মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করা জরুরী। মূলনীতি নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করেছেন শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহি.। হজের শাব্দিক অর্থ হলো ইচ্ছে করা। কিন্তু শরিয়তে হজ্ব একটি নির্দিষ্ট পরিভাষা। হজ্ব বললে নির্দিষ্ট মাসে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট কিছু কর্মকে আমরা বুঝি। এখন মনে করুন এক ব্যক্তি পল্টন থেকে গুলিস্তান যাওয়ার নিয়ত করেছে। তার জন্য এখানে শাব্দিক অর্থে হজ্ব শব্দ ব্যবহার করা অনুচিত।
মুরতাজা হাসান জাবিদি রাহি. (১২০৫ হি.) রব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:
رَبُّ كلِّ شيءٍ، أَي مالِكُه، لَهُ {الرُّبُوبِيَّةُ على جَمِيعِ الخَلْقِ، لَا شَرِيكَ لَهُ، وَهُوَ رَبُّ} الأَرْبَابِ، ومَالِك المُلوكِ والأَمْلاَكِ، قَالَ أَبو مَنْصُور:! والرَّبُّ يُطْلَقُ فِي اللُّغَة على المَالِكِ، والسَّيِّدِ، والمُدَبِّرِ، والمُرَبِّي، والمُتَمِّمِ و (بالَّلامِ لاَ يُطْلَقُ لِغَيْرِ اللَّهِ عَزَّ وجَلَّ)
অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তুর মালিককে বলা হয় রব। আবু মানসুর বলেন, শাব্দিক অর্থে রব মালিক, নেতা, মুরব্বি অভিভাবক ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে আলিফ, লামসহ ব্যবহার হলে অর্থ নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তখন শুধুমাত্র আল্লাহকেই বুঝায়।
ইবনুল মুনজির রাহি. বলেন,
وربُّ كلِّ شيءٍ: مالِكُه ومُسْتَحِقُّه؛ وَقِيلَ: صاحبُه. وَيُقَالُ: فلانٌ رَبُّ هَذَا الشيءِ أَي مِلْكُه لَهُ. وكُلُّ مَنْ مَلَك شَيْئًا، فَهُوَ رَبُّه. يُقَالُ: هُوَ رَبُّ الدابةِ، وربُّ الدارِ، وفلانٌ رَبُّ البيتِ، وهُنَّ رَبَّاتُ الحِجالِ؛ وَيُقَالُ: رَبٌّ، مُشَدَّد؛ ورَبٌ، مخفَّف؛
অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তুর মালিককে রব বলা হয়। আরবি ভাষায় যদি বলা হয়, অমুক এ বস্তুর রব হয়েছে, তাহলে উদ্দেশ্য হলো, মালিক হয়েছে। বলা হয়, চতুষ্পদ জন্তুর রব, বাড়ির রব, অমুক ঘরের রব ইত্যাদি।
মালিক অর্থে রব শব্দটি প্রসিদ্ধ হাদিসে জিবরিলে ব্যবহৃত হয়েছে। জিবরিল আ. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন,
وأَن تَلِدَ الأَمَةُ رَبَّها، أَو رَبَّتَها
অর্থাৎ দাসী তার রব তথা মালিককে প্রসব করবে।
ইসলামি পরিভাষায় রব আল্লাহ তাআলার একটি নাম। রবের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আল্লামা ইবনু কায়্যিমিল জাওজিয়্যাহ রাহি. বলেন,
قيوما. قام بنفسه وقام به كل شيء فهو قائم على كل نفس بخيرها وشرها. قد استوى على عرشه وتفرد بتدبير ملكه.
فالتدبير كله بيديه ومصير الامور كلها إليه, فمراسيم التدبيرات نازلة من عنده على أيدي ملائكته بالعطاء والمنع والخفض والرفع والإحياء والإماتة والتوبة والعزل والقبض والبسط وكشف الكروب وإغاثة الملهوفين وإجابة المضطرين {يَسْأَلُهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ} , لا مانع لما أعطى ولا معطي لما منع ولا معقب لحكمه ولا راد لأمره ولا مبدل لكلماته تعرج الملائكة والروح إليه وتعرض الأعمال أول النهار وآخره عليه فيقدر المقادير ويوقت المواقيت ثم يسوق المقادير إلى مواقيتها قائما بتدبير ذلك كله وحفظه ومصالحه.
অর্থাৎ তিনি নিজে কল্যাণ এবং অকল্যাণ সবকিছু করতে সক্ষম। তিনি আরশে ইসতেওয়া করেছেন। পৃথিবী পরিচালনায় তিনি একক। তিনি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো ফিরিশতাদের জানান। এক কথায় রব হলেন তিনি, যিনি প্রত্যেককে তার যোগ্যতা ও উপযুক্ততা বিবেচনা করে যখন যা প্রয়োজন তা দিয়ে ধীরে ধীরে লালন-পালন করে পূর্ণতায় পৌঁছান। তিনি কোন কিছু দান করলে কেউ বাধা দিতে পারে না। এমনভাবে বাধা দিলে কেউ দান করতে পারে না। তার হুকুম কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। তার কথা কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। তিনি তাকদির নির্ধারণ করেন। এরপর তাকদির অনুযায়ী নির্ধারিত সময় সে কাজ সম্পাদন হয়। পৃথিবীর সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
মূলকথা হলো রবতো রবই। এটা অন্য ভাষায় পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। রবের অর্থ এতটাই ব্যাপৃত যে, কুরআনে ৯০০ এর চেয়ে বেশি জায়গায় রব শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য এক কথায় বলতে গেলে রব আল্লাহ তাআলার একটি নাম। এ নামের ভিতর আল্লাহ তাআলার বেশিরভাগ নাম চলে আসে। ইবনে কাসির রাহি. এর মতে রব শব্দের যতগুলো অর্থ হতে পারে, সবগুলো আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
রব আল্লাহর বিশেষ নাম হওয়ার কারণে কোন ধরণের ইজাফাত তথা সম্বন্ধ ছাড়া অন্য কারও ক্ষেত্রে এ নাম ব্যবহার করা জায়েজ নেই। ইবনে কুতাইবা রাহি. বলেন,
ولا يقال للمخلوق: هذا الرب معرفاً بالألف واللام كما يقال لله، إنما يقال رب كذا فيعرف بالإضافة لأن الله مالك كل شيء، فإذا قيل: الرب دلت الألف واللام على معنى العموم، وإذا قيل لمخلوق: رب كذا ورب كذا نسب إلى شيء خاص لأنه لا يملك شيئاً غيره
অর্থাৎ কোন মাখলুককে রব বলা যাবে না। তবে সম্বন্ধ করে অমুক জিনিসের রব বলা যাবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা সবকিছুর মালিক। যদি সম্বন্ধ ছাড়া ব্যাপকভাবে রব বলা হয়, তাহলে এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা উদ্দেশ্য হোন। কোন মানুষের দিকে রব শব্দের সম্বন্ধ হলে এর দ্বারা সে বিশেষ কোন বস্তুর মালিক হওয়া প্রমাণিত হয়।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা অন্যান্য নামের তুলনায় রব নামটি বেশি ব্যবহার করেছেন। অধিকাংশ নবী আল্লাহর কাছে এ নামে মিনতি করেছেন। উদাহরণস্বরুপ কয়েকজন নবীর কথা উল্লেখ করছি। আমাদের আদি পিতা আদম আ. এবং মাতা হাওয়া আ. কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন,
رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
অর্থ, হে আমাদের রব আমরা নিজেদের প্রতি জুলম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব। ।
হজরত নুহ আ. দোয়ায় একাধিক জায়গায় রব শব্দ বলে আল্লাহকে ডেকেছেন। তিনি বলেন,
رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ
অর্থ, হে রব, আমাকে এবং আমার পিতা-মাতাকে ক্ষমা করে দিন।
رَبِّ إِنَّ ابْنِي مِنْ أَهْلِي
অর্থ, হে আমার রব, আমার ছেলে আমার পরিবারের অন্তর্ভূক্ত।
মুসা আ. আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন,
رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلأَخِي وَأَدْخِلْنَا فِي رَحْمَتِكَ
অর্থ, হে আমার রব, আমাকে এবং আমার ভাইকে ক্ষমা করুন, আমাদের আপনার রহমতে আবৃত করে রাখুন।
ইউসুফ আ. বলেন,
رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ
অর্থ, হে আমার রব, তারা আমাকে যে কাজের জন্য আহবান করেছে, তারচেয়ে কারাগার আমার কাছে অধিক প্রিয়।
কুরআনে যে সকল নবীদের কথা আলোচিত হয়েছে, তাদের অধিকাংশ-ই রব নামে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। নবীরা ছাড়াও কুরআনে পূণ্যবান বান্দাদের দোয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। তারাও রব নামে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। এক আয়াতে বলা হয়েছে,
رَّبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلإِيمَانِ أَنْ آمِنُواْ بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الأبْرَارِ رَبَّنَا وَآتِنَا مَا وَعَدتَّنَا عَلَى رُسُلِكَ وَلاَ تُخْزِنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّكَ لاَ تُخْلِفُ الْمِيعَادَ
অর্থ, হে আমাদের রব! আমরা নিশ্চিতরূপে শুনেছি একজন আহবানকারীকে ঈমানের প্রতি আহবান করতে যে, তোমাদের পালনকর্তার প্রতি ঈমান আন; তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব! অতঃপর আমাদের সকল গোনাহ মাফ কর এবং আমাদের সকল দোষত্রুটি দুর করে দাও, আর আমাদের মৃত্যু দাও নেক লোকদের সাথে। হে আমাদের রব! আমাদেরকে দাও, যা তুমি ওয়াদা করেছ তোমার রসূলগণের মাধ্যমে এবং কিয়ামতের দিন আমাদিগকে তুমি অপমানিত করো না। নিশ্চয় তুমি ওয়াদা খেলাফ করো না। ।
অপর আয়াতে বলা হয়েছে,
رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا
অর্থ, হে আমার রব, আমাদের কাছ থেকে জাহান্নামের শাস্তি হটিয়ে দাও। নিশ্চয় এর শাস্তি নিশ্চিত বিনাশ।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ দোয়ায় মহান আল্লাহ তাআলাকে রব বলে সম্বোধন করেছেন। এক হাদিসে তিনি বলেন,
ألا أدلك على سيد الاستغفار، اللهم أنت ربي لا إله إلا أنت……
অর্থ, আমি কি তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসতেগফার সম্পর্কে অবগত করব? সেটা হল, আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা…। অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি আমার রব। আপনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই…।
এছাড়া মুসিবতের সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত দোয়া করতেনÑ
্রلاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ العَظِيمُ الحَلِيمُ، لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ العَرْشِ العَظِيمِ، لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ السَّمَوَاتِ وَرَبُّ الأَرْضِ، وَرَبُّ العَرْشِ الكَرِيمِগ্ধ
পরাক্রমশালী মহানুভব আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, যিনি হলেন আরশের রব। আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, যিনি আসমান, জমিন এবং সম্মানিত আরশের রব।
কুরআন, হাদিস, সাহাবা এবং তাবেয়িনরা এত অধিক রব শব্দ ব্যবহার করেছেন, যেগুলো জমা করলে কয়েক খণ্ডের বই হয়ে যাবে। এর থেকে আমরা রব শব্দের বিশালত্ব অনুমান করতে পারি। কোন নির্দিষ্ট শব্দ বা অর্থ দিয়ে রবকে ফুটিয়ে তোলা একেবারে অসম্ভব। ইবনে তাইমিয়া রাহি. এর মতে রব তো রব-ই। অন্য কোন শব্দ বা ভাষা দ্বারা সেটা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ বিশালত্বের কারণে কাফেররাও আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করেছিল। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
قُلْ مَن يَرْزُقُكُم مِّنَ السَّمَاء وَالأَرْضِ أَمَّن يَمْلِكُ السَّمْعَ والأَبْصصَارَ وَمَن يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيَّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ الأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللّهُ فَقُلْ أَفَلاَ تَتَّقُونَ
অর্থ, তুমি জিজ্ঞেস কর, কে রুযী দান করে তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে, কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ! তখন তুমি বলো তারপরেও ভয় করছ না?
এখানে যে কয়েকটি কাজের কথা বলা হয়েছে, ইবনুল কায়্যিম রাহি. এর সংজ্ঞা মতে সবগুলো রবের অর্থের মাঝে বিদ্যমান। সুতরাং কাফেররাও এক অর্থে আল্লাহকে রব মানে। কিন্তু এরপর তারা শিরক করার কারণে মুশরিক।
বর্তমানে কেউ কেউ রবকে বাদশাহ বা রাষ্ট্রপতি হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। পূর্বের আলোচনা থেকে আশা করি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, রবের অর্থ অনেক বিস্তৃত এবং গভীর। এর বিপরিত রাষ্ট্রপতি এবং বাদশাহ এবং সীমিত অর্থ বহন করলে। এজন্য পরিভাষাগতভাবে রবকে এ ধরণের শব্দ দ্বারা উপস্থাপন করলে শরিয়তের পরিভাষা বিকৃত হয়ে যায়। রবতো রব-ই। বর্তমানে আধুনিক কোন পরিভাষা দিয়ে রবকে উপস্থাপন করার প্রয়োজন নেই। যুগে যুগে নেতা, বাদশাহকে বুঝানোর জন্য বিভিন্ন পরিভাষা বিভিন্ন এলাকায় ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সালফে সালেহিনের কেউই রব বুঝানোর জন্য সেগুলো ব্যবহার করেননি। এজন্য রবের অর্থ বিকৃত হয়ে গেছে দাবি করা যেমনভাবে অবান্তর, তেমনভাবে রবের নতুন অর্থ আবিষ্কার করাও অবান্তর। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন।
লেখক : রেজাউল কারীম আবরার, লেখক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষক