আজ ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ রবিবার | ৫ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এখন সময়- রাত ২:০১

আজ ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ রবিবার | ৫ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের বাজেট পরিচিতি

বাজেট হলো সরকারের আয়-ব্যয়ের সামগ্রিক দর্শন, কৌশল ও ব্যবস্থাপনা। এর প্রধান বিষয়বস্তু হলো সরকারি আয় যার অন্য পিঠে রয়েছে সরকারি ব্যয়। বাজেট জাতীয় অর্থনীতিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। ফরাসি শব্দ ‘ইড়ফমবঃঃব’ হতে বাজেট বা ইঁফমবঃ শব্দের উৎপত্তি। যার শাব্দিক অর্থ ছোট আকারের থলে বিশেষ। অতীতে থলেতে ভরে এটি আইন সভা বা সংসদে আনা হতো বলে এই দলিলটি ‘বাজেট’ নামে অভিহিত হয়ে আসছে। তবে বর্তমানে একটি দেশের বার্ষিক আয়-ব্যয় পরিকল্পনার বিশাল এক দলিল/নথি হিসেবে পরিচিত । আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহ বাজেটকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। কতিপয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য সামনে রেখে সরকার বাজেট প্রণয়ন করে থাকে। এতে সম্পদের সম্ভাব্য মোট পরিমাণ এবং খাতওয়ারী বণ্টনের বিবরণ উল্লেখ থাকে। এটি সরকার পরিচালনার একটি অন্যতম উপাদান। এজন্যই অধ্যাপক টেইলর ‘সরকারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক পরিকল্পনা’ (গধংঃবৎ ভরহধহপধরষ ঢ়ষধহ ড়ভ এড়াবৎহসবহঃ)-কে বাজেট বলে অভিহিত করেন। বাজেটে যেমনি কোন রাষ্ট্রের সরকারের একটি নির্দিষ্ট সময়ের (সাধারণত এক বছর/ অর্থবছর) সম্ভাব্য রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা থাকে, তেমনি সম্ভাব্য ব্যয়ের অনুমিত হিসাব থাকে। বাজেট ঘোষণা দ্বারা সরকার কি কি কাজে হাত দিতে যাচ্ছে তার একটি ইঙ্গিত থাকে। থাকে কিভাবে এসব কাজের অর্থায়ন হবে- তারও ইঙ্গিত। সরকারের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটে এই বাজেটে।
বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সরকারকে তিনটি ধাপে অগ্রসর হতে হয়। প্রথমে একটি খসড়া বাজেট প্রস্তুত করতে হয়। সরকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন শাখার ওপর খসড়া বাজেট প্রস্তুতকরণের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির পক্ষে বাস্তবায়ন শাখা এ দায়িত্ব পালন করে থাকে। অন্যদিকে মন্ত্রীপরিষদশাসিত সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। খসড়া বাজেট প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাদের অধীনস্ত বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আয়-ব্যয়ের হিসাব ও বিগত সময়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিবরণ তলব করেন। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেলের কর্মচারী-কর্মকর্তারা প্রাপ্ত ব্যষ্টি পর্যায়ের আয়-ব্যয়ের হিসাবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে সমষ্টি পর্যায়ের বাজেটের খসড়া প্রণয়ন করেন। বাংলাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব প্রস্তাবসমূহ প্রণয়ন করে এবং অর্থ বিভাগ ব্যয় প্রস্তাবসমূহ প্রণয়ন করে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে, খসড়া বাজেট প্রণয়ন শেষে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেল কর্তৃক তা পর্যালোচনার জন্য দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়। অতপর এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন-সংশোধন করার লক্ষ্যে আইনপ্রস্তাব বা বিল আকারে দেশের আইন সভা বা সংসদে উপস্থাপিত হয়। একে অর্থ বিল বলা হয়। আইন সভায় গৃহীত হলে তা রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির নিকট অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত হলে তা আইনগত ভিত্তি অর্জন করে। মন্ত্রী পরিষদশাসিত সরকার ব্যবস্থায় আইন সভা বাজেটে সম্মতি দিলে প্রধানমন্ত্রী তা অনুমোদন করেন। এই সম্মতি ও অনুমোদনের মধ্য দিয়ে বাজেট চূড়ান্ত রূপ অর্জন করে। দেশের অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে অর্থ বিল পেশ করেন।
তৃতীয় পর্যায়ে, অনুমোদিত বাজেট বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় নির্ধারিত অর্থ সংস্থানের মাধ্যমে বহুমূখী দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়। এ পর্যায়ে সরকারের প্রশাসনিক বিভাগগুলো বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ উল্লিখিত প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে কিনা তা পর্যালোচনা করেন। অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব বিভাগগুলো বরাদ্দকৃত অর্থের যোগান দেয়ার উদ্দেশ্যে সরকারের আয়ের সম্ভাব্য উৎসগুলোর দিকে সদাসর্বদা নজর রাখে।
একটি আদর্শ বাজেট প্রণয়নে কতিপয় বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়। পূর্বাপর প্রতিটি বাজেটের মধ্যে যোগসূত্র ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হয় । পূর্ববর্তী বৎসরের কর্মকাণ্ড এবং চলতি বৎসরের জন গৃহীত কর্মসূচির একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ থাকবে। চলমান ঘটনার প্রতিফলন, বিলাসিতা পরিহার, বায়স্তবায়ন যোগ্যতা, আয়ের উৎস এবং ব্যয়ের খাতের স্পষ্টতা ও যৌক্তিকতা থাকতে হয়। সামষ্টিক অর্থনীতির চলকসমূহ যেমন- সাধারণ দামস্তর, মজুরী স্তর, নিয়োগ স্তর, আয়স্তর, মুনাফার হার, বিনিয়োগ স্তর ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা অর্জনের বিষয়টি বিবেচ্য। বাজেটের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গবেষক, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী শ্রেণি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সর্বোপরি আইন সভায় ব্যাপক আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনা করার সুযোগ দিতে হয়। তাছাড়া বাজেট প্রণয়নের পূর্বেই সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি আয়ের উৎস ও ব্যয়ের খাতগুলো পছন্দ করতে হয়।
বাংলাদেশের বাজেট দু’টি ভাগে বিভক্ত। রাজস্ব (জবাবহঁব) বাজেট ও মূলধনী/উন্নয়ন (ঈধঢ়রঃধষ/উবাবষড়ঢ়সবহঃ) বাজেট। রাজস্ব বাজেটে রাজস্ব আয় ও ব্যয় সংক্রান্ত বিবরণী অন্তর্ভূক্ত থাকে। অন্যদিকে মূলধনী বাজেটে উন্নয়নমূলক ব্যয়ের খাতসমূহ এবং ব্যয় মিটানোর জন্য কোন কোন উৎস হতে অর্থ সংস্থান করা হবে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ থাকে। তাছাড়া সরকারি আয় ও ব্যয়ের পরিমাণের ভিত্তিতে বাজেটকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। সুষম বাজেট (ইধষধহপবফ ইঁফমবঃ) ও অসম বাজেট (টহনধষধহপবফ ইঁফমবঃ) । সুষম বাজেটে সরকারের সম্ভাব্য রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের পরিমাণ সমান হয়। আর অসম বাজেটে সরকারের সম্ভাব্য আয় ও ব্যয়ের পরিমাণ পরস্পর সমান হয় না। অসম বাজেট আবার দু’ভাগে বিভক্ত। উদ্বৃত্ত (ঝঁৎঢ়ষঁং) ও ঘাটতি (উবভরপরঃ) বাজেট।
বাজেটে রাজস্ব আয় অংশে কর এবং কর-বহির্ভূত রাজস্ব সংক্রান্ত বিবরণী লিপিবদ্ধ থাকে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে কর রাজস্বকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ-এ দু’ভাগে ভাগ করা হয়। ব্যক্তিগত আয়কর, কর্পোরেট আয়কর, সম্পদ কর, ইত্যাদি হচ্ছে পরোক্ষ করের অংশ। তবে বাংলাদেশের বাজেটে কর রাজস্ব আহরণে প্রত্যক্ষ করের চাইতে পরোক্ষ করের ভূমিকা প্রাধান্য পায়। মোট কর রাজস্বের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে এবং বাকি ২০ শতাংশ আসে প্রত্যক্ষ কর থেকে। আবার কর-বহির্ভূত রাজস্বের মধ্যে স্ট্যাম্প বিক্রয় বাবদ আয়, রেলওয়ের ভাড়া, পোস্ট অফিসের আয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত আয়, বিভিন্ন ধরণের ফি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের রাজস্ব বােেজটের আওতায় সাধারণত ২২ থেকে ২৫টি খাতে রাজস্ব ব্যয়ের হিসাব দেখানো হয়। এগুলোর মধ্যে শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, প্রশাসন, পুলিশ-বিজিবি, রেলওয়ে, খাদ্য ভর্তুকী ইত্যাদি প্রধান। তবে পৃথকভাবে শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় সবচাইতে বেশি এবং তা থাকাটাও যুক্তিসঙ্গত।
বাংলাদেশের মূলধনী বাজেটে ব্যয়ের খাতসমূহের মধ্যে কৃষি, গ্রামীণ উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী, যাতায়াত ও যোগাযোগ ইত্যাদি প্রধান। তবে পৃথকভাবে যাতায়াত ও যোগাযোগ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এরপর গুরুত্ব পায় শিল্প, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, গ্রাণীণ উন্নয়ন ইত্যাদি। মূলধনী বাজেটের এ সকল খাতের ব্যয়ের সংস্থান ঘটে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উৎস হতে। রাজস্ব বাজেটের উদ্বৃত্ত, জনগণ ও ব্যাংক থেকে ঋণ সংগ্রহ, ঘাটতি অর্থ সংস্থান ইত্যাদি হচ্ছে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ উৎস। অন্যদিকে, বাহ্যিক উৎসসমূহের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ, সাহায্য, অনুদান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাজেটগুলো পর্যালোচনা করলে দেয়া যায়, এখানে অর্থায়নের উৎস হিসাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (ঘজই) নিয়ন্ত্রিত কর, কর ব্যতীত প্রাপ্তি, অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন, বৈদেশিক ঋণ, বৈদেশিক অনুদান, এনআরবি বহির্ভূত কর রাজস্ব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর রাজস্ব সংগ্রহে মূল্য সংযোজন কর (ঠঅঞ), আমদানি শুল্ক, আয়কর। সম্পূরক শুল্ক ইত্যাদির ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকে।
তাছাড়া, সাম্প্রতিক বাজেটগুলোতে পরিবেশ উন্নয়নে পরিবেশ-বান্ধব কল-কারখানা স্থাপন এবং শিল্প দূষণ রোধে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্জ্য-হ্রাস, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রমে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। দ্রব্যমূল্য, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে বাজারভিত্তিক হস্তক্ষেপ, আমদানি ও উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ বৃদ্ধি, উৎপাদন ও আমদানি খরচ হ্রাস ইত্যাদির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বৈদেশিক সাহায্য কমিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের ওপর জোর হয়েছে, যাতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যবধান হ্রাস করে বৈদেশিক দেনা-পাওনার ক্ষেত্রে ভারসাম্য অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। পাশাপাশি বাজেটে প্রায়শঃ বৈদেশিক বিনিময় হারের স্থিতিশীলতার প্রতি লক্ষ্য রাখে।

তথ্যসূত্র:
১. ড. মোহাম্মদ ইউসুফ আলী; অর্থ, ব্যাংকিং, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সরকারী অর্থব্যবস্থা, জনকল্যাণ প্রকাশনী, ঢাকা।
২. বাংলা উইকিপিডিয়া।

লেখক : মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম শাহীন, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম

Leave a Comment

লগইন অথবা নিবন্ধন করুন

লগইন
নিবন্ধন