ভূমিকা
পবিত্র আল-কুরআনে (د ي ن) থেকে দুটো শব্দ এসেছে। যথাÑ ১. الدَّيْنُ ও ২. الدِّيْنُ। দীন বা দ্বীন (আরবি: الدِّيْنُ بِكَسْرِ الدَّالِ الْمُهْمَلَةِ) আল-কুরআনের একটি প্রধান শব্দ, মৌলিক পদ এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। প্রাচীন আরবি সাহিত্য, জাহিলি যুগ ও আরব বোল-চালে শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইসলামের আগমনের পর শব্দটি আল-কুরআনুল কারীমেও ঠিক অভিন্ন আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে আল-কুরআনে শব্দটি এসব অর্থসমন্বিত এমন একটি পরিভাষা হিসেবে প্রযুজ্য হয়েছে যা মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি-আদর্শের নির্দেশ করে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা আরবি ভাষার প্রামাণ্য অভিধান, আল-কুরআনের তাফসীর ও মহানবী সা.-এর মুখনিসৃত হাদীসের আলোকে শব্দটির মৌলিকত্ব যাচাই, জীবনব্যবস্থা হিসেবে এর পূর্ণাঙ্গতা এবং ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনে তার তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ।
আভিধানিক তত্ত্ব
আরবি ভাষায় ‘দীন’ শব্দটি অসংখ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আভিধানিক মুহাম্মদ মুরতাযা আয-যুবাইদী (১২০৫ হি.) দীনের ২৭ টির মতো অর্থ-তথ্য উল্লেখ করেছেন। পবিত্র আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াত, হাদীস শরীফ ও আরবি গদ্য-পদ্যের উদারহণ টেনে তিনি এসব মানে-মর্ম বর্ণনা করেন। অন্যদিকে আহমদ আসিম এফেন্দি (১২৩৫ হি.) আল-কামুসুল মুহীত-এর তুর্কি অনুবাদে দীনের ৩০ টিরও অধিক অর্থ বর্ণনা করেছেন। আরবি অভিধান ও শব্দকোষসমূহে শব্দটির অর্থব্যঞ্জনা ও ভাবব্যক্তিও ব্যাপক এবং বৈচিত্রপূর্ণ।
শব্দটি বিভিন্নার্থে ব্যবহৃত হয়, ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা দেয়; সমার্থে যেমন ব্যক্ত হয়, ঠিক একই সঙ্গে তার বিপরীতার্থেও ব্যক্তীকৃত হয়। অতএব দীনের এক অর্থ ‘রাজত্ব’ আরেক অর্থ ‘দাসত্ব’ও। দীন এক অর্থে ‘মর্যাদা’ অন্য অর্থে ‘তুচ্ছতা’, এক অর্থে ‘বাধ্য করা’ অন্য অর্থে ‘বশ্যতা স্বীকার’, এক অর্থে ‘স্বভাব-রেওয়াজ’ অন্য অর্থে ‘ইবাদত-উপাসনা’, এক অর্থে ‘প্রভাব-প্রতাপশীলতা’ অন্য অর্থে ‘বিনয়-নমনশীলতা’, এক অর্থে ‘আনুগত্য’ অন্য অর্থে ‘বিদ্রোহ’, এক অর্থে ‘ইসলাম ও তাওহীদ’ অন্য অর্থে ‘সর্বপ্রকার বিশ্বাস-ভক্তি বা উপাসনার নাম’।
শব্দটির মধ্যে এমন পরস্পরিক বিপরীত ও বিসংগত অর্থসমূহের মধ্যে একটি চমৎকার সমন্বয় বিধান করেছেন শায়খ ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ দারায (১৩৭৭ হি.)। তাঁর মতে, শব্দটির বুৎপত্তি ও ক্রিয়ারূপের ব্যবহারিক ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, দৃশ্যমান এই বৈপরীত্যের গভীরে পারস্পরিক সম্বন্ধ এবং দারুন যোগসূত্রও রয়েছে। দীন একটি অর্থবহুল শব্দ, তবে এর মৌলিক অর্থ হচ্ছে তিনটি, অর্থ তিনটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বটে, কিন্তু পারস্পরিক প্রাসঙ্গিক এবং এর প্রথম অর্থের জন্য দ্বিতীয় অর্থ, দ্বিতীয় অর্থের জন্য তৃতীয় অর্থটি অপরিহার্য। তিনি বলেন,
إِنَّ كَلِمَةَ ্রالدِّيْنُগ্ধ تُؤْخَذُ تَارَةً مِنْ فِعْلٍ مُتَعَّدٍ بِنَفْسِهِ: ্রدَانَهُ يَدِيْنُهُগ্ধ، وَتَارَةً مِنْ فِعْلٍ مُتَعَّدٍ بِالَّلَامِ: ্রدَانَ لَهُগ্ধ، وَتَارَةً مِنْ فِعْلٍ مُتَعَّدٍ بِالْبَاءِ: ্রدَانَ بِهِগ্ধ، وِبِاخْتِلَافِ الْاشْتِقَاقِ تَخْتَلِفُ الصُّوْرَةُ الْمَعْنَوِيَّةُ الَّتِيْ تُعْطِيْهَا الصِّيْغَةُ.
‘দীন শব্দটি কখনো সাধারণ সকর্মক ক্রিয়া থেকে গ্রহণ করা হয়: ্রدَانَهُ يَدِيْنُهُগ্ধ, আবার কখনো লাম-সহযুক্ত সকর্মক ক্রিয়া থেকে: ্রدَانَ لَهُগ্ধ। কখনো আবার বা-সহযুক্ত সকর্মক ক্রিয়া থেকে: ্রدَانَ بِهِগ্ধ। অর্থরূপের বৈচিত্র্য মূলত শব্দটির বুৎপত্তিগত বৈভিন্ন্যের কারণেই হয়েছে, যা তার শব্দরূপান্তর দ্বারা প্রকাশ পেয়ে থাকে।’
বিস্তারিত বর্ণনায় তিনি বলেন,
১. ্রدَانَهُ دَيْنًاগ্ধ: একথাটি যখন আমরা বলি, তখন এর অর্থ হচ্ছে, مَلِكَهُ (রাজত্ব, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা), حَكَمَهُ (শাসন), سَاسَهُ (রাজনীতি), دَبَّرَهُ (ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা), قَهَرَهُ وَغَلَبَ عَلَيْهِ وَاسْتَعْلَى (দমন করা, পরাভূত করা; বিজয় লাভ করা; উচ্চ মর্যাদা অধিকার করা, সার্বভৌম ক্ষমতা লাভ করা), حَاسَبَهُ (হিসাব-কিতাব, বিচার-বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন, পর্যালোচনা), قَضَى فِيْ شَأْنِهِ (বিচার, ফায়সালা, রায়), جَازَاهُ وَكَافَأْهُ (প্রতিফল, প্রতিদান; পুরস্কার বা শাস্তি)।
অতএব এ-ব্যবহার অনুযায়ী দীন রাজনীতি ও ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি যেমনÑ দেশ রাষ্ট্র পরিচালনা, দেশ শাসন, শক্তিপ্রয়োগ, দমন, জবাবদেহি ও প্রতিদান ইত্যাদি অর্থ অন্তর্ভুক্ত করে। যেমনÑ مٰلِكِ يَوْمِ الدِّيْنِؕ۰۰۳ অর্থাৎ হিসাব ও প্রতিদান দিবসের অধিপতি। হাদীসে এসেছে, ্রالْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُগ্ধ অর্থাৎ বুদ্ধিমান হচ্ছে সে ব্যক্তি যে নিজের প্রবৃত্তিকে শাসন করে ও নিয়ন্ত্রণ করে। এ-অর্থে শাসক ও বিচারককে الدَّيَّانُ বলা হয়।
২. ্রدَانَ لَهُগ্ধ: একথাটি যখন বলি, তখন এর অর্থ হচ্ছে, أَطَاعَهُ (সে তার আনুগত্য করল), خَضَعَ لَهُ (সে তার বশ্যতা ও বাধ্যতা স্বীকার করল)। এখানে দীন হচ্ছে, অবনতি, আনুগত্য, ইবাদত, খোদাভীরুতা। ্রالدِّيْنُ للهِগ্ধ অর্থাৎ আদেশ আল্লাহরই বা আল্লাহরই বশ্যতা দুটো অর্থই সঠিক শব্দটির। স্পষ্টতই এ-দ্বিতীয় অর্থ প্রথম অর্থের জন্য অপরিহার্য এবং এটি তার জন্য নির্ভরশীল। ্রدَانَهُ، فَدَانَ لَهُগ্ধ অর্থাৎ সে তাকে আনুগত্যে বাধ্য করেছে, ফলে সে তার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে।
৩. ্রدَانَ بِالشَّيْءِগ্ধ: একথাটি যখন বলি, তখন এর অর্থ হচ্ছে, اتَّخَذَهُ دِيْنًا وَمَذْهَبًا (ধর্মমত হিসেবে গ্রহণ, পথ-পদ্ধতি অনুসরণ, মতাদর্শ বেঁচে নেওয়া) অর্থাৎ বিশ্বাস বা অভ্যাসে পরিণত করা কিংবা স্বভাব-চরিত্র গ্রহণ করা। এ-অর্থে দীন হচ্ছে, মতাদর্শ ও পথ-পন্থার নাম, যার ভিত্তিতে মানুষ তার চিন্তা বা কর্মপদ্ধতি পরিচালনা করে।
দীন শব্দের এ ব্যবহারও পূর্বোক্ত দু’অর্থের জন্য আবশ্যক। কারণ রাজত্ব, শাসন ও বিচারের জন্য শাসনতন্ত্র, আইন-কানুন ও বিধিবিধানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, যার ভিত্তিতে মানুষ শাসিত হবে, শাসকের অনুগত হবে এবং পুরস্কৃত বা শাস্তির মুখোমুখি হবে।
বস্তুত আরবদের নিকট الدِّيْنُ শব্দটি দুটো পক্ষের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দেশ করে, যার একটি পক্ষ প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হলে অন্য পক্ষটি তার প্রতি বিনয়াবনত হয়। এখানে প্রথমপক্ষের সাথে দ্বিতীয় পক্ষের সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে আনুগত্য এবং দ্বিতীয় পক্ষের সাথে প্রথম পক্ষের সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে নেতৃত্ব, রাজত্ব ও শাসন। আর উভয়ের মাঝে সমন্বিত যে সম্পর্ক সেটি হচ্ছে শাসনতন্ত্র, সংবিধান ও আইন বা বিধিবদ্ধ নিয়ম। অতএব দীন শব্দটি মূলত আনুগত্যের আবশ্যকতার অর্থ ধারণ করে। প্রথম ব্যবহারে দীন হচ্ছে, আনুগত্যের আবশ্যকীয়তা। দ্বিতীয় ব্যবহারে দীন হচ্ছে, আনুগত্যে বাধ্যবাধকতা। আর তৃতীয় ব্যবহারে দীন হচ্ছে, সেই উৎস যার নীতি অনুসারে আনুগত্যের দায়বদ্ধতা আরোপিত হয়েছে।
আল-কুরআনে দীন শব্দের ব্যবহার
(ক) আভিধানিক অর্থ
দীন একটি অর্থবহুল শব্দ। পবিত্র আল-কুরআন যেহেতু আরবি ভাষায় অবতীর্ণ একটি আসমানি গ্রন্থ স্বাভাবিকভাবে এতে শব্দটি অনুরূপ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে কুরআনবিশারদ ও পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ সুনির্দিষ্ট কিছু অর্থের সবিশেষ উল্লেখ করেছেন। শায়খুল ইসলাম আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী (৫৯৮ হি.) বিভিন্ন তাফসীরকারকের বরাতে আল-কুরআনে দীনের এগারটি অর্থ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,
وَذَكَرَ بَعْضُ الْمُفَسِّرِيْنَ أَنَّ الدِّيْنَ فِي الْقُرْآن عَلَى عَشْرَةِ أَوْجُهٍ:
ক্স أَحَدُهَا: الْإِسْلَامُ، وَمِنْهُ قَوْلُهُ تَعَالَى فِيْ بَرَاءَة: [هُوَ الَّذِيْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰى وَدِيْنِ الْحَقِّ ۙ ۰۰۳۳] {التوبة: ৩৩}، وَمِثْلُهَا فِي الْفَتْحِ.
ক্স وَالثَّانِيْ: التَّوْحِيْدُ، وَمِنْهُ قَوْلُهُ تَعَالَى فِي يُونُس: [دَعَوُا اللّٰهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ١ۚ۬ ۰۰۲۲] {يونس: ২২}، وَفِيْ لَمْ يَكُنْ: [وَمَاۤ اُمِرُوْۤا اِلَّا لِيَعْبُدُوا اللّٰهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ١ۙ۬ ۰۰۵] {البينة: ৫}.
ক্স وَالثَّالِثُ: الْحِسَابُ، وَمِنْهُ قَوْلُهُ تَعَالَى فِي النُّوْرِ: [يَوْمَىِٕذٍ يُّوَفِّيْهِمُ اللّٰهُ دِيْنَهُمُ الْحَقَّ ۰۰۲۵] {النور: ২৫}.
ক্স وَالرَّابِع: الْجَزَاءُ: وَمِنْهُ قَوْلُهُ تَعَالَى فِي الْفَاتِحَة: [مٰلِكِ يَوْمِ الدِّيْنِؕ۰۰۳] {الفاتحة: ৩}، وَفِي الصَّافَاتِ: [هٰذَا يَوْمُ الدِّيْنِ۰۰۲۰] {الصافات: ২০}، وَفِي الْمُطَفِّفِيْنَ: [الَّذِيْنَ يُكَذِّبُوْنَ بِيَوْمِ الدِّيْنِؕ۰۰۱۱] {المطففين: ১১}.
ক্স وَالْخَامِسُ: الْحُكْمُ، وَمِنْهُ قَوْلُهُ تَعَالَى فِي يُوسُف: [مَا كَانَ لِيَاْخُذَ اَخَاهُ فِيْ دِيْنِ الْمَلِكِ ؕ ۰۰۷۶] {يوسف: ৭৬}.
ক্স وَالسَّادِس: الطَّاعَةُ، وَمِنْهُ قَوْلُهُ تَعَالَى فِيْ سُورَةِ التَّوْبَةِ: [وَلَا يَدِيْنُوْنَ دِيْنَ الْحَقِّ ؒ۰۰۲۹ {التوبة: ২৯}، وَقَالَ ابْنُ قُتَيْبَةَ: لَا يُطِيْعُوْنَهُ.
ক্স وَالسَّابِعُ: الْعَادَةُ، وَمِنْهُ قَوْلُهُ تَعَالَى فِي الْحُجَرَاتِ: [قُلْ اَتُعَلِّمُوْنَ اللّٰهَ بِدِيْنِكُمْؕ ۰۰۱۶ {الحجرات: ১৬}.
ক্স وَالثَّامِنُ: الْملَّةُ، وَمِنْهُ قَوْلُهُ تَعَالَى فِيْ لَمْ يَكُنْ: [وَذٰلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِؕ۰۰۵] {البينة: ৫}، أَي: وَذَلِكَ دِيْنُ الْملَّةِ الْمُسْتَقِيْمَةَ.
ক্স وَالتَّاسِعُ: الْحُدُوْدُ، وَمِنْهُ قَوْلُهُ تَعَالَى فِي النُّوْرِ: [وَلَا تَاْخُذْكُمْ بِهِمَا رَاْفَةٌ فِيْ دِيْنِ اللّٰهِ ۚ ۰۰۲]
{النور: ২}.
ক্স وَالْعَاشِرُ: الْعَدَدُ، وَمِنْهُ قَوْلُهُ تَعَالَى فِيْ سُوْرَة التَّوْبَةِ: [مِنْهَاۤ اَرْبَعَةٌ حُرُمٌ١ؕ ذٰلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ١ۙ۬ ۰۰۳۶] {التوبة: ৩৬}، أَيِ: الْعَدَدُ الصَّحِيْحُ.
ক্স وَقَدْ أَلْحَقَ بَعْضُهُمْ وَجْهًا حَادِيْ عَشَرَ، فَقَالَ: وَالدِّيْنُ: الْقُرْآنُ، وَمِنْه قَوْلُهُ تَعَالَى: [اَرَءَيْتَ الَّذِيْ يُكَذِّبُ بِالدِّيْنِؕ۰۰۱] {المأمون: ১}.
১. الْإِسْلَامُ (ইসলাম): আল্লাহ তাআলা সুরা বারাআতে ইরশাদ করেন, ‘তিনিই প্রেরণ করেছেন তাঁর রাসুলকে হিদায়েত ও সত্য দীন-সহকারে।’ সুরা আল-ফাতাহেও আল্লাহ অনুরূপভাবে ইরশাদ করেছেন। [এ-অর্থে ইমাম রাগিব আল-আসবাহানী (৫০২ হি.) বলেন,
اَفَغَيْرَ دِيْنِ اللّٰهِ يَبْغُوْنَ ۰۰۸۳ يَعْنِي الْإِسْلَامَ، لِقَوْلِهِ: وَمَنْ يَّبْتَغِ غَيْرَ الْاِسْلَامِ دِيْنًا فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْهُۚ ۰۰۸۵ وَعَلَى هَذَا قَوْلِهِ: هُوَ الَّذِيْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰى وَدِيْنِ الْحَقِّ ۙ ۰۰۳۳
‘তারা কি আল্লাহর দীনের পরিবর্তে অন্য দীন তালাশ করছে?’ অর্থাৎ ইসলামের পরিবর্তে। কেননা আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, ‘যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম তালাশ করে কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না। আর আল্লাহর এ-বাণীর: ‘তিনিই তাঁর রাসুলকে হিদায়ত ও সত্য দীন সহকারে প্রেরণ করেছেন’ থেকে এটিই উদ্দেশ্য। ]
২. التَّوْحِيْدُ (আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস): আল্লাহ তাআলা সুরা ইউনুসে ইরশাদ করেন, ‘তারা একত্ববাদে একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহকে ডাকে।’ সুরা লাম ইয়াকুনে আরও ইরশাদ করেন, ‘তাদেরকে এছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা একত্ববাদে একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে।’
৩. الْحِسَابُ (হিসাব): আল্লাহ তাআলা সুরা আন-নুরে ইরশাদ করেন, ‘সেদিন আল্লাহ তাদের পুরোপুরি হিসাব নেবেন।’ [অনেকেই নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
ءَاِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا وَّعِظَامًا ءَاِنَّا لَمَدِيْنُوْنَ۰۰۵۳ أَيْ مُحَاسَبُوْنَ.
‘আমরা যখন মরে যাবো এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হবো তখনও কি আমরা হিসাব-নিকাশের মুখোমুখী হবো?’ ]
৪. الْجَزَاءُ (প্রতিফল, প্রতিদান, পুরস্কার, শাস্তি): আল্লাহ তাআলা সুরা আন-নুরে ইরশাদ করেন, ‘যিনি প্রতিদান দিবসের অধিপতি।’ সুরা আস-সাফ্ফাতে ইরশাদ করেন, ‘এটাই তো প্রতিফল দিবস।’ সুরা আল-মুতাফফিফীনে আরও ইরশাদ করেন, ‘যারা প্রতিফল দিবসকে মিথ্যারোপ করে।’ [পবিত্র আল-কুরআনে কাফিরদের স্বগোক্তি উল্লেখ করে ইরশাদ হয়েছে,
ءَاِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا وَّعِظَامًا ءَاِنَّا لَمَدِيْنُوْنَ۰۰۵۳ أَيْ مَجْزِيُّوْنَ.
‘আমরা যখন মরে যাবো এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হবো তখনও কি আমরা প্রতিফলপ্রাপ্ত হবো?’ ]
৫. الْحُكْمُ (শাসন, আইন, বিচার): আল্লাহ তাআলা সুরা ইউসুফে ইরশাদ করেন, ‘সে বাদশার আইনে আপন ভাইকে কখনো দাসত্বে দিতে পার না।’
৬. الطَّاعَةُ (আনুগত্য, বশ্যতা, বাধ্যতা): আল্লাহ তাআলা সুরা ইউসুফে ইরশাদ করেন, ‘এবং সত্য দীন গ্রহণ করে না।’ ইবনে কুতাইবা বলেন, ‘অর্থাৎ আনুগত্য করে না।’ [এ-অর্থে ইমাম রাগিব আল-আসবাহানী (৫০২ হি.) বলেন,
وَمَنْ اَحْسَنُ دِيْنًا مِّمَّنْ اَسْلَمَ وَجْهَهٗ لِلّٰهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ ؕ ۰۰۱۲۵ أَيْ: طَاعَةً.
‘যে আল্লাহর নির্দেশের সামনে মস্তক অবনত করে সৎকাজে নিয়োজিত থাকে তার চাইতে উত্তম আনুগত্য কার?’ ]
৭. الْعَادَةُ (অভ্যাস-স্বভাব): আল্লাহ তাআলা সুরা আল-হুজরাতে ইরশাদ করেন, ‘বলুন: তোমরা কি তোমাদের ধর্মপরায়ণতা সম্পর্কে আল্লাহকে অবহিত করছ?।’
৮. الْملَّةُ (মতবাদ, মতাদর্শ, জাতি): আল্লাহ তাআলা সুরা ইউসুফে ইরশাদ করেন, ‘এটিই সঠিক দীন।’ অর্থাৎ এটিই সরল জীবনাদর্শ।
৯. الْحُدُوْدُ (শাস্তি, দণ্ড, বিধান): আল্লাহ তাআলা সুরা আন-নুরে ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর বিধান কার্যকরকরণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়।’
১০. الْعَدَدُ (সংখ্যা, গণনা): আল্লাহ তাআলা সুরা আত-তাওবায় ইরশাদ করেন, এর মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।’ অর্থাৎ সহজ হিসাব ও সঠিক গণন।
অনেকে আরও একটি অর্থের উল্লেখ করেছেন,
১১. الْقُرْآنُ (কুরআন): আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে দীনকে মিথ্যা বলে?’ অর্থাৎ কুরআনকে।
১২. الْمُلْكُ (মালিকানা, কর্তৃত্ব, রাজত্ব, শাসনক্ষমতা) : নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে যিয়াদ আল-র্ফারা (২০৭ হি.) বলেন,
فَلَوْ لَاۤ اِنْ كُنْتُمْ غَيْرَ مَدِيْنِيْنَۙ۰۰۸۶ أَيْ غَيْرَ مَمْلُوْكِيْنَ.
‘যদি তোমারা কর্তৃত্বাধীন না হওয়াই ঠিক হয়।’
১৩. الْقَضَاءُ (বিচার, রায়, ফায়সালা, মীমাংসা) : এ-অর্থে হযরত কাতাদা ইবনে দি‘আমা (১১৮ হি.) নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন যে,
مَا كَانَ لِيَاْخُذَ اَخَاهُ فِيْ دِيْنِ الْمَلِكِ ؕ ۰۰۷۶ أَيْ قَضَائِهِ.
‘সে বাদশার বিচারে আপন ভাইকে কখনো দাসত্বে দিতে পার না।’
১৪. الشَّرِيْعَةُ وَالْقَانُوْنُ (শরীয়ত, আইন-কানুন) : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
مَا كَانَ لِيَاْخُذَ اَخَاهُ فِيْ دِيْنِ الْمَلِكِ ؕ ۰۰۷۶
‘সে বাদশার আইনে আপন ভাইকে কখনো দাসত্বে দিতে পার না।’
(খ) পারিভাষিক অর্থ গঠন
আরবিতে দীন শব্দটির অর্থব্যঞ্জনা ও ভাবব্যক্তিও ব্যাপক এবং বৈচিত্রপূর্ণ। শব্দটি বিভিন্নার্থে ব্যবহৃত হয়, ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা দেয়; সমার্থে যেমন ব্যক্ত হয় ঠিক একই সঙ্গে তার বিপরীতার্থেও ব্যক্তীকৃত হয়। তবে শব্দটির এমন পরস্পরিক বিপরীত ও বিসংগত অর্থসমূহের গভীরে এক চমৎকার সমন্বয়ও রয়েছে। আরবদের নিকট দীন শব্দটি মূলত দুটো পক্ষের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দেশ করে, যার একটি পক্ষ প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হলে অন্য পক্ষটি তার প্রতি বিনয়াবনত হবে। এখানে প্রথমপক্ষের সাথে দ্বিতীয় পক্ষের সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে আনুগত্য এবং দ্বিতীয়পক্ষের সাথে প্রথম পক্ষের সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে নেতৃত্ব, রাজত্ব ও শাসন। আর উভয়ের মাঝে সমন্বিত যে সম্পর্ক সেটি হচ্ছে শাসনতন্ত্র, সংবিধান ও আইন বা বিধিবদ্ধ নিয়ম এবং এ-তিন সম্পর্কের ফলস্বরূপ কর্মফল, প্রতিফল ও প্রতিদান নির্ধারিত হবে।
শায়খ ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ দারায (১৩৭৭ হি.) তিন এবং সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (১৩৯৯ হি.) চার ক্যাটারিতে দীনের অর্থসমূহকে বিন্যাস করেছেন। যথাÑ (১) প্রভাব-প্রতিপত্তি, (২) আনুগত্য-বিনয়াবনত, (৩) নিয়ম-নীতি ও (৪) প্রতিদান-প্রতিফল। এ-অর্থচারটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বটে, কিন্তু পারস্পরিক প্রাসঙ্গিক এবং এর প্রথম অর্থের জন্য দ্বিতীয় অর্থ, দ্বিতীয় অর্থের জন্য তৃতীয় অর্থটি এবং তৃতীয় অর্থের জন্য চতুর্থ অর্থটি অপরিহার্য। পবিত্র আল-কুরআনে ‘দীন’ শব্দটি একটি বিশেষ পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং উপর্যুক্ত চারটি অংশ নিয়ে সেই পরিভাষা গঠিত:
১. সার্বভৌম ক্ষমতা:
(ক) আল্লাহর সার্বভৌমত্ব,
(খ) আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবী মানুষের রাজনীতিক নেতৃত্ব,
২. আনুগত্য:
(ক) আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি,
(খ) রাজনীতিক নেতৃত্বের আনুগত্য,
৩. নীতিমালা: আকীদা-শরীয়ত-আইন,
৪. প্রতিফল:
(ক) ইহকালীন: বিচারব্যবস্থা,
(খ) পরকালীন: হিসাব-কিতাব, পুরস্কার বা শাস্তি।
আল-কুরআনে কখনো প্রথম অর্থে, কখনো দ্বিতীয় অর্থে দীন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো তৃতীয় অর্থে, আবার কখনো চতুর্থ অর্থে, কখনো দীন বলতে চার অংশের পুরো ব্যবস্থাটিই গ্রহণ করেছে।
(খ) পারিভাষিক অর্থ
প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থ:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اَللّٰهُ الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ الْاَرْضَ قَرَارًا وَّالسَّمَآءَ بِنَآءً وَّ صَوَّرَكُمْ فَاَحْسَنَ صُوَرَكُمْ وَرَزَقَكُمْ مِّنَ الطَّيِّبٰتِ١ؕ ذٰلِكُمُ اللّٰهُ رَبُّكُمْ١ۖۚ فَتَبٰرَكَ اللّٰهُ رَبُّ الْعٰلَمِيْنَ۰۰۶۴ هُوَ الْحَيُّ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ فَادْعُوْهُ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ١ؕ اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ۰۰۶۵
‘আল্লাহ, পৃথিবীকে করেছেন তোমাদের জন্যে বাসস্থান, আকাশকে করেছেন ছাদ এবং তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর তোমাদের আকৃতি সুন্দর করেছেন এবং তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন পরিচ্ছন্ন রিযিক। তিনি আল্লাহ, তোমাদের পালনকর্তা। বিশ্বজগতের পালনকর্তা, আল্লাহ বরকতময়। তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্য নিবেদিত করে তোমরা তাঁকে ডাকো। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহর জন্য।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
قُلْ اِنِّيْۤ اُمِرْتُ اَنْ اَعْبُدَ اللّٰهَ مُخْلِصًا لَّهُ الدِّيْنَۙ۰۰۱۱ وَ اُمِرْتُ لِاَنْ اَكُوْنَ اَوَّلَ الْمُسْلِمِيْنَ۰۰۱۲ قُلْ اِنِّيْۤ اَخَافُ اِنْ عَصَيْتُ رَبِّيْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ۰۰۱۳ قُلِ اللّٰهَ اَعْبُدُ مُخْلِصًا لَّهٗ دِيْنِيْۙ۰۰۱۴ فَاعْبُدُوْا مَا شِئْتُمْ مِّنْ دُوْنِهٖ١ؕ قُلْ اِنَّ الْخٰسِرِيْنَ الَّذِيْنَ خَسِرُوْۤا اَنْفُسَهُمْ وَاَهْلِيْهِمْ يَوْمَ الْقِيٰمَةِ١ؕ اَلَا ذٰلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِيْنُ۰۰۱۵ لَهُمْ مِّنْ فَوْقِهِمْ ظُلَلٌ مِّنَ النَّارِ وَمِنْ تَحْتِهِمْ ظُلَلٌ١ؕ ذٰلِكَ يُخَوِّفُ اللّٰهُ بِهٖ عِبَادَهٗ١ؕ يٰعِبَادِ فَاتَّقُوْنِ۰۰۱۶ وَالَّذِيْنَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوْتَ اَنْ يَّعْبُدُوْهَا وَاَنَابُوْۤا اِلَى اللّٰهِ لَهُمُ الْبُشْرٰى ١ۚ فَبَشِّرْ عِبَادِۙ۰۰۱۷
‘বলুন, আমি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি। আরও আদিষ্ট হয়েছি, সর্বপ্রথম নির্দেশ পালনকারী হওয়ার জন্যে। বলুন, আমি আমার পালনকর্তার অবাধ্য হলে এক মহাদিবসের শাস্তির ভয় করি। বলুন, আমি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ তা’আলারই ইবাদত করি। অতএব তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইচ্ছা তার ইবাদত কর। বলুন, কিয়ামতের দিন তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যারা নিজেদের ও পরিবারবর্গের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জেনে রাখ, এটাই সুস্পষ্ট ক্ষতি। তাদের জন্যে ওপর দিক থেকে এবং নীচের দিক থেকে আগুনের মেঘমালা থাকবে। এ শাস্তি দ্বারা আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করেন যে, হে আমার বান্দাগণ! আমাকে ভয় কর। যারা শয়তানি শক্তির পূজা-অর্চনা থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহঅভিমুখী হয় তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দিন আমার বান্দাদেরকে।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اِنَّاۤ اَنْزَلْنَاۤ اِلَيْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ فَاعْبُدِ اللّٰهَ مُخْلِصًا لَّهُ الدِّيْنَؕ۰۰۲ اَلَا لِلّٰهِ الدِّيْنُ الْخَالِصُؕ ۰۰۳
‘আমি আপনার প্রতি এ-কিতাব যথার্থরূপে নাযিল করেছি। অতএব আল্লাহর জন্য দীনকে নিবেদিত করে তাঁর ইবাদত করুন। জেনে রাখুন, দীন একনিষ্টভাবে আল্লাহরই জন্য নিবেদিত।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَلَهٗ مَا فِي السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَلَهُ الدِّيْنُ وَاصِبًا١ؕ اَفَغَيْرَ اللّٰهِ تَتَّقُوْنَ۰۰۵۲
‘যা কিছু নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে আছে তা তাঁরই, দীন একান্তভাবে তাঁরই জন্য নিবেদিত। তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করবে?’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اَفَغَيْرَ دِيْنِ اللّٰهِ يَبْغُوْنَ وَلَهٗۤ اَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ طَوْعًا وَّكَرْهًا وَّاِلَيْهِ يُرْجَعُوْنَ۰۰۸۳
‘তারা কি আল্লাহর দীনের পরিবর্তে অন্য দীন তালাশ করছে? আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, তাঁরই অনুগত হবে এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাবে।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَمَاۤ اُمِرُوْۤا اِلَّا لِيَعْبُدُوا اللّٰهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ١ۙ۬ حُنَفَآءَ ؕ۰۰۵
‘তাদেরকে এছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে দীনকে আল্লাহর নিবেদিত করে তাঁর ইবাদত করবে।’
এসব আয়াতে সার্বভৌম ক্ষমতা এবং সে ক্ষমতার অনুকুলে তাঁর বন্দেগি ও আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ার অর্থে দীন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
তৃতীয় অর্থ:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
قُلْ يٰۤاَيُّهَا النَّاسُ اِنْ كُنْتُمْ فِيْ شَكٍّ مِّنْ دِيْنِيْ فَلَاۤ اَعْبُدُ الَّذِيْنَ تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ وَلٰكِنْ اَعْبُدُ اللّٰهَ الَّذِيْ يَتَوَفّٰىكُمْ١ۖۚ وَاُمِرْتُ اَنْ اَكُوْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَۙ۰۰۱۰۴ وَاَنْ اَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّيْنِ حَنِيْفًا١ۚ وَلَا تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ۰۰۱۰۵
‘বলে দাও, হে মানবকুল! তোমরা যদি আমার দীনের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে থাক তবে (জেনে রেখ) আমি তাদের ইবাদত করি না যাদের ইবাদত তোমরা কর আল্লাহ ব্যতীত। কিন্তু আমি ইবাদত করি আল্লাহর, যিনি তুলে নেন তোমাদেরকে। আর আমার প্রতি নির্দেশ হয়েছে যাতে আমি ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত থাকি। আর যেন সোজা দীনের প্রতি মুখ করি সরল হয়ে এবং যেন মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত না হই।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اِنِ الْحُكْمُ اِلَّا لِلّٰهِ١ؕ اَمَرَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِيَّاهُ١ؕ ذٰلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ ۰۰۴۰
‘আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না। এটিই সঠিক দীন।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَلَهٗ مَنْ فِي السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ١ؕ كُلٌّ لَّهٗ قٰنِتُوْنَ۰۰۲۶ وَ هُوَ الَّذِيْ يَبْدَؤُا الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيْدُهٗ وَ هُوَ اَهْوَنُ عَلَيْهِ١ؕ وَلَهُ الْمَثَلُ الْاَعْلٰى فِي السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ١ۚ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُؒ۰۰۲۷ ضَرَبَ لَكُمْ مَّثَلًا مِّنْ اَنْفُسِكُمْ١ؕ هَلْ لَّكُمْ مِّنْ مَّا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ مِّنْ شُرَكَآءَ فِيْ مَا رَزَقْنٰكُمْ فَاَنْتُمْ فِيْهِ سَوَآءٌ تَخَافُوْنَهُمْ كَخِيْفَتِكُمْ اَنْفُسَكُمْ١ؕ كَذٰلِكَ نُفَصِّلُ الْاٰيٰتِ لِقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ۰۰۲۸ بَلِ اتَّبَعَ الَّذِيْنَ ظَلَمُوْۤا اَهْوَآءَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ١ۚ فَمَنْ يَّهْدِيْ مَنْ اَضَلَّ اللّٰهُ١ؕ وَ مَا لَهُمْ مِّنْ نّٰصِرِيْنَ۰۰۲۹ فَاَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّيْنِ حَنِيْفًا١ؕ فِطْرَتَ اللّٰهِ الَّتِيْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا١ؕ لَا تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللّٰهِ١ؕ ذٰلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ١ۙۗ وَلٰكِنَّ اَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُوْنَۗۙ۰۰۳۰
‘নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সব তাঁরই। সবাই তাঁর আজ্ঞাবহ। তিনিই প্রথমবার সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনয়ন করেন, অতঃপর তিনি সৃষ্টি করবেন। এটি তাঁর জন্য সহজ। আকাশ ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই এবং তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য থেকে একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন, তোমাদের আমি যে রুযী দিয়েছি, তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীরা কি তাতে তোমাদের সমান সমান অংশীদার? তোমরা কি তাদেরকে সেরূপ ভয় কর, যেরূপ নিজেদের লোককে ভয় কর? এভাবে আমি সমঝদার সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলি বিস্তারিত বর্ণনা করি। বরং যারা যে-ইনসাফ, তারা অজ্ঞানতাবশত তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে থাকে। অতএব আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে কে বোঝাবে? তাদের কোনো সাহায্যকারী নেই। তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রেখ। এটিই আল্লাহর প্রকৃতি, যার ওপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটিই সঠিক দীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اَلزَّانِيَةُ وَالزَّانِيْ فَاجْلِدُوْا كُلَّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ١۪ وَّلَا تَاْخُذْكُمْ بِهِمَا رَاْفَةٌ فِيْ دِيْنِ اللّٰهِ اِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَ الْيَوْمِ الْاٰخِرِ١ۚ وَ لْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَآىِٕفَةٌ مِّنَ الْمُؤْمِنِيْنَ۰۰۲
‘ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
كَذٰلِكَ كِدْنَا لِيُوْسُفَ١ؕ مَا كَانَ لِيَاْخُذَ اَخَاهُ فِيْ دِيْنِ الْمَلِكِ اِلَّاۤ اَنْ يَّشَآءَ اللّٰهُؕ ۰۰۷۶
‘এমনিভাবে আমি ইউসুফকে কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলাম। সে বাদশাহর আইনে আপন ভাইকে কখনও দাসত্বে দিতে পারত না, কিন্তু আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَكَذٰلِكَ زَيَّنَ لِكَثِيْرٍ مِّنَ الْمُشْرِكِيْنَ قَتْلَ اَوْلَادِهِمْ شُرَكَآؤُهُمْ لِيُرْدُوْهُمْ وَلِيَلْبِسُوْا عَلَيْهِمْ دِيْنَهُمْؕ ۰۰۱۳۷
‘এভাবে অনেক মুশরিকের দৃষ্টিতে তাদের উপাস্যরা সন্তান হত্যাকে সুশোভিত করে দিয়েছে যেন তারা তাদেরকে বিনষ্ট করে দেয় এবং তাদের দীনকে তাদের কাছে বিভ্রান্ত করে দেয়।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اَمْ لَهُمْ شُرَكٰٓؤُا شَرَعُوْا لَهُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا لَمْ يَاْذَنْۢ بِهِ اللّٰهُؕ ۰۰۲۱
‘তাদের কি এমন শরীক দেবতা আছে, যারা তাদের জন্য সেই দীনের অনুরূপ তৈরি করেছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِؒ۰۰۶
‘তোমাদের জন্য তোমাদের দীন আর আমার জন্য আমার দীন।’
এসব আয়াতে দীনের অর্থ আইন-বিধান, নিয়ম-কানুন, শরীয়ত, পথ-পন্থা এবং সেসব চিন্তা ও কর্মপন্থা যা মানুষ মেনে জীবন যাপন করে।
চতুর্থ অর্থ:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اِنَّمَا تُوْعَدُوْنَ لَصَادِقٌۙ۰۰۵ وَّاِنَّ الدِّيْنَ لَوَاقِعٌؕ۰۰۶
‘তোমাদের প্রদত্ত ওয়াদা অবশ্যই সত্য। ইনসাফ অবশ্যম্ভাবী।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اَرَءَيْتَ الَّذِيْ يُكَذِّبُ بِالدِّيْنِؕ۰۰۱ فَذٰلِكَ الَّذِيْ يَدُعُّ الْيَتِيْمَۙ۰۰۲ وَلَا يَحُضُّ عَلٰى طَعَامِ الْمِسْكِيْنِؕ۰۰۳
‘আপনি কি দেখেছেন তাকে যে বিচারদিবসকে মিথ্যা বলে ? এই সেই ব্যক্তি যে এতিমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং মিসকিনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না।’
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَمَاۤ اَدْرٰىكَ مَا يَوْمُ الدِّيْنِۙ۰۰۱۷ ثُمَّ مَاۤ اَدْرٰىكَ مَا يَوْمُ الدِّيْنِؕ۰۰۱۸ يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِّنَفْسٍ شَيْـًٔا١ؕ وَالْاَمْرُ يَوْمَىِٕذٍ لِّلّٰهِؒ۰۰۱۹
‘আপনি জানেন, বিচার-দিবস কি? অতঃপর আপনি জানেন, বিচার-দিবস কী? যেদিন কেউ কারও কোনো উপকার করতে পারবে না এবং সেদিন সব কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর।’
এসব আয়াতে দীন শব্দটি হিসাব-নিকাশ, ফায়সালা ও কর্মফল অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
উপসংহার
অভ্যাস, স্বভাব, গুণ-বৈশিষ্ট্য, রীতি-রেওয়াজ ইত্যাদি অর্থে বাংলায় ‘ধর্ম’ ও দীনের আভিধানিক তত্ত্ব কিছু সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও প্রভাব, আনুগত্য, বিচারব্যবস্থা, শাসন, রাজনীতি ও হিসাব-কিতাব ইত্যাদির মতো ব্যাপক অর্থ ধর্মে নেই। আরবি আভিধানিক তত্ত্ব, পবিত্র কুরআন-হাদীসের আলোকে এটি প্রমাণিত হয় যে, দীন একটি ব্যাপকভিত্তিক ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা নাম। সেক্ষেত্রে প্রচলিত ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী ‘ধর্ম’ শব্দটি দীনের পরিপূর্ণ অর্থ বহন করে না, এটি তার সঠিক অনুবাদ কিংবা প্রতিশব্দ হতে পারে না।
লেখক : মু. সগির আহমদ চৌধুরী