করা হয়। তবে মানসুরের সময় এই স্থাপনাটিকে আব্বাসীয় প্রশাসনের একটি বিভাগ বলে মনে করা হত। সাসানীয় নিদর্শনের ভিত্তিতেই এই কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় বাগদাদে। এর দায়িত্ব ছিল সাসানীয় সঙস্কৃতি এবং ইতিহাসকে পাহলাভি ভাষা থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা এবং সেগুলোকে যত্নের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ করা। আর এই কাজের লক্ষ্যে সেখানে বহু দক্ষ দক্ষ অনুবাদককে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেইসাথে নিয়োগ দেওয়া হয় একদল দক্ষ বুক বাইন্ডার বা পুস্তক বাঁধাইকারীকে। হারুন এবং বারমাকিয়ানের শাসনামল পর্যন্ত বাইতুল হেকমার এই গুরু দায়িত্ব বা কর্মকাণ্ডগুলোটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছিল। তবে মামুনের সময় পূর্ববর্তী কার্যক্রমের পাশাপাশি বাইতুল হেকমায় নতুন কিছু কর্মসূচি বা কাযর্ক্রম যুক্ত হয়। এইসব কার্যক্রমের মধ্যে অধ্যয়ন এবং গবেষণাকর্ম উল্লেখযোগ্য। তবে গণিত এবং জোতির্বিজ্ঞানের মতো আরো বহু বিষয়ের ওপর এই কেন্দ্রে বেশি গবেষণা হতো। গ্রিক শিল্পকর্মগুলো অনুবাদ করার জন্যে বায়তুল হেকমায় উপযুক্ত পরিবেশ ছিল।
মামুনের সময় বাইতুল হিকমাহ আরো বেশি ঐশ্বর্য লাভ করে। কেননা তিনি অনুবাদ ছাড়াও বিদ্যার বিভিন্ন বিষয় বিশেষ করে দর্শনের বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। তার এই পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল মোতাযিলাদের আকিদা-বিশ্বাস এবং চিন্তাভাবনাকে আরো শক্তিশালী করে তোলা। ইবনে নাদিম তাঁর বই নির্ঘন্টে লিখেছেন এক রাতে মামুন বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটলকে স্বপ্নে দেখেন এবং স্বপ্নের ভেতরেই এরিস্টটলকে অনেক প্রশ্ন করেন। ঘুম ভাঙ্গার পর তাই এরিস্টটলের বইগুলো অনুবাদ করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি রোমান বাদশাহকে একটি চিঠি লেখেন রোমে প্রচলিত প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে যেগুলো শ্রেষ্ঠ সে সম্পর্কে তাঁকে জানাতে। রোমের বাদশাহ মামুনের ঐ আহ্বানে সাড়া দেয় এবং মামুন বাইতুল হেকমাহ’র প্রধান সালমানসহ একদল প্রতিনিধিকে রোমে পাঠান। তারা সেখানে গিয়ে তাদের পছন্দের বিষয়বস্তুর ওপর লেখা মূল্যবান বইগুলো এনে মামুনের কাছে দেয় আর মামুন শ্রেষ্ঠ অনুবাদকদের শীর্ষস্থানীয় হুনাইন ইবনে ইসহাকের নেতৃত্বে বিশেষ করে গ্রিক দর্শন বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থগুলোকে অনুবাদ করার জন্যে একদল অনুবাদককে দায়িত্ব দেন।
মামুনের সময়েই গ্রিক, ভারতীয়, ইরানী এবং আরবদের ঐতিহ্যবাহী শিল্প-সাহিত্যকর্মগুলো বাইতুল হিকমায় সংগ্রহ করা হয়। এভাবেই মামুনের শাসনামলে বাইতুল হিকমা মানবীয় জ্ঞানের অনুবাদ ও স্থানান্তরের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এ সময় বায়তুল হিকমার পূর্ণতার জন্যে বাগদাদে মানমন্দিরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইতালির বিশিষ্ট লেখক নালিনুর ভাষ্য মতে, ইতিহাসে এই সময়টাই ছিল ইসলামের জন্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম অধ্যায়। অনেক বড়ো বড়ো আলেমে এই বাইতুল হিকমার দায়িত্ব পালন করেছেন, কাজ করেছেন, তাদেরকেই এক কথায় বাইতুল হিকমার মালিক বলে মনে করা হতো। কথিত আছে যে বাইতুল হিকমায় একেবারে প্রথম দিকে যারা যাওয়া-আসা করতেন, অনুবাদের কাজের সাথে জড়িত ছিলেন তারা ছিলেন ইরানী। তাদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন হলেন সাহল বিন হারুন, সায়িদ বিন হারুন এবং সালাম বা সালমান।
সাহল বিন হারুন ছিলেন ইরানের আহওয়ায প্রদেশের মেইশান-খুযিস্তানের অধিবাসী। হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে তিনি বাগদাদে বসবাস করতেন এবং তিনি ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগুণী মনীষী এবং সাহিত্যিক। সাহল আরবি ভাষা ও সাহিত্যে অনেক বড়ো পণ্ডিত ছিলেন এবং এ ভাষার একজন স্বনামধন্য লেখকও ছিলেন। মানবীয় নৈতিকতা এবং পৌরনীতি সম্পর্কে তাঁর লেখা বিখ্যাত একটি বই রয়েছে যেটি কালিলা ও দেমোনা’র স্টাইলে পশুপাখির জবানিতে রচিত হয়েছে।
সালাম বা সালমান ছিলেন অপর এক বিখ্যাত ইরানী মনীষী ও অনুবাদক যিনি বাইতুল হিকমাহ পরিচালকদের একজন ছিলেন। ফার্সি ভাষা থেকে আরবি ভাষায় বহু বই তিনি অনুবাদ করেছেন। কালিলা ও দেমোনার কিছু অংশও তিনি আরবিতে অনুবাদ করেছেন। এই মনীষী আরো ক’জন অনুবাদককে সাথে নিয়ে রোমে যান এবং রোমের বাদশার অনুমতিক্রমে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং দর্শনের মূল্যবান মূল্যবান বহু বিষয় আরবি ভাষায় অনুবাদ করে বাগদাদে নিয়ে আসেন। প্রাচীন অনেক দুর্লভ বইয়ের যেসব অনুবাদ এখন লক্ষ্য করা যায় সেগুলোর অধিকাংশই সেই অনুবাদ যুগের বিজ্ঞ অনুবাদকদের অবদান। তবে আব্বাসীয় খলিফা মুতাসেমের সময় ইসলামী হুকুমাতের কেন্দ্র বাগদাদ থেকে সরিয়ে সামেরায় নিয়ে যাবার কারণে বাইতুল হিকমার সৌকর্য ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়। পরবর্তীকালে অবশ্য মুসলমানরা আরো অনেক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেমন মামুনের অনুসরণে স্পেনের উমাইয়া খলিফা আল-মুস্তানশার বিল্লাহ বিশাল এক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। মিশরেও ফাতেমি খলিফারা বড়ো বড়ো অনেক লাইব্রেরি গড়ে তোলেন।
১১তম পর্ব
গত আসরে আমরা অনুবাদ আন্দোলন বা অনুবাদ যুগ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আব্বাসীয় শাসনামলে বিশেষ করে খলিফা মানসুরের সময় প্রচুর শিল্পকর্ম অনুবাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলাম। আসলে আব্বাসীয় শাসনামলে অনুবাদের ধারাটাকে শক্তিশালী করে তোলার লক্ষ্যে প্রতি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছিল। বাইতুল হিকমাহ স্টাডি সেন্টার তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে অনুবাদের পাশাপাশি ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজও রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। এরি ধারাবাহিকতায় আমরা আজকের আসরে কথা বলার চেষ্টা করবো।
আব্বাসীয় খলিফা মামুনের সময় জনগণকে পড়ালেখা করা তথা জ্ঞান অর্জনের জন্যে অনুপ্রাণিত করা হয়েছিল। সেজন্যে অনুবাদের এই যুগে ডুক্তিবিদ্যা, দর্শনমহ বিভিন্ন বিষয়ের বহু লেখা অনুবাদ করার প্রয়েঅজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রয়োজনীয়তার কারণেই ইরান, ইরাক, ভারত এবং সিরিয়া থেকে অনেক অনুবাদককে বাগদাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এইসব অনুবাদক বিভিন্ন ধর্ম ও মাযাহাবের এবং বিভিন্ন বর্ণের ছিলেনঃ যেমন নেস্তুরিয়ান, জরাথ্রুস্টি, ব্রাহ্মণ, রোমি ইত্যাদি। এই অনুবাদগণ বাগদাদে গ্রিক, ফার্সি, সুরিয়ানী, হিন্দি ইত্যাদি ভাষার বই অনুবাদ করেন। লেবাননের বিশিষ্ট লেখক জর্জি জিদান এই সময়ে বাগদাদে বই বিক্রয়ের দোকান, সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চার প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
আব্বাসীয় শাসক মানসুরের সময় নিজস্ব উদ্যোগেও অনেকেই অনুবাদকর্মে হাত দিয়েছিলেন। এই শ্রেণীর মধ্যে বনি মুসা নামে পরিচিত ইরানের বনি শাকের খান্দানের নাম উল্লেখ করা যায়। মুসা বিন শাকের এবং তার সন্তান মুহাম্মাদ, আহমাদ এবং হাসান খোরাসানের অধিবাসী ছিলেন। মুসার সন্তানেরা বায়তুল হেকমায় গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, ম্যাকানিক্স্ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে পড়ালেখা করেন এবং এসব বিষয়ের ওপর ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেন। এই তিন ভাই জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বহু বই লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেন। তাদের বহু বই পরবর্তীকালে ইউরোপে আরবি থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর এরকম উল্লেখযোগ্য একটি বই ছিল মেকানিক বিষয়ে। বলা যায় ইসলামী যুগে মেকানিকেল বিষয়ে সর্বপ্রথম বই এটি।
তৎকালীন অপরাপর অনুবাদকদের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে মুসা খাওয়ারেযমির নাম উল্লেখ করার মতো। ইসলামী যুগের মহান এই মনীষী ছিলেন একদিকে গণিতবিদ অপরদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ভূগোলবিদ এবং সে সময়কার নামকরা ইতিহাসবিদ। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলেন খাওয়ারেযমের অধিবাসী। এ কারণেই তিনি খাওয়ারেযমি হিসেবেই প্রসিদ্ধি পান। খাওয়ারেযমি তাঁর শৈশবে এবং শিক্ষাজীবন শেষে খলিফা মামুনের সময় দারুল হিকমার সদস্য হন। যেসব জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে বাদশা মামুন গ্রন্থাগার প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাদের একজন ছিলেন খাওয়ারেযমি। তিনি তাঁর নিজস্ব লেখালেখিতে এবং জোন্দি শাপুর বিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় বিভিন্ন দেশ ও জাতির বইগুলো বিশেষ করে ইরানী এবং ভারতীয় প্রাচীন বইগুলোকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
খাওয়ারেযমি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বীজগণিত এবং সমাধান নিয়ে বই লিখেছেন। তিনি বীজগণিতকে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে গণ্য এবং প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ‘আল-জাবরা’ নামে তাঁর বইটি এ বিষয়ক অনবদ্য গ্রন্থ হিসেবে আজো অবশিষ্ট রয়েছে। বীজগণিত ছাড়াও হিসাব বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও খাওয়ারেযমির ব্যাপক অবদান ছিল।এ্যালগোরিদম নামে হিসাব বিজ্ঞানে যে পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয় তা খাওয়ারেযমির দেওয়া নাম। পরবর্তীকালে এই পরিভাষাটি ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় প্রবেশ করে। খাওয়ারেযমি সম্পর্কে ইতালির বিশিষ্ট মনীষী মধ্যপ্রাচ্যবিদ আলদোমেইলি তাঁর লেখা আরবের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেনঃ খাওয়ারেযমি ছিলেন সবচেয়ে বড়ো মুসলিম গণিতবিদ। তিনি কেবল মুসলিম বিশ্ব কিংবা প্রাচ্যেই নন বরং পশ্চিমা বিশ্বেও গণিতবিদ হিসেবে ব্যাপক খ্যাতিমান। গণিতশাস্ত্রে খাওয়ারেযমি নতুন এক যুগের সূচনা করেন। তাঁর লেখা বইগুলো হিসাব বিজ্ঞান, জ্যামিতি এবং ত্রিকোণমিতিতে নজিরবিহীন।
আব্বাসীয় খলিফা মামুনের পরবর্তী কালের শ্রেষ্ঠ অনুবাদকদের মাঝে সাবেত বিন র্কোরার নামটি উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন একজন সাবেয়ী দার্শনিক। হাররানে বসবাস করতেন, হাররান এখন তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে পড়েছে। সাবেত চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে ব্যাপক পারদর্শী ছিলেন।্এসব বিষয়ে তাঁর পারদর্শিতার নিদর্শন তাঁর লেখা বইগুলোতে সুস্পষ্ট। এগুলোর বাইরেও তিনি সুরিয়ানী ভাষায় সাবেয়ী মাযহাব সম্পর্কে বই লেখেন। তিনি সুরিয়ানী ভাষায় ব্যাপক দক্ষ ছিলেন এবং এ ভাষায় বহু বই অনুবাদও করেছিলেন। গ্রিক ভাষার বহু বই বিশেষ করে গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যার বইগুলো অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা করেন।
বাগদাদে অনুবাদের এই ধারা দুই শতাব্দী পর্যন্ত ব্যাপক তোড়জোড়ের সাথে চলে। এরপর ধীরে ধীরে অনুবাদের কাজে ভাটা পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় সহস্রাব্দে এসে অনুবাদের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে অনুবাদের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে কিংবা অনুবাদ করার মতো যোগ্য লোকের অভাব ছিল। উল্টো বরং বাগদাদে আজুদি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং ডাক্তার, অনুবাদক, বিজ্ঞানীদের সমাবেশ হিজরী চতুর্থ শতকের শেষদিকে আলে-বুইয়েরের সমকালে জ্ঞান ও বিজ্ঞানে কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে যে ব্যাপক উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটেছে তারই পরিচয় বহন করে।
অনুবাদ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবার একটা মৌলিক কারণ হলো বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন কোনো অগ্রগতি না হওয়া। এর অর্থ এই নয় যে জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রিসের আর কোনো বই হাতের কাছে ছিল না, বরং জ্ঞানী-গুণী মনীষীদের জন্যে বা লেখকদের কাঙ্ক্ষিত আর কোনো বই গ্রিক ভাষায় অবশিষ্ট ছিল না। যার ফলে অনুবাদের এই ধারা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে। জ্ঞানের বহু শাখাতেই অনেক আগে থেকেই মূল টেক্সটগুলো পড়া, অনুবাদ করা এবং ব্যাখ্যা করা হয়ে গেছে। যার ফলে জ্ঞানের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় অনেক বেশি বিচরণ করার সুযোগ আসে এবং নতুন নতুন মৌলিক বই বা শিল্পকর্মও তৈরি হতে থাকে। নতুন নতুন বিষয় এবং বই রচিত হবার কারণে অনুবাদের শৌকর্য ম্লান হয়ে যায় এভং নতুন নতুন বই আর বিষয় নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। আগে যাঁরা অনুবাদের জন্যে আগ্রহী ছিলেন তারাই এখন আরবি ভাষায় নতুন নতুন বই রচনা করার আগ্রহ দেখাতে থাকেন।
আলবুইয়ের আমলে নতুন নতুন বই লেখার চর্চা অনেক বেশি বেড়ে যায়। এভাবে নতুন বই, নতুন লেখালেখি, নতুন নতুন বিষয়-আশয়ের চর্চার কারণে অনুবাদের ধারাটির একেবারেই পরিসমাপ্তি ঘটে।
১২তম পর্ব
ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে শুরু থেকেই জ্ঞান-গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক গুরুত্ব ছিল। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সাংস্কৃতিক যে বিশাল ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, ইসলামী সভ্যতার বিভিন্ন যুগে সেই ঐতিহ্য ব্যাপক উজ্জ্বলতা পায় বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী সভ্যতার যুগে এসে অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণতা পায়। এইসব প্রতিষ্ঠান ইসলামী সমাজের মৌলিক অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতো। মসজিদ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, বাইতুল হিকমা এবং লাইব্রেরির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত উন্নত, প্রশান্ত এবং স্থিতিশীল সমাজেই গড়ে ওঠে। ইসলামী সভ্যতার যুগে তাই উপযুক্ত পরিবেশ থাকায় বড়ো বড়ো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং লাইব্রেরি বেশি বেশি গড়ে উঠেছে। এগুলোর এতো বেশি বিকাশ ঘটেছে যে তৎকালীন সময়ের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এইসব প্রতিষ্ঠান।
মাদ্রাসার মতো জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করার পেছনে মূল লক্ষ্যটি ছিল সাধ্যমতো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা নিয়ে মুসলমান হওয়ার পথ সুগম করা। যাই হোক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হবার এই আসরে আমরা আজ চেষ্টা করবো মসজিদ, মাদ্রাসার মতো সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে খানিকটা আলোকপাত করার।
ইসলামী সভ্যতার অঙ্গনে ধর্মীয় কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা কেন্দ্র হিসেবে সর্বপ্রথম যে স্থাপনাটির নাম উঠে আসবে তা হলো মসজিদ। মসজিদই মুসলমানদের জন্যে সর্বপ্রথম কোনো ধর্মীয় কেন্দ্র। রাসূলে আকরাম (সা) মানুষের কাছে তাঁর মুক্তির বাণী পৌছিয়েঁ দেওয়ার লক্ষ্যে এবং তাদেরকে সরল সঠিক পুণ্যের পথে পরিচালিত করার লক্ষ্যে দাওয়াতী কাজের কেন্দ্র হিসেবে মদিনায় সর্বপ্রথম যে মসজিদটি স্থাপনন করেছিলেন, দাওয়াতী কাজের সম্প্রসারণের সাথে সাথে মসজিদ নির্মাণের সেই ধারাও ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। মদিনায় প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম মসজিদটি ছিল শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, দ্বীনী প্রচার, বিচার-আচারসহ সাংস্কৃতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক সকল কর্মকান্ডের মূল কেন্দ্র। নবীজীর পর হযরত আলী (আ) ও তাঁর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে নবীজীর প্রদর্শিত পন্থাই অনুসরণ করেন। সে কারণেই সেই সময়েও জ্ঞান এবং শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডগুলো মসজিদ কেন্দ্রিক পরিচালিত হতো। জ্ঞানের বিভিন্ন রকম আসরে তিনি ইসলাম পরিচিতি বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করতেন এবং জ্ঞান সংক্রান্ত বিভিন্ন সংলাপ বা বাহাসেও অংশগ্রহণ করতেন।
হযরত আলী (আ)-এর শাহাদাতের পরও আহলে বাইতের মাধ্যমে ঐ ধারা অভ্যাহত থাকে। তারি ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে বাগদাদসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মাদ্রাসা, বাইতুল হিকমাহ এবং লাইব্রেরির মতো বিচিত্র প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা গড়ে ওঠে। ইমাম সাদেক (আ) এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদানের পাশাপাশি গবেষণা ও সংলাপমূলক কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হতো। ইমাম তাঁর প্রত্যেক ছাত্রের জন্যে একেকটি বিষয় সুনির্দিষ্ট করে দিতেন যে বিষয়ের ওপর ঐ ছাত্রকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হতো এবং প্রশ্নকারীদের প্রশ্নের সমাধান দিতে হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অবন বিন তাগলাব ফিকাহ বা ইসলামী আইনশাস্ত্রে ব্যাপক প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। ইমাম তাকে বললেন, তুমি মসজিদে গিয়ে বসো এবং ফতোয়া দাও। ফতোয়া মানে হলো জীবনের বিভিন্ন সমস্যার ইসলামী আইন ভিত্তিক সমাধান। হিশাম বিন হাকাম ছিলেন কালাম শাস্ত্রে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। তিনি মসজিদে ইমামত, আকায়েদ নীতি সম্পর্কে বাহাস এবং সংলাপে অংশ নিতেন। ইমামের আরেক শাগরেদের নাম ছিল জাবের ইবনে হাইয়্যান। তিনি ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রসহ আরো অনেক শাস্ত্রে বিজ্ঞ। মসজিদে তিনি সেইসব বিষয়ে পড়াতেন। স্বয়ং ইমাম সাদেক (আ) ছিলেন জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যাপক পারদর্শী।
কথিত আছে যে, ইমাম জাফর (আ) ছিলেন জাফরি শিয়া মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। মদিনায় তাঁর মক্তবে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে আসতেন। চার হাজারেরও বেশি মানুষ ফিকাহসহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্যে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করেন। ইমাম সাদেক (আ) এর পাঠ দানের জলসা বা ক্লাসগুলো সাধারণত মসজিদেই অনুষ্ঠিত হতো। তাঁর ছাত্ররাও বেশিরভাগ ক্লাসই মসজিদে নিতেন, মসজিদে সবাই বৃত্ত রচনা করে বসতেন আর ইমামের ছাত্ররা সেখানে দারস দিতেন।
মসজিদ ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে সর্বপ্রথম স্থাপনা। মাদ্রাসার প্রচলন হয় মসজিদের পরে। অবশ্য মাদ্রাসার স্থাপত্য কার্যক্রমও অনেকটা মসজিদের মতোই ছিলো। মসজিদে যেমন জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হতো, মাদ্রাসাগুলোতেও তা-ই হতো। তবে মাদ্রাসার ব্যাপক বিকাশ সত্ত্বেও মসজিদের সেই প্রশিক্ষণমূলক ভূমিকা কিন্তু অক্ষুন্নই ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরানের সিস্তানে হিজরী প্রথম শতকে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। ঐ মসজিদে বছরের পর বছর ধরে ধর্মীয় বিষয় আশয় শিক্ষা দেওয়া হতো। বোখারাতেও বেশ কয়েকটি মসজিদ দ্বীনী শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহৃত হতো। খোরাসানের শিক্ষা ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র নিশাবুরে বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। মাতারযি মসজিদ, আকিল মসজিদ এবং প্রাচীন মসজিদ এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই মসজিদগুলোকেও শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহার করা হতো।
ইসলামী শহরগুলোতে সেই শুরু থেকেই বহু মসজিদ নির্মিত হয়েছে যেগুলোতে লাইব্রেরি ছিল। এরকম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের নাম করা যেতে পারে, যেমনঃ আল-আকসা মসজিদ, জামে উমাইয়া দামেশ্ক, তিউনিশিয়ার জামেউল কাবির, কায়রোর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। ইসলামী সভ্যতার ই্তহিাসে এইসব প্রতিষ্ঠান বেশ খ্যাতিময়। এসব প্রতিষ্ঠানে বিশাল বিশাল গ্রন্থাগার ছিল। বিভিন্ন পবিত্র স্থান বা স্থাপনাতেও বড়ো বড়ো গ্রন্থাগার ছিল। যেমন মাসজিদুল হারাম বা হারামে মাক্কি, মদীনার হারামে নববী, নাজাফের হারামে ইমাম আলী, কাজেমাইনের হারামে মূসা ইবনে জাফর, মাশহাদের ইমাম রেযা (আ) এর মাযার ইত্যাদি স্থাপনায় বড়ো বড়ো গ্রন্থাগার ছিল এবং এখনো আছে। এগুলো ছাড়াও বড়ো বড়ো মাযারগুলোতে যেমন কাউনিয়ায় মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির মাযার, তাব্রিযে গাযান খানের মাযার, তোরবাত জামে শেখ আহমাদ জামের মাযার ইত্যঅদিতেও বড়ো বড়ো লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল। একইভাবে সরাইখানা বা পান্থশালা, খানকাহ কিংবা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল।
ইসলামী সভ্যতা ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ আরো কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যঅদির নাম করা যায়। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ক গবেষণাও করা হতো। সেজন্যে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে গড়ে উঠতো বড়ো বড়ো বইয়ের লাইব্রেরি। এরকম কয়েকটি হাসপাতালের মধ্যে মিশরের কুসাত হাসপাতাল, কায়রোর আলকাবির মানসুরি হাসপাতাল, বাগদাদের মোক্তাদেরি হাসপাতাল এবং রেই হাসপাতালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলো ইসলামী সভ্যতা ও ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। ইরাক, সিরিয়া এবং মিশরসহ মুলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শত শত মাদ্রাসা গড়ে উঠেছিলো। আর লাইব্রেরি ছাড়া কোনো মাদ্রাসার অস্তিত্ব কল্পনাই করা যেত না। মাদ্রাসা এবং লাইব্রেরি পরস্পরে অঙ্গাঙ্গিভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, পবিত্র স্থান ইত্যাদির বাইরেও স্বতন্ত্রভাবে বহু লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল।
১৩তম পর্ব
ইসলামী সভ্যতার উন্নয়ন ও বিকাশে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গণগ্রন্থাগারগুলোর ব্যাপক ভূমিকা ছিল। এগুলোকে তখন ‘দারুল এল্ম’ বলে অভিহিত করা হতো। হিজরী চতুর্থ শতকে দারুল এলমগুলোর প্রতিষ্ঠা শুরু হতে থাকে। এগুলোই ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের গ্রন্থাগার। ইসলামের আবির্ভাবের পর জ্ঞানের বিকাশের প্রয়োজণীয়তা দেখা দেয় কেননা ইসলাম হচ্ছে জ্ঞান ভিত্তিক একটি ধর্ম। তারই প্রয়োজনে লাইব্রেরিগুলো গড়ে ওঠে। লাইব্রেরি মানেই হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র। ফাতেমিয়ান দারুল এলমটিও তেমনি একটি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র। হিজরী ৩৯৫ সালে কায়রোতে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। এখানে গণিতসহ প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ দেওয়া হতো। এখানে একটি লাইব্রেরিও ছিল যাতে দশ লাখেরও বেশি বই ছিল। মোসেল দারুল এলমটিও ছিল আরো একটি বিখ্যাত লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিটিতে জ্ঞানের প্রায় সকল বিষয়েরই বইয়ের সংগ্রহ ছিল। ত্রিপলি দারুল এলম, বাগদাদ দারুল এলম, বায়তুল মোকাদ্দাস দারুল এলম প্রভৃতিও মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে স্বনামখ্যাত ছিল। এসব দারুল এলমের প্রত্যেকটিতেই হাজার হাজার বইয়ের সংগ্রহ ছিল। যার ফলে বহু গবেষক, লেখক এসব প্রতিষ্ঠানে এসে গবেষণা করতেন, লেখালেখি করতেন।
দারুল এলমের পাশাপাশি আরো এক ধরনের জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো,এগুলো নেজামিয়া নামে পরিচিত ছিল। হিজরী পঞ্চম শতাব্দিতে সেলজুকি শাসনামলের মন্ত্রী খাজা নিযামুল মুলক বাগদাদ এবং নিশাবুরসহ আরো অনেক শহরে নিজামিয়া নামে অসংখ্য মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন। এইসব নেজামিয়া বর্তমান যুগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আদলেই গড়ে তোলা হয়েছিল। এইসব নেজামিয়া স্থাপনের মধ্য দিয়ে ইসলামী সভ্যতায় উচ্চ শিক্ষাকে উন্নত পর্যায়ে বা পূর্ণতায় পৌঁছার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। হিজরী ৪৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বাগদাদ নেজামিয়াটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ নেজামিয়াগুলোর একটি। আবু ইসহাক শিরাজির মতো মহান মনীষী এখানে পাঠদান করতেন। এক সময় গাযযালির মতো মুসলিম দার্শনিকও এই বিশ্ববিধ্যালয়ে ছাত্রদের ক্লাস নেন এবং তারপর থেকে মুসলিম বিশ্বে এ ধরনের মাদ্রাসা বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
বাগদাদ নেজামিয়ার গ্রন্থাগার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম গ্রন্থাগার ছিল এবং যশ-খ্যাতি ও সমৃদ্ধির দিক থেকে এই গ্রন্থাগারটির গর্ব করার মতো সংক্ষিপ্ত একটি দিনপঞ্জী বা ইতিহাসও রয়েছে। নিজামুল মুলক এই গ্রন্থাগারগুলো নির্মাণ করেছেন এভং তিনি নিজেই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি বা দেখাশোনা করতেন। তিনি বাগদাদ নেজামিয়াটি পরিদর্শন করতে গিয়ে ছোট্ট একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন। সুখের বিষয় হচ্ছে এই গ্রন্থাগারটির পরিচালনা কিংবা প্রশাসনিক কার্যক্রম সংক্রান্ত ইতিহাসের অংশবিশেষ এখনো সংরক্ষিত আছে। সেলজুকি শাসনামলে বিশেষ করে নিযামুল মুলকের আদেশে এইসব নেজামিয়া বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণে জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চার এইসব প্রতিষ্ঠান নেজামিয়া নামে পরিচিতি ও খ্যাতি পায়। বাগদাদ নেজামিয়াতে শিক্ষকদের বাসভবন ছাড়াও মসজিদ এবং গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা ছিল। যারফলে একটা বিশাল অঙ্গন জুড়ে গড়ে উঠতো নেজামিয়াগুলো। এখানে তাই ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিও বিশেষ করে ওয়াজের মজলিশ, ধর্মীয় বিষয়-আশয় নিয়ে যুক্তি-তর্কের আসর ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো। এসবের কারণে বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী মনীষীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল নেজামিয়াগুলো।
ধর্মীয় ব্যাপারে ভীষণ আকর্ষণ বোধ করতেন বলে তিনি একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাগদাদের দারুল খোলাফাকে ধর্মীয় বিশ্বাস বিষয়ক মত বিনিময় কেন্দ্রে পরিণত করবেন। তাই তিনি বাগদাদ নেজামিয়াকে মুসলিম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। এগুলোর পাশাপাশি খোরাসান এবং ইরাকের বিভিন্ন শহরেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বাগদাদ নেজামিয়া প্রতিষ্ঠালগ্নে শাফেয়ি ফিকাহ, হাদিস এবং কোরআন অধ্যয়ন ইত্যাদি বিষয়ই ছিল সেখানকার পাঠ্যতালিকায়। পরে ধীরে ধীরে তার সাথে যুক্ত হয় উসুলে ফিকা, তাফসির, কোরআন শিক্ষা, এলমে কালাম, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্যসহ আরো অনেক বিষয়। খাজা নিযামুল মুলকের উপদেশ নামক গ্রন্থের লেখক বাগদাদ নেজামিয়ায় যেসব মহান মনীষীগণ শিক্ষকতা করেছেন তাঁদের ৮৫ জনের নামের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কয়েকজন বিখ্যাত শিক্ষকের নাম উল্লেখ করা যায় যেমনঃ আবু আব্দুল্লাহ তাবারি, আবু হামেদ মোহাম্মাদ গাযযালি এবং আবু মুহাম্মাদ খাওয়ারেযমি।
নিশাবুর শহরের ওপর সেলজুকি বাদশা খাজা নিযামুল মুলকের বিশেষ দৃষ্টি থাকার কারণে এই শহরটিও জ্ঞান ও বিজ্ঞানে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করে। বিশিষ্ট কবি ও দার্শনিক ওমর খৈয়াম, ইমাম মোয়াফফাক নিশাবুরি, ইমামুল হারামাইন জুয়িনি, আত্তার নিশাবুরি প্রমুখের মতো জগদ্বিখ্যাত মনীষীগণ এই নিশাবুরেই গড়ে ওঠেন। অসংখ্য মনীষী থাকার কারণে এই নিশাবুরেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি নেজামিয়া। এই নিজামিয়াতেও অসংখ্য স্বনামধন্য মনীষী শিক্ষকতার গুরুদায়িত্ব পালন করেন। মানের দিক থেকে নিশাবুর নেজামিয়াটিকে বাগদাদের পরই স্থান দেওয়া হয়। ইস্ফাহান নিজামিয়াও খাযা নিযামুল মুলকেরই নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক নামকরা জ্ঞানী গুণী মনীষী শিক্ষকতা করেছেন। যাদেঁর মধ্যে আবু বকর মোঃ বিন সাবেত খোজান্দি এবং ফখরুদ্দিন আবুল মায়ালি ভেরকানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এই মহান প্রতিষ্ঠানটির কারণে ইস্ফাহান অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছিল।
বালখ নেজামিয়াটিতেও আদম বিন আসাদ সোহরাওয়ার্দির মতো শিক্ষক এবং রাশিদ ভাতভতের মতো ছাত্র থাকায় প্রতিষ্ঠানটি বেশ নাম করেছিল। বসরা নেজামিয়াও কম খ্যাতিময় ছিল না। বসরা নেজামিয়া নামের বিশ্ববিদ্যালয়টি বাগদাদ নেজামিয়ার চেয়েও বড়ো এবং বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য তা ধ্বংস হয়ে যায় এবং একই নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠান বসরার উত্তরাঞ্চলে গড়ে ওঠে। অনরূপ একটি বিশ্ববিদ্যালয় বায়তুল মোকাদ্দাসে গড়ে তুলেছিলেন সালাউদ্দিন আইয়ুবী।্এভাবে মুসলিম ভূখণ্ডের পূর্বাঞ্চলে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ধারা অব্যাহত থাকে। দজলার তীরে বাগদাদের মোস্তানসারিয়া মাদ্রাসা, মধ্য্এশিয়ার মাদ্রাসার মধ্যে সমরকন্দ্ মাদ্রাসার নাম উল্লেখ করার মতো। সাফাভি বাদশাদের আদেশেও আরো কয়েকটি মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। যেমন ইস্ফাহানের চাহারবাগ মাদ্রাসা এবং শিরাযের খান মাদ্রাসা। এখানে ইরানের বিখ্যাত দার্শনিক মোল্লা সাদরাও শিক্ষকতা করেছিলেন। মধ্য যুগের শুরু থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ধারা আরো বেশি গতিময় হয়ে ওঠে।
এগারশ’ বছর আগে মরক্কোর ফাস শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় কারভিন মাদ্রাসা। এটি সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কায়রোর আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটিও এই তালিকার অগ্রভাগে উঠে আসবে। কিছুদিন আগে প্রতিষ্ঠানটি তার প্রথম সহস্র বার্ষিকী উদযাপন করেছে। ইরাকের নাজাফে হিজরী পঞ্চম শতাব্দিতে গড়ে উঠেছিল ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্র। এটি এখনো তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এভাবেই ইসলামী সভ্যতা বিকাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা পালন করে এসেছে।
১৪তম পর্ব
পশ্চিমা অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার বিকাশে মুসলমানদের সবচেয়ে বড়ো অবদান হচ্ছে এসবের রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং গ্রিক যুগ থেকে রেনেসাসেঁর যুগে এই জ্ঞানকে স্থানান্তর করার মধ্যে। কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে মুসলমানরা কেবল মানব জ্ঞানের সম্পদকে রক্ষাই করে নি বরং এসবের পাশাপাশি নতুন নতুন অনেক কিছু উদ্ভাবনও করেছেন, এগুলোকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌছিয়েঁও দিয়েছেন। অন্তত ছয় শতাব্দি ধরে মুসলিম মনীষীরা ছিলেন জ্ঞান ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে স্বণোর্জ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আলো বিকিরণকারী। অথচ সেই সময় ইউরোপে জ্ঞানীদের কণ্ঠ রোধ করে ফেলা হতো। মধ্যযুগে গীর্যাগুলো চিন্তাশীল মনীষী, জ্ঞানী-গুণী, বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল। তারা এইসব মহান ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে বিচারালয়ও স্থাপন করেছিল। এভাবেই গির্যাপন্থীরা জ্ঞান বিকাশের পথে এবং জ্ঞানের জগতে নতুন নতুন উদ্ভাবনীর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সেইসাথে দার্শনিক এবং পণ্ডিতজনদের ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করে অপমান অপদস্থ পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু শ্বাশ্বত ও পবিত্র ধর্ম ইসলাম সেই সূচনা লগ্ন থেকেই মুসলমানদেরকে জ্ঞান অর্জনের জন্যে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে এসেছে।
কেননা নবী করিম (সা) জ্ঞান অর্জনকে মুসলমানদের ওপর ফরয অর্থাৎ অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছেন, এমনকি জ্ঞান অর্জনের জন্যে প্রয়োজন হলে দেশের বাইরে দূর দূরান্তেও যেতে বলেছেন। একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বিভিন্ন জ্ঞান বিশেষ করে চিকিৎসাবিদ্যা এবং গণিতবিদ্যার মতো জ্ঞানগুলো গ্রিস থেকে মুসলিশ বিশ্বে প্রবেশ করে নি। বরং এইসব বিদ্যা বা শাস্ত্র মুসলমান মনীষীগণ নিজেরাই আবিষ্কার করেছেন। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন জালিনুসের চিকিৎসা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি এবং টলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিগুলোই কেবল মুসলমানরা অর্জন করেছে। অথচ ইসলামী সভ্যতা নিয়ে গভীর গবেষণায় দেখা গেছে মুসলমান মনীষীগণ এসবের বাইরেও অনেক অনেক ক্ষেত্রেই গবেষণা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী সভ্যতায় এমন সব কার্যক্রম বা উপাদান রয়েছে যেগুলো মুসলমানদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। হিজরী প্রথম ছয় শতাব্দিতে শক্তিশালী এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেগুলো বিচিত্র দার্শনিক চিন্তার রসদ জুগিয়েছে এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হবার প্রেরণা জুগিয়েছে।
এগুলো ছাড়াও বিদ্যা বা জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে মুসলিম লেখকদের লেখালেখির প্রবণতা এবং বায়তুল হিকমার মতো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির কারণে মুসলমানরা প্রকৃতি বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছে। চিকিৎসাবিদ্যা, নক্ষত্র বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা এবং মেকানিক্স প্রভৃতির মতো জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রায় সব ক্ষেত্রেই এমনসব তথ্যপঞ্জী পাওয়া যায়, যেগুলোকে সামনে রেখে ঐসব বিদ্যাকে গ্রিক বলে মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।
ইসলামী সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হচ্ছে, জ্ঞানের শ্রেণীবিন্যাস করা। ইসলামী সভ্যতার উত্থান-পতন নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্যে জ্ঞানের এই শ্রেণীবিন্যাস খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। বিজ্ঞ মনীষীগণ জ্ঞানকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে মুসলিম মনীষী অবদান রেখেছেন তিনি হলেন আবু নাস্র ফারাবি। এহসাউল উলুম নামে তাঁর বইটি প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের জ্ঞানীজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই বইটির গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রভাব কতটুকু পড়েছিলো তা বোঝা যাবে পরবর্তীকালে লেখা অন্যান্য বইতে। ফারাবি অবশ্য তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেই ঐ স্তর বিন্যাস করেছেন।
ফারাবির পর এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ ইউসুফ খাওয়ারেযমি। তিনি তাঁর লেখা মাফাতিহুল উলুম গ্রন্থে জ্ঞানের শ্রেণীবিন্যাসের নতুন একটি পদ্ধতি উপস্থাপন করেছেন। তিনি জ্ঞানকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। একটি হচ্ছে ইসলামী জ্ঞান এভং অপরটি হলো মানবীয় জ্ঞান। মানবীয় জ্ঞান বিভাগে রয়েছে দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসা এবং রসায়ন শাস্ত্রের মতো বিষয়গুলো। ইসলামী সভ্যতা বিস্তারে যে বিদ্যাটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তা হচ্ছে হিসাব বা গণিতবিদ্যা। ইসলামী যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে আরবরা হিসাব শেখার প্রতি তেমন একটা আগ্রহ দেখাত না। কারণ হলো সেযুগে যারা আয়কর সংগ্রহ করতো তারা হিসাব নিকাশের দায়িত্বটাও পালন করতো,আর এইসব কর্মকর্তা সাধারণত দায়িত্বশীল শ্রেণী থেকেই নির্বাচন করা হতো। তবে নগরবাসীদের সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পেলো তখন হিসাব বিজ্ঞান এবং গণিত শিক্ষার প্রয়োজণীয়তা আগের তুলনায় অনেক অনুভূত হলো।
এ জন্যেই জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো হিসাব বিজ্ঞানও আরবি ভাষায় অনূদিত হতে লাগলো। তারপর থেকেই জ্ঞান পিপাসুরা গণিত এভং হিসাব বিজ্ঞান শিখতে শুরু করে। এভাবে গণিত বিদ্যার মধ্য দিয়ে হিন্দি সংখ্যা পাশ্চাত্যে গিয়েছিল। গ্রিক গণিতে সংখ্যা লেখায় চল্লিশটি চিহ্ন ব্যবহৃত হতো। কিন্তু হিন্দী সংখ্যায় মাত্র দশটি চিহ্ন ব্যবহৃত হতো যা একেবারেই সহজ। হিন্দি সংখ্যা চিহ্নগুলো ছিল মুসলমানদের আবিষ্কার। আর এই সহজ সংখ্যা চিহ্নগুলোই পশ্চিমারা আয়ত্ত করেছিল। মুহাম্মাদ ইবনে মূসা খাওয়ারেযমি ছিলেন অপর এক ইরানী মুসলিম মনীষী। তিনি গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং ভূগোলের মতো বিভিন্ন বিষয়ে নামকরা পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনিই হিন্দি সংখ্যা লিখন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে বই লিখেছিলেন এবং মুসলিম বিশ্বে তার প্রসার ঘটিয়েছেন। খাওয়ারিযমির বইটিই সম্ভবত হিসাব বা গণিত সংক্রান্ত সর্বপ্রাচীন বই যা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে আদৃত হয়। অ্যালজেবরা বা বীজগণিত আবিষ্কারের জন্যেও খাওয়ারেযমি খ্যাতিমান ছিলেন। তিনি আলজাব্র ওয়াল মোকাবেলা নামে যে বিখ্যাত গ্রন্থটি রচনা করেন ঐ গ্রন্থটির নাম অনুসরণে ইউরোপীয়রা এই গণিতবিদ্যার নামকরণ করেছেন অ্যালজেবরা।
বিশিষ্ট মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন লিখেছেন, মধ্যযুগে ্উরোপীয়রা বীজগণিত ও সমাধানকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ধারণ করে। ফ্রান্সিস ভিয়েতের সময় পর্যন্ত ইউরোপে জ্ঞান চর্চার ভিত্তিই ছিল অ্যালজেবরা। এলগো রিদম নামে যে পরিভাষাটি হিসাব বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বহুল পরিচিত এবং ব্যবহৃত, তা খাওয়ারেযমির দেওয়া নাম থেকেই ইেেউাপীয় ভাষাগুলোতে প্রবেশ করেছে। ইবনে নাদিম তাঁর নির্ঘন্ট বইতে খাওয়ারেযমির দুটি অ্যাস্টেেরানমিকেল চার্টের কথা উল্লেখ করেছেন। খাওয়ারেমির এই অ্যাসট্রোনমিকেল চার্ট ইসলামী যুগের প্রথম গ্রন্থ যাতে কেবল ত্রিকোণামিতির কথাই বলা হয় নি, বরং এই গ্রন্থের ভূমিকায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতিও ইঙ্গিত করা হয়েছে।
১৫তম পর্ব
গণিতশাস্ত্রে বিখ্যাত আরো একজন মুসলিম মনীষী ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তিনি হচ্ছেন ইব্রাহিম ওকলিদেসি। খাওয়ারেযমির পর গণিতশাস্ত্রে তিনি নতুন নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার করেন। ডেসিমলস বা দশমাংশের মাধ্যমে ভগ্নাংশের যে হিসাব গণিতশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয় ওকলিদেসি তা উদ্ভাবন করেছিলেন। দামেশকের অধিবাসী এই গণিতবিদ তাঁর এই তত্ত্ব হিন্দি হিসাব নামক নিজস্ব বইতে তুলে ধরেন। অবশ্য জীবিতাবস্থায় তিনি তাঁর এই বইয়ের প্রতি কিংবা তাঁর দেওয়া থিউরির প্রতি গণিত চর্চাকারীদের আকর্ষণ বোধ করার বিষয়টি দেখে যেতে পারেন নি। তবে তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৫০০ বছর পর গিয়াস উদ্দিন জামশিদ কাশানির মাধ্যমে ওকলিদেসির তত্ত্ব বা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পুনরায় সবার সামনে উঠে আসে।
মুসলিম গণিতবিদরাই সর্বপ্রথম অ্যালজেবরাকে জ্যামিতির ভেতর প্রবেশ করান এবং বীজগণিতের সমীকরণের মাধ্যমে জ্যামিতির বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। মূসা বিন শাকের হিজরী তৃতীয় শতাব্দির একজন মনীষী ছিলেন। বিখ্যাত এই মনীষী ছিলেন মুসলমান এবং ইরানের অধিবাসী। তিনি এবং তাঁর সন্তানেরা জ্যামিতি এবং গণিতের ক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। এইসব গবেষণামূলক কাজগুলোকে পরবর্তীকালে পশ্চিমা পন্ডিতেরা অনুবাদ করেছেন এবং সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছেন।মূসার সন্তান বানু মূসা বৃত্তের পরিধি বা আয়তন মাপার জন্যে তুলনামূলকভাবে নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বৃত্তের ব্যাস বা ঘনত্ব পরিমাপের ক্ষেত্রে কিংবা জ্যামিতিক গঠনের পরিমাপ করার জন্যেও তিনি ব্যাপক অবদান রেখেছেন।
ইসলামী যুগে গণিতশাস্ত্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এরকম আরো একজন গণিতবিদ হলেন আবুল হাসান সাবেন বিন কুররা। তিনি ছিলেন হাররানের অধিবাসী। ২১১ হিজরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সুরিয়ানী ভাষায় কথাবার্তা বললেও তিনি গ্রিক এবং আরবি ভাষায় ব্যাপক দক্ষ ছিলেন। গণিতশাস্ত্রে তিনি যেসব অবদান রেখেছেন সেগুলো পরবর্তীকালে এক্ষেত্রে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, নতুন নতুন থিওরি আবিষ্কার করেছেন তাদেরকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছে, পথের নির্দেশনা দিয়েছে। জ্যামিতি এবং গণিতবিজ্ঞানে বিশেষ করে তিনি বিভিন্ন গঠনের বাইরের আকৃতি পরিমাপ করার চমৎকার সব পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। তাঁর বইগুলোতে অর্থাৎ নিজের লেখাতে যেমন তেমনি গ্রিক গণিতবিদদের যেসব বই তিনি আরবি ভাষায় অনুবাদ করেছেন সেগুলোতেও তাঁর সেইসব পদ্ধতির বর্ণনা রয়েছে।
অপর এক মুসলিম গণিতবিদ হলেন আবু সাইদ সেজযি। গণিত শাস্ত্রের উন্নয়ন ও বিকাশে তিনিও ব্যাপক অবদান রেখেছেন। আবু সাইদ সেজযি ছিলেন সিস্তানের অধিবাসী। তিনি হিজরী চতুর্থ শতকের গণিতবিদ ছিলেন এবং আবু রায়হান বিরুনির সমসাময়িক ছিলেন তিনি। বিশেষ করে জ্যামিতিতে তিনি ব্যাপক দক্ষ ছিলেন। স্বয়ং বিরুনি তাঁর লেখায় আবু সাইদ সেজযির নাম উল্লেখ করতে ভোলেন নি। আবু সাইদ সেজযি জ্যামিতির সমস্যাকে সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে সমাধান করেছেন। তিনি অন্তত ৪৫টি বই লিখেছেন এবং অসংখ্য ছোটো পুস্তিকা লিখেছেন যার মধ্যে প্রায় ৩৪টি বই-ই গণিতশাস্ত্র বিষয়ক। বাকি বইগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক।
বর্তমান বিশ্বে মুসলিম মনীষী আবু রেইহান বিরুনির নামটি সবার কাছেই মোটামুটি পরিচিত। ইরানী এই মহান মনীষীর জীবনকাল ছিল হিজরী চতুর্থ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধ। ৩৬২ হিজরীতে তিনি খাওয়ারেযমশাহীদের রাজধানী শহর তাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অত্যন্ত উঁচু মাপের এই লেখক প্রচুর বই লিখে গেছেন। ভূগোল, নক্ষত্র ও গণিতশাস্ত্রের ওপরই তিনি বেশি লিখেছেন। অনুবাদ এভং মূল রচনা মিলে ১৮০ টিরও বেশি বই তিনি লিখেছেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়টি হচেছ আরবি থেকে ল্যাটিনে অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর বইগুলো অনূদিত হয় নি। বিরুনির বিখ্যাত একটি বই হচ্ছে আততাফহিম। অ্যালজেবরা, জ্যামিতি এবং হিসাব বিজ্ঞানের ওপর লেখা এ বইটি। ত্রিকোণামিতির ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যাপক অবদান রয়েছে।
ইসলামী যুগের গণিতবিদদের উদ্ভাবনী ও অর্জনগুলোই গণিত শাস্ত্রের উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়। তবে বিখ্যাত মনীষীদের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে গণিতশাস্ত্রে যাঁর নামটি সর্বাধিক উচ্চারিত হয় তিনি হলেন ইবনে সিনা। আবু আলি সিনা দর্শন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, গণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। হিজরী ৩৭০ সালে বোখারার কাছে-বর্তমান উজবেকিস্তানের কাছে-জন্মগ্রহণ করেন। বোখারাতে তিনি যুক্তবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা এবং গণিতশাস্ত্র পড়েন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি নুহ ইবনে মানসুর সামানীর চিকিৎসা করেন। আবু আলী সিনা ব্যাপক খ্যাতি অর্জনের পর মানসুর সামানীর রাজকীয় গ্রন্থাগারে প্রবেশ করার অনুমতি পান। ইবনে সিনা আবু রেইহান বিরুনির েেমা কিংবা আবু নাসর ইরাকির মতো মনীষীদের সাথে গণিতশাস্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে মত-বিনিময় করেন, গঠনমূলক বিতর্কও করেন।
মুসলিম এই মহান মনীষী বিশ্ববাসীর জন্যে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই রচনা করে গেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যারা পড়ালেখা করেন কিংবা চর্চা করেন তাদের জন্যে অবশ্যপাঠ্য মূল্যবান অনেক গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। শাফা তাঁর বিখ্যাত আরো একটি বই। এ বইতে গণিত ছাড়াও মিউজিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক আলোচনা রয়েছে। সংখ্যাতত্ত্ব নিয়েও এ বইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। মুসলিম মনীষীদের মধ্য থেকে আরো যাঁরা গণিত শাসেেত্র অবদান রেখেছেন তাদের মাঝে খাই্য়্যম নিশাবুরির নামটি অবশ্যই উল্লেেেযাগ্য। ওমর খৈয়াম নামেই তিনি বেশি পরিচিত। হিজরী পঞ্চম শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধ এবং ষষ্ঠ শতাব্দির প্রথমার্ধের সবচেয়ে বড়ো গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন ওমর খৈয়াম। মহাজ্ঞানী এই মনীষী সমগ্র ইরানী জাতির গর্ব। বীজগণিত ও সমাধান বিষয়ে তাঁর লেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিসাব বিজ্ঞানও তাঁর আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে।
আরো যেসব মুসলিম মনীষীর নাম এক্ষেত্রে উল্লেেেখাগ্য তাদের মধ্যে খাজা নাসিরুদ্দিন তুসির নামটি অবশ্যই উঠে আসবে। গণিত বিষয়ের পণ্ডিত হিসেবে তিনি ব্যাপক খ্যাতিমান ছিলেন। ইরানের তূস শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গণিত ছাড়াও ইসলামী বিধি-বিধান এবং সাহিত্য বিষয়ের পাঠ তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। তূসের বিখ্যাত ফকিহ এবং মুহাদ্দিস হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। ছোটোবেলায় তিনি নিশাবুরে যান এবং প্রফেসর কামালুদ্দিনের কাছে গণিত শেখেন। ৬৫৭ হিজরীতে মারা’গেতে তিনি যে মানমন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন দেশ এবং জাতির জন্যে তা ছিল খাজা নাসিরুদ্দিন তূসির অনন্য এক অবদান। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গ্রন্থাগারও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই। অবশেষে ৬৭২ হিজরীর ১৮ই জিলহজ্বে বর্তমান ইরাকে অবস্থিত কাজেমাইনে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
১৬তম পর্ব
মুসলমানদের মাঝে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে শাখাটির চর্চা সবচেয়ে বেশি ছিল তা হলো জ্যোতির্বিজ্ঞান। এই জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে আজকের আসরে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো।
মুসলিম দার্শনিকগণ জ্যোতির্বিজ্ঞানে ইরানী ও ভারতীয় অর্জন বা উদ্ভাবনীগুলোকে কাজে লাগিয়ে অনেক মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। বিভিন্ন প্রকার সোলার সিস্টেম ঘড়ি তৈরি, গ্রহ নক্ষত্রের উচ্চতা ও গতিবিধি নির্নায়ক যন্ত্র অ্যাসট্রোলেইব আবিষ্কার, সময় নির্নায়ক সরঞ্জাম ইত্যাদি মুসলিম মনীষীদের অবদান। মুসলিম মনীষীগণ বহুধরনের অ্যাসট্রোলেইব তৈরি করেন। এগুলোর কার্যক্রম এতো উন্নত মানের ছিল যে ব্যবহারিক দিক থেকে এগুলো বর্তমান যুগের কম্পিউটারের নির্ভুল ফলাফলের সাথে তুলনাযোগ্য। সময় নির্নায়ক বিদ্যা বা ক্রোনোলজি সম্পর্কে মুসলমান বিজ্ঞানীরা যখন ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন তখন ইউরোপে এই সময় নির্দেশক ঘড়ি বা যন্ত্রের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর মাঝে একটি হলো ভূপৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের উপায় নিয়ে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো। ইতিহাসের বিচিত্র তথ্যপঞ্জী অনুযায়ী আব্বাসীয় খলিফা মামুন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আদেশ দিয়েছিলেন ভূপৃষ্ঠকে পরিমাপ করার জন্যে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তখন তাদের পূর্ববর্তী মনীষীদের বিশেষ করে গ্রিক মনীষীদের রেখে যাওয়া পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে নতুন আরেকটি পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। এই পদ্ধতিটা বেশ আকর্ষণীয় ছিল সবার কাছে। এর কিছুদিন পর আবু রেইহান বিরুনি অ্যাসট্রোলেইব ব্যবহার করে আরো একটি পদ্ধতি আবিষ্কারে হাত দেন। তাঁর এই বিখ্যাত আবিষ্কারটির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে তাঁরই লেখা ভূপৃষ্ঠ পরিক্রমা নামক বইতে।
নক্ষত্রবিদ্যার ক্ষেত্রে মুসলিম মনীষীদের কাজের সূত্রপাত ঘটে টলেমির বই অনুবাদের মধ্য দিয়ে। তাঁর বইটি অনুবাদের পর এর ব্যাখ্যাধর্মী আরো অনেক বই লেখা হয়। সেইসব গবেষণা থেকে টলেমির দৃষ্টিভঙ্গির কিছু নেতিবাচক দিক বেরিয়ে আসে মুসলিম বিজ্ঞানীদের বিবেচনায়। তারা টলেমির দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈপরীত্য পোষণ করে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমান বিজ্ঞানীদের সেইসব মতামত বর্তমানে ‘কোপারনিক-পূর্ব’ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বিখ্যাত। টলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখাগুলোর বহু অনুবাদ এবং অসংখ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে এগুলোর মধ্য থেকে তিনটি অনুবাদ এবং বেশ কিছু বিশ্লেষণ এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। টলেমি পাঠের ফলে মুসলিম বিজ্ঞানীগণ নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে এস্ট্রোনমিকেল টেবলস তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হন এবং পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থৈরি কেরন। নক্ষত্র সম্বন্ধে যথার্থ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার লক্ষ্যেই এইসব চেষ্টা প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল এবং চেষ্টাগুলো সফলও হয়েছিল।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর মাঝে একটি ছিল সৌরবর্ষের দৈর্ঘ নিরূপণ করা। এ লক্ষ্যে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অবিরাম পর্যবেক্ষণের ফলে মুসলিম বিশ্বে সময় গণনা বিদ্যার উন্নয়ন ঘটে। সৌরবর্ষেরৈ দৈর্ঘ গণনা করতে গিয়েই তাঁরা মুসলিম বিশ্বে পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটান। জালালী পঞ্জিকাই তার ঐতিহাসিক উদাহরণ। এভাবেই সৌরবর্ষের সময়সীমা বা কালক্ষণ বাত্তানী এবং খযানীর মতো মুসলিম বিজ্ঞানীদের হাতেই নিরূপিত হয়।
এস্ট্রোনমিকেল টেবলস তৈরির জন্যে বারবার পর্যবেক্ষণ চালানোর ফলে নক্ষত্র সম্পর্কে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ নতুন নতুন তথ্য দিতে শুরু করলেন। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বুঝতে পারলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে পূর্বেকার ধারণাগুলোতে সমস্যা রয়েছে। মুসলমান জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ সুষ্ঠু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে টলেমির থিওরিগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন বা সন্দেহের জন্ম দিলেন। ইবনে সিনা তাঁর জেেযাতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখায় এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনিও মুসলমান জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতোই টলেমির থিওরির গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। টলেমির থিওরিটি ছিল ‘এই পৃথিবী হচ্ছে সমগ্র বিশ্বের কেন্দ্র।’
টলেমির থিওরিটির ব্যাপারে আরো যেসব জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিরোধীতা করেছেন তাদের মধ্যে খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি অন্যতম। তিনিও টলেমির থিওরিটির অনেক ভুলভ্রান্তি তুলে ধরেছেন। টলেমির থিওরিটির মধ্যে ছিলো গ্রহ-নক্ষত্রগুলো পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে-তাঁর এই মতামত সম্পর্কে সন্দেহেে াষণ করেন তুসি। নাসির উদ্দিন তুসির এই মতামত মুসলিম বিশ্বের একেবারে পশ্চিম প্রান্ত তথা স্পেনসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের বিজ্ঞানীগণ অনুমোদন করেন। নাসিরুদ্দিন তুসির পর আবু রেয়হান বিরুনি, ইবনে হিশামসহ আরো অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীই টলেমির থিওরির সমালোচনা শুরু করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে কপলার এবং কোপারনিক মুসলিম বিজ্ঞানীদের প্রভাবিত ছিলেন বিশেষ করে খাজা নাসির উদ্দিন তূসির প্রভাব তাদের ওপর ব্যাপকভাবে পড়েছিল।
মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উচ্চতর গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় চিকিৎসা বিদ্যায় তাদেঁর অগ্রগতির পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন আহমাদ বিন আব্দুল্লা.. মারুযি। মারুযি হিজরী ২০৯ থেকে ২২০ সালর পর্যন্ত নক্ষত্র পর্যবেক্ষণে আত্মনিয়োজিত ছিলেন। চাঁদের পরিক্রমণও নিয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। আবু আব্দুল্লা.. মুহাম্মাদ বিন জাবের বাত্তানী একজন বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন। হিজরী ২৪৪ সালের দিকে তিনি হাররানে জন্মগ্রহণ করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানগুলো খুবই মূল্যবান। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে তিনি মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মাঝে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। আবু রেয়হান বিরুনিসহ মুসলিম অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী জাবের বাত্তানীর দৃষ্টিভঙ্গিগুলো ভ্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। নতুন চাঁদ দেখার ব্যাপারে তিনি নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি দেন। সূর্যের পরিভ্রমণ সম্পর্কে নিকোলাস যে থিওরি দেন তা সুস্পষ্টভাবেই বাত্তানীর দৃষ্টিিিভ্গর প্রভাবে প্রভাবিত। বাত্তানীর উদ্ভাবনীগুলো সমগ্র ইেেরাপে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
সৌরবিজ্ঞানে েেরা যেসব জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহা মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন তাদের মধ্যে আবুল ভাফায়ী বুযজানী নাম উল্লেেেখাগ্য। ৩২৮ হিজরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাগদাদে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা কাজগুলো চালিয়েছিলেন। চন্দ্রগহণের সময় নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে আবু রেয়হান বিরুনির সাথে তিনিও সহয়োগিতা করেছিলেন। বুজডানীও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মূল্যবান বহু বই লিখেছেন। এগুলোর মাঝে পূর্নাঙ্গ অ্যাস্ট্রোনমিকেল চার্ট একটি। কী করে দূরত্ব পরিমাপ করা যায়, পাহাড়ের উচ্চতা নির্ণয় করা যায়, নদীর দৈর্ঘ নির্ধারণ করা যায় সেসব যন্ত্র থৈরির দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন এ বইতে। এই যন্ত্র দিয়ে অ্যাসট্রোলেইবের কাজও চালানো যেত।
১৭তম পর্ব
গত কয়েকটি আসরে আমরা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলিম মনীষীদের অবদানের সংক্ষিপ্ত অথচ ঐতিহাসিক কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদির পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা কিংবা মেকানিকসেও মুসলিম মনীষীদের ব্যাপক অবদান থাকলেও সেগুলো খুব একটা গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয় নি। তাই আজকের আসরে মেকানিক্স বা যন্ত্রকৌশল বিষয়ে মুসলমানদের অবদান নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো।
যন্ত্রকৌশলবিদ্যা বিভিন্ন রকম সরঞ্জামাদি বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার পদ্ধতি সংক্রান্ত বিদ্যা। আধুনিককালের যন্ত্রকৌশলবিদ্যার সাথে আগেকার সেই মেকানিক্সের নিকট সম্পর্ক রয়েছে। মুসলমান বিজ্ঞানীদের কাছে জ্ঞানের স্তর বিন্যাসে মেকানিকও গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, মিউজিক ইত্যাদির মতোই বিদ্যার আলাদা একটি শাখা হিসেবে বিবেচিত ছিল। ক্রুসেড যুদ্ধ ছিল বিভিন্ন সভ্যতার মাঝে জ্ঞান ও বিদ্যার বিনিময় বিশেষ করে যন্ত্রকৌশলবিদ্যা এবং কারিগরী বিদ্যা মুসলমানদের কাছ থেকে পাশ্চাত্যে যাবার একটি প্রধান কারণ। যন্ত্রকৌশলবিদ্যার ক্ষেত্রে যেসব বইপুস্তক মুসলিম বিজ্ঞানীগণ লিখেছেন সেসব খুব কমই ইউরোপীয় ভাষাগুলোতে অনূদিত হয়েছিল। তবে ক্রুসেড যুদ্ধের সময় পাশ্চাত্য মুসলিম বিজ্ঞানীদের ব্যাপক উন্নতি ও অগ্রগতি দেখে বিস্মিত হয়। মুসলমানরা স্বয়ংক্রিয় ঘড়ি, ভারি মালামাল উত্তোলন করার বিভিন্ন যন্ত্রসহ বিভিন্ন রকমের সামরিক সরঞ্জাম থৈরি করেছিল। যন্ত্রকৌশলবিদ্যায় কী রকম অগ্রগতি মুসলিম বিজ্ঞানীগণ অর্জন করেছিলেন এসব তার ক্ষুদ্র প্রমাণ।
নিঃসন্দেহে বলা যায়, মুসলমান প্রকৌশলীগণ মধ্যপ্রাচ্য এবং মেডিটেরিয়ান অঞ্চলের বিজ্ঞানীদের প্রকৌশলগত অর্জন থেকে প্রভাবিত হয়ে থাকবে। মিশরীয় এবং রোমানরা যন্ত্রকৌশলে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছিল তবে সবার চেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছিল গ্রিস। আব্বাসীয় খেলাফতের সময় গ্রিক ভাষা এবং সুরিয়ানী ভাষার বহু বই আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। সে সময় মুসলমানদের হাতে জলঘড়ির প্রযুক্তির ওপর একটি বই ছিল। মুসলিম বিজ্ঞানী জাযারি এই বইটিকে যন্ত্রকৌশল বিদ্যার অন্যতম একটি উৎস বলে মনে করেন। বদিউযযামান জাযারি ছিলেন প্রাচীন আমলে মুসলমান যন্ত্রকৌশল বিজ্ঞানীদের মধ্যে খুবই খ্যাতিমান। হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে এবং সপ্তম শতাব্দির প্রথমার্ধের শুরুতে তুরস্কের দিয়ারবাক্র শহরে বাস করতেন। জাযারি দিয়ারবাকরের শাসক মালেক সালেহর আহ্বানে তাঁর লেখা যন্ত্রকৌশল বিষয়ক এই বইটি লিখেছিলেন।
যন্ত্রকৌশল বিদ্যায় তাঁর এই লেখা এ বইটি সমকালীন গবেষক বা জ্ঞানীদের মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয় এবং তাকে প্রকৌশলীদের প্রধান উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয় দিক থেকে তিনি ব্যাপক দক্ষ ছিলেন বলেই এ ধরনের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। জাযারি তার কাজের ব্যাপরে ভীষণ মেধা এবং সৃজনশীলতার অধিকারী ছিলেন। অত্যন্ত জটিল সরঞ্জামাদির ব্যাপারেও তিনি একেবারে যথার্থ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতেন। মুসলিম বিজ্ঞানীদের প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার ওপর তিনি খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন। অভিজ্ঞতাহীন কোনো জ্ঞানকে তিনি গ্রহণ করতে চাইতেন না। মেসোপটেমিয়া, ভারত এবং ইরানের সভ্যতাগুলোর মতো ইসলামপূর্ব সভ্যতায় মুসলমান প্রকৌশলীদের আবিষ্কার ও নতুন নতুন উদ্ভাবনীগুলোর মাঝে জাযারির আবিষ্কার গ্রন্থিত মালার ছোট্ট একটি বৃত্তের মতো। মুসলিম এই বিজ্ঞানীর একটি বই আছে ‘আল-জামেউ বাইনাল এলমি ওয়াল আমাল,আন-নাফেউ ফি সানাআতিল হিয়াল’ নামে। তাঁর এই বইটি আগেকার যুগে হাইডেেরালিক ও মেকানিক্যাল সরঞ্জামাদি সম্পর্কে জানার ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো একটি বই ছিল। এ বইটিতে থিউরি এবং ব্যবহারিক পদ্ধতির মাঝে এক ধরনের মিল লক্ষ্য করা যায়। বিংশ শতাব্দির প্রথম কয়েক দশকে জার্মানীর বিখ্যাত দুই গণিতবিদ এ্ই বইটির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং এ বইয়ের কিছু কিছু অংশ তাঁরা তাদেঁর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিবেদনে অনুবাদও করেন, উদ্ধৃতও করেন। এদের একজন হলেন বিদম্যান এভং অপরজন হাউজার। পরবর্তীকালে অবশ্য জাযারির বইগুলো ডোনাল্ড হেইলের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয় এবং বই আকারে প্রকাশিত হয়। এরপর আহমাদ ইউসুফ আল হাসান নামে সিরীয় এক মনীষী ১৯৭৯ সালে জাযারির পুর্ণাঙ্গ বইটিকে আরবি থেকে সিরিয়ার ভাষায় অনুবাদ করেন। উল্লেখ করা যায় যে জাযারির বইটির ফার্সি সংস্করণ এখনো তেহরানের শহীদ মোতাহহারী হাইস্কুলের লােেই্ররিতে সংরক্ষিত আছে।
জাযারির বিখ্যাত বইটি মেকানিক্যাল বিভিন্ন সরঞ্জামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দিক থেকে খুব্ই মূল্যবান একটি বই হিসেবে স্বীকৃত। সত্যিই ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত জাযারির গবেষণা এবং উদ্ভাবনীগুলোর গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ক মহান ইতিহাসবিদ জর্জ শার্টুন জাযারির বই সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ একটি বই এটি। যন্ত্রকৌশলবিদ্যা সংক্রান্ত বিশেষ করে যন্ত্র পরিচিতি ও তার বিশদ ব্যাখ্যা সম্পর্কে মুসলমানদের একটি শ্রেষ্ঠ বই এটি।’ জাযারি যে-কোনো শিল্প সরঞ্জাম তৈরির পদ্ধতি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর বইতে, আজকের যুগের শিল্পস্রষ্টারাও সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে যে-কোনো সরঞ্জাম খুব সহজেই তৈরি করতে পারেন। যন্ত্রকৌশলবিদ্যার বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন জাযারি এমন একটি মেশিন সম্পর্কে পুরো ডিজাইন দিয়ে গেছেন, যন্ত্রকৌশলবিদ্যার পরিপূর্ণতার ক্ষেত্রে যার ভূমিকা অপরিসীম।
বলা যায়, এমন বহু পার্টস এবং পদ্ধতি জাযারি ব্যবহার করেছেন, যেগুলোকে নয়া প্রকৌশল সামগ্রী হিসেবে গণ্য করা হয়। কিছুদিন আগে জাযারি প্রদত্ত ব্যাখ্যা ও পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি করা বেশ কিছু শিল্প-সরঞ্জাম লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ব উৎসবে পাঠানো হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে পাম্পার বা হাওয়া ঢুকানোর যন্ত্র, রক্ত নেওয়ার যন্ত্র এবং বিরাট জলঘড়ি। শ্রোতাবন্ধুরা! ঘড়ির প্রসঙ্গ এসে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলো আজ আর আমাদের হাতে সময় নেই কথা বলার। তাই পরবর্তী আসরে যন্ত্রকৌশলবিদ্যা এবং পদার্থবিদ্যায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের আরো কিছু অর্জন ও অবদান নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে রইলো।
১৮তম পর্ব
গত আসরে আমরা যন্ত্রকৌশলবিদ্যায় মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদান নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী গুরুত্ববহ মুসলিম বিজ্ঞানী জাযারির অনন্য আবিষ্কার নিয়ে কথা বলেছি। বলেছিলাম যে তিনি জলঘড়ি আবিষ্কার করেছিলেন, গভীর কুপ থেকে পানি উত্তোলনের যন্ত্রসহ েেআা অনেক কিছু আবিষ্কার করেছিলেন। আজো আমরা তারি ধারাবাহিকতায় কথা বলার চেষ্টা করবো।
হিজরী তৃতীয় শতকে মুসলিম বিশ্বে যন্ত্রকৌশলবিদ্যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আর এ বিদ্যার সোনালী যুগ ছিল সপ্তম শতাব্দীর প্রথম পর্যায়। মুসলিম প্রকৌশলীগণ যান্ত্রিক সরঞ্জামাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছিলেন। বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরির ক্ষেত্রে মুসলমান বিজ্ঞানীগণ স্টিল, লৌহজাত সামগ্রী, স্বর্ণ, রূপা, কাঠ, কাঁচ, চামড়া, তুলা, রেশমসহ আরো বহুরকম জিনিসপত্র প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতেন। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতো কাঠ এবং পাতলা তামা। তামার ব্যবহার পাইপ তৈরিসহ বিভিন্ন ডিজাইন তৈরির ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হতো। মুসলিম বিজ্ঞানীগণ তার তৈরির জন্যে তামার ব্যবহার করতেন বেশি, তবে লোহার ব্যবহারও করতেন অনেক সময়। এই তার দিয়ে তাঁরা শেকল জাতীয় জিনিস তৈরি করতেন। গিয়ারহুইল কিংবা ববিন তৈরির ক্ষেত্রেও কাঠ বা তামা ব্যবহার করতেন।
ইসলামী সভ্যতার মাঝামাঝি সময়ে মুসলমানরা বিশেষ একটা সম্যসার মুখোমুখি হতেন। সেটা হলো কোনো কোনো এলাকায় উপরের দিকে পানি নেওয়ার সমস্যাটা ছিল প্রকট। পানি সমস্যার কারণে ঐসব এলাকার অধিবাসীদের খুব কষ্ট পোহাতে হতো। মুসলিম প্রকৌশলীগণ বিশেষ করে জাযারি এবং বনুমুসার মতো বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি করে পানি উপরের দিকে তোলার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাদেঁর এই পদ্ধতি বা উদ্ভাবনীকে নাউরা বা র্চাখ্ চহ্ বলে অভিহিত করা হতো, যার বাংলা দাঁড়াবে ‘চরকি কল’। মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশেই এখনো পানি উপরে তোলার যন্ত্র এই চরকি কলের অস্তিত্ব খুজেঁ পাওয়া যাবে। বনুমুসার খান্দান ছিল যন্ত্রকৌশল বিদ্যায় সর্বপ্রথম পারদর্শী মুসলিম বিজ্ঞানী যাদেঁর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে এই বিদ্যার প্রসার ঘটে। বনুমুসার আলহিয়াল বইটি যন্ত্রকৌশল বিদ্যার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বই মুসলিম বিশ্বে যার নমুনা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। এই বইটিতে এক শ’টি যন্ত্রের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে।
বনু মুসা এবং তার ভাইদের বেশি কিছু আবিষ্কার আছে সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেসব যন্ত্র তাঁরা তৈরি করেছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে খনন কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র, বায়ুকে দূষণমুক্ত করার যন্ত্রসহ শ্রমিকদের জন্যে এবং পারিবারিক প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্র। মিল্লাং নামে গাড়ির একটি পার্টস আছে ইংরেজিতে যাকে ক্র্যাংক বলে, এটি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেছিলেন বনুমুসা। ইউরোপে আবিষ্কার হবার পাঁচ শ’ বছর আগে তিনি এটি উদ্ভাবন করেছিলেন। জলপ্রবাহের শক্তি চালিত ঘড়িও তিনি আবিষ্কার করেছেন। এইসব ঘড়ি পরবর্তীকালে ইেেউাপের বিভিন্ন গির্যা এবং স্কোয়ারে ব্যাপকভাবে ব্যভহৃত হয়েছে। এই ঘড়িগুলো নির্দিষ্ট সময়ে এলার্ম দিতো।
আবুল ফাত্হ আব্দুর রাহমান খযানি ছিলেন ইসলামী সভ্যতার যুগে বিখ্যাত একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থ বিজ্ঞানী এবং যন্ত্রকৌশল বিদ্যায় পারদর্শী একজন মুসলিম বিজ্ঞানী। খযানি ইবনে হিশাম এবং বিরুনীকে অনুসরণ করে যন্ত্রকৌশল বিদ্যায় ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে অনেক অগ্রগতি লাভ করেছেন। ওজন মাপার যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। খযানি একটি বই লিখেছিলেন মিযানুল হিকমা নামে। যন্ত্রকৌশলবিদ্যার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। এ বইতে তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করার আগে রাযি, বিরুনী, খৈয়্যাম প্রমুখের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। সময় পরিমাপক যন্ত্র, বিভিন্ন রকম পাল্লা, বস্তুর ঘনত্ব পরিমাপক যন্ত্রসহ েেরা অনেক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনীর বর্ণনা এই বইতে রয়েছে। ইতালির বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অলদুমিয়ে লি বিরুনি এবং খযানির পরিমাপ পদ্ধতি এবং তাদের আবিষ্কারগুলোকে তুলনামূলক পর্যালোচনা করে বলেছেন তাদের যন্ত্র এবং পরিমাপ একদম সঠিক। শরীরের ওপর বায়ুর চাপের প্রভাব সম্পর্কে খযানি যথাযথ ধারণা দিয়েছেন।
ইবনে হিশাম নামে বহুল পরিচিত আবু আলী হাসান ইবনে হিশাম বাসরি ছিলেন হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ এবং পদার্থবিজ্ঞানী। মেকানিক এবং ফিযিক্সে তিনি মূল্যবান কিছু অবদান রেখেছেন। ইবনে হিশাম ছিলেন ফটোলজির জনক। ফটোলজি বিদ্যাকে তিনি সুশৃঙ্খল রূপ দেন। আলো নিয়ে এবং ছায়া নিয়ে তিনি ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। অন্ধকার কক্ষের বৈশিষ্ট্য নিয়েও তিনি অনেক গবেষণা করেছেন। একইভাবে তিনি আলোর প্রতিফলনের নিয়মের ক্ষেত্রে চমৎকার কিছু পর্যালোচনা করেছেন। সমতল বা কনভেক্স অর্থাৎ স্ফীত লেন্সকে বড়ো করে দেখানোর বিষয়টিকে পরিমাপ করেছেন। তাঁর লেখা বহু বই রয়েছে। ইউরোপীয় এবং মুসলমান গবেষকগণ ইবনে হিশামের লেখাগুলোকে অন্তত এক শতাব্দি আগে অনুবাদ করেন এবং প্রকাশ করেন।
ফটোলজি এবং পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ইবনে হিশামের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই এখনো পাওয়া যায়। তাঁর লেখা নুরুল মানাজির নামক বইটি ল্যাটিনে অনুদিত হবার পর সেই মধ্যযুগে এটি পশ্চিমা বিশ্বে ফটোলজি এবং পদার্থবিজ্ঞানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তবে ইবনে হিশামের পর মুসলিম বিশ্বে ফটোলজি বিদ্যা চর্চায় আগ্রহ কমে যায় এমনকি খাজা নাসিরুদ্দিন তূসির মতো েেবা বড়ো মনীষীও ইবনে হিশামের অবদান সম্পর্কে ততোটা অবহিত ছিলেন না। তবে পরবর্তীকালে অর্থাৎ হিজরী সপ্তম শতাব্দিতে ফটোলজি নিয়ে পুনরায় চর্চা শুরু হয় এবং কুতুব উদ্দিন শিরাযি ফটোলজির একটি শাখাকে ইরানে ব্যাপকভাবে প্রবর্তন করেন। এই শাখাটি ফার্সি কুসও কাজাহ যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে রেইনবৌ অর্থাৎ রংধনু। আধুনিক পাশ্চাত্যে ফটোলজি নিয়ে যতোটা চর্চা হচ্ছে তা বহুলাংশেই ইবনে হিশামের মতো মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদানের কাছে ঋণী। এ কারণেই পাশ্চাত্যে ইবনে হিশামকে েেফালজির জনক উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। বিখ্যাত বৃটিশ দার্শনিক ও বিজ্ঞানী রজার বেকনও পরিপূর্ণভাবেই ইবনে হিশামের প্রভাবে ভীষণরকম প্রভাবিত ছিলেন।
১৯তম পর্ব
গত আসরে আমরা গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান এবং যন্ত্রকৌশলবিদ্যার েেমা বিষয়গুলোর গুরুত্ব নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। সেইসাথে এইসব বিদ্যায় মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদান নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করেছি। আজকের আসরে চিকিৎসা বিদ্যায় মুসলিম চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের অবদান নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা বলবো।
চিকিৎসা বিদ্যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের েেমাই মুসলমানদের মাঝে জ্ঞানচর্চার প্রাথমিক পর্যায়েই গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয় এবং এবং ব্যাপকভাবে মুসলামন মনীষীগণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের চর্চা করেন। সমগ্র মুসলিম বিশ্বেই চিকিৎসা বিদ্যার ব্যাপক প্রচলন দেখা দেয়। একটি বর্ণনায় জ্ঞানকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ একটি হলো এলমে আবদান অর্থাৎ দেহ বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিদ্যা, অপরটি হলো এলমে আদিয়ান। এই বর্ণনা থেকেই ইসলামে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গুরুত্ব ও মর্যাদার বিষয়টি ফুটে ওঠে। চিকিৎসা বিদ্যার উন্নয়নে মুসলমানদের ব্যাপক গঠনমূলক ভূমিকা ছিল। অবশ্য চিকিৎসা বিষয়ক তাত্ত্বিক জ্ঞানের ধারণাগুলো মুসলমান বিজ্ঞানীদের কাছে এসেছিল অনুবাদের পথ ধরে। গ্রিক বিজ্ঞানীদের মূল্যবান গ্রন্থগুলো বিশেষ করে হিপোক্রেটিস এবং জালিনুসের বইগুলো অনুবাদ হবার ফলে এই বিদ্যায় মুসলমানদের তৎপরতার ধারা বেগবান হয়।
তবে মুসলমান চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ নিজেদের দেশে যেসব রোগ-ব্যাধির মুখোমুখি হয়েছেন, সেগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থাটা মুসলিম ভূখণ্ডের আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও আবহাওয়ার আলোকে মুসলিম চিকিৎসাবিদগণই আবিষ্কার করেছেন।গ্রিক বিজ্ঞানীদের কোনো নির্দেশনা এক্ষেত্রে কাজে লাগে নি। যেমন ধরুন, যাকারিয়া রাযি তিনি তাঁর মহামূল্যবান গ্রন্থ আলহাভি’তে অন্তত ৭০০ প্রজাতির উদ্ভিদের ওষুধিগুণ বর্ণনা করেছেন। অথচ গ্রিক বিজ্ঞানী দিউসকুরিদস তাঁর বইতে মাত্র ৫০০ টি ওষধি উদ্ভিদের ভৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসের ক্ষেত্রে আলহাভি গ্রন্থটি একটি আকর গ্রন্থ। এ বইটিতে বেশ কিছু রোগ-ব্যাধি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। রাযির আলহাভি বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে যেসব রোগব্যাধি নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে কিংবা সেসব রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলো গ্রিক চিকিৎসাবিদ জালিনুস কিংবা হিপোক্র্যাটিসের বইয়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশি এবং স্বতন্ত্র।
চিকিৎসাবিদ্যা ইসলামী যুগে ভারত এবং গ্রিক চিকিৎসাশাস্ত্রগুলো অনুবাদের মধ্য দিয়ে বিস্তৃতি পায়। খ্রিষ্টিয় পঞ্চম শতাব্দিতে রোম সরকার প্রাচীন কনস্টান্টিনোপলের খ্রিষ্টান ধর্মনেতা নাস্তুরের অনুসারীদেরকে তাদের সাম্রাজ্য থেকে বের করে দিয়েছিল। তারপর নাস্তুরিরা ইরানে আসে এবং জন্দিশাপুরে তারা তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করে। জন্দিশাপুরে তারা চিকিৎসা বিদ্যালয় স্থাপন করে এবং সেখানেই তারা গ্রিক চিকিৎসাবিদ্যা আর ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার সংমিশ্রণ ঘটায়। পরবর্তীকালে এই চিকিৎসা বিদ্যালয় থেকে বহু চিকিৎসক তৈরি হয় যারা ইসলামী চিকিৎসার উন্নয়ন এবং চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতালের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক গঠনমূলক ভূমিকা রাখে। আসলে ইসলামী যুগে চিকিৎসাবিদ্যার বিস্তৃতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের অন্যতম একটি নিদর্শন হলো এই জন্দিশাপুর চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। জন্দিশাপুর চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও এখানে ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি হাসপাতালও। জন্দিশাপুর হাসপাতালটি ইরানের প্রাচীনতম চিকিৎসাকেন্দ্র। দ্বিতীয় শাপুরের শাসনামলে এই হাসপাতালটির অস্তিত্ব ছিল।
জন্দিশাপুর হাসপাতালটির কার্যক্রম ইরানী চিকিৎসক এবং প্রফেসরদের উদ্যমে এবং তৎপরতায় তিনটি শতাব্দি ধরে চলমান ছিল। এটিই ছিল ইসলামী সভ্যতার যুগে সর্বপ্রথম চিকিৎসাকেন্দ্র। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার ্ই কেন্দ্রে সমকালীনেে ্রষ্ঠ ও বিখ্যাত ডাক্তারগণ ছাত্রদের পড়াতেন এবংেে াগীদের চিকিৎসা করতেন। জোন্দিশাপুরে যেই খান্দানটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপণর্ণ অবদান রেখেছিলেন সেই খান্দানটি হলো বাখতিশু। এই খান্দানের বারোজন সদস্য কয়েক প্রজন্মের জন্যে অর্থাৎ হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধ থেকে হিজরী পঞ্চম শতাব্দির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খলিফাদের উপদেষ্টা এবং চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত বই পুস্তক অনুবাদের কাজেও নিয়োজিত ছিলেন। এরা আব্বাসীয় খলিফাদের দরবারে চিকিৎসক হিসেবে, উপদেষ্টা হিসেবে এভং নতুন কোনো বই-পুস্তক কিংবা কোনো লেখা এলে সেগুলো অনুবাদ করতেন। বারমাকিয়ানও বাগদাদে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের নামে। তবে এই হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইবনে দেহ্ন নামের এক ভারতীয় চিকিৎসকের ওপর। তাঁরা ভারতীয় ঐ চিকিৎসককে সংস্কৃত ভাষার চিকিৎসাশাস্ত্রগুলোকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করার আহ্বান জানান। এই হাসপাতালটির খ্যাতির ফলে অনুরূপ আরো বহু হাসপাতাল গড়ে ওঠে।
আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর দিকে বাদশাহদের দৃষ্টি ছিল প্রাচীন সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি বিশেষ করে গ্রিক বিদ্যার প্রতি। হিজরী ১৪৮ সালে আব্বাসীয় খলিফা মানসুর নিজের রোগের কারণে বাখতিশুকে বাগদাদে ডেকে পাঠান। বাখতিশু খলিফার চিকিৎসা করেন এবং তারপর থেকে তিনি খলিফার সুনজরে পড়ে যান। বাখতিশু খান্দানের পরবর্তী প্রজন্মও বাগদাদে বসবাস করেন। অনুবাদের কাজ যখন উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে করা হয় তখন ধীরে ধীরে পূর্ব রোম, গ্রিক ডাক্তারদের চিকিৎসা পদ্ধতিকে কাজে লাগানোর সুযোগ হয়। গ্রিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব বই আরবি ভাষায় অনুদিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দিউসকুরিদস এর বই। হিজরী তৃতীয় শতিি্দার শুরুতে বাইতুল হিকমা ফাউন্ডেশান প্রতিষ্ঠার ফলে চিকিৎসা বিষয়ক বইপত্র অনুবাদের ক্ষেত্রে বহু জ্ঞানী গুণী আত্মনিয়োজিত হন। সবচেয়ে বেশি অনুবাদ করেছিলেন যিনি তাঁর নাম হলো হুনায়ন্ ইবনে ইসহাক আব্বাদি। হুনায়ন প্রায়ই অনূদিত বইগুলোকে অন্যদের সহযোগিতায় বিশেষ করে তাঁর ছেল্ইেসহাকের সহযোগিতায় সুরিয়ানী এবং আরবি ভাষায় অনুবাদ করতেন। মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন জালিনুসের ৯৫টি বই সুরিয়ানী ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ৩৪টি বই আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন।
না, কেবল অনুবাদই নয় বরং তিনি মৌলিক গ্রন্থও লিখেছেন চিকিৎসা বিষয়ে। তাঁর বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে আল-মাসায়িলু ফিত্তিব্বিল মুতায়াল্লিমিন ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিল। চক্ষু চিকিৎসার ব্যাপারেও তিনি মৌলিক একটি বই লিখেছেন আলআশরু মাকালাতি ফিল আইন নামে। এভাবেই চিকিৎসাবিদ্যায় মুসলমান মনীষীগণ ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন। চিকিৎসাবিদ্যায় আরো যে কজন ব্যক্তিত্বের নাম অবশ্যই উল্লেখ করার মতো তাদের েেম্য একজন হলেন আবুল হোসাইন আলি বিন সাহাল রাবান তাবারি। তিনি একটি বই লিখেছিলেন ফিরদাউস আল হিকমা নামে। এ বইতে তিনি ভারতীয়, গ্রিক এবং রোমের চিকিৎসা পদ্ধতির বর্ণনা দেন। জালিনুস এবং হিপোক্রেটিসের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেই হিজরী তৃতীয় শতাব্দির শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞান চর্চা হতো, তবে এই শতকেই তিব্বুন নববী নামে নতুন একটি বইয়ের প্রকাশ ঘটে যেটি লিখেছিলেন আলেমগণ। নবীজীর প্রদর্শিত এবং আলকোরআনে বর্ণিত নিদের্শনা অনুযায়ী এবং রাসূলে খোদার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ঐ বইটি লেখা হয়। তিব্বুল আয়িম্যা নামেও আরেকটি বই লেখা হয়েছিল এ সময়। এভাবেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানরা অবদান রেখেছিলেন।
২০তম পর্ব
আবু বকর মুহাম্মাদ বিন যাকারিয়া রাযি ছিলেন একজন নামকরা চিকিৎসাবিদ। হিজরী ২৫১ সালের পহেলা শাবানে তিনি বর্তমান তেহরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় রেই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। রাযির জন্মের সময় রেই ছিল খুবই উন্নত একটি এলাকা এবং ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র। রাযি রেই’তে গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়েন। তিনি চিকিৎসাবিদ্যা ছাড়াও রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চালিয়েছেন। উয়ুনুল আম্বিয়া গ্রন্থে ইবনে উসাইবার বর্ণনা অনুযায়ী রাযি যখন বাগদাদে এসছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ত্রিশের কোঠায়। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন জ্ঞানপিয়াসী। বিশেষ করে সাহিত্য এবং দর্শনের ব্যাপারে তিনি বেশি বেশি আগ্রহী ছিলেন। বেশি বয়সে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়েন। তাঁর চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন আলী বিন রাবান তাবারি।
রাযি যখন বাগদাদ থেকে রেই শহরে ফিরে আসেন তখন এখানকার একটি হাসপাতালের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে চিকিৎসার কাজ ছাড়াও যারা চিকিৎসাবিদ্যার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন তাদেরকে এই বিদ্যা শেখাতেন। আলহিকমার ইতিহাস গ্রন্থে এসেছেঃ মুসলিম বিজ্ঞানী এবং হাসপাতালের ডাক্তার রাযি প্রথমে রেই হাসপাতালের দায়িত্ব নেন এবং তারপর বাগদাদ হাসপাতালের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। রাযিকে অনেকেই ইসলামী জালিনূস নামে অভিহিত করতো। ইবনে সিনার পর ইসলামী সভ্যতার যুগের সবচেয়ে বড়ো চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন তিনি। তিনি তাঁর ছাত্র এবং রোগীদেরকে ভালোবাসতেন্ এবং সবসময় লেখালেখি করতেন বা পড়ালেখা করতেন যতোদিন না তিনি অন্ধত্ব বরণ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রাযি যেসব গবেষণা করেছেন সেগুলো ছিল তাঁর চোখে দেখা অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে করা গবেষণা।
ইতিহাসে এসেছে, যখন ইজদুদদৌলা দেইলামি চেয়েছিলেন বাগদাদে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে তখন বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী এই রাযিকে বলেছিলেন হাসপাতাল তৈরি করার জন্যে সবোর্ত্তম এবং উপযুক্ত একটি স্থান নার্বাচন করতে। রাযি যেহেতু এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞ ছিলেন সেজন্যে তিনি মজার একটা কাজ করলেন। তিনি তাঁর সহযোগীদের বললেন শহরের বিভিন্ন স্থানেেে াশতের টুকরো ঝুলিয়ে রাখতে। তাই করা হলো। চব্বিশ ঘণ্টা এভাবে ঝুলে থাকার পর তিনি একটার সাথে আরেকটাকে তুলনা করলেন। তারপর আদেশ দিলেন যে স্থানের গোশতের টুকরা তুলনামূলকভাবে ভালো সেখানে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে।
রাযি ছিলেন নতুন নতুন জিনিসের উদ্ভাবক। বিনা গবেষণায় তিনি তাঁর পূর্ববর্তী চিকিৎসাবিদদের ধারণা বা ব্যবস্থাগুলোর ওপর নির্ভর করতেন না। ‘আশশুকুকু আলা জালিনূস’ নামে তাঁ একটি পুস্তিকা রয়েছে। তাতে তিনি জালিনুসের চিকিৎসা পদ্ধতি এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচনা করেছেন। আলোক রশ্মি এবং দেখা ও শোনার ব্যাপারে জালিনুসের দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচনা করেছেন সবচেয়ে বেশি। রাযি জালিনুসের বিপরীত মত দিয়েছেন এ সম্পর্কে।
যাকারিয়া রাযি ছোটো বড়ো মিলিয়ে অন্তত দুই শ’টি বই লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে শ’খানেক বই লিখেছেন চিকিৎসা, ফার্মাসি বা ঔষধ বিজ্ঞান, দর্শন, প্রকৃতি বিজ্ঞান, জেেযাতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের ওপর। বিশেষ করে আলহাভি এবং আলমানসুরি গ্রন্থ দুটি চিকিৎসা বিষয়ে লেখা তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর অন্যতম। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দুটি মৌলিক গ্রন্থ এগুলো। আলহাভি গ্রন্থে রাযি শয্যাশায়ী রোগীদের ব্যাপারে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। গুরুত্বের দিক থেকে এই গ্রন্থটিকে চিকিৎসা-বিশ্বকোষ হিসেবে মনে করা হয়। এখনো এই গ্রন্থটির মূল আরবি সংস্করণের অন্তত অর্ধেকটার অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। রাযির হাভি গ্রন্থটির দুটি বিভাগ রয়েছে। একটি হলো ব্যবহারিক বিভাগ অপরটি তাত্ত্বিক বিভাগ। ইসলামী যুগের মাঝামাঝি সময়ে চিকিৎসা বিষয়ক অপরাপর লেখালেখির জন্যে এই দুটি বিভাগ ছিল উপযুক্ত আদর্শ।
আলহাভিতে বারোটি অধ্যায় রয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়েই রয়েছে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংলিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আেেলাচনা। এ বইতে স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ভেষজ ওষুধ তৈরি ও পরিচিতিসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক রাযির অপর একটি বই হচ্ছে আলমানসুরি। এই বইটি সর্বপ্রথম কোনো বই যা য়ুেেরাপে ছাপা হয়েছিল। মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ঔষধপত্র, কীটপতঙ্গের বিষ, জখমসহ আরো বহু বিষয় নিয়ে বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে এ বইটিতে। ল্যাটিন ভাষায় বইটির বহু সংস্করণ ছাপা হয়েছে। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে এ বইটি ইতালীয় ভাষাতেও অনূদিত এবং মুদ্রিত হয়। বসন্ত এবং হাম সম্পর্কেও তাঁর একটি মূল্যবান বই আছে। বইটির নাম হচ্ছে আলজাদরি ওয়াল হাসবা। বসন্ত নিয়ে বা হাম নিয়ে সম্ভবত প্রাচীনতম বই এটি।
রাযিই সর্বপ্রথম চিকিৎসা বিজ্ঞানী যিনি হাম থেকে বসন্তকে আলাদা করেছেন এবং পৃথক দুটি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই বইটি পশ্চিমাদের চক্ষুকে ছানাবড়া করে দিয়েছে এবং চিকিৎসা বিষয়ক বই পুস্তকের মাঝে এ বইটিকে তারা প্রাচীন চিকিৎসা বিষয়ক একটি উত্তম বই বলে উল্লেখ করেছে। চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলমানদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হিসেবে এ বইটিকে স্মরণ করা হয়। হাম এবং বসন্ত নিয়ে রাযি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং এই রোগ দুটির যেসব চিকিৎসা পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন, তা অনেকটাই এসব রোগের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির কাছাকাছি। চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস লেখক নেভিবুর্গারসহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করছেন েেমাটামুটি তাদের সবাই রাযির এই গ্রন্থটির কথা েেউ্লখ করেছেন। কেবল উল্লেখই নয় বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানের ক্ষেত্রে এই বইটির গুরুত্ব অপরিসীম বলেও মন্তব্য করতে ভোলেন নি তাঁরা।
১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই বইটির অন্তত চল্লিশটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মূত্রথলির পাথর এবং কিডনির পাথর নিয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা চালিয়েছেন এবং তাঁর ঐসব গবেষণা একটি বইতে সংকলিত হয়েছে। মূল আরবি ভাষার ঐ সংকলনটি ফরাশি ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদও হয়েছে। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বইটি লন্ডনেও ছাপা হয়। রাযির আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বই হচ্ছে মাল্ লা ইয়াহ্যুরুহুত তাবিব। গরিবের চিকিৎসা নামে বইটি বিখ্যাত। কেননা বইটি লেখা হয়েছে সেইসব সাধারণ রোগীর জন্যে ডাক্তারদের সাথে যাদের যোগাযোগের সুযোগ কম।