আজ ২৬শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ সোমবার | ২৭শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি | ১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এখন সময়- রাত ২:২৯

আজ ২৬শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ সোমবার | ২৭শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি | ১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জার্মান থেকে কোরিয়া; বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণ

বলা চলে সাপে নেউলে সম্পর্ক। পারলে মুহুর্তের মধ্যে একে অপরকে ধ্বংস করে দেয়। প্রতিনিয়ত চলে হুমকি পাল্টা হুমকি। দ¶িণ কোরিয়া বনাম উত্তর কোরিয়ার বাকযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়ায় প্রতিমুহুর্ত। বাকযুদ্ধ আর পরমানু অস্ত্রের মহড়ায় শঙ্কা হয় কখন যেন যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলে দুই কোরিয়া। ১৯৫০ সালে শুরু হওয়া বিভক্ত দুই কোরিয়ার সামরিক যুদ্ধ ১৯৫৩ সালে যুদ্ধ বিরতি চুক্তির মাধ্যমে বন্ধ হলেও সামান্য সময়ের জন্যও যুদ্ধ যুদ্ধ মনোভাব দূর হয়নি কোরিয়া উপদ্বীপ থেকে। সম্প্রতি দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা সংঘাত ভুলে সেই দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠক কিছুটা বিস্ময় এবং অবাক করার মতোই। শুধুমাত্র বৈঠক করেছে তা নয়; পরমানু অস্ত্র নিস্ক্রিয়করণে দুই কোরিয়া ঐক্যমতে পৌঁছেছে। ফলে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং আনের দ¶িণ কোরিয়া সফর এখন অব দ্যা ওয়ার্ল্ডে পরিণত হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে কোরিয়া রাষ্ট্রের জন্ম। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজবংশ দেশটি শাসন করে। ১৯১০ সালে দেশটি প্রথম জাপানিদের দখলে চলে যায়। ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত কোরিয়া জাপানিদের দখলেই ছিল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘মিত্রশক্তি’র অন্যতম দুই পরাশক্তির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েতে ইউনিয়নের আঙ্গুলিতে দুটি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয় অবিভক্ত কোরিয়া। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টে¤^র জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধ পরিচালনা ও ইউরোপে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে ইতালির সাথে মিত্রজোট গঠন করে জামার্নি। এই মিত্রজোটই মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম প¶ তথা ‘অ¶শক্তি’।
১৯৪১ সালের জুন মাসে অ¶শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। ‘অ¶শক্তি’র প্রতিরোধে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মিলে গড়ে উঠে ‘মিত্রশক্তি’। ১৯৪১ সালের ডিসে¤^রে জাপান অ¶শক্তিতে যোগ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করে। ফলশ্রæতিতে ‘মিত্রশক্তি’তে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে চীনের সাথে জাপানের যুদ্ধ চলছিলো ১৯৩০ সাল থেকেই। জাপানের মোকাবেলায় চীনও যোগ দেয় ‘মিত্রশক্তি’তে। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ‘মিত্রশক্তি’ আর ‘অ¶শক্তি’র পাল্টাপাল্টি যুদ্ধই মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪৫ সালে জার্মান এবং জাপানিদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানিদের আত্মসমর্পনে দখলমুক্ত কোরিয়া নিয়ে অঘোষিত স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত হয় মিত্রশক্তির চালকের আসনে উঠে আসা যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েতে ইউনিয়ন। ফলশ্রুতিতে বিভক্ত হয়ে যায় অবিভক্ত কোরিয়া। জন্ম নেয় নতুন দুটি রাষ্ট্র। বিভক্ত কোরিয়ার দ¶িণ অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে চলে যায়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত দ¶িণ কোরিয়া মার্কিনিদের প্রভাব বলয়ে অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া সোভিয়েতের সমাজতন্ত্রী আদর্শে পরিচালিত চীন এবং রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে অবস্থান করছে।
বর্তমান জার্মান রাষ্ট্রের জন্ম খ্রিস্ট্রপূর্ব ৮৪৩ অব্দে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে একাধিকবার ভাঙা-গড়ার পর ১৮৭১ সালে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ জার্মান প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় জার্মানিতে শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর মিত্রশক্তির চার দেশ যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানিকে চারটি ভাগে ভাগ করে। ব্রিটিশ, ফরাসি, মার্কিনিদের দখলে থাকে পশ্চিম জার্মানের আলাদা তিনটি অঞ্চল। পূর্ব জার্মান থাকে সোভিয়েতের দখলে। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ‘মিত্রশক্তি’তে ফাটল দেখা দিলে সোভিয়েত ও পশ্চিমাদের প্রভাব কমে যায়। এই সুযোগে পশ্চিমের তিনটি অঞ্চল মিলে গঠন হয় পশ্চিম জার্মান এবং সোভিয়েত অঞ্চলে গঠন হয় জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র তথা পূর্ব জার্মান। পশ্চিমাদের ছোঁয়ায় পশ্চিম জার্মানে অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও শিল্প সমৃদ্ধিতে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। ফলশ্রুতিতে উন্নত জীবন-যাপনের আশায় পূর্ব জার্মানির নাগরিকরা অর্থনীতি ও শ্ল্পি সমৃদ্ধ পশ্চিম জার্মানিতে অভিবাসী হতে শুরু করে। ফলে বাধ্য হয়ে ১৯৬১ সালে পূর্ব জার্মান সরকার বার্লিন প্রাচীরের একটি দেয়াল তুলে দেয়। এতে করে দুই জামার্নির ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও রীতিনীতির মিলন এবং যোগাযোগ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে। পর্যায়ক্রমে ১৯৯০ সাল দুই জার্মানি চুড়ান্তভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি মুছতে ঐক্যবদ্ধ জার্মান আগ্রাসী নীতি পরিহার করে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং বিশ্ব দরবারে নিজেদেরকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মনোনিবেশ করে। বিজয়ী মিত্র স¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরাও বিভিন্ন কারণে নিজেদের গুটিয়ে নেয় আগ্রাসী মনোভাব ও কর্মকাণ্ড থেকে। অন্যদিকে সোভিয়েত পতনের পর আধুনিক শক্তিশালী রাশিযার জন্ম হলেও সোভিয়েতের বিশাল স¤্রাজ্যের পতনে তা অর্জনে রাশিয়াকে যথেষ্ট সময় এবং বেগ পোহাতে হয়। ফলে শক্তিশালী প্রতিদ্ধ›দ্বীহীন খালি মাঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠে বিশ্বরাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক শক্তি।
সম্প্রতি দুই কোরিয়ার বৈঠকের পর গুঞ্জন শুরু হয়েছে বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণের। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই এই গুঞ্জনটা শুরু হয়েছিলো। মূলত দুই কোরিয়ার বৈঠক তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কেননা জার্মানিদের থেকে শি¶া নিয়ে দুই কোরিয়া যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে জার্মানিদের নীতি অবল¤^নকরে তাহলে বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রণ শক্তি যে অন্য দিকে মোড় নিবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মার্কিনিদের প্রভাব কমে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পাবে বিষয়টা তখন এমন নাও হতে পারে। কেননা, আগ্রাসন এবং বিভাজনের নীতি ছেড়ে দুই কোরিয়া নিজেদের শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে মনোনীবেশ করলে মার্কিনিদের প্রভাব কমলেও এই অঞ্চলে (এশিয়া) রাশিয়ার প্রভাব বাড়বে না। বরং এক একটা শক্তিশালী জার্মানি আর কোরিয়াই হয়ে উঠতে পারে বিশ্বরাজনীতির নতুন কোনো নিয়ন্ত্রক অথবা নিয়ামক শক্তি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কোরিয়া কী জার্মানিদের দেখানো পথে হাঁটবে নাকি নতুন কোনো রাস্তা তৈরি করবে। এই প্রশ্নটার বড় কারণ দুই কোরিয়া ঐক্যবদ্ধ হলেও মার্কিনিদের বলয়ে থেকে যাবার সম্ভাবনাটা বেশ প্রবল। কেননা, পশ্চিম জার্মান মার্কিনি এবং পশ্চিমা শক্তির ছোঁয়ায় অর্থনীতি ও শিল্প সমৃদ্ধিতে উন্নতি সাধন করলেও ঐক্যবদ্ধ জার্মান গঠনের পর পশ্চিমাদের গোলামি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু দুই কোরিয়া একীভুত হলেও পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট অপে¶কৃত শক্তিশালী ও উন্নত দ¶িণ কোরিয়া মার্কিনিদের বলয় থেকে বেরিয়ে আসবে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না। কারণ, দুই কোরিয়ার মিলনের যে ¯^প্নটা কোরিয়া উপদ্বীপে দেখা দিয়েছে তার পুরো কৃতিত্বটা ¯^য়ং দ¶িণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন নিজেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়ে দিচ্ছেন। দ¶িণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন এ কথা প্রকাশ্যেই বলেছেন, উত্তরের সাথে এই শান্তি আলোচনা হবার পেছনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বড় কৃতিত্ব পাওনা আছে। তার কথায় মার্কিন-নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা ও চাপের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে ট্রাম্প নিজেও কৃতিত্বটা নিজের দাবি করছেন। ট্রাম্প তার টুইটার একাউন্টে টুইট করে দুই কোরিয়ার মিলনের আভাস দিয়ে কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন অনেক আগেই। চলতি বছর জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখ ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট করেছিলেন, ব্যর্থ বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে নানান কথা বলছে। কিন্তু আমি যদি শক্ত অবস্থান না নিতাম এবং উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগের অঙ্গীকারের কথা প্রকাশ না করতাম- তাহলে এ সংলাপ-আলোচনা হতো এমন কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে?’
তবে দুই কোরিয়ার নমনীয় মনোভাবের কৃতিত্বটা ট্রাম্প নিজের দাবি করলেও জোরালোভাবে এই দাবিটা করতে পারে এশিয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তি ঠান্ডা মাথার চীন। উত্তর কোরিয়ার ওপর চীনের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার চাপ এই কৃতিত্বের দাবি রাখে বলে অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত। কেননা, উত্তর কোরিয়া তার শক্তিশালী অর্থনৈতিক মিত্র চীনের ওপর ভরসা করেই এতোদিন পশ্চিমা শক্তি এবং জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাকে থোরাই কেয়ার করে আসছিলো।
২০০৬ সালে উত্তর কোরিয়া প্রথম পরী¶ামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। তার পর থেকে জাতিসংঘ উত্তর কোরিয়ার ওপর বহু বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার অধিকাংশগুলোই মার্কিন প্রস্তাবে। এর পর দিন দিন এসব নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর থেকে কঠোরতর হয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়াকে জাতিসংঘ এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় দমন করা যায়নি। নিবৃত করা যায়নি পরমানু কর্মযজ্ঞ থেকে। সম্প্রতি পরমানু নিস্ক্রিয়করণে উত্তর কোরিয়াকে বাণিজ্যিক অবরোধের হুমকি দেয় পরম মিত্র চীন। এরপরই মূলত উত্তর কোরিয়া নমনীয় হয় এবং দ¶িণ কোরিয়ার সাথে শান্তি আলোচনায় উৎসাহী হয়। তাই বিশেষজ্ঞদের দাবি, দুই কোরিয়ার পরমানু নিস্ক্রিয়করণে চীনের অবস্থান পরিবর্তন উত্তর কোরিয়াকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে।
উত্তর কোরিয়ার বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই হয় চীনের সাথে। সেই চীন যখন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কথা বলে তখন উত্তর কোরিয়া নমনীয় হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। সেজন্য অনেকের দাবি দুই কোরিয়ার বৈঠকের কৃতিত্ব চীনের প্রাপ্য। তবে কৃতিত্ব যারই হোক, এই আলোচনা কোরিয়া উপদ্বীপে উত্তেজনা কমিয়ে দীর্ঘ ৬৮ বছরের পুরোনো কোরিয়া যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনবে এমনটাই আন্তার্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের প্রত্যাশা। অনেকে আশা করছেন এই আলোচনা থেকে একটি শান্তি চুক্তিও হতে পারে। জার্মানিদের দেখানো পথে দুই কোরিয়া যদি একীভুত হতেই পারে তাহলে বিশ্ববাসীও তাকে সাধুবাদ জানানোর জন্য প্রস্তুত।
এশিয়ার দেশ হলেও দুই কোরিয়ার একীভুত হওয়া বা শান্তি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি কিংবা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের তেমন কোনো আশঙ্কা বা সম্ভাবনা আপাতত নেই। কোরিয়া রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানদের আগ্রাসী ও আক্রমণাত্বক মনোভাব বলা চলে কোরিয়া উপদ্বীপকে বহির্বিশ্ব থেকে কিছুটা আলাদা করে রেখেছে। দুই কোরিয়ার কোনোটার সাথেই বাংলাদেশের তেমন উচ্চপর্যায়ের উল্লেখ্যযোগ্য সম্পর্ক নেই বললেও চলে। কোনো সরকারের আমলেই সেটা ছিলো না। ¯^াধীন ও ¯^তন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ¯^াভাবিক কুটনৈতিক সম্পর্ক যেটুকু আছে সেটার তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। তবে হ্যাঁ একত্রিত কোরিয়া উপদ্বীপ যদি চীন রাশিয়ার বলয়ে চলে যায় তাহলে তার কিছুটা প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে। কেননা এশিয়া অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় চীন-ভারতের চেষ্টা প্রচেষ্টায় অঘোষিত হলেও প্রকাশ্যেই ¯œায়ু প্রতিযোগিতা চলছে। বিশ্ব পরাশক্তির অন্যতম দাবিদার রাশিয়া তো আছেই। মার্কিনিদের প্রতিরোধে এই অঞ্চলে অন্যতম উদিয়মান শক্তি ভারতকে এখন যেমন প্রয়োজন তখন আর তেমন প্রয়োজন পড়বে না। তখন চীন-রাশিয়া ও কোরিয়া মিলে আলাদা একটি সমাজতন্ত্রবাদী বলয়ই গড়ে উঠবে। তবে কোরিয়া নিয়ে চীন-রাশিয়া ও মার্কিনিদের টানা হেঁচড়ায় শান্ত এশিয়ায় নতুন করে কোনো অশান্তির ডঙ্কা বেজে উঠে কিনা সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে পারস্পিরিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক উষ্ণ ও শীতল হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপট থেকেই বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গায়ে মাখামাখি সম্পর্ক এড়িযে চলার চেষ্টা করে। সর্বোচ্চ শীতল ও নির্ভতার সম্পর্ক যে একমাত্র ভারতের সাথে এটা সুস্পষ্ট। তবে রাশিয়ার সাথেও সম্পর্কটা বেশ শীতল। চীনের সাথেও খারাপ না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন একদিকে ভারতের সাথে গায়েমাখা সম্পর্ক অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মরস্তাত্বিক বৈরিতা সত্তেও মার্কিনিদের ভারত তোষণ করতে হয় চীন-রাশিয়ার মোকাবিলায়। ভারতও মার্কিনিদের সাথে সম্পর্ক রাখে চীনকে ঠেকাতেই। বিষয়টা এরকম যে বড় শত্রæর মোকাবিলায় ছোট শত্রæর সাথে সম্পর্ক জিইয়ে রাখা যদিও সে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে আছে। যেমন বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের আমলে মার্কিদের প্রভাব বিস্তারে একমাত্র বাঁধা ভারতই তবুও এই বিষয়ে ভারতকে ছাড় দিতে হচ্ছে চীন-রাশিয়ার মোকাবিলায় বৃহত্তর ¯^ার্থ রক্ষায়। চীন-রাশিয়াও বাংলাদেশ নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাতে পারছে না ভারতের কারণেই। কিন্তু চীন-রাশিয়া ও কোরিয়া বলয় গড়ে উঠলে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকেও ভারত বলয় থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে আসতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে মার্কিন প্রভাবও থাকবে না বাংলাদেশের উপর। এটাও ঠিক যে, প্রভাব-বলয় হ্রাস বৃদ্ধি ঘটলেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তেমন ভুমিকা রাখতে পারবে না। একীভুত কোরিয়া যদি মার্কিন বলয়েই সীমাবদ্ধ হয় তাহলে ভারতকে সহজেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পারবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আবার এটাও ঠিক আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যতদিন ক্ষমতায় আছে ততদিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীলই থাকবে। ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট নীতিই এই ধারণার শক্তিশালী যুক্তি। তার মানে দুই কোরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ায় বর্তমানে কিংবা ভবিষতে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি বা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের তেমন বড় কোনো আশঙ্কা নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিরাপদ এবং চিন্তমুক্তই থাকবে। থাকার প্রয়োজনও। কেননা প্রত্যেকটা দেশের জন্যই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিঃশক্তির প্রভাব উটকো জামেলা এবং আতঙ্কেরই হয়ে থাকে সে দেশের নাগরিকদের জন্য।
সে যাই হোক, ঐক্যবদ্ধ কোরিয়া ¯^প্নের বাস্তবায়নের পর কোরিয়া কী রুশ-মার্কিন বলয় থেকে বেরিয়ে আসবে নাকি নির্দিষ্ট বলয়ে আবদ্ধ থেকে স¤্রাজ্যবাদী পালে নতুন করে হওয়া লাগাবে নাকি নিজেই কোনো শক্তিশালী পরাশক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করবে তা এখন সময়ের অপে¶া। সময়ই বলে দিবে উচ্চারিত প্রশ্নের অনুচ্চারিত সব উত্তর। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে বিশ্ববাসীকে।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

তথ্যসুত্র :
বিবিসি
রয়টার্স
দ্যা নিউ ইয়র্ক টইমস
এএফপি
ভয়েস অফ আমেরিকা
উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট
Korea কলিয়ার নিউ এনসাইক্লোপিডিয়া ১৯২১
Korea এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা ১৯২০
Castillo Cortes 1996, page. 413, North Korea
Castillo Cortes 1996, page. 498, South Korea
Mangled-Max, editor (1995) page 271
Dudes (Aussprachewörterbuch) (6th edition) page 53
Milner Gull and, R. R. (1997) The Russians : The People of Europe
Blackwell Publishing page 1–4.
Weinberg, G. L. (1995) A World at Arms: A Global History of World War II Cambridge University Press। page 264.

Leave a Comment