ইসলামের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে দেশ ও জাতির সহায়তা কি বৈধ?
গাযওয়া বদর বা বদর যুদ্ধ ছিলো ইসলাম ও কুফরের মাঝে যুদ্ধ, তাই আল্লাহ স্বয়ং বদর যুদ্ধের দিনকে ‘হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী দিবস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। মক্কার কিছু সংখ্যক লোক নবী কারীম সা. মক্কায় থাকাকালেই ইসলাম কবুল করেছিলো, কিন্তু যখন হিজরতের নির্দেশ এল, সকল সাহাবী ও স্বয়ং হুজুরও হিজরত করলেন তখন এলোকগুলো মক্কাতেই থেকে যায়। যখন বদর যুদ্ধের ঘটনা ঘটে, তখন তাদের কতক কাফের জ্ঞাতী গোষ্ঠির সহায়তা করতে যুদ্ধেও অংশ গ্রহণ করে এং মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। তাদের সম্পর্কে আয়াত নাযিল হয় :
“যারা নিজেদের আত্মার উপর জুলুম করেছেএ অবস্থায় ফেরেশতারা তাদের রূহ কব্জা করতে এলে বলে, ‘তোমরা কি অবস্থায় ছিলে?’ তারা বলে, ‘আমরা দুনিয়ায় অসহায় ছিলাম’। ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিলো না যে, কোথাও তোমরা হিজরত করতে?’ এমন লোকদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর তা অত্যন্ত মন্দ পরিণাম। ০ সেসব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু (এ পরিনাম থেকে তারা ব্যতিক্রম) যারা (হিজরতের বিষয়ে) কোনাপ্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে অক্ষম ছিলো এবং তারা (বের হওয়ার) কোন পথ খুঁজে পায়নি। অতএব আশা করা যায়, আল্লাহ তাদের মাফ করবেন। আল্লাহ পাপ মোচনকারী, ক্ষমাশীল।” (নিসা- ৯৭-৯৯)
বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “বদর যুদ্ধে মক্কার কিছু মুসলমান কাফেরদের দল ভারী করার উদ্দেশ্যে কাফেরদের সাথে বের হয় এবং হয়তো তাদের কেহ মুসলমান দলের তীরের আঘাতে মারা পড়ে, কেহ সাহাবীদের তরবারীর আঘাতে নিহত হয়। যারা এভাবে কাফেরদের সাথে দলের লোক হিসেবে বদর যুদ্ধে অংশ নেয় এবং মারা পড়ে তাদের উদ্দেশ্যেই এ আয়াত নাযিল হয়।” (বুখারী শরীফ, ২য় খন্ড, তাফসীর অধ্যায়, ৬৬১ পৃষ্ঠা)
হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর এ রেওয়ায়াতটি ইমাম বুখারী রহ. তার কিতাবের কিতাবুল ফিতার অধ্যায়ে (পৃঃ ১০৪৯) পুনরায় উল্লেখ করেছেন এবং হাদীসটির শিরোনামে লিখেছেন, বাব মানকারিহা য়াকছূর সাওয়াদাল ফিতান আও আয জুলুম। অর্থাৎ, ফিতনা-ফাসাদ কারী, গোনাহগার পাপী লোকদের সংখ্যাবৃদ্ধি ও প্রাবল্য সৃষ্টি করা অনুচিত।
হযরত অলী উল্লাহ রা. তার কুরআন তারজামায় উক্ত আয়াতের টিকায় লিখেছেন, দারুল হরব থেকে দারুল ইসলামে হিজরত না করে কাফেরদের সঙ্গে থেকে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি করা নাজায়েয। তাঁর এ কথায় এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, কাফেরদের সংখ্যা বৃদ্ধি করাই স্বতন্ত্র অপরাধ। তাদের সাথে মিলিত হয়ে প্রতিপক্ষ মুসলণমানদের প্রতি আক্রমণ-হামলা করুক বা নাই করুক। তেমনিভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নিমিত্তে কাফেরদের সেনা দলে ভর্তি হওয়াই হারাম। এ সম্পর্কে হ্দাীস শরীফে সুস্পষ্ট সতর্কবাণী উল্লেখিত হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সংখ্যাবৃদ্ধি করবে সে সেই স্মপ্রদায়ভুক্ত বলে গণ্য হবে। (ফাতহুল বারী, ১৩ খন্ড, ১৩২ পৃষ্ঠা সহ তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে কুরতুবী ও তাফসীরে দুররে মানসূর, সূরা নিসা, আয়াত-৯৮) দ্রষ্টব্য।) (সীরাতে মুস্তফা, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১৯০-৯১)
বদর পরবর্তী অবস্থা
মুষ্টিমেয় মুসলমান যাদেরকে কোন গণনার মধ্যেই আনা হতো না এখন তারা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দলে পরিণত হলো। তাদের প্রভাব সকল কুরাইশদের অন্তরে এমনভাবে ছেয়ে গেলো যে, আরবদের দৃষ্টি তাদের প্রতি এখন বিশেষ মর্যাদার সাথে পড়তে লাগলো। একারণে মুসলমানদের সমস্যার মধ্যেও অতিরিক্ত কিছু যোগ হলো।
মুসলমানরা নতুন যে সব সমস্যায় পতিত হলেন
১. কুরাইশী কাফেররা মুকাবালা করার জন্য পুর্বের থেকে বেশি প্রস্তুত হয়ে গেল।
২. সুতরাং মদীনার ইয়াহুদিদের প্রতি পুর্বের থেকে বেশি কঠোরতার সাথে চাপ সৃষ্টি করল যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধাচারণ করা হোক।
৩. আবূ সুফিয়ান শফথ করে নিল যে, যতক্ষন পর্যন্ত মুসলমানদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ না করব, (ততক্ষন) মাথা ধৌত করবো না।
৪. আরবের অন্যান্য গোত্রও এখন তৎপর হয়ে গেল।
৫. বিশেষ করে মদীনার ইয়াহুদিদের হিংসা এবং বিদ্বেষের কোন সীমা থাকলো না।
৬. অবশেষে বনু কাইনুকা তৎক্ষণাৎ চুক্তি ভঙ্গ শুরু করল এবং সে বছরই যুদ্ধের ঘোষণা করে দিল।
৭. নবীজী সা. কে হত্যার ষঢ়যন্ত্রও করলো।
শত্রুদের চারটি দল
১. ইয়াহুদি ২. মুশরিক ৩. মুনাফিক ৪. মদীনার চাপাশের দস্যুদল
ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যারা তখন শত্রুতায় লিপ্ত ছিলো, মদীনার শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা বিরোধিতা করে ছিলো তারা ছিলো মূলত চারটি দল। তাদের দু’দল সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে, “মুমিনদের প্রতি শত্রুতায় মানুষের মধ্যে ইয়াহুদি এবং মুশরিকদেরকেই আপনি সর্বধিক উগ্র দেখবেন। (সূরা মায়েদা- ৮২)
এখানে ইয়াহুদি এবং মুশরিকদের কথা বলা হয়েছে। আর তৃতীয় দল হলো যারা ইয়াহুদি এবং মুশরিকদের অন্তরঙ্গ বন্ধু। তারা যখন ইসলাম ও মুসলমানদের ধরাবাহিক বিজয় প্রত্যক্ষ করলো। তাদের মান মর্যাদার পথ রুদ্ধ হতে দেখলো তখন তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামে প্রবেশ করলো। তারা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এরে দল। তাদের সম্পর্কে কালামে পাকে ঘোষিত হয়েছে, “কিছু লোক আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর উপর এবং আখেরাত দিবসের উপর ঈমান এনেছি। অথচ প্রকৃতপক্ষে তারা মুমিন নয়। (বাকারা- ৮)
চতুর্থ দল হলো মদীনার চারপাশে বসবাসরত ঐসব বেদুঈন, ঈমান-কুফর কোন কিছুরই প্রতি যাদের কোন আকর্ষণ কিংবা আবেগের প্রশ্ন জড়িত ছিলো না। তারা ছিলো লুন্ঠনকারী দস্যু। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সাফল্য দেখে তারাও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলো।
তাদের আশংকা ছিলো যে, মদীনায় একটি শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়ে গেলে তাদের লুন্ঠন ও দস্যু বৃত্তির পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে তাদের অন্তরেও মুসলমানদের প্রতি হিংসার আগুণ জ্বলে উঠলো। তারাও মুসলমানদের শত্রুদল ভুক্ত হয়ে গেলো।
এ কালের শত্রু
মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা বাধা সৃষ্টি করেছিলো, বর্তমানে তাদের উত্তরসূূরীরাই ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার পথে বাধা। বর্তমানে সে ইয়াহুদি, মুশরিকরা তো আছেই, তাদের সঙ্গে তাদের মিত্রদল যারা তাদেরকে প্রভু ও বন্ধুরূপে গ্রহণ করে নিয়েছে। তাদের সন্তুষ্টির জন্য ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষয়-ক্ষতি করে থাকে। মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সে ইয়াহুদী খৃস্টানদেরকেই সাহায্য করে থাকে। মৌলবাদের নামে, জঙ্গীবাদের নামে দীন প্রেমিদের নির্যাতন ও নিধন করে থাকে। আবার ভোটের বেলায়, ক্ষমতার বেলায় এসে ইসলামী মূল্যবোধের কথা বলে, ইসলামের খেদমতের দাবী করে।
আবার বর্তমানেও ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়াকে তারাই নিজেদের স্বার্থের পথে কাঁটা মনে করে। যারা দুর্নীতি, দুঃশাসনের মাধ্যমে দেশের সম্পদ লুন্ঠন করে, ক্ষমতার জন্য সন্ত্রাস লালন করে, দস্যু বাহীনি গড়ে তোলে। তারা আশংকা করে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
ইয়্হাুদীদের চরম বিরোধিতার কারণ
ইসলামের ক্রমবর্ধমান উন্নতি দেখে ইয়াহুদী আলেমগণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে ছিলো। বিশেষ কয়েকটি কারণে।
১. তাদের একটা অহমিকা ছিলো যে, তারা ধার্মিক। ধর্মীয় দিক থেকে তারা অগ্রসরমান। সবাই ধর্মীয় বিষয়ে তাদেরকে সম্মান করতো। ইসলামের প্রচার-প্রসারের কারণে সত্যিকার ধার্মিকতা মানুষের সামনে উপস্থাপিত হলো। তাদের ভ্রান্ত ধার্মিকতার মুখোশ উম্মোচিত হলো।
২. তাদের ধার্মীক শ্রেণীর লোকদের আচার-আচারণ ও নৈতিকতার সমালোচনা করে খোলা মেলা আয়াত অবতীর্ণ হতে লাগলো। এ কারণে তাদের হতাশা আরো বেড়ে গেলো।
সূরা মায়েদার ৪২ নং আয়াতে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “এরা মিথ্যা শুনতে অত্যন্ত আগ্রহী ও অবৈধ ভক্ষণে বড়ই আসক্ত” আর একই সূরার ৬২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তাদের মধ্যে এমন অনেক লোককেই আপনি দেখবেন যে, তারা পাপ, অবাধ্যতা এবং হারাম ভক্ষণে পরষ্পর প্রতিযোগিতা করছে। তারা যে সব কাজ করছে তা কতইনা মন্দ”।
আর সূরা নিসার ১৬১ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আর তারা সুদ গ্রহণ করতো। অথচ তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। আর তারা লোকদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করতো। তাদের মধ্যে যারা কাফের তাদের জন্য আমি আমি প্রস্তুত করে রেখেছি মর্মান্তুদ শাস্তি। এসব কথা শোনে তাদের অনেকেই ইসলামের বিরোধিতায় লেগে গেলো।
৩. ইসলামের ধারাবাহিক বিজয়, শক্তি উন্নতি দেখে তারা আশংকা করছিলো যে, একদিন না একদিন তাদেরকে মুসলামানদের সামনে মাথা নত করতে হবে।
নবীজী সা. কে হত্যার চেষ্টা
বদর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুশরিকরা ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। রাসূল সা. কে হত্যা করে পরাজয়ের গ্লানি ও অপমানের প্রতিশোধ নিতে চায়। সফওয়ান এবং উমায়ের একদিন হাতিমে বসে শলা-পরামর্শ করে। সফওয়ান উমায়েরর ঋণ মুক্তির জিম্মাদারী নেয়ায় উমায়ের রাসূল সা. কে হত্যার উদ্দেশ্য মদীনাতে আসেন এবং রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাৎ করে। রাসূল সা. মক্কার গুপ্ত ষঢ়যন্ত্র এবং সাফওয়ানের সাথে প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রতির সব কথা ব্যক্ত করে দিলেন। তখন সে অনুতপ্ত হয়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।
বনু কাইনুকার যুদ্ধ ও তার কারণ
বনু কাইনুকার সঙ্গে যুদ্ধ করার কারণঃÑ
১. তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত হলো
২. মুসলামানদের পরষ্পরে দ্বন্দ্ব, কলহ এবং গন্ডগোল বাধানোর অপচেষ্টা করলো
৩. প্রকাশ্যভাবে শত্রুতার ভাব প্রকাশ করলো এবং অঙ্গিকার ভঙ্গ করলো
রাসূল সা. এর উপদেশ
ইমাম আবু দাউদ এবং অন্যান্যরা হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সা. বদর প্রান্তরে কুরাইশদের পরাজিত করে যখন মদীনায় আগম করলেন তখন বনু কাইনুকার বাজারে ইয়াহুদিদের একত্রিত করে বললেন, “হে ইয়াহদি সমাজ! তোমরা আনুগত্য স্বীকার কর। অন্যথায় কুরাইশদের মত তোমাদেরকেও বিপন্ন হতে হবে।”
তাদের জবাব
কিন্তু তারা তাঁর উপদেশ গ্রহণ করলো না। চরম দৃষ্টতাসহকারে তারা বলতে লাগলো, হে মুহাম্মদ! কতগুলো আনাড়ী কুরাইশীকে হত্যা করেছ বলে গর্বিত হইওনা। যুদ্ধ সম্বন্ধে তারা একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলো। কিন্তু আমাদের সাথে যুদ্ধ হলে তখন বুঝতে পারবে ব্যাপারটা কত কঠিন। (আওনুল মা’বুদহ সুনানে আবী দাউদ, ৩য় খন্ড, ১১৫ পৃষ্ঠা এবং ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃষ্ঠাা ৫৫২)
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিজবাব
“যারা কুফরী করে তাদেরকে বল, তোমরা শীঘ্রই পরাভূত হবে এবং তোমাদেরকে জাহান্নামে একত্রিত করা হবে। আর সেটা হচ্ছে কত নিকৃষ্ট আবাসস্থল। দু’টি দলের পরষ্পর সম্মখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। এক দল আল্লাহর পথে সংগ্রাম করেছিলো, অন্য দল ছিলো কাফির। তারা তাদের দৃষ্টিতে তাদেরকে দ্বিগুণ দেখছিলো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা নিজ সাহায্যের দ্বারা শক্তিশালী করেন। নিশ্চয় এতে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। (সূরা আল ইমরান ১২-১৩)
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
আবু আওন থেকে ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন যে, এ সময়ে জনৈকা মুসলিম মহিলা বনু কাইনুকার বাজারে দুধ বিক্রি করে বিশেষ কোন প্রয়োজনে এ ইয়াহুদি স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে বসে পড়েন। কয়েকজন দুর্বৃত্ত ইয়াহুদী তারে মুখের অবগুন্টন খোলাবার অপচেষ্টা করে, এতে মহিলাটি অস্বীকার করেন। উক্ত স্বর্ণকার গোপনে মহিলাটির পরিহিত বস্ত্রের এক প্রান্ত তার পিঠের ওপরে গিরা দিয়েছিলো তিনি তা বুঝতেই পারলেন না। তিনি উঠতে গিয়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়লেন। এই ভদ্র মহিলাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখে করে নর পিশাচের দল হো হো করে হাত তালি দিতে থাকলো। মহিলাটি ক্ষোভে ও লজ্জায় মৃত প্রায় হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন। তা শুনে জনৈক মুসলমান ঐ স্বর্ণকারকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। অপর দিকে ইয়াহুদীগণ মুসলমানটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে হত্যা করে।
এরপর নিহত মুসলমানটির পরিবারবর্গ চিৎকার করে ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের নিকট ফরিয়াদ করলেন। এর ফলে মুসলমান ও বনু কাইনুকার ইয়াহুদীদের মধ্যে সংঘাত বেঁেধ গেলো। (ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, ৪৭-৪৮পৃষ্ঠা)
রাসূল সা. এর সময়োপযোগী পদক্ষেপ
এ ঘটনার পর রাসূল সা. এর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। তিনি মদীনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হযরত আবু লুবাবাহ ইবনে আবদুল মুনযির রা. এর ওপর অর্পণ করে স্বয়ং হযরত হামযাহ ইবনু আবদুল মুত্তালিব রা. এর হাতে মুসলমানদের পতাকা প্রদানপুর্বক আল্লাহর সেনাবাহীনিকে সঙ্গে নিয়ে বনু কাইনুকার দিকে ধাবিত হলেন। ইয়াহুদীরা তাদেরকে দেখা মাত্র দুর্গের মধ্যে আশ্রয়গ্রহণ করে দুর্গের দ্বারগুলো উত্তমরূপে বন্ধ করে দিলো। রাসূলুল্লাহ সা. কঠিনভাবে তাদের দুর্গ অবরোধ করলেন। এ দিনটি ছিলো শুক্রবার, হিজরী ২য় সনের শাওয়াল মাসের ১৫ তারিখ। ১৫ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ যুলকাদার নতুন চাঁদ উদয় হওয়া অবধি অবরোধ জারি থাকলো। অতপর আল্লাহ তাআলা ইয়াহুদীদের অন্তরে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করলেন এবং তার নীতি এটাই যে, যখন তিনি কোন সম্প্রদায়কে পরাজিত ও লাঞ্ছিত করার ইচ্ছা করেন। তখন তিনি তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে থাকেন। অবশেষে বনু কাইনুকা আত্মসমর্পণ করলো এবং বলল যে, রাসূলুল্লাহ সা. এর নির্দেশক্রমে তাদের সকলকে বেঁধে নেয়া হয়।
প্রাণদন্ড রহিত হওয়ার কারণ
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার কপট চাল চালবার সুযোগ গ্রহণ করলো। সে রাসূলুল্লাহ সা. কে অত্যন্ত অনুনয় বিনয় করে বলল, “হে মুহাম্মদ সা.! আপনি এদের প্রতি সদয় ব্যবহার করুন।” প্রকাশ থাকে যে, বনু কাইনুকা গোত্র খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিলো। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের ব্যপারে বিলম্ব করলেন। সে পিড়াপিড়ি করতে থাকলো। রাসূলুল্লাহ সা. তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু শেষ সে তাঁর সা. জামার বুকের অংশ বিশেষ ধরে ফেলল। রাসূলুল্লাহ সা. বিশেষ বিরক্তি ও ক্রোধ সহকারে পুনঃ পুনঃ তাকে ছেড়ে দিতে বললেন, কিন্তু সে পুনঃ পুনঃ উত্তর করতে লাগলো, “আমি কোন মতেই ছাড়বো না যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ওপর দয়া পরবশ হন। চারশ’ জন খোলা দেহের যুবক এবং তিনশ’ জন বর্মপরিহিত যুবককে আপনি একই দিনের সকালে কেটে ফেলবেন, অথচ তারা আমাকে কঠিন বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলো। আল্লাহর কসম! আমি কালচক্রের বিপদের আশংকা করছি।”
অবশেষে রাসূলুল্লাহ সা. এই মুনাফিকের প্রতি দয়া প্রদর্শণ করলেন যে, মাত্র এক মাস পূর্বে যে বাহ্যত ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার খাতিরে তিনি তাদের প্রত্যেকেরই প্রাণদন্ড রহিত করেন। তবে অবশ্যই তিনি তাদের মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সুতরাং তারা সকলেই সিরিয়ার দিকে চলে গেল এবং অল্পদিনের মধ্যে তাদের অধিকাংশই তথায় মৃত্যু বরণ করলো।
তাদের থেকে অর্জিত আসবাব
রাসূলুল্লাহ সা. তাদের যে ধন-মাল হস্তগত করলেন সেগুলির মধ্যে তিনটি কামান, দুটি বর্ম, তিনটি তরবারী, এবং তিনটি বর্শা নিজের জন্য বেছে নেন এবং গণীমতের মালের এক পঞ্চমাংশও বের করেন। মুহাম্মদ ইবনু মাসলাম রা. গণীমত একত্রিত করার কাজ সম্পাদন করেন। (যাদুল আমাদ, ২য় খন্ড, ৭১ ও ৯১পৃষ্ঠা এবং ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, ৪৭-৪৯ পৃষ্ঠা)
গাযওয়ায়ে সাভীক বা ছাতুর যুদ্ধ
বদর যুদ্ধের মাত্র দু’মাস পর হিজরী ২য় সনের যিলহজ্জ মাসে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে দু’শ জন অশ্বারোহী নিয়ে নীর’ নামক পর্বত প্রান্তে তাবু স্থাপন করে। এই জায়গাটি মদীনা হতে প্রায় বারো মাইল দুরত্বে অবস্থিত।
যুদ্ধের কারণ
১. সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া ইয়াহুদী এবং মুনাফিকদের নিজ নিজ ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা।
২. আবু সুফিয়ানের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করা। কারণ আবু সুফিয়ান কষ্ট কম আর ফল ভাল হওয়া এবং স্বীয় কওমের মর্যাদা রক্ষা ও তাদের শক্তি প্রকাশ করার ইচ্ছায় এই বলে প্রতিজ্ঞা করে ছিলো যে, অপবিত্রতার কারণে তার মস্তক পানি স্পর্শ করবে না যে পর্যন্ত না সে মুহাম্মদ সা. এর সাথে যুদ্ধ করবে।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
সে রাতের অন্ধকারে তারা মদীনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং হোয়াই ইবনু আখতারের নিকটে গিয়ে তার দরজা খুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুলে নেয়। কিন্তু হোয়াই পরিণাম চিন্তা করে তাকে তার বাড়িতে প্রবেশ করার অনুমতি তে অস্বীকার করে। আবু সুফিয়ান তখন সেখান হতে ফিরে গিয়ে বনু নযীরের সালাম আবনু মুসকিম নামক আর এক সর্দরের নিকট উপস্থিত হয়। সে বনু নযীর গোত্রের কেষাধক্ষ্য ছিলো। আবু সুফিয়ান তার বাড়ির ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলে সে অনুমতি প্রদান করে। সে তার অতিথী সেবাও করে। খাদ্য ছাড়া মদও পাণ করায় এবং লোকদের গোপনীয় অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করে রাতের শেষভাগে আবু সুফিয়ান সেখান থকে বের হয়ে নিজের সঙ্গীদের সাথে মিলিত হয় এবং একটি দল পাঠিয়ে মদীনার পার্শ্ববর্তী আরীয নামক একটি জায়গায় হামলা করার জন্য তাদের নির্দেশ দেয়। ঐ দলটি তথাকার কিছু খেজুর গাছ কর্তন করে এবং জ্বালিয়ে দেয়, আর একজন আনসারী ও তার মিত্রকে তাদের জমিতে পেয়ে হত্যা করে। পরে তারা দ্রুত বেগে মক্কার পথে পলায়ন করে। রাসূলুল্লাহ সা. এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই আবু লুবাব ইবনু আবদুল মুনযির রা. এর ওপর মদীনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করে দ্রুত গতিতে আবু সুফিয়ান এবং তার সঙ্গীদের পিছু ধাওয়া করেন।
ফলাফল
তাদের পলায়নের গতি আরো দ্রুত হওয়ায় তাদের যদিও ধরা স্মভব হয়নি। কিন্তু এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপুল পরিমাণে ছাতু, পাথেয় এবং বহু আসবাব পত্র হস্তগত হয়। অবশেষে রাসূলুল্লাহ সা. ‘কারকুরাতুল কুদর’ পর্যন্ত পশ্চাদ্ধাবন করে ফিরে আসেন।
গাযওয়ায়ে গাত্বফান
তৃতীয় হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে বনী মুহারিব গোত্রের দু’ছূর নামক এক ব্যক্তি বনী ছা’লাব এবং বনী মুহারিবের ৪৫০ জন লোক নিয়ে মদীনায়ে মুনাওয়ারার উপর আক্রমণ করে মুসলমানদের ক্ষতীসাধন করার জন্য। হুজুর সা. যখন তাদের এ বিষয়টি অবগত হলেন, তখন হুজুর সা. তাদের মুকাবালা করার জন্য মদীনার বাইরে আগমন করলেন। দু’ছূর এবং তার সঙ্গীরা ভয় পেয়ে পাহাড়ে গিয়ে আত্মগোপন করল। হুজুর সা. নিশ্চিন্ত হয়ে ময়দান থেকে ফিরে এলেন।
যুদ্ধের কারণ
১. ইসলাম এবং মুসলামানদের ক্ষতিসাধন করে তাদের নির্মূল করে দেয়া।
২. বদরের বিজয়ে তাদের এই ইচ্ছা আরো দৃঢ় এবং শক্তিশালী হওয়া।
হুজুর সা. এর মহানুভবতা
ঐ সফরে ঘটনাক্রমে কিছুটা বৃষ্টিপাত হয়েছিলো। ময়দান থেকে ফিরে হুজুর সা. নিজের কাপড় খুললেন এবং একটি গাছের উপর শুকানোর জন্য ছড়িয়ে দিলেন। দোজাহানের বাদশাহ হুজুর সা. (গাছের) ছয়ায় বিশ্রাম করার জন্য মাটিতে শুয়ে গেলেন। সেনাদলের লোকেরা কিছু দূরে ছিলো। দু’ছূর পাহাড়ের উপর থেকে হুজুর সা. কে একাকী দেখলো এবং সুযোগটিকে কাজে লাগাতে সে তৎক্ষণাৎ হুজুর সা. এর শিয়রে পৌঁছে গেল। তলোয়ার উত্তোলন করে সে হুজুর সা. কে বলল, ‘বল এখন আমার হাত থেকে তোমামে কে বাঁচাবে?’ রাসূলুল্লাহ সা. অত্যন্ত শান্তভাবে উত্তর দিলেন, ‘আমার আল্লাহ’। কি ছিলো এ একটি বাক্যে? দু’ছূর ভীত বিহ্বল হয়ে কাঁপতে আরম্ভ করলো এমনকি তার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেলো আর সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তখন নবী কারীম সা. তরবানী খানা উঁচিয়ে নিয়ে বললেন, ‘তুমি বল, এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে?’ তার নিকট ‘কেউ নয়’ এ কথা ছাড়া আর কিইবা জবাব ছিলো ! মানবতার পরম বন্ধু করুণার দ্বার উম্মোচন করে অনুভব করলেন তার অসহায়ত্বকে। তিনি তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
দু’ছূর এখান থেকে উঠে চলে গেল, কিন্তু অন্তরে এমন গভীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে ফিরে গেল যে, সে শুধু নিজে মুসলমান হয়েছে তাই নয়; বরং নিজ গোত্রে ফিরে গিয়েইসলামের এক মহান প্রচাারকে পরিণত হলো।
লেখক : মাওলানা আবদুর রাজ্জাক