আজ ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ বৃহস্পতিবার | ১৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এখন সময়- বিকাল ৫:২১

আজ ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ বৃহস্পতিবার | ১৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.

জীবন বৃত্তান্ত:
নাম, হুসাইন আহমদ। আরবী বর্ণমালার সংখ্যামান অনুযায়ী অপর নাম, চেরাগে মুহাম্মদ। উপাধি, শায়খুল আরব ওয়াল আজম। ১২৯৬ হিজরির ১৯ শাওয়াল (১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দ) ক্ষণজন্মা এ মহাপুরুষের জন্ম। ভারতের উত্তর প্রদেশে উন্নাও জেলার অন্তর্গত বাংগার মৌ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সাইয়্যিদ হাবীবুল্লাহ। বংশগত পরিচয়ে হযরত মাদানী ছিলেন হুসাইনি সাইয়্যিদ বংশের। বংশ পরম্পরায় ৩৩ সূত্রে সাইয়্যিদ হযরত হুসাইন ইবনে আলী রা. এর সাথে মিলিত হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের ব্যার্থতার পর মুসলিম সমাজ যখন দীনি দুনিয়াবী উভয় ক্ষেত্রে ইংরেজ সাম্রজ্যবাদ কর্তৃক কোণঠাসা ছিলেন সেই সময় তার জন্ম।
শিক্ষা-দীক্ষা :
হযরত মাদানী প্রাথমিক কুরআন শিক্ষা করেন তার মায়ের কাছে। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩০৯ হিজরিতে তেরো বছর বয়সে তিনি দেওবন্দ গমন করেন। বড় ভাই মাওলানা সিদ্দিক আহমদ ও পরম স্নেহশীল শিক্ষাগুরু শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের তত্ত্বাবধনে ইলম অর্জন শুরু করেন। শায়খুল হিন্দ রহ. দরসে নেজামীর সর্ব্বোচ্চ শ্রেণী দাওরায়ে হাদিসের গুরুত্ত্বপূর্ণ কিতাবাদির পাঠদানে নিযুক্ত ছিলেন। তা সত্ত্বেও হুসাইন আহমদ মাদানির মত মেধাবি ও আদর্শ ছাত্রকে নিচের দিকের কিতাবাদিও তিনি নিজেই পড়ান। সফলতা ও সৌভাগ্যের নানা লক্ষণ হযরত মাদানীর মাঝে পূর্ব থেকেই পরিস্ফুটিত ছিল। হযরত শায়খুল হিন্দের মত মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য ও সুদৃষ্টি প্রতিভাকে আরো বিকশিত করলো। উজ্জ্বল মেধার পাশাপাশি ত্যাগ, বিনয় ও খেদমতের অসাধারণ চেতনা তার মধ্যে কৈশোরেই লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। দেওবন্দের মাত্র সাড়ে ছয় বছরের শিক্ষা জীবনে তিনি দরসে নেজামীর সতেরটি বিষয়ের সাতষট্টিটি কিতাবের পাঠ সমাপ্ত করেন। এতে চর্তুদিকে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। সকল শিক্ষকের স্নেহ ও ভালোবাসার পাত্র হয়ে যান তিনি। পাশাপাশি উস্তাদের খেদমত করার অসাধারণ গুণ ছিল তার মাঝে। ১৩১৬ হিজরিতে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ সমাপ্ত করে পিতামাতা ও ভাইবোনদের সাথে পবিত্র মদিনা তাইয়্যেবায় হিজরত করেন। মদিনা শরীফে গমন করে সেখানকার প্রখ্যাত আরবী সাহিত্যিক শায়খ আবদুল জলীল বুরাদা ওরফে শায়খ আফেন্দির কাছে আরবী সাহিত্য ও হাদিসের পাঠ গ্রহণ করেন। শায়খুল হিন্দ রহ. ছাড়া তিনি যাদের কাছ থেকে হাদিসের পাঠ গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন শায়খ খলিল আহমদ সাহরানপুরি রহ., শায়খ আব্দুল জলীল বুরাদা রহ. ও শায়খ আব্দুল আলী রহ.। এছাড়াও তিনি দেওবন্দ থাকাকালে আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহীর কাছে এবং চিশতিয়া তরিকায় সবক নেন ও খলিফা হন।
কুরআন হিফজ:
ইংরেজদের বিরুদ্ধে তখন কঠোর আন্দোলন চলছিল। শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দিকে গ্রেপ্তার করে আন্দামান দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হল। স্বীয় উস্তাদ ও শায়খের কষ্টের কথা চিন্তা করে তার একাকী নির্বাসনকে মেনে নিতে পারলেন না প্রিয় শিষ্য হুসাইন আহমদ মাদানি। তিনি বললেন, উস্তাদের সঙ্গে আমাকেও নির্বাসন দিতে হবে। আমি তার সঙ্গে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করতে প্রস্তুত। ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত তার আবেদন মঞ্জুর করল। তাকেও পাঠিয়ে দেয় আন্দামানে। কিছুদিন পর রমজান এলো। হজরত শাইখুল হিন্দ প্রিয় শিষ্যকে আক্ষেপের সুরে বললেন, এ রমজানে আমার কুরআনে কারিমের তিলাওয়াত শুনা হবে না। কারণ দু’জনের কেউই হাফেজ নয়। উস্তাদের কথা শুনে হযরত মাদানী মুহূর্তকাল মাথা নিচু করে কী যেন ভাবলেন। তারপর আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও অসীম রহমতের উপর ভরসা করে বলে ফেললেন, হজরত! আপনি দোয়া করুন। ইনশাআল্লাহ আমিই খতমে তারাবি পড়াব। শাইখুল হিন্দ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে পড়াবে? তুমি তো হাফেজ নও। জবাবে মাদানি বললেন, দিনে মুখস্থ করে রাতে নামাজ পড়াব। উস্তাদ দুআ করে দিলেন। দেখা গেল, প্রথম রমজান থেকে হযরত মাদানি দিনে এক পারা করে মুখস্থ করে রাতে তা তারাবির নামাজে স্বীয় শায়খকে শোনাতেন। এভাবে তিনি ত্রিশ দিনে পূর্ণ কোরআন মুখস্থ করে হাফেজ হলেন।
অধ্যাপনা:
হযরত মাদানীর অধ্যাপনার জীবন নানাবিধ কীর্তি ও কৃতিত্বে ভাস্বর। কবুলিয়াত ও রুহানিয়াতের দৌলতে পরিপূর্ণ। মদীনা হিজরতের প্রাক্কালে তার প্রিয় শিক্ষাগুরু শায়খুল হিন্দ রহ. তাঁকে এই বলে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, অধ্যাপনা কখনো ছাড়বে না, দুই একজন ছাত্র নিয়ে হলেও খেদমত অব্যাহত রাখবে। হযরত মাদানী রহ. আমৃত্যু তাঁর উস্তাদের এই উপদেশ মেনে চলেছেন। মদীনা শরীফের জীবনে কঠিন দৈন্য-দশার পরীক্ষার ভেতর এবং হিন্দুস্তানে নানাবিধ সংকটের মূহুর্তেও তিনি ইলমের শুধা বিলিয়ে গেছেন।
দীর্ঘকাল মসজিদে নববিতে হাদিসের দরস দিয়ে তিনি ১৩২৬ হিজরিতে হিন্দুস্তানে প্রত্যাবর্তন করেন। তারপর ১৩২৯ হিজরিতে পুনরায় মদীনা তাইয়্যেবায় গমন করেন। সেখানে কিছুকাল অবস্থানের পর আবার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তারপর শুরু হয় মাল্টার বন্দি জীবন। জেল জীবনের অবসান শেষে কিছুকাল আমরোহার মসজিদে পাঠদান করেন। তারপর শায়খুল হিন্দ রহ. এর সান্নিধ্যে আসেন। এ সময় মাওলানা আজাদ রহ. কলিকাতা আলিয়া মাদরাসার প্রধান শিক্ষকের পদের জন্য একজন সুযোগ্য আলেম খোঁজেন। হযরত শায়খুল হিন্দ রহ. এ পদের জন্য হযরত মাদানীকে নির্বাচন করেন। হযরত মাদানী রহ. বেশ কিছূকাল কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর ১৩৩৮ থেকে ১৩৪৬ হিজরি পর্যন্ত সিলেটের জামিয়া ইসলামিয়ার শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর থেকে ইন্তেকাল [১৩৭৭হিজরি] পর্যন্ত তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের দরসে হাদিস আলোকিত করেন।
রাজনীতি:
শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানের পর ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে আলিমদের মধ্যে ভারতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দানে যারা এগিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্যে শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী অন্যতম। তার ত্যাগ ও সংগ্রাম অপরিসীম। হযরত মাদানী মহান সংগ্রামী উস্তাদের আদর্শ এবং দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তার গোটা জীবনকে দীন ও মিল্লাতের স্বার্থে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। তিনি ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে যে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তা ইতিহাসের এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায় হয়ে আছে। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.)-এর পর তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান অধ্যাপক নিয়োজিত হন। তিনি যখন রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে সুরার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিপরীতে এ বিষয়ে তাঁর অধিকার দাবি করলেন তখন অনেকে ছিলেন দ্বিধা-দ্বন্দে, তারা এতে দ্বিমত প্রকাশ করেন। কিন্তু তৎকালীন মজলিসে শুরার প্রধান, হাকিমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. সকলকে অবাক করে দিয়ে হযরত মাদানীর শর্ত মেনে নিলেন। হযরত মাদানী রহ.অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ইংরেজের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম চালিয়ে যান। ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের কারণে তিনি ঐতিহাসিক করাচি মামলার মুখে পড়েন এবং দুই বছর জেল খাটেন। ১৯৩২ সালে মুক্তি পেয়ে তিনি পুনরায় ইংরেজ-বিরোধী সংগ্রাম শুরু করেন। এ পর্যায়ে তিনি বক্তৃতার উদ্দেশ্যে দিল্লীর অভিমুখে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে ইংরেজ সরকারের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে পুনরায় কিছুকাল কারাবন্দি রাখে। এভাবে সংগ্রামী জীবনের ধাপে ধাপে অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার করেন এবং সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তিকে বিতাড়িত করে দেশকে স্বাধীন করেন।
আধ্যাত্ম সাধনা:
হযরত মাদানী রহ. ১৩১৬ হিজরিতে কুতুবুল ইরশাদ হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর কাছে বায়আত হন। তারপর হযরত মাদানী মক্কা শরীফ গমনকালে শায়খ গাঙ্গুহী তাকে উপদেশ দেন যে, তোমার তো মক্কা শরীফ চলে যেতে হচ্ছে, সেখানে গিয়ে তুমি হযরত মাওলানা ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কিকে পাবে। তুমি তার কছে যিকিরের তালকিন গ্রহণ করবে। মক্কা শরীফ গিয়ে হযরত মাদানী হযরত মুহাজিরে মক্কির দরবারে হাজির হলে তিনি তাকে যিকিরের তালকিন করেন এবং বলেন যে প্রতিদিন এখানে এসে যিকির করবে। কিছুদিন পর হিন্দুস্থান থেকে হযরত গাঙ্গুহী রহ. হযরত মাদানীকে পত্র লিখেন এবং তাঁকে হিন্দুস্থানে ফিরে যেতে বলেন। সেমতে হযরত মাদানী হিন্দুস্থানে ফিরে গেলে তিনি তাকে নিজের কাছে রেখে বিভিন্ন প্রকার দীক্ষা দান করেন এবং তাকে খিলাফত প্রদান করেন। পরবর্তীকালে হযরত মাদানী রহ. নানা ব্যস্ততায় তাসাউফ ধারার খিদমতে বেশ কিছুকাল অপারগ থাকলেও দেশ স্বাধীন করার পর ব্যাপকভাবে এই খেদমতে অংশ গ্রহণ করেন।
ইন্তেকাল:
হযরত মাদানী ১৩৭৪ হিজরিতে সর্বশেষ হজ্জব্রত পালন করেন। তারপর ১৩৭৫ হিজরিতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ শরীরেই তিনি দরস দিতেন এবং মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করতেন। অবশেষে ১৩৭৭ হিজরির ১৩ জুমাদাল উলা (মোতাবেক ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫৭ সাল) রোজ বৃহস্পতিবার বাদ যোহর তিনি অনন্তের পথে পাড়ি জমান। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন। ঘটনাক্রমে সেদিন ছিল দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী রহ.এর মৃত্যু দিবস।

রাজনৈতিক চিন্তাধারা:
ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আলিমগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয় ১৮০৩ সালে হযরত শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. এর বিপ্লবী ফতোয়ার মাধ্যমে। তারপর যথাক্রমে আমীরুল মুজাহিদীন হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ রহ., মাওলানা ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা এনায়েত আলী, হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী, হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহী, হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান প্রমুখ সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। হযরত শাইখুল ইসলাম মাদানী এ আন্দোলনে যোগ দেন ১৯১৬ সালে। তিনি ১৯২০ পর্যন্ত শায়খুল হিন্দের একান্ত সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। শায়খুল হিন্দ ইন্তেকাল করলে আন্দোলন পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব অর্পিত হয় তাঁর উপর। উল্লেখ্য এটি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে জটিল ও সর্বাপেক্ষা স্পর্শকাতর সময়। তিনি পরম অবিচলতা ও বহু ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে আকাবিরে ওলামার পবিত্র আমানত ১৯৪৭ সালে চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে দেন।
শায়খুল ইসলাম ১৯১৬ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত মোট ৩১ বছর স্বাধীনতার সংগ্রাম করেন। এই ৩১ বছরের মধ্যে ৮ বছরের অধিক সময় অতিবাহিত হয় ইংরেজ কারাগারে। অবশিষ্ট ২৩ বছর তিনি মাঠে ময়দানে সক্রিয় আন্দোলনের সুযোগ পান। তিনি জমিয়তে উলামা, জাতীয় কংগ্রেস ও খেলাফতের বহু মিটিং, সভা-সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। তার বক্তৃতা পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত ‘নকশে হায়াত’ গ্রন্থ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সংক্রান্ত অন্যতম গ্রন্থ। তাছাড়া ‘মাকতুবাতে শায়খুল ইসলাম’ এর বিশাল অংশ রাজনৈতিক বিষয়ের উপর লিখিত। এসব রচনা ও বক্তৃতা থেকে তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় সেটি নিম্নরূপ:-
১. শায়খুল ইসলাম মাদানী উপলব্ধি করেন যে, ইংরেজ সম্রাজ্যবাদ গোটা বিশ্বের উপর যে আধিপত্য বিস্তার করে আছে তার মূলে রয়েছে ভারত বর্ষ থেকে আহরিত তাদের সামরিক শক্তি। ভারত বর্ষ থেকে সংগৃহীত সৈন্য ও রসদ তাদেরকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের উপর আধিপত্য কায়েমের রাজপথ তৈরি করে দিয়েছে। কাজেই এই সাম্রাজ্যবাদকে কোনোক্রমে ভারত থেকে উৎখাত করা সম্ভব হলে শুধু মুসলিম দেশগুলোই নয় বরং গোটা বিশ্ব থেকে তারা উৎখাত হতে বাধ্য। মোটকথা তার দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা শুধু ভারতবর্ষের স্বার্থে নয় বরং প্রকৃত পক্ষে এশিয়াসহ পুরোবিশ্বকে মুক্ত করার স্বার্থে জরুরী ছিল।
২. হযরত শাইখুল ইসলাম এর নিকট এটা সুবিদিত ছিল যে, ভারতের কোটি কোটি মানুষের দেশ। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়। এ সম্প্রদায়গুলো স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ না হলে ভারত থেকে সাম্রাজ্যবাদ কখনো তাড়ানো সম্ভব নয়। তাই তিনি ভারতীয় সকল সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ঐক্য গঠনে জোর দেন। তার মতে ঐক্যই হল স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল করার একমাত্র উপায়। তবে এ ঐক্য হবে কেবল রাজনীতি ও আন্দোলনের ঐক্য। ভারতবাসীর পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রাখার ঐক্য। স্বধর্শ ত্যাগ করা কিংবা ধর্মীয় বিধান যথাযথভাবে পালনে ত্রুটি কিংবা লংঘন করার ঐক্য নয়। কাজেই প্রত্যেক ধর্মালম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনে থাকবে পূর্ণ স্বাধীন। তার মতে স্বাধীনতা আন্দোলন সফল করার জন্য সাম্প্রদায়িকতার প্রতিরোধ করাও আবশ্যক। সাম্প্রদায়িকতা পরিহার পূর্বক নিজেদের দৃঢ় ঐক্য স্থাপন না করা পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা অর্জন কখনো সম্ভব হবে না।
৩. তার মতে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করা মুসলমানদের ধর্মীয় কর্তব্য। কেননা জাগতিক সুস্থ জীবন যাপনের জন্য যেমন দেশের স্বাধীনতা জরুরি তেমনি আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত ধর্মীয় বিধি-বিধান পূর্ণাঙ্গভাবে পালনের জন্য স্বাধীনতা জরুরী। ইসলাম কোন ধরনের জুলুম সমর্থন করেনা বরং জুলুমের প্রতিবাদ করা এবং জালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার শিক্ষা দেয়। ইসলাম মানবতার ধর্ম। এই ধর্মে অন্যায়ভাবে কোন জীব জন্তুকেও কষ্ট দেয়া হারাম। কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া কিংবা নির্যাতিত পরাধীন জীবনযাপনে পরিতুষ্ট হয়ে থাকা ইসলাম পছন্দ করে না। “ইসলাম মানুষকে উন্নত করে, তাকে অন্যের সামনে অবনত হয়ে থাকতে দেয়না”Ñআল হাদিস। পরাধীনতার জীবন যাপনে তুষ্ট থাকা কিংবা পরাধীনতার প্রতিরোধে কথা না বলা উপর্যুক্ত হাদিসের পরিপন্থি।
৪. স্বাধীনতার এ আন্দোলনকে তিনি ইসলামে বর্ণিত ‘জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ’-এর অংশ হিসেবে জ্ঞান করেছেন। আর ঐ প্রেরণা ধারণ করেই আজীবন আজাদির লড়াই করে গেছেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে পূর্ববর্তী ওলামা ও আকাবিরের অনুভূতিও এটাই ছিল। হযরত শাহ আব্দুল আজিজ, সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ, কাসিম নানুতবী, শায়খুল হিন্দসহ সকলে এটিকে ‘জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ’ জ্ঞান করেছেন। এ কারণেই তাঁরা দ্বিধাহীনভাবেই আন্দোলনের বিজয়ীকে গাজী, জীবনদানকারীকে শহীদ ও দেশত্যাগ কারীকে মুহাজির আখ্যা দিয়েছেন। এক চিঠিতে সায়খুল ইসলাম স্পষ্টভাবে লিখেছেন, ‘আমি সংগ্রামের এই কঠিন অঙ্গনে পার্থিব কোন লোভে অবতীর্ণ হয়নি। এ আন্দোলনকে আমি কাফেরদের বিরুদ্ধে পবিত্র জিহাদ বলে বিশ্বাস করি। দীন ও শরিয়তের স্বার্থে একটি পবিত্র সংগ্রাম বিবেচনা করেই আমি অন্তর্ভুক্ত হয়েছি।
৫. তিনি এক বক্তব্যে বলেন, মুসলমানরা প্রায় এক হাজার বছর যাবৎ ভারত শাসন করেছে। এ দেশ ছিল ‘দারুল ইসলাম’। এখানে ইসলামের পতাকা উড্ডীন ছিল। কুফর ও শিরকের ঝান্ডা ছিল অবনমিত। ইংরেজ নানা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এবং ভারতীয়দেরকে পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত করে মুসলিম সম্রাটদের হত্যা করে। তাদের ধন সম্পদ লুন্ঠন করে সর্বশ্রান্ত করে দেয়। গোটা ভারতবর্ষকে ‘দারুল কুফর’ এর দিকে ঠেলে দেয়। ইসলামের পতাকা অবনমিত করে এখানে কুফরের পতাকা উড্ডীন করে। ভারতকে গোলাম বানিয়ে ভারত থেকে আহরিত সম্পদ ও সামরিক শক্তি দ্বারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোকে একের পর এক পরাভূত করছে। ইংরেজরা বহির্দেশীয় মুসলিম বাহিনীকে হত্যা করছে, মুসলিম রাষ্ট্রশক্তিকে পরাভূত করছে। তাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ গ্রাস করছে। তাই আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন যে, আমাদের জন্য ইংরেজ সাম্রজ্যবাদ ব্যতীত বড় শত্রু আর কে হতে পারে? তাই সাম্রাজ্যবাদ নিঃসন্দেহে ইসলাম ও মুসলমানের শত্রু। এমনকি হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল ভারতীয়দের সর্বাপেক্ষা বড় দুশমন। এহেন দুশমনের বিরুদ্ধে জিহাদ করা প্রত্যেক সচেতন মুসলমানের কর্তব্য।
৬. কংগ্রেসে যোগদানের ক্ষেত্রে তার চিন্তাধারা ও যৌক্তিকতা হলো, হযরত মাদানী গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, তুমুল আন্দোলন ও সংগ্রাম দ্বারা সাম্রাজ্যবাদকে সম্পূর্ণ বাধ্য করা ব্যতীত ভারত ত্যাগে সম্মত করা যাবে না। তাই ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভারতীয় ঐক্যবদ্ধ না হলে তা সম্ভব নয়। এ নীতির আলোকে তিনি কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। কংগ্রেসের কোনো কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে তার মতানৈক্য ঘটে থাকলেও ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন থেকে তিনি কখনো বিচ্ছিন্ন হননি। কংগ্রেসে যোগদান সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি চাই স্বাধীনতা, আমি চাই বিপ্লব, চাই ইংরেজ রাজত্বের পতন। ভারতবর্ষে ইংরেজ শক্তিকে দুর্বল করার লক্ষ্যে এবং নির্মূল করার স্বার্থে যে কোনো সংগঠনই কাজ করবে, আমি তার সঙ্গে অংশগ্রহণে সর্বদা প্রস্তুত।
৭. বস্তুত মুসলমানদের প্রধান শত্রু ইংরেজদেরকে পরাস্ত করার লক্ষ্যে তিনি হিন্দুদের সঙ্গে ঐক্য স্থাপনে বাধ্য হন। পরিস্থিতির দাবি অনুসারে এটি করা ব্যতিরেকে তার গত্যন্তর ছিলো না। কারণ তৎকালে এককভাবে মুসলিমদের শক্তি এতটুকু ছিল না যার দ্বারা সম্রাজ্যবাদী সরকারকে কাবু করা যায়। এ কারণেই তাকে কংগ্রেস ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদী অমুসলিমদের সাথে মিলে ঐক্য গঠন করতে হয়। ঐক্য গঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, হিন্দুদের বর্তমান অবস্থায় এতটুকু শক্তি নেই যতটুকু শক্তি রয়েছে ইংরেজদের হাতে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিরিখে এ কথা সুস্পষ্ট যে, মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় শত্রু ইংরেজ। হিন্দুদের ব্যাপারে শুধু এতটুকু বলা যায় যে, হয়তো ভবিষ্যতে তারা ইংরেজদের কিংবা তাদের চেয়েও বড় ধরনের অনিষ্টকারী হতে পারে। তবে সেটি কেবল ধারণা ও আশঙ্কা মাত্র। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
৮. শায়খুল ইসলামের দৃষ্টিতে ভারত উপমহাদেশে উল্লিখিত শর্তযুক্ত অভিন্ন জাতীয়তা প্রযোজ্য। ভারতকে আরবের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। ভারতের পরিবেশ আর আরবের পরিবেশ এক নয়। ভারতে বহু ধর্মের মানুষের সহাবস্থান বিদ্যমান। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের শর্তযুক্ত অভিন্ন জাতীয়তাবাদ অনুসরণ করা না হলে ধর্মে-ধর্মে হানাহানি ও সাম্প্রদায়িকতা নির্ঘাত ছড়িয়ে পড়বে। পরিণামে মুসলিম ও অমুসলিম সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইসলামে জিহাদের বিধান আছে কিন্তু সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও প্রতিহিংসার বিধান নেই।
৯. পৃথক ভূখণ্ড রচনার ক্ষেত্রে হযরত মাদানীর চিন্তাধারা ছিল অখন্ড ভারত। কারণ তিনি মনে করতেন, পৃথক ভূখন্ডের সিদ্ধান্ত মুসলমানদের জন্য আত্মঘাতী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ভারত স্বাধীনতার দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়। স্বাধীনতার শুভক্ষণ যত ঘনিয়ে আসে, ভারতের শাসনতন্ত্র ও তার রূপরেখা বিষয়ক প্রশ্ন তত প্রকট হতে থাকে। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ প্রত্যেকে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি চিন্তাভাবনা করতে থাকে।
স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্র কিরূপ হবে তা নিয়ে সবচেয়ে বেশী জটিলতা দেখা দেয় মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে। অবশ্য এ জটিলতার যৌক্তিক কারণ ছিল। কেননা সমগ্র ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ৯-১০ কোটি। পাশাপাশি হিন্দুদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ কোটির বেশি। অর্থাৎ মুসলমানরা হিন্দুদের ৪ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। কাজেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠিত হলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ৪ টি সুবায় মুসলিম সরকার গঠিত হলেও মুসলিম সংখ্যালঘু অন্যান্য শুবা এবং কেন্দ্রীয় সরকারে সবসময়ই প্রাধান্য থাকবে হিন্দুদের। পরিণামে মুসলমানরা ভারতে সবসময় ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকবে। মুসলিমলীগ নেতারা পূর্ব থেকেই মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর সমন্বয়ে একটি পৃথক ভূখন্ড রচনার চিন্তা করেন। জিন্নাহ সাহেব স্পষ্ট করে বলেন যে, আমরা ৫ কোটি মুসলমানের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে ৩ কোটি মুসলমানের ক্ষতিগ্রস্ততা সহ্য করে যাচ্ছি। কিন্তু লীগের এই চিন্তার সাথে শায়খুল ইসলাম একমত হতে পারেননি। তিনি মনে করেন, পৃথক ভূখন্ড রচনার পদক্ষেপ হিন্দু-মুসলিম সকলের স্বার্থবিরোধী। এ প্রদক্ষেপ দ্বারা ভারতীয়দের বর্তমান সমস্যার নিরসন তো হবেই না বরং আরো জটিল আকার ধারণ করবে।
তিনি আরো বলেন, যারা পৃথক ভূখন্ডের দাবি করছেন, তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের নিরিখে একথা স্পষ্ট যে, খণ্ডিত অংশে শাসন ব্যবস্থা কোন ইসলামী শাসন ব্যবস্থা হবে না। সেটি হবে ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। কাজেই ভারতকে হিন্দু ভূখন্ডে ও মুসলিম ভূখন্ডে খন্ডিত করা হলে হিন্দু ভূখন্ডে মুসলমানদের সংখ্যা হবে সর্বোচ্চ ১৪% আর সর্বনিম্ন ৫%। আনুপাতিক এই হার ঐ ভূখন্ডে মুসলমানদেরকে জীবন্ত সমাধিস্থ করা বৈ কিছুই নয়। অপরদিকে মুসলিম ভূখন্ডে অমুসলিমদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪৫% যা মুসলিম সরকারের জন্য নিত্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে থাকবে। অতএব বিভক্তির পরিণামে হিন্দু ভূখন্ডে ৩ কোটি মুসলমানকে জীবন্ত দাফন করে নিজেরা পৃথকভাবে এমন এক ভূখন্ডে গিয়ে সরকার গঠন করা, যেই সরকারকে অমুসলিমরা সর্বদা অস্থির করে রাখবে এমন সিদ্ধান্ত কোন বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
১০. শায়খুল ইসলামের পূর্ণ অসম্মতির উপরে ভারত বিভক্ত হয়। বিভক্তির পর তিনি উভয় ভূখণ্ডের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষিত রাখা জরুরি বলে মত প্রকাশ করেন।তার চরিত্র ছিল ক্লান্তিহীন মর্দে মুমিনের চরিত্র। তাই ভারতবর্ষে মুসলিম মিল্লাতের স্বার্থে তিনি যা কল্যাণ মনে করেছেন সেটি বাস্তবায়নের সকল ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ঐ চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি ভাগ্যকে মেনে নেন এবং পেছনের দিকে না তাকিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জন্য যা করণীয় তা সম্পাদনে আত্মনিয়োগ করেন। ভারত বিভক্তির কারণে মুসলমানরা উভয় ভূখন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উভয় ভূখন্ডেই তার শাগরিদ, কর্মী ও ভক্তরা ছিলেন। তিনি প্রত্যেককে স্ব স্ব ভূখণ্ডে অবস্থিত মুসলমানদের সেবায় আত্মনিয়োগ এর আদেশ দেন। এ আদেশের কারণে পাকিস্তান ভূখন্ডে অবস্থিত বহু জমিয়ত কর্মী পরবর্তীকালে মুসলিমলীগে যোগদান করে পাকিস্তানের সেবায় নিয়োজিত হয়।
১১. বিভক্ত ভারতের মুসলমানরা যখন হতাশাগ্রস্থ শায়খুল ইসলাম মাদানী ভারতীয় মুসলমানদের ভাগ্যোন্নয়নের পথ নির্দেশ করে ১৯৪৮ সালে জমিয়তের বোম্বাই অধিবেশনে বলেন, ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ২ সপ্তমাংশ থেকে ১ সপ্তমাংশে নেমে গিয়েছে। এবং তাদের বহুকালের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবুও ইন্ডিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত মুসলমানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলা যায় না। তবে এর জন্য প্রয়োজন মুসলমানদের নিজেদের কাজকর্ম ও নিজেদের অবদানের দ্বারা নিজেদেরকে দেশের কল্যাণকামী প্রমাণ করা। যদি মুসলমানরা নিজেদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে চায় তাহলে কর্ম ও অবদানের মাধ্যমে নিজেদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করা আবশ্যক। যদি নিজেদেরকে সত্যিকারের দেশ প্রেমিক ও দেশবাসির সেবক হতে পারেন নিঃসন্দেহে বিজয় ও সফলতা আপনাদের পদচুম্বন করবে।
১২. ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ইসলামী রাজনীতির ব্যাপারে দুটি প্রান্তিক অভিমত পাওয়া যায়। কারো মতে ইসলামে রাজনীতি নেই। আবার কেউ কেউ বলেন, ইসলাম মানেই রাজনীতি। শায়খুল ইসলাম উপর্যুক্ত দুটি অভিমতকেই অতিশয়তা ও বাড়াবাড়ি বলে মনে করেন। তার মতে রাজনীতি করা ইসলাম বহির্ভূত নয়। সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে রাজনীতি চর্চায় ইসলামের কোথাও নিষেধ করা হয়নি। পক্ষান্তরে মিথ্যা, প্রতারণা ও শঠতা অবলম্বন করা, সেটি রাজনীতির ক্ষেত্রে হোক কিংবা অন্য যে কোন ক্ষেত্রে হোক পরিত্যাজ্য। মিথ্যা ও প্রতারণা জঘন্য গুনাহের কাজ।
অবদান:
মাদানীর খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন :
খেলাফত আন্দোলনের পাশাপাশি যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, তখন সরকারী অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সরকার পরিচালিত স্কুল-কলেজ-মাদরাসা সব শুন্য হতে শুরু করলো। অসহযোগ আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য মওলানা মাদানী যে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তা ভারতের মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌবরজনক অধ্যায় হিসাবে ভাস্বর হয়ে থাকবে। তিনি ‘রিসালা-এ তরকে মুয়ালাত’ নামে একখানা তথ্য ও যুক্তির্পূণ পুস্তিকা রচনা করে ইংরেজদের ব্যাপারে উত্তেজিত ভারতবাসীর জেহাদী আগুনকে অধিক প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন। পুস্তকটি এতই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে, শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার তা বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হয়। তাতে মওলানা মাদানী যুক্তি প্রমাণ ও শরীয়তের হুকুম-আহকামের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, বৃটিশ শক্তি তদানীন্তন মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্র তুর্কী খেলাফতের মূলোৎপাটন করতে বদ্ধপরিকর। যারা মিসর, হেজাজ বিশেষতঃ মক্কা-মদীনা ভূমির উপর নানা ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে নির্যাতন ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, যারা আরব জাহানের বিষফোঁড়া ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, যারা মুসলিম জাহানের মেরুদণ্ড তুরস্ক সাম্রাজ্যকে আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা শুধু ইসলামী শরীয়ত বিরোধীই নয়, মানবতা বিরোধীও বটে। বলাবাহুল্য, মওলানার এই পুস্তক বৃটিশ-ভারতে ইংরেজদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে তোলে।
করাচীর মোকদ্দমা ও মাওলানা মাদানী :
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রধান সম্বল ছিল ভারতের জনবল ও সম্পদ। তুর্কী খেলাফতের অধীন মক্কা মদীনার পবিত্র ভূমিকা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলার জন্য যে বৃটিশ সামরিক শক্তি ব্যবহৃত হয়েছিল, তাতে সৈন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল প্রধানতঃ ভারত থেকেই। এতে করে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা প্রকারান্তরে মুসলিম সেনাবাহিনী দ্বারাই তুরস্ক, সাইপ্রাস এবং সমস্ত মধ্যপ্রাচ্যের আরব মুসলমানদের বুকে গুলি বর্ষণ করাচ্ছিল। মুসলমানদেরকে দিয়ে কুচক্রী সাম্রাজ্যবাীদের চালিত জগত জুড়ে মুসলিম নিধনের এই ন্যাক্কারজনক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানরা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ৮, ৯ ও ১০ জুলাই তারিখে করাচীতে ‘নিখিল ভারত খেলাফত কমিটি’র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মওলানা মাদানী এই প্রস্তাব উত্থাপন করলেন যে, যে কোন মুসলমানের পক্ষে বৃটিশ সৈন্যবাহিনীতে চাকুরী করা বা চাকুরীকে উৎসাহিক করা সম্পূর্ণ হারাম। বৃটিশ সৈন্যবাহিনীতে কর্মরত সকল মুসলিম সৈনিকের নিকট একথা পৌঁছিয়ে দেয়া প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। সম্মেলনে মওলানা মাদানীর এই বিপ্লবাত্মক প্রস্তাবটি বিপুল উত্তেজনাপূর্ণ সাড়ার মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় এবং মূহুর্তের মধ্যে সারা ভারতে একথা ছড়িয়ে পড়ে। মওলানা মাদানীর এ প্রস্তাবকে প্রকাশ্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে বৃটিশ সরকার ঘোষণা করে এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০, ১৩১ ও ৫০৫ ধারা মতে মওলানা মাদানী ও মওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার, মওলানা শওকত আলী, ডক্টর শায়ফুদ্দীন কিচলু, মওলানা নিসার আহমদ কানপুরী, পীর গোলাম মুজাদ্দিদ সিন্ধী ও স্বামী শঙ্কর আচার্যের বিরুদ্ধে এক রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক মোকদ্দমা দায়ের করে।
তাবলিগের মারকায ও ভারতে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা:
৪৭’ এ দেশভাগের সময় লোকেরা বারবার তাবলীগ মারকাযের প্রধান মাওলানা ইউসুফ রহ. কে হিজরতের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। কেউ কেউ বিমানের ২৫-৩০ টি টিকেট হাতে দিয়ে বলে যে, পরিবার-পরিজন নিয়ে পাকিস্তান চলুন। তাঁদের পরামর্শ ছিল, ভারতের অধিকাংশ মুসলমান বর্তমানে পাকিস্তান চলে গেছেন। কাজেই দীনি দাওয়াত ও ইসলাহের কাজ শক্তিশালীভাবে করতে হলে আপনার সেখানে চলে যাওয়া জরুরি। তাছাড়া উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লিতে যে হারে মুসলমানদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে এখানে দীনি কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ আশা করা অসম্ভব। তাদের পীড়াপীড়ির জবাবে মাওলানা ইউসুফ সাহেব একটি কথাই বলতেন, ‘যদি ভাই সাহেব (হযরত মাওলানা যাকারিয়্যা রহ.) হিজরত করে যান তাহলে আমিও যাবো, নয়তো যাবো না।’
হযরত শায়খুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়্যা রহ. নিজে কেন পাকিস্তাান হিজরত করেননি, সেই কারণ তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা হিজরতের ব্যাপারে হযরত মাদানি রহ. এর সঙ্গে পরামর্শ করলাম। হযরত মাদানি আমাদের বক্তব্য শুনে একটি ঠাণ্ডা নিশ্বাস ছাড়লেন। তাঁর চোখে তখন অশ্রু। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তিনি বললেন, “আমাদের পরিকল্পনা সফল হতে পারেনি। যদি আমাদের পরিকল্পনা মেনে নেয়া হতো তাহলে এতো রক্তারক্তি যেমন হতো না, তেমনই আবাসস্থল বিনিময়ের প্রয়োজনও দেখা দিতো না। এখন আমি কাউকে চলে যেতে বারণ করি না। যদিও মদিনা শরিফে আমার থাকার জায়গা রয়েছে। আমার ভাই সাইয়্যিদ মাহমুদ আমাকে মদিনায় চলে যেতে বারবার পীড়াপীড়ি করছেন; কিন্তু আমি ভারতীয় মুসলমানদেরকে নিঃস্বতা, অসহায়ত্ব, ত্রাস ও প্রাণভয়ের এই পরিস্থিতিতে ফেলে রেখে অন্যত্র কোথাও যাবো না। কাজেই যে ব্যক্তি নিজের জীবন-সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান ও দীন-দুনিয়া এখানকার মুসলমানের জন্য উৎসর্গ করতে সম্মত, সে-ই এখানে থাকবে। আর যার পক্ষে এহেন ত্যাগ-তিতিক্ষা বরণ করা সম্ভব নয় তার চলে যাওয়াই উচিত।”
হযরত মাদানির এ বক্তব্য শুনে আমি দ্রুত বলে উঠলাম, “হযরত, আমি আপনার সাথে আছি।” তখন হযরত আবদুল কাদির রায়পুরি রহ.ও বললেন, “তোমাদের দু’জন ব্যতিরেকে আমার পক্ষেও যাওয়া অসম্ভব।” হযরত মাদানি রহ. এর পরামর্শে শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রহ. পাকিস্তান হিজরতের সিদ্ধান্ত নেননি বিধায় হযরতজি মাওলানা ইউসুফেরও যাওয়া হয়নি। ফলে তাবলিগের মারকায কেন্দ্র করে অসংখ্য মুসলমান ভারতে রয়ে যায়। সেদিন যদি হযরত শায়খ মাদানি রহ. ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতেন তাহলে আজ হয়তো ভারত থেকে মুছে যেত ঈমান-আমল ও দীনের মারকায। হয়তো হারিয়ে যেতো খোদ মুসলমানদেরই অস্তিত্ব, যেমনটি ঘটেছে স্পেনের গ্রানাডা-কর্ডোভায়। শায়খুল ইসলাম মাদানি রহ. এর এই এক সিদ্ধান্ত ভারতে মুসলমানদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার শক্তিশালী বুনিয়াদ রচনা করে দিয়েছিল। মদনী রহ. সে সিদ্ধান্ত না দিলে ভারত হত একক হিন্দু রাষ্ট্র।

সাম্প্রদায়িক উগ্রতা প্রশমন:
১৯২৩ সালে অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত হওয়া থেকে ১৯৩০ সালে কংগ্রেস কর্তৃক পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহিত হওয়া পর্যন্ত মোট ৬ বছর কাল ভারতবর্ষের রাজনীতিতে চরম বিশৃংখলা ও অস্থিরতা বিরাজ করে। স্বাধীনতা আন্দোলন তখন পারষ্পরিক ধর্মীয় বিরোধ ও সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসায় রুপান্তরিত হয়। অসহযোগ আন্দোলনে খেলাফতের নেতৃত্বে হিন্দু মুসলিম সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পড়লে ক্ষমতাসীন ইংরেজ নিজেদের ভবিষ্যত সম্পর্কে দারুন উদ্বিগ্ন হয়ে গিয়েছিল। বৃটিশ উপলব্ধি করে যে, ভারতীয়দের এ ঐক্য যেকোন মূহুর্তে ইংরেজ আধিপত্য নির্মূল করতে সক্ষম। তাই সরকার সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে ভারতীয়দের ঐক্য ভেঙ্গে দেয়ার এবং সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিহিংসা উস্কে দেয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। করাচির মামলায় হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী, মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার প্রমুখ নেতা কারারুদ্ধ হওয়ার পর অসহযোগ আন্দোলনের দায়ে কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির আরো বহু নেতা কারাগারে প্রেরিত হন। মহাত্মাগান্ধি, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, চিত্ত রঞ্জন দাস, মতিলাল নেহেরুসহ রাজবন্ধীগণের সংখ্যা তখন ২০ হাজারে গিয়ে দাড়িয়েছিল। ইংরেজরা নেতাদের গণ গ্রেপ্তার ও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব উস্কে দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের পট পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ঘোলাটে করে ফেলে। হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী দুই বছর জেল খেটে মুক্তির পর সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা প্রতিরোধে তৎপর হন। কোকনাদের ভাষনে তিনি এ ব্যাপারে প্রধানত ইংরেজ সরকারকে দায়ী করেন। তিনি সাম্প্রদায়িক উগ্রতা প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হিসেবে সকলকে স্বাধীনতা আন্দোলন জোরালো ও শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন। সিলেটে আগমনের পর জমিয়ত ও কংগ্রেসের বিভিন্ন সভায় তিনি জনগনকে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা থেকে বিরত থাকার আবেদন জানান। তিনি হিন্দু উগ্রপন্থী নেতার সংকীর্ণ চিত্ততার অভিযোগ করে বলেন, পরিতােেপর বিষয় যে, হিন্দু সম্প্রদায় ও তাদের নেতাদের বিন্দুমাত্র অনুভূতি হচ্ছে না। তারা মনের অপ্রশস্ততা ও বিবেকের অপরিপক্কতার দরুন উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্মুখে এক কঠিন বাধা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। ফলে স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টি বিলম্বিত হয়ে যাচ্ছে। যদি এ অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে ভারতবর্ষ দিনে দিনে এমন অধঃপতনের দিকে চলে যাবে, যেখান থেকে মুক্তির কোন উপায় অবশিষ্ট থাকবে না। তাই সকলে সাম্প্রদায়িক উগ্র মানসিকতা পরিহার করে ঐক্যবদ্ধভাবে পুনরায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। এভাবে তিনি সাম্প্রদায়িক উগ্রতা প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

দেওবন্দ মাদরাসার ভাঙ্গনরোধ:
১৯২৭ সালে দারুল উলূম এক ভয়াবহ দুর্যোগের সম্মুখিন হয়। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৬১ বছর পর এ প্রথমবার অভ্যন্তরিন মতবিরোধের পরিণতিতে দারুল উলূম দেওবন্দ অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে পড়েছিল। ১৯১৪ সালে তৎকালীন সদরুল মুদাররিসিন হযরত শায়খুল হিন্দ হিজায যাত্রার প্রাক্কালে নিজের প্রিয় ও সুযোগ্য শাগরিদ আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরীকে ঐ পদে মনোনীত করে যান। হযরত কাশ্মিরীর অপরিসীম মেধা ও যোগ্যতা সর্বজন স্বীকৃত। হাদিস শাস্ত্রে অসামান্য দক্ষতা ও সুগভীর প্রজ্ঞার কারণে তদানীন্তন দেশের ইমাম বুখারী নামে অবিহিত ছিলেন। তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণের পরে দারুল উলূমের পরিচিতি ও সুখ্যাতি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। উপমহাদেশ ও বহির্বিশ্ব থেকে জ্ঞান পিপাসু শিক্ষার্থীরা দলে দলে ছুটে আসে। কিন্তু ১২ বছর পর মাদরাসার প্রশাসন বিভাগের সঙ্গে শিক্ষা বিভাগের মতানৈক্য ঘটে। তর্ক-বিতর্ক থেকে বিষয়টি বিবাদে রূপ নেয়। জনসাধারণ্যে এবং বাজারে, ঘাটে অলিতে-গলিতে এসব ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি পেপার পত্রিকায় বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি পর্যন্ত গড়ায়। ফলে এমন এক উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, আল্লামা কাশ্মিরী মাদরাসা থেকে ইস্তেফা দিয়ে চলে যান। পরিস্থিতি এত নাজুক হয়ে ওঠে যে, দারুল উলূম ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। তখন নির্বাহী মুহতামিম ছিলেন, মাওলানা হাবিবুর রহমান উসমানী। তিনি শায়খুল ইসলামের উস্তাদ। চিঠি মারফত শায়খ মাদানীকে সিলেট থেকে দেওবন্দ আসার নির্দেশ দেন। তিনি এসে মাদরাসার অবাঞ্চিত পরিস্থিতি দেখে খুবই দুঃখিত হন এবং আল্লামা কাশ্মিরীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ব্যর্থ হন। নির্বাহী মুহতামিম মাওলানা হাবিবুর রহমান মাদরাসার পরিস্থিতিকে সামাল দেয়া এবং আল্লামা কাশ্মিরীর ঘাটতি পূরণের জন্য শায়খুল ইসলাম মাদানীকে মাদরাসার দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য করেন। কিন্তু তিনি রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে অপারগতা পেশ করে। অবশেষে তিনি ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন ও রাজনীতি করার পূর্ণ স্বাধীনতার শর্তে দারুল উলূমের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সদরুল মুদাররিসিনের পদে তাঁর যোগদানের ফলে বিগত দেড় বছরের অভ্যন্তরিন সমস্যা দ্রুত প্রশমিত হয়ে যায়। দারুল উলূম নিশ্চিত বিনাশ থেকে রক্ষা পায়। মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী বলেন, বুযুর্গানে দীনের অর্ধ শতাব্দীকালের অমূল্য সঞ্চয় ধুলায় বিলিন হওয়ার যে আশংকা দেখা দিয়েছিল, শায়খ মাদানীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ এ বিরাট ক্ষতি থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করেন।
প্রভাব:
মাওলানা সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. শতাব্দির প্রতিভাধর এক প্রভাবশালী ইসলামী ব্যক্তিত্ব। তিনি শায়খুল আরব ওয়াল আজম উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। তার প্রভাব ছিল সর্বত্র। ইসলামী, অনৈসলামী, রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, আলেম-উলামা, সাধারণ জনতা সকলের মাঝে তিনি সমাদৃত। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে কথা বলতেন। ইংরেজ বেনিয়ারা তার হুংকারে তটস্থ থাকতো। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাঝে তিনি যেমন শেরেতাজ ছিলেন। অরাজনৈতিকদেরও ছিলেন তিনি মধ্যমনি। অনেক আলেম আছেন যারা রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন, রাজনীতি পছন্দ করেন না, তারাও শায়খুল ইসলামকে ভক্তি করেন, শ্রদ্ধা করেন, ভালবাসেন। তার বিরুদ্ধাচারণ করার কারো হিম্মত হয়ে ওঠেনি। আশরাফ আলী থানভী রহ. নিজে রাজনীতি করতেন না, কিন্তু শায়খ মাদানীর রাজনীতির বিরুদ্ধাচরণ কখনো করেননি। বরং শায়খুল ইসলাম যখন রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শুরার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিপরীতে তাঁর রাজনীতি করার অধিকার দাবি করলেন তখন অনেকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকলেও হাকিমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. সকলকে অবাক করে দিয়ে শায়খ মাদানীর শর্ত মেনে নিলেন।

পর্যালোচনা:
মাওলানা সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. একটি নাম, জীবন্ত অনেকগুলো আন্দোলন, ভারত উপমহাদেশের স্বনামধন্য প্রখ্যাত আলিম, বরেণ্য মুহাদ্দিস, বিচক্ষণ রাজনীতিক, ক্ষণজন্মা সাধক, আধ্যাত্মিকপুরুষ, এমন আরো বহু পরিচয়-অভিধায় তাঁকে চিহ্নিত করা সম্ভব। এক কথায় বলতে গেলে, দীন ইসলামের প্রচার-প্রসাররের এমন কোনো শাখা-পল্লব নেই, যা মাওলানা সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. এর অবদানের বারিধারায় সিঞ্চিত হয়নি। তিনি কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন না; বহুমুখি গুণ-প্রতিভার অধিকারী ইসলামের সুউচ্চ এক প্রাণবন্ত মিনার, জীবন্ত এক ইলমী প্রতিষ্ঠান। শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী রহ. ছিলেন জ্ঞান-পান্ডিত্য, তাকওয়া-পরহেজগারি, ইবাদত ও দাওয়াত- এক কথায় আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলামের বিজয় ও প্রতিষ্ঠা সাধনের ভুবনে এক কিংবদন্তি পুরুষ। তিনি শাইখুল হিন্দ হযরত মাহমুদ হাসান দেওবন্দি রহ.-এর যোগ্যতম উত্তরসূরী। এই মনীষীর ইবাদত-বন্দেগি, কোরআন তেলাওয়াত, সিয়াম সাধনা, তারাবি ও রাতভর তাহাজ্জুদের কান্নাপ্লাবিত সাধনা ছিল উপমাময়। উপমহাদেশের বরকতপূর্ণ এই জমিন-সীমানায় যে ক’জন বিপ্লবী আলিমে দীনের আবির্ভাব ঘটেছে, ইংরেজ বেনিয়াদের নানামুখি ‘নীল নকশা’ থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের জান-মাল-ঈমান রক্ষার আন্দোলন করেছেন যাঁরা, সাইয়্যিদহুসাইন আহমদ মাদানি রহ. তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তিনি ইসলামী আন্দোলনের অগ্রগামী একজন সিপাহসালার। জীবন সাধনার নানামুখি কর্মদক্ষতা, চিন্তা-ফিকির, সংস্কার-মানসিকতা এবং গুণ-বৈশিষ্ট্যের বিচারে শতাব্দির প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হাজার আসকালানী রহ. -এর সাথে তুলনা করা হতো তাঁকে। মাওলানা মাদানির ব্যাপারে বিজ্ঞ অনেকের ভাষ্য এমন যে, ভারত উপমহাদেশের সীমানায় মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানিই একমাত্র আলিম; দীন ইসলামের সব বিষয়-দিক ও শাখা-পল্লবে সমান দক্ষতা এবং সুদীপ্ত পদচারণা ছিল যাঁর। শায়খুল হিন্দের ইন্তেকালের পর শায়খুল ইসলাম মাদানীকে তার স্থলাভিসিক্ত মনে করতেন সকলে। শায়খুল হিন্দের সকল ছাত্র, সকল কর্মী ও ভক্তবৃন্দের কাছে এক বাক্যে ‘জা-নাশীনে শায়খুল হিন্দ’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। সে সময় রাজনৈতিক তৎপরতা জোরেসোরে চলছিল। দেশে ছোট বড় নেতৃবৃন্দের কোন অভাব ছিল না। এতদসত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শায়খুল ইসলামকে হযরত শায়খুল হিন্দের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মেনে নেন। পত্র-পত্রিকায় তাঁর নামের পূর্বে উল্লেখ থাকত ‘জা-নাশীনে শায়খুল হিন্দ’।

লেখক : মাওলানা আবদুর রাজ্জাক, সেক্রেটারি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ফেনী জেলা

Leave a Comment

লগইন অথবা নিবন্ধন করুন

লগইন
নিবন্ধন