আজ ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার | ১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | ২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এখন সময়- দুপুর ২:৩৯

আজ ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার | ১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি | ২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়

আমরা এমন হতভাগা জাতি যে, মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হয়ে দীর্ঘ চার দশক অতিবাহিত হয়ে গেল কিন্তু এখনো আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক শেষ হলো না। সমান্তরালে চলছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বিতর্কও। কিছুদিন পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও জাতীয় অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের “বামপন্থী রাজনীতি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়” নামক একটি বই পেলাম, লেখক উপরোক্ত বইয়ে অত্যন্ত চতুরতার সাথে একথা প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা চালান যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। তিনি লিখেন- একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব যদি ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নিদর্শন হয় তবে এটা নিঃসন্দেহে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে যে ইসলামি আদর্শ ও ইসলামি জাতীয়তাবাদ কাজ করেছিল সেটাকেও অপসারণ করে। তিনি তার মতের সমর্থনে পুরো বইয়ে একথাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, যাদের লক্ষ্যই হল একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। মুক্তিযুদ্ধে কতজন বামপন্থী অংশগ্রহণ করেছিলো? তার একটি পরিসংখ্যানও তিনি দিয়েছেন। তিনি লিখেন- ভারত সরকার আওয়ামীলীগ কে বাংলাদেশের গণমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া ছাড়াও কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলার মুক্তিসংগ্রামে ব্যাপক সহায়তা ও সমর্থন দিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত বামপন্থী দলের নেতা ও কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধে কেবল সহায়ক ভূমিকা পালনে সামর্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের অঙ্গ সংগঠনসমূহ যেমন মস্কোপন্থী ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করেছিল এবং আওয়ামীলীগের নীতি অনুযায়ী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের অন্তর্ভূক্ত না করার বিধি সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীতে মস্কোপন্থী দলের প্রায় ৬০০০কর্মী যোগ দিয়েছিলেন। এমনিভাবে আরও দুই এক হাজার বামপন্থী গেরিলার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। তার প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী ১০ থেকে ১৫ হাজার বামপন্থী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আর এর ভিত্তিতেই তিনি একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তোলা। একজন জাতীয় অধ্যাপক হয়েও তিনি একথা কিভাবে বললেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মুসলমান অংশংগ্রহণ করেছিলেন। যাদের চেতনা কখনই ধর্মনিরপেক্ষতা ছিলো না। কারণ, কোনো মুসলমান ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ পোষণ করতে পারে না। কেননা ইসলামি আইনশাস্ত্র অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ পোষণকারী কাফের বলে বিবেচিত হয়। এখন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান সাহেবের কথা অনুযায়ী ১০-১৫ হাজার বামপন্থীদের লক্ষ উদ্দেশ্য অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্ণয় করা হবে, না কোটি মুসলমানের লক্ষ-উদ্দেশ্য অনুযায়ী নির্ণয় করা হবে তার দায়ভার সাধারণ জনতার উপর রইল।
চেতনার স্বরূপ :
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রণ্টের ১দফা, ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি রচনা করেছিলো। স্বাধীনতা সংগ্রাম পূর্ব এসব দলিল এবং তৎকালীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক শোষণ, জুলুম নির্যাতন থেকে নিষ্কৃতি সর্বোপরি রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের তীব্র আকাঙ্খা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগনকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় দেশের মানুষের আশা আকাক্সক্ষার পরিবর্তে আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের দর্শনই অধিকতর প্রতিফলিত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের সেক্যুলারপন্থীরা সর্বদা যে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ করে থাকেন সেই গর্হিত কাজটি ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনার সময় তারা সর্বপ্রথম করেছিলেন। মরহুম আবুল মনসুর আহমদ তার “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” গ্রন্থে এ বিষয়টি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন- আমাদের সংবিধান রচয়িতারাও তাই করেছেন। প্রস্তাবনায় তারাও বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মহান আদর্শই আমাদের বীর জনগনকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বলিদানে শহিদগণ কে প্রানোৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। তথ্য হিসেবে কথাটা ঠিক নয়। আওয়ামীলীগের ছয় দফা ও সর্বদলীয় ছাত্র অ্যাকশন কমিটির এগারো দফার দাবিতেই আমাদের মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়। এসব দফার কোনোটিতেই ওই সব আদর্শের উল্লেখ ছিলো না। ওই দু’টি দফা ছাড়া আওয়ামীলীগের একটি মোনাফেকী ম্যানিফেস্টো ছিলো। তাতেও এসব আদর্শের উল্লেখ নেই; বরং ওই ম্যানিফেস্টোতে ব্যাংক, ইনসুরেন্স, পাট ব্যবসা ও ভারী শিল্পকে জাতীয়করণের দাবি ছিলো। ওই ‘দফা’ ম্যানিফেস্টো নিয়েই আওয়ামীলীগ ৭০ সালের নির্বাচনে লড়েছিলো এবং জিতেছিলো। এরপর মুক্তি সংগ্রামের আগে বা যুদ্ধের সময়ে জনগণ, মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদদের পক্ষ থেকে আর কোনো দফা বা ম্যানিফেস্টো বের করার দরকার বা অবসর ছিলো না। আমাদের সংবিধান রচয়িতারা ওই মহান আদর্শকে সংবিধানভুক্ত করার ইচ্ছা করেছিলেন। তাই জনগণও মুক্তিযুদ্ধাদের নামে ওই ভুল তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন।
১৯৭০ এর নির্বাচনী ইশতেহার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
স্বাধীনতার পূর্বে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ শব্দটিও যে কারো মাথায় ছিলো না তার অন্যতম প্রমাণ হলো, ১৯৭০ এর নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান যে নির্বাচনী ইশতিহার জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিলেন তাতে স্পষ্ট লেখা ছিলো- “কোরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন করবো না” আরো একধাপ এগিয়ে ২৮ শে অক্টোবর ১৯৭০ তার টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন- “আমরা এই শাসনতান্ত্রিক নীতির প্রতি অবিচল ওয়াদাবদ্ধ যে, কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত ইসলামি নীতির পরিপন্থী কোনো আইনই এ দেশে পাস হতে পারে না, চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে না। তার এসব কর্মকাণ্ডে অনুপ্রেরণা পেয়েই বাংলার মুসলমান আওয়ামীলীগকে ভোট দিয়েছিলো। ফলে এই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ৭৬.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন লাভ করে এবং জাতীয় পরিষদে (পাকিস্তান) ৭২.৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৬২ টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয় লাভ করে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পরে সেই শেখ মুজিব সংবিধানে কুরআন সুন্নাহ বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ স্থাপন করে বুঝিয়ে দিলেন তিনি কথা ও কাজে কতটা পারঙ্গম!

লেখক : মুফতি হুসাইন আহমদ (জাবের), শিক্ষক, জামিয়া কারিমিয়া আরাবিয়া রামপুরা, ঢাকা।

Leave a Comment

লগইন অথবা নিবন্ধন করুন

লগইন
নিবন্ধন