উপক্রমণিকা :
ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে যাকাত। যাকাত সঠিকভাবে উত্তোলন এবং সুষম বণ্টন নীতি চালু থাকলে মানুষের আর্থিক দুর্দশা কেটে যেতো। একটি সমৃদ্ধশালী সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনের জন্য যাকাতের সুষ্ঠু ব্যাবহারের বিকল্প নেই।
ইরশাদ হচ্ছে
انما وليكم الله ورسوله والذين امنوا الذين الصلوة ويؤتون الزكوة وهم ركعون
অনুবাদ :
নিশ্চয়ই তোমাদের বন্ধু তো অাল্লাহ্ তায়া’লা, তার রাসূল ও মুমিনগণ ; যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে এবং বিনম্র হয়।
আয়াতের তথ্য সমূহ :
সূরা মায়িদা। সূরা নং ০৪, আয়াত নং ৫৫। পারা নং ০৬। সূরাটি মাদানী তথা হিজরতের পরে অবতীর্ণ হয়েছে। (www.iscabd.org)
অবতীর্ণের সময়কাল :
সূরা মায়িদার ০৮ রুকু ওহুদ যুদ্ধের পরে অবতীর্ণ হয়েছে। আর উল্লিখিত ৫৫ নং আয়াতটি এরই অংশ বিশেষ।
সুরার নামকরণ :
সুরা মায়িদা এর নামকরণ হয়েছে (تسمية كل بإسم الجزء) অনুসারে। অর্থাৎ সূরার ১১২ ও ১১৪ নং আয়াতে মায়িদা শব্দটির উল্লেখ রয়েছে।
আয়াতের শানে নুযূল :
অায়াতটির শানে নুযূল সম্পর্কে কয়েকটি অভিমত রয়েছে। যেমন :
১. ইবনে মারদুবিয়া সুফিয়ান সাওরীর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন। হযরত ইবনে অাব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত অালী ইবনে অাবি তালেব রা. নামাযে দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি যখন রুকু অবস্থায় তখন একজন ভিক্ষুক এসে তার কাছে কিছু চাইলেন। হযরত অালী রা. তাকে তাঁর অাংটিটি দিয়ে দিলেন। তখন অল্লাহ্ তায়া’লা অালোচ্য অায়াতটি অবতীর্ণ করলেন।
২. হযরত অাবু সালেহ ইবনে অাব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন তার হুজরা মোবারক থেকে মসজিদের দিকে বের হলেন। তখন কতিপয় লোক রুকু অবস্থায়, কতিপয় লোক সেজদা অবস্থায়, কতিপয় লোক দাঁড়ানো অবস্থায়, কতিপয় লোক বসা অবস্থায় ছিল। সেখানে একজন ভিক্ষুক ভিক্ষা করছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা তোমাকে কে দান করেছে? ভিক্ষুকটি হযরত অালী রাঃ দিকে ইঙ্গিত করল। রাসূল অাবার জিজ্ঞেস করলেন, কী অবস্থায় দিয়েছে? সে বলল, অামাকে তিনি রুকু অবস্থায় দান করেছেন। এটা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীর ধ্বনি প্রদান করলেন। অার তখনই অাল্লাহ্ তায়া’লা অালোচ্য অায়াত অবতীর্ণ করলেন।
৩. হযরত জাবির ইবনে অাব্দুল্লাহ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এ অায়াত হযরত অাব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রা. সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হয়ে অারজ করলেন, হে অাল্লাহর রাসূল! অামার স্বগোত্র বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা সম্প্রদায় অামাকে পরিত্যাগ করেছে এবং অামার সাথে সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করে অামাকে দূরে রাখতে চাচ্ছে। তখন অাল্লাহ্ তায়া’লা এ অায়াত অবতীর্ণ করেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এটা পাঠ করে শুনান। তখন হযরত অাব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রা. বলেন, অামি অাল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছি অার কাফেরদের বন্ধুত্ব থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছি। (www.icabdlibrary.com)
মূল বক্তব্য :
মুমিনের বন্ধু কারা-এই প্রশ্নের উত্তরেও সালাত-যাকাতের প্রসঙ্গ শামিল রয়েছে। এছাড়া কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, সালাত ও যাকাতের পাবন্দি ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রশ্নই অবান্তর। কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে, যেখানে খাঁটি মু’মিনের গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে সেখানে সালাত-যাকাতের কথা এসেছে অপরিহার্যভাবে।
الذ ين ان مكنهم في الارض اقاموا الصلوة واتوا الزكاة-
তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে।
(সূরা হজ্জ্ব : ৪১)
এছাড়াও যাকাত সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াত সমূহের মাঝে যাকাতদাতার দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণের স্বরুপ ফুটে উঠেছে।
যাকাতের পরিচয় :
“যাকাত” শব্দটি অারবী। এর অর্থ : বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্র করা।
পরিভাষায় : নেছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক কর্তৃক বছরান্তে শরিয়তের পক্ষ থেকে তার মালের উপর নির্ধারিত অংশ নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলে। (www.facebook.com/iscabd91)
যাকাতের গুরুত্ব :
ইসলামী শরিয়তে পাঁচটি মূল বুনিয়াদি রুকন বা স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম। যাকাত একটি ইবাদত যেমন নামায একটি ইবাদত। ধনাঢ্য লোকদের জন্য অাল্লাহর নৈকট্য লাভে নামায ও যাকাতের কোন বিকল্প নেই। মানুষ অাল্লাহর প্রিয় হওয়ার জন্য দুটি জিনিস জরুরী।
১. অাল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক জোড়া।
২. বান্দার সাথে সুসম্পর্ক গড়া।
অাল্লাহর সাথে সম্পর্ক হয় নামাযের মাধ্যমে। অার বান্দার সঙ্গে সম্পর্ক হয় দানের মাধ্যমে। যাকাতের মাধ্যমে। এ কারণে কুরআনে কারীমের বত্রিশ জায়গায় যাকাতের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে অাটাশ জায়গায় নামায ও যাকাতের কথা একত্রে বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে :
واقيموا الصلوة واتوا الزكاة
“তোমরা নামায কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর।” (সূরা মুজ্জাম্মিল : ২০)
অাল্লাহ্ তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর রাস্তায় ব্যয় করার জন্য বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন। প্রথমে অাল্লাহ্ করয চেয়েছেন।
واقرضوا الله قرضا حسنا
“অাল্লাহ্কে করযে হাসানা( উত্তম করয) দাও।” (সূরা মুজ্জাম্মিল : ২০)
তিনিই প্রকৃতপক্ষে ধনী অার অামরা দুনিয়াবাসী সকলেই মূলত ফকীর। তবে তার করযের দরকারটা,কি? তিনি কার জন্য তলব করেছেন? গরিব, মিসকিন, অসহায় এতিমের জন্য। এই করয দিলে কী হবে? অাল্লাহ্ বলেন,
تجدوه عند الله
“তোমরা এর বিনিময় অাল্লাহর কাছে পাবে”। গরিবদেরকে দেওয়া মানে অামাকে দেওয়া। অার গরিবদের খেদমত করা মানে অামার খেদমত করা। যাকাত-সাদকা মূলত অাল্লাহ্কে দেওয়া হয়। অাল্লাহ্ তা গ্রহণ করেন। (www.twitter.com/iscabd91)
অাল্লাহ্ তায়া’লা বলেন- তারা কি জানে না যে, অাল্লাহ্ তো তার বান্দার তাওবা কবুল করেন এবং সাদকা গ্রহণ করেন। (সূরা তাওবা-১০৪)
যাকাতের ফযিলত :
অাল্লাহ্ তায়া’লা বলেন- যারা অাল্লাহর রাস্তায় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি শস্যদানা। যাতে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ’ করে দানা থাকে। অাল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। অাল্লাহ্ প্রাচুর্যময় সর্বজ্ঞ। (সূরা অাল-বাকারা : ২৬১)
মানুষ মনে করে যাকাত দিলে সম্পদ কমে যায়। তাই মাল কমে যাওয়ার ভয়ে যাকাত দেওয়া থেকে বিরত থাকে। অথচ যাকাতের অর্থ হলো বাড়া, বৃদ্ধি পাওয়া। এই বৃদ্ধি দুনিয়ায় বাহ্যিকভাবেও হয়। অার অাখেরাতের হিসেবেও বৃদ্ধি পায়। যাকাতের অারেক অর্থ হলো ‘পবিত্রতা’।
অাল্লাহ্ তায়া’লা বলেন- “অাপনি তাদের মাল থেকে সাদকা (যাকাত) উসূল করুন। যাতে এর মাধ্যমে তাদেরকে পবিত্র ও পরিশোধিত করতে পারেন। অাপনি তাদের জন্য দোয়া করুন। নিঃসন্দেহে অাপনার দোয়া তাদের জন্য সান্ত্বনা স্বরূপ। বস্তুত অাল্লাহ্ সবকিছু শোনেন, জানেন।” (সূরা তাওবা : ১০৩)
যাদের উপর যাকাত ফরয :
স্বাধীন, জ্ঞানসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারী যখন নিসাব পরিমাণ মালের পূর্ণ মালিক হয় এবং তার উপর এক বছর অতিক্রান্ত হয়, তখন ঐ ব্যক্তির মালের উপর যাকাত ফরয হয়।
যাকাতের খাত :
যাকাত কাকে দিবে, এ যাকাতের খাত সম্পর্কে অাল্লাহ্ তায়ালা বলেন-
انما الصدقت للفقراء والمسكين والعملين عليها والمؤلفة قلوبهم وفي الرقاب والغرمين وفي سبيل الله وبن السبيل , فريضة من الله,والله عليم حكيم-
“যাকাত তো কেবল গরীব, মিসকিন, অামীলীন- যাকাত সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের জন্য ও যাদের চিত্তাকর্ষণ প্রয়োজন তাদের জন্য এবং তা দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্থদের জন্য। অাল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এ হলো অাল্লাহর নির্ধারিত বিধান। অাল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা-৬০)
যাকাত না দেয়ার পরিণতি :
” যারা সোনা-রূপা পুঞ্জিভূত করে এবং অাল্লাহর রাস্তায় ব্যয় না করে তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন। সেই দিন জাহান্নামের অাগুনে তা,উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাটে, পার্শ্বদেশে ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে। (সূরা তাওবা:৩৪-৩৫)
রাসুলে কারিম সাঃ বলেন, অাল্লাহ তায়া’লা যাকে ধনসম্পদ দান করেছেন, সে যদি তার যাকাত অাদায় না করে তা হলে ঐ ব্যক্তির মাল সম্পদকে কেয়ামতের দিন ভয়ানক বিষধর সাপের অাকৃতিতে পরিণত করা হবে। যার চোখের উপর দুটি কালো বিন্দু থাকবে। কেয়ামতের দিন উক্ত সাপ তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। অতঃপর সে সাপ ঐ ব্যক্তির চোয়ালে কামড়ে ধরে বলবে, অামিই তোমার মাল, অামিই তোমার পুঞ্জীভূত সম্পদ। (বুখারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৬৫৫)
শিক্ষা :
ক. গুটি কয়েক লোকের হাতে সমস্ত সম্পদ যাতে পুঞ্জীভূত না হয়।
খ. সম্পদের সর্বত্র সম্প্রসারণ।
গ. সমাজ থেকে দারিদ্র বিমোচন।
ঘ. দারিদ্রের কষাঘাতে মানুষ যেন সুদখোরদের অাশ্রয়ে যেতে বাধ্য না হয়।
ঙ. ভিক্ষাবৃত্তিতে নিজেকে সমর্পণ না করা।
চ. অভাবের তাড়নায় মানুষ যেন ঈমান হারা না হয়।
লেখক : মুহাম্মাদ ফরহাদ হোসাইন, মুবাল্লিগপ্রত্যাশী, কুমিল্লা জেলা দক্ষিণ