আজ ১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ মঙ্গলবার | ৬ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি | ৩রা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এখন সময়- দুপুর ১:৫৩

আজ ১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ মঙ্গলবার | ৬ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি | ৩রা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাসূল শব্দের ইতিবৃত্ত

রাসুল শব্দ কুরআনে কারিম ও হাদিস শরিফে বেশ আলোচিত। শুধু ‘রাসুল’ শব্দ আমি অধমের হিসাব মতে আল্লাহ তাআলা ২৪১বার ব্যবহার করেছেন। বহুবচন রুসুল শব্দ ধরে গণনা করলে আরও অনেক বেশি হবে। একটা শব্দ এত অধিক ব্যবহার থেকেই তার গুরুত্ব প্রষ্ফুটিত হয়।
রাসুল শব্দ নিয়েই আমরা কথা বলছি।
রাসুল শব্দটি আরবি ‘মুবালাগা’ তথা ‘অধিক অর্থ প্রকাশক’ শব্দ। যেমন, ‘ফাউলুন’।
শাব্দিক অর্থ: প্রেরণ করা। যাকে প্রেরণ করা হয়। আমাদের ভাষায় দূত। বিশেষ প্রয়োজনে নিজে যেতে না পেরে অন্যকে প্রেরণ করা। যাকে প্রেরণ করা হয়, তাঁকে দূত [রাসুল] বলা হয়।

পরিভাষিক অর্থ :
বিখ্যাত গবেষক আলিম আল্লামা সাদ উদ্দিন তাফতাজানি রাহ. বলেন-
هي سفارة العبد بين الله وبين ذوي الالباب من خليقته ليزيح بها عللهم فيما قصرت عنه عقولهم من مصالح الدنيا والاخرة
আল্লাহ তাআলা ও বুদ্ধিমান বান্দার মধ্যে প্রতিনিধিত্ব, যাতে ঐ সকল সমস্যা, অসুবিধা দূর করা যায়, যার কারণে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ থেকে তারা দূরে সরে গেছে।

আমরা সহজ কথায় বলি, আল্লাহ তাআলা মানুষের হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন মানুষ নির্বাচন করেন। পরিভাষায় তাঁদেরকে নবি ও রাসুল বলা হয়।
আল্লাহ তাআলা শাব্দিক অর্থে কখনো ফেরেশতাদেরও রাসুল বলেছেন। কুরআনে কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
انه لقول رسول كريم
নিশ্চয়, এই কুরআন সম্মানিত দূতের বাণী।
انا رسل ربك لن يصلوا اليك
আমরা আপনার পালনকর্তার দূত, তারা আপনার ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।
ولما جاءت رسلنا لوطا سيء بهم
ফেরেশতারা লুত আ.-এর কাছে এলে তাঁদের সাথে খারাপ আচরণ করা হয়।
لقد جاءت رسلنا ابراهيم بالبشري
ফেরেশতারা ইবরাহিম আ.-এর কাছে সুসংবাদ নিয়ে আসে।
بلي ورسلنا لديهم يكتبون
হ্যাঁ, আমার ফেরেশতারা তাদের কাছে থেকে সবকিছু লিপিবদ্ধ করে।
নবি ও রাসুলদের বিষয়ে কুরআনে কারিমে তো অনেক ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন:
وما محمد الا رسول قد خلت من قبله الرسل
মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসুল, ইতোপূর্বে আরও অনেক নবি গত হয়েছেন।
يا ايها الرسول بلغ ما انزل اليك من ربك
হে রাসুল, আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বিষয় মানুষের কাছে পেঁছে দিন।
ياايها الرسول كلوا من الطيبات واعملوا صالحا
হে রাসুল, পবিত্র খানা গ্রহণ করুন, এবং নেক আমল করুন।
রাসুল শব্দের পাশাপাশি আরেকটি শব্দ হলো নবি। কুরআনে কারিমে এই শব্দটিও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মৌলিকভাবে নবি ও রাসুলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উভয়ই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রেরিত। কিন্তু শাস্ত্রীয় পরিভাষায় নবি ও রাসুল শব্দের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। এবিষয়ে তিন ধরনের মতামত পাওয়া যায়।
১. নবি ও রাসুলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যিনি নবি, তিনিই রাসুল। আল্লামা সাদ উদ্দিন তাফতাজানি রাহ. এই মতটি গ্রহণ করেছেন। শরহে আকায়িদে নাসাফি এবং শরহুল মাকাসিদ গ্রন্থে তাই উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনুল হুমাম রা.-এর মতে অনেক মুহাক্কিক উলামায়ে কেরামও এই মতটি গ্রহণ করেছেন। আল মুসায়ারাহ কিতাবে তিনি লেখেন-
واما علي ما ذكره المحققون من ان النبي انسان بعثه الله لتبليغ ما اوحي اليه وكذا الرسول فلا فرق
মুহাক্কিক আলিমগণের মতে, নবি এমন মানুষ যাকে আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রেরিত বিষয় সম্পর্কে মানুষকে অবগত করেন। রাসুলও এমনই। এ হিসেবে নবি ও রাসুলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
বিখ্যাত গবেষক আলিম, গত শতাব্দীর কিংবদন্তি মুহাদ্দিস ও ফকিহ আল্লামা আবদুর রশিদ নুমানি রাহ. বলেন, এ মতটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, কুরআনে কারিমের একটি আয়াত থেকে নবি ও রাসুলের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য বুঝে আসে। আল্লাহ তাআলা এক আয়াতে বলেন,
وما ارسلنا من قبلك من رسول ولا نبي
এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা নবি ও রাসুল শব্দের মধ্যে ‘ওয়াও’শব্দ উল্লেখ করেছেন। যা উভয়ের মধ্যে বৈপরিত্যের ইঙ্গিত করছে।
উলামায়ে কেরামের জন্য এভাবে বলি।
মা’তুফ আলাইহি এবং মা’তুফের মধ্যে বৈপরিত্য থাকে। এখানে নবি শব্দকে রাসুলের উপর আ’তফ করা হয়েছে। ফলে উভয়ের মধ্যে বৈপরিত্য সুস্পষ্ট। যদি কোনো পার্থ্যকই না থাকে, তাহলে আতফ করা হলো কেন?
২. নবি ও রাসুল পরষ্পর বিপরীতার্থক শব্দ। রাসুল, যার উপর নতুন শরিয়ত অবতীর্ণ হয়। নবি, নতুন শরিয়ত নেই যার। এজন্য কোনো রাসুল নবি নয়, আর কোনো নবি রাসুল নয়।
হযরত নুমানি রাহ. বলেন, এ মতটিও প্রত্যাখ্যাত। কারণ, কুরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা হযরত ইসমাইল [আ.] বলেন,
وكان رسولا نبيا
ইসমাইল [আ.] নবি ও রাসুল ছিলেন। একজন মানুষের ব্যাপারেই নবি ও রাসুল বলা হচ্ছে। এতে প্রতিয়মান হয়, নবি ও রাসুলের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।
৩. গ্রহণযোগ্য ও প্রণিধানযোগ্য মত হলো, রাসুলগণ রাসুল হওয়ার পাশাপাশি নবি। আর নবিরা রাসুল নন।
তবে, এক্ষেত্রে নবি ও রাসুলের সংজ্ঞা বিষয়ে উলামায়ে কেরামের মধ্যে রয়েছে বিস্তর মতপার্থক্য।
শাহ আবদুল কাদির রাহ. বলেন, ‘নবি বলা হয় যার উপর আল্লাহর নিকট থেকে ওহি অবতরণ হয়েছে। আর রাসুল বলা হয়, যার উপর নতুন কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে, অথবা যার উম্মত রয়েছে।
২. আল্লামা কাজি বায়জাবি রাহ. বলেন, রাসুল বলা হয়, যাকে নতুন শরিয়ত দেওয়া হয়েছে। আর নবি বলা হয়, যার উপর নতুন শরিয়ত অবতীর্ণ হয় নি। সাবেক শরিয়ত প্রচার করার জন্য যাকে আদেশ করা হয়েছে। হযরত মুসা আ. ও ইসা আ.এর মধ্যবর্তী সময় প্রেরিত নবিগণ এমনই ছিলেন।
বিষয়টি হাদিস শরিফ দ্বারাও সত্যায়িত। নবি সা.কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নবিদের সংখ্যা কত? নবি সা. বললেন, ১ লক্ষ ২৪ হাজার। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো, তাঁদের মধ্যে রাসুল কতজন? নবি সা. বললেন ৩১৩ জন।
কারও মতে, রাসুল বলা হয়, যার উপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে, এবং তাঁর মাধ্যমে মুজিজা প্রকাশ হয়েছে। আর নবি, যার উপর নতুন কিতাব অবতীর্ণ হয় নি।
৩. মুল্লা আলি কারি রাহ. বলেন, রাসুল বলা হয়, ওহি অবতীর্ণ করার পাশাপাশি উম্মতকে দাওয়াত করার আদেশ করা হয়েছে। আর নবি হলেন, যার উপর ওহি অবতরণ করা হয়। কিন্তু দাওয়াতের আদেশ করার বিষয়টি ব্যাপক। হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।
ইবনুল হুমাম রাহ.-এর মতে এই পার্থক্য আসহাবে হাদিস এবং আহলে জাওয়াহিরদের মত।
শায়খ মুহি উদ্দিন আকবার রাহ. এমতেরই প্রবক্তা। আল্লামা জালাল উদ্দিন মহল্লি রা.ও এমতকেই সমর্থন করেছেন।

অনেক উলামায়ে কেরাম আবার এভাবে বলেন, নবি শব্দ থেকে রাসুল শব্দ ব্যাপকতর। নবিরা কেবল মানুষ হন। রাসুল [শাব্দিকভাবে] মানুষ ও ফেরশতা উভয় হতে পারেন। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
الله يصطفي من الملائكة رسلا و من الناس
আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা এবং মানবজাতি থেকে রাসুল নির্বাচন করেন।
৪. শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর মতে, নবি হলেন যাকে কেবল মুমিনদেরকে দাওয়াত করার জন্য প্রেরণ করা হয়। আর রাসুল, যিনি মুমিন ব্যক্তি এবং কাফির সবাইকে দাওয়াত প্রদান করেন।

লেখক : মুহাম্মাদ আতাউল কারীম মাকসুদ

Leave a Comment

লগইন অথবা নিবন্ধন করুন

লগইন
নিবন্ধন