আজ ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ বৃহস্পতিবার | ১৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এখন সময়- রাত ৯:৫৬

আজ ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ বৃহস্পতিবার | ১৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের রাজনীতি পঁচাত্তর হতে পনের

মুজিব শাসনের ব্যর্থতা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট মুজিবুর রহমানের হত্যার মাধ্যমে মুজিব শাসনের অবসান ঘটে। তাই ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক ইতিহাস লেখতে গেলে মুজিব শাসনের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরতে হয়। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো-
১. সেনাবাহিনীর প্রতি উদাসীনতা : যাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, সেই সেনাবাহিনীর প্রতি শেখ মুজিব উদাসীনতা প্রদর্শন করেন।
২. প্রতিরক্ষা খাতে ব্যায় বরাদ্দ হ্রাস : প্রতিরক্ষা খাতের ৭৮% ব্যায় বরাদ্দ শেখ মুজিব ১৯৭২-৭৩ সালে কমিয়ে ১৭.৫০% করেন।
৩. ভারত-রুশ ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি : জোটনিরপেক্ষতার নামে ভারত ও রুশ ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণই তার পতন তরান্বিত করে।
৪. অস্ত্র উদ্ধারে ব্যর্থতা : স্বাধীনতা যুদ্ধের অস্ত্র উদ্ধারের ব্যর্থতাও বঙ্গবন্ধুর পতনকে ত্বরান্বিত করে।
৫. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন : সংসদীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে জনগণের স্বপ্ন ভূলুষ্টিত হলে জনগণ মুজিব মসরকারের প্রতি বিমূখ হতে থাকে।
৬. বাকশাল গঠন : সকল রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘোষণা করে ‘বাকশাল’ (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) গঠনের ঘোষণা দিলে চারদিকে প্রবল প্রতিবাদের ঝড় উঠে।
৭. ইসলামের প্রতি উদাসীনতা : সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্ম ইসলাম ও মাদরাসা শিক্ষার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন ধর্মপ্রাণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি।
৮. গণতন্ত্রের কবর রচনা : আওয়ামী লীগ সরকার দেশে সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় শাসনব্যস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করে।
৯. আইন-শৃঙ্খলার অবনতি : যুদ্ধের পর দেশের যুকদের হাতে কিছু অস্ত্র থেকে যাওয়ায় দেশের জনগণ তাদের দুষ্কৃতির কাছে যিম্মি হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব আইন-শৃঙ্খলার অবনতি রোধ করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
১০. দুর্নীতি ও সীমান্তে পাচার : সরকারী দলের নেতা-কর্মী এ সব দুর্নীতি ও সীমান্তে পাচারের সাথে জড়িত থাকায় আওমী লীগ সরকার তা রোধ করতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
১১. জাতি সত্তার অবমূল্যায়ন : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট মুজিব সরকারের পতনের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোয় এ সম্পর্কে মূল্যায়নধর্মী অনেক প্রতিবেদন ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেগুলো ঢাকার কাগজগুলোয়, বিশেষত দৈনিক ইত্তেফাকে নিয়মিতভাবে পুনর্মুদ্রিত হয়। এ সব বিদেশী পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয় যে, জাতির আত্মপরিচয় বা জাতিসত্তা সংক্রান্ত বোধ, বিশ্বাস ও এতিহ্য সম্পর্কে মূল্যায়নের ব্যর্থতা এবং বিশেষভাবে ইসলামের অমর্যাদা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করা শেখ মুজিবের পতনের অন্যতম কারণ ছিল। মুজিব সরকারের পতনের মূল কারণ হিসেবে যা পাওয়া যায় তা হলো ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারীর বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী। এ কারণে চতুর্থ সংশোধনীর আলোচনা করলে মুজিব সরকারের ব্যর্থতা ও পতনের কারণ ফুটে উঠবে।
বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী
১. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান : অর্থাৎ এ সংবিধান সহজে পরিবর্তনযোগ্য নয়।
২. রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন : সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী অনুযায়ী মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকারের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
৩. প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন : এ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয়।
৪. আজ্ঞাবহ মন্ত্রি পরিষদ : এ সংশোধনীর মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদকে রাষ্ট্রপতির আজ্ঞবহ করা হয়। রাষ্ট্রপতি যেকোন ব্যক্তিকে মন্ত্রী হিসেবে নিযোগ ও বরখাস্ত করতে পারবেন বলে উল্লেখ করা হয়।
৫. নিষ্ক্রিয় আইন পরিষদ : এ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতার সমাবেশ ঘটানো হয় এবং দলীয় নিয়ন্ত্রণের ফলে জাতীয় সংসদ দুর্বল সংস্থায় পরিণত হয়।
৬. উপ-রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি : এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করার জন্য উপ-রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি করা হয়।
৭. বিচার বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস : বিচারকদের নিয়োগ, অপসারণ ও স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিধানের ধারাগুলোয় ব্যাপক রদবদল করে আদালতের ক্ষমতা ও বিচারকদের স্বাধীনতা হ্রাস করা হয়।
৮. এক দলীয় ব্যবস্থা : রাষ্ট্রপতিকে এক জাতীয় দল গঠনের ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি কার্যকর করার জন্য একটিমাত্র রাজনৈতিক দল গঠন করার অনুমতি দেয়া হয়।
৯. সম্পত্তির শ্রেণীকরণ : সমাজতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে সম্পত্তিকে রাষ্ট্রীয়, সমবায় ও ব্যক্তিগতÑ এ তিন শেণীতে ভাগ করা হয় এবং ব্যক্তিগত ও সমবায় মালিকানা আইনের মাধ্যমে সীমিত রাখা হয়।
১০. ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি : সরকারী কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা এবং প্রয়োজনীয় শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করা হয়।
১১. মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ বাতিল : ৪৪নং ধারায় বর্ণিত জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলা রুজু করার অধিকার ৩নং ধারার মাধ্যমে বাতিল করা হয় এবং হরণ করা হয় সুপ্রিম কোর্টর রিট জারির ক্ষমতা।
১২. জাতীয় সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি : এ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদের মেয়াদ ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী থেকে পরবর্তী পাঁছ বছরের জন্য বাড়িয়ে দেয়া হয়।
১৩. স্থানীয় সরকার সংঘঠনের গুরুত্ব হ্রাস : স্থানীয় সরকারের গঠন সংক্রান্ত বিধান রহিত করে তা রাষ্ট্রপতির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়ায় স্থানীয় সরকার সংগঠনের গুরুত্ব অনেকাংশে হ্রাস পায়।
১৪. রাষ্ট্রপতির অপসারণ : সারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা বা সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের স্থলে তিন-চতুর্থাংশের সম্মতি গ্রহণের বিধান এ সংশোধনীতে করা হয়।
১৫. সরকারী কর্মচারীদের রাজনৈতিক অধিকার প্রদান : এ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের রাজনীতি করার সুযোগ প্রদান করা হয়।
১৬. নিয়ন্ত্রিত নাগরিক অধিকার : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে সরকার বিদ্যমান ১৯টি জেলাকে ৬১ জেলায় রূপান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
১৭. সরকারী চাকরিজীবীদের রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার সুযোগ : সরকারী চাকরিজীবীদেরকে দলের সদস্য হওয়ার সুযোগদান চতুর্থ সংশোধনীর অন্যতম কৌতুহলোদ্দিপক দিক।
চতুর্থ সংশোধনীর প্রেক্ষাপট
১. অভ্যন্তরীণ চাপ : ড. সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম এ সম্পর্কে বলেন, “স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অভ্যন্তরীণ চাপের কারণেই সংসদীয় শাসনের প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থন চূড়ান্তভাবে বিলুপ্ত হয়।”
২. মতভেদ ও কোন্দলের উদ্ভব : শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ মনির উচ্চাকাঙ্খা ও অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপের ফলে আওয়ামী লীগের মধ্যে মতভেদ ও কোন্দল সৃষ্টি হয়। ফলে শেখ মুজিব সংসদীয় গণতন্ত্র অপেক্ষা রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তন করাই উপযুক্ত বলে মনে করেন।
৩. জাতীয় দল গঠনের পরিকল্পনা : জাতীয় দল গঠনের পরিকল্পনাই শেখ মুজিবকে চতুর্থ সংশোধনী আনতে উদ্বুদ্ধ করে।
৪. রাজনেতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত : শেখ মুজিব রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
৫. সোভিয়েতপন্থি আওয়ামী লীগ সদস্যদের আকাঙ্খা : আওয়ামী লীগের সোভিয়েতপন্থি সদস্যরা সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুকরণে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের আকাঙ্খা করেন।
৬. বিপর্যস্ত অর্থনীতি : অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য একটি শাসনতান্ত্রিক প্রবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়ে।
চতুর্থ সংশোধনীর বৈশিষ্ট্য সমূহ
১. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান : অর্থাৎ সহজে পরিবর্তন করা যেত না।
২. রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন : এ সংশোধনী অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
৩. প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন : এতে রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয়।
৪. আজ্ঞাবহ মন্ত্রিপরিষদ : এতে মন্ত্রিপরিষদকে রাষ্ট্রপতির আজ্ঞাবহ করা হয়। রাষ্ট্রপতি যে কোন ব্যক্তিকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ ও বরখাস্ত করতে পারবেন বলে উল্লেখ করা হয়।
৫. নিষ্ক্রিয় আইন পরিষদ : চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতার সমাবেশ ঘটানো হয়।
৬. উপ-রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি : এতে রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করার জন্য উপ-রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি করা হয়।
৭. বিচার বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস : বিচারক নিয়োগ, অপসারণ ও স্বাধীনতা সংক্রান্ত ধারাগুলোয় ব্যাপক রদ বদল করে আদালতের ক্ষমতা ও বিচারকদের স্বাধীনতা হ্রাস করা হয়।
৮. একদলীয় ব্যবস্থা : এতে একটি জাতীয় দল গঠন করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়। তাই বলে সকল রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ‘বাকশাল’ নামে একটি মাত্র দল গঠন করা হয়।
৯. সম্পত্তির শ্রেণীকরণ : সমাজতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে সম্পত্তিকে রাষ্ট্রীয়, সমবায় ও ব্যক্তিগত- এতিন শেণীতে ভাগ করা হয় এবং ব্যক্তিগত ও সমবায় মালিকানা আইনের মাধ্যমে সীমিত রাখা হয়।
১০. ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি : সরকারী কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা এবং প্রয়োজনে শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করা হয়।
১১. মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ বাতিল : মূল সংবিধানের ৪৪নং ধারায় জনসাধারণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষনের জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলা রুজু করা যাবে বলে উল্লেখ ছিলো। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর ৩নং ধারায় সে অধিকার বাতিল করা হয় এবং হরণ করা হয় সুপ্রিম কোর্টর রিট জারীর ক্ষমতা।
১২. জাতীয় সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি : জাতীয় সংসদের মেয়াদকাল ১৯৭৫ সাল ২৫ জানুয়ারী থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য বাড়িয়ে দেয়া হয়।
১৩. স্থানীয় সরকার গঠনের গুরুত্ব হ্রাস : স্থানীয় সরকার গঠন সংক্রান্ত বিধান রহিত করে তা রাষ্ট্রপতির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে স্থানীয় সরকার সংগঠনের গুরুত্ব অনেকাংশে হ্রাস পায়।
১৪. রাষ্ট্রপতির অপসারণ : সারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা বা সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের স্থলে তিন-চতুর্থাংশের সম্মতি গ্রহণের বিধান এ সংশোধনীতে করা হয়।
১৫. সরকারী কর্মচারীদের রাজনৈতিক অধিকার প্রদান : এ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারী কর্মচারীদের রাজনীতি করার সুযোগ প্রদান করা হয়।
১৬. নিয়ন্ত্রিত নাগরিক অধিকার : প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যেগকে সামনে রেখে সরকার বিদ্যমান ১৯টি জেলাকে ৬১টি জেলায় রূপান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সংবাদপত্রের সংখ্যা হ্রাস করে নাগরিক অধিকার খর্ব করা হয়।২
ধর্মীয় কাজে শেখ মুজিব
১. রমনা রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় বন্ধ করা।
২. লাইসেন্স ব্যতিরেকে মদ্যপান বন্ধ করা।
৩. পাকিস্তান আমলের ইসলামিক একাডেমি ও বাইতুৃল মোকাররম সোসাইটির সমন্বয়ে ইলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ গঠন করা।
৪. ভারতের অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও লাহোর ইসলামিক সামিটে যোগ দিয়ে ওআইসির সদস্যপদ গ্রহণ করা।
৫. স্বাধীনতার পর বন্ধ থাকা মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার নির্দেশ দেয়া।
৬. সীরাতুন নবী মাহফিল ও সম্মেলনের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে সীরাত কমিটি গঠিত হওয়া।
শেখ মুজিব শাসনামলের সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ
শেখ মুজিবের শাসনামলের পর্যবেক্ষনে দ্বিধা সৃষ্টিকারী ভিন্নমূখী বহু উপাদান পাওয়া যায়। যা থেকে এ শাসনামল বিষয়ে প্রায়ই ভিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তে উপণিত হবার কারণ ঘটতে পারে। স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী শেখ মুজিব বলেছিলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। তিনিই আবার দেশটির সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণের ব্যবস্থা করছেন। বেতার টেলিভিশনে কুরআন তিলাওয়াত বন্ধ করছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলাম ও মুসলিম ঐতিহ্য প্রকাশক শব্দ বা বৈশিষ্ট্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করছেন। ইসলামিক একাডেমিসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করছেন। এই শেখ মুজিবই আবার ইসলামিক একাডেমি ও বন্ধ হয়ে যাওয়া মাদরাসা খুলে দেয়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা, মাদরাসা বোর্ড স্থাপন করা, ওআইসি-র সদস্যপদ গ্রজহণ করা প্রভৃতি কাজে অনেক ঘনিন্ঠজনকে মনঃক্ষুন্ন করেও নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। যদিও এ সময় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অব্যাহত ছিলো। ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির বিদ্যমানতায় ‘ধর্ম সাপেক্ষ’ কার্যক্রম ও প্রতিষ্ঠান বাহ্যত সাংঘর্ষিক আচরণ। শেখ মুজিবের শাসনামলে বাস্তবে তা-ই ঘটেছে। এ সময়ে ‘ধর্ম সাপেক্ষ’ কার্যক্রম ও প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে নির্বাহী প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার দল আওয়ামী লীগের কিছু শীর্ষ আলেম নেতার দ্বারা যেমন প্রভাবিত ও অনুরুদ্ধ হয়েছেন, তেমনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খাঁন ভাষাণীর পরামর্শ, অনুরোধ ও হুমকির দ্বারা উদ্ভুদ্ধ ও প্রভাবিত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। আওয়ামী লীগের দলীয় শীর্ষ আলেম নেতাদের মধ্যে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশের নাম এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
শাসক হিসেবে শেখ মুজিবের অস্থিরচিত্ততা এবং পরিনামে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের নিকটই অনাস্থাভাজন হবার বিষয়টিও কোন কোন গবেষক চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। গবেষক মাসূদুল হক লিখেছেন,
“শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও শেখ মুজিবের দ্বৈত মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে উঠে- যা তাকে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কাছে বিরাগভাজন করে তোলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতার কথা অস্বীকার করার উপায় ছিল না বলেই ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরাগান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে শেখ মুজিব যে পঁচিশ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সহযোগিতা চুক্তি সাক্ষর করেন- যা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাক্ষরিত ভারত-সোভিয়েত চুক্তিরই অনুরূপ, খুশি করে ভারতকে যেমন, রাশিয়াকেও তেমনি। কিন্তু এ চুক্তি শেখ মুজিবের স্ববিরোধী চরিত্রকে তুলে ধরে পশ্চিমা জগত, বিশেষ করে মার্কিন প্রশাসনের কাছে। আবার মার্কিনীদের খুশি করার জন্য এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট (পরে প্রধানমন্ত্রী) জুলফিকার আলী ভূট্টোকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনের লক্ষ্যে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম দেশ সমূহের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করে বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন ভারতের। এমনকি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জারের কাছে নিজেকে অধিকতর পশ্চিমা ঘেঁষা বলে তুলে ধরার জন্য তাকে (তাজুদ্দীন আহমদকে) অবমাননার চুড়ান্ত করলেন। ১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকে উপ-মহাদেশ সফরে বেরিয়ে বাংলাদেশ আসেন হেনরী কিসিঞ্জার। তার সম্মানে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এক ভোজসভার আয়োজন করে। তাজুদ্দীন আহমদকে ঐ ভোজসভায় আমন্ত্রন জানানো হলো না এই কারণে যে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ : তিনি অতিমাত্রায় ভারত ঘেঁষা। একই অভিযোগের কারণে মার্কিন চাপে মন্ত্রিসভা থেকে তিনি হন অপসারিত।
শেখ মুজিবের এই দ্বৈত মানসিকতা অর্থাৎ সব পক্ষকে খুশি রেখে চলার কৌশল, এতে রাশিয়াও বিরক্ত হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবের এই স্ব-বিরোধী চরিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার সম্পর্কে কতটা আস্থাহীন করে তোলে, তা আমরা জানতে পাবো র’র পর্যবেক্ষন থেকে। র’র সে পর্যবেক্ষণ কি ছিল? শেখ মুজিবুর রহমান দুই পরা শক্তির আস্থা হারিয়েছেন (সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ও ভারতেরও। তারা তাদের নিজস্ব লোক না পাওয়া পর্যন্ত তাকে ক্ষমতায় রাখছে। তার অস্থির নীতি তাকে বিশেষ কোন শক্তির প্রতি আসঞ্জিত না করায় তাকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করছে। শেখ মুজিব র’র এ পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। শেখ মুজিবের এই স্ববিরোধী রাজনৈতিক চরিত্রের কারণেই ‘সি আই এ’ তার পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে আরম্ভ করে।”৩
শেখ মুজিব যা করেছেন যে কারণে করেছেন
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী মাত্র কয়েক মিনিটের সংসদীয় ক্যু এর মাধ্যমে চতুর্থ সংশোধনী গ্রহণ করা হয়। এর মাধ্যমে সংবিধনের খোল-নলচে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে ফেলা হয়। জনগণের প্রতিনিধিত্ব, মৌলিক অধিকার, মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীলতা, আইন ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা- সব কিছুর ব্যাপারে সকল রীতি-রেওয়াজ, পদ্ধতি ও আইনের আমূল পরিবর্তন করে মধ্য যুগীয় সামন্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্রের আদলে ‘এক দলের’ নামে এই দেশের সব কিছু ‘এক ব্যক্তির’ ইচ্ছার কাছে বিসর্জন দেয়া হয়। আর এ পরিবর্তনের নাম দেয়া হয় ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’।
যে মানসিকতা থেকে এ অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে আবুল মনসূর আহমদ আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর এ এই তথা কথিত বিপ্লবের অনেকদিন আগেই লিখেছেন :
“সত্যই শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে এই দুর্বলতা ছিলো যে, তিনি যেটাকে পার্টিপ্রীতি মনে করিতেন, সেটা ছিলো আসলে তার ‘ইগইযম’-আত্মপ্রীতি। স্ব-রাজদেশের জন্য খুবই দরকার। কিন্তু সেটা যদি আমার হাত দিয়া না আসে তবে না আসাই ভলো। আমার বিবেচনায় মুজিবুর রহমানের মধ্যে আত্মপ্রীতি ছিলো খুবই প্রবল। এটাকে তিনি পার্টিপ্রীতি বলিয়া চালাইতেন।
শেখ মুজিবের এই ‘ইগইযম’কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মতলব হাসিলের জন্য মসকো পন্থি কম্যুনিষ্টরাই চতুর্থ সংশোধনী নেপথ্য-নায়কের ভূমিকা পালন করে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশ তখন একটা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। দেশে অর্থভন্ডার শূণ্য। দ্রব্যমূল্য আকাশ ছোঁয়া। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। বিশ্বখ্যাত পত্রিকাগুলো কালোবাজারীকে ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি’ রূপে চিহ্নিত করছে। মহানগরী পরিণত হয়েছে বে-ওয়ারিশ লাশের নগরীতে। মানুষ কলাপাতায় লজ্জা ঢাকছে। ডাস্টবিনে চলছে মানুষ-কুকুরে কাড়াকাড়ি। গুম, খুন, ছিন্তাই, রাহাজানি সংবাদপত্রের খবর হওয়ার যোগ্যতা হারাচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতে দেশের সাধারণ মানুষের বিশীর্ণ মিছিলের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সর্বস্তরের মানুষ চাইছে পরিবর্তন। ভুখা জনতার অসহায় ক্ষীণ কন্ঠ ঊর্ধ্বপানে শীর্ণ দু’খানি হাত তুলে ফরিয়াদ করছে, “খোদা গজব থেকে বাঁচাও।” এমনি পরিস্থিতিতে রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনীর ধারালো দাঁত-নখও ভোঁতা প্রমাণিত হচ্ছিল। এই পটভূমিতে ক্ষমতার মসনদে আসন্ন গণরোষের হাত থেকে হেফাজত করার “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” রূপেই আনা হয় “চতুর্থ সংশোধনী”। দুনিয়ার রাজনীতির ইতিহাসে এ ধরণের সংশোধনীর নযীর নেই।
শেখ মুজিব তাঁর ক্ষমতার বিস্তার ও স্থিতির জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন। তার এই ‘ইগয়িষ্ঠ’ মানসিকতাকে সহজেই কাজে লাগাতে পেরেছে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের এদেশী এজেন্টরা। মধ্যপন্থি জাতীয়তাবাদি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ছিলো আন্তর্জাতিকতাবাদি কম্যুনিজমের বিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তি। এই নীতির উপর ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ একবার ভাগ হয়েছিলো। কিন্তু ৭৩ সালে দেশে বিরাজিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মুজাফফর ন্যাপ মনিসিংহ’র কম্যুনিষ্ট পার্টি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা তাদের এজেন্টদের সহযোগীতায় ‘গণঐক্যজোট’ নামে তৃদলীয় ঐক্যজোট গঠনে সক্ষম হয়। তাদেরই প্ররোচনায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের এমন এক পর্যায়ে প্রবেশ করে, যেখান থেকে ফিরে আসার সকল দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়।”

সংক্ষিপ্ত বিবরণ
১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট থেকে ১৯৮২ এর ২৪ মার্চ পর্যন্ত
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সশস্ত্র বাহিনীর এক ক্ষুদ্র অংশের সশস্ত্র অভ্যূাত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্ব-পরিবারে নিহত হলে বাংলাদেশে শেখ মুজিব শাসনামলের অবসান ঘটে। কর্নেল ফারুক ও রশীদের নেতৃত্বের সশস্ত্র অভ্যূাত্থানের সময় সেনা প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ এবং উপ-সেনাপ্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। শেখ মুজিবের পর তার ধীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব পান অথবা গ্রহণ করেন। আগষ্টের শেষ সাপ্তাহে জেনারেল শফিউল্লাহ-র স্থলে সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। অভ্যূাত্থানের শেষে প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাক দেশে সামরিক আইন জারি করেন, যার ফলে কিছু নাগরিক-রাজনৈতিক অধিকার স্থগিত করা হয়। তবে তিনি জাতীয় সংসদ বাতিল করেননি এবং দেশে সামরিক শাসনের প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেননি। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর একটি পাল্টা সশস্ত্র অভ্যূাত্থানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ (সেনা বাহিনীর তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ-সিজিএস) ও তার সল্প সংখ্যক অনুগামী বঙ্গভবনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ১৫ আগষ্টের অভ্যুত্থানের নেতাদের প্রবাসে পাঠান এবং সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে গৃহ অন্তরীণ করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন। খন্দকার মোশতাকের স্থলে খালেদ মোশাররফ ও তার শুভার্থীরা তৎকালীন প্রধান বিচরপতি আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েমকে ১৯৭৫-র ৬ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত করিয়ে বঙ্গভবনে অধিষ্ঠিত করেন। ৬ নভেম্বর দিবাগত মধ্যরাত থেকে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান শুরু হয়। এতে অংশ নেন কর্নেল (অব.) আবু তাহের গঠিত ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার’ সাথে সংশ্লিষ্ট সৈনিকরা, জাসদ-সৃষ্ট ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’র সমাজতন্ত্রপন্থী বেসামরিক ব্যক্তিরা এবং ভারত বিরোধী মানসিকতা সম্পন্ন ও জেনারেল জিয়ার প্রতি অনুরাগী সৈনিকেরা উল্লেখিত চার ধারা ‘সিপাহী ও জনতা’ যেভাবেই হোক প্রায় একই রকম ভূমিকায় একই সময় অবতীর্ণ হন। ‘বিপ্লবী’ (সমাজতন্ত্রী?) সৈনিকদের মিছিলে বিভিন্ন শ্লোগানের দুটি ছিলো এমন : ক. “সিপাই সিপাই ভাই ভাই-সুবেদারের উপর অফিসার নাই” ও খ. “সিপাই সিপাই ভাই ভাই-অফিসারদের রক্ত চাই।” ‘অফিসারদের রক্ত চাইবার’ ভয়ঙ্কর পরিণতিতে এ অভ্যুত্থানে সেনাবহিনীর একজন লেডী মেডিকেল অফিসার ডা. চেরীসহ ১২ জন আর্মি অফিসার নিহত হন। এ অভ্যুত্থানের (বিপ্লবের?) নায়ক সিপাহীরা ৬ নভেম্বর মধ্য রাতের কিছু পরেই গৃহবন্দী অবস্থা থেকে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করেন এবং জিয়ার হাতে তাদের নেতৃত্ব অর্পণ করেন। ৭ নভেম্বর সকালে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের নায়ক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশররফ ‘বিপ্লবী সৈনিকদের’ হাতে নিহত হন। ৬ নভেম্বর পেসিডেন্ট এর দায়িত্ব গ্রহণকারী বিচারপতি সায়েম ৭ নভেম্বর এক ঘোষণার মাধ্যমে প্রথম জাতীয় সংসদ বাতিল করেন, সামরিক শাসনের প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক- সিএমএলএ ঘোষণা করেন। ৬ নভেম্বর রাতব্যাপী ও ৭ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লবের’ প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ও সিএমএলএ বিচারপতি সায়েম জেনারেল জিয়াকে ৭ নভেম্বর সেনাপ্রধান হিসেবে ‘অন্যতম ডিসিএমএলএ’ (উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক) নিয়োগ করেন। এভাবেই জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের ‘ক্ষমতা-কেন্দ্রের’ নিকটবর্তী অবস্থান ‘লাভ’ করেন। অতপর সময়ের ব্যবধানে তিনি সিএমএলএ (২৯ নবেম্বর ১৯৭৬) ও প্রেসিডেন্ট (১১ এপ্রিল ১৯৭৭, সামরিক এবং অতপর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত)- এর দায়িত্ব ‘গ্রহণ’ করেন।
১৯৮১-র ৩০ মে এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হন। তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট এর অস্থায়ী দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নির্বাচনের মাধ্যমে বিচারপতি আবদুস সাত্তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন (১৫ নভেম্বর ১৯৮১)। চার মাসের ব্যবধানে তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জে. এইচ. এম এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে সামরিক শাসন জারি করে বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং এই সাথে জিয়াউর রহমান শাসনামলের অবসান ঘটে। বর্তমান গবেষণাকর্মে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে ২৪ মার্চ ১৯৮২ পর্যন্ত সময়কালকে ‘জিয়াউর রহমান শাসনামল’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
জিয়াউর রহমান যেভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন
১. সামরিক বাহিনীর প্রধান : সামরিক বাহিনীর প্রধান হওয়ার কারণে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ক্ষমতা ছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানর হাতে। আর সামরিক বাহিনী তারই নেতৃত্বে পরিচালিত হতো।
২. সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ : ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ নিহত হলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়।
৩. বাকশাল বিরোধী প্রচারণা : সামরিক সরকার যদিও প্রথম থেকে নিজেদেরকে রাজনীতি নিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করেন, তবুও তারা দেশের সকল রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে বাকশাল বিরোধী করে তুলতে সচেষ্ট হয়।
৪. জনকল্যাণকর কাজে ভূমিকা : সীমান্ত চাপ প্রতিরোধ, ফারাক্কা সমস্যার সমাধানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উন্নয়ন ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে সামরিক সরকারের পক্ষে ধীরে ধীরে জনমত সৃষ্টি হতে থাকে।
৫. সামরিক আইনের প্রয়োজনীয়তা ব্যখ্যা : ১৯৭৬ সালের মার্চ মাস থেকে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তাওয়াব, নৌবাহিনী প্রধান রিয়াল এডমিরাল মোশাররফ হোসেন সভা-সমিতি, সেমিনার ও আলোচনার আয়োজন করে সামরিক আইনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা দিতে থাকে।
৬. তাওয়াবের অপসারণ ও কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদন্ড : ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। যার একটি হলো জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তাওয়াবকে বলপূর্বক ক্ষমতা থেকে অপসারণ এবং অপরটি হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদন্ড প্রদান।
৭. মধ্যপন্থিদের আস্থা অর্জণ : ডানপন্থী ও বামপন্থিদের নিয়ন্ত্রন থেকে বেরিয়ে আসার ফলে তিনি মধ্যপন্থিদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন।
৮. রাজনৈতিক দলবিধি ঘোষণা : দলীয় কর্মকান্ড সীমিত পর্যায়ে শুরু করার অধিকার প্রদানের লক্ষ্য কে সামনে রেখেই ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই সামরিক সরকার রাজনৈতিক দলবিধি ঘোষণা করেন।
৯. নির্বাচন অনুষ্ঠান ও দলীয় কার্যক্রম : তারপর ১৯৭৬ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে পুনরায় দলীয় কর্মকান্ড শুরু হবে এবং ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করেন।
১০. মোহাম্মদ সায়েমের পদত্যাগ ও জিয়াউর রহমানের দায়িত্ব গ্রহণ : ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
জিয়াউর রহমানের অবদান
১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন : রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই ছিলো তার প্রধান সফলতা। যার জন্য তিনি আইন-শৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করেন। পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেন।
২. সংবিধান সংশোধন : পেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে এক সংশোধনী আদেশ জারি করে ভাষাভিত্তিক ‘বাঙালী’ জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ভৌগলিক ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন।
৩. সুষ্ঠু গণভোট ও বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া : গণতন্ত্রমনা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়ার লক্ষ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই গণভোটের ব্যবস্থা ও এর জন্য ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
৪. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা : বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, সর্বোচ্ছ বিচার বিভাগীয় পরিষদ গঠন, রাষ্ট্রপতির উপর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির নিয়োগ দান বা বরখাস্তকরণে একক দায়িত্বসহ বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল তিনি তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
৫. বহু দলীয় রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা : স্থগিত সংবিধান, নিষিদ্ধ দলীয় কার্যক্রমের পুনরুজ্জীবিত ও রাজনৈতিক দলবিধি ঘোষণা করে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর হতাশা দুর করেন।
৬. বৈদেশিক সাহায্য বৃদ্ধি : সমাজতন্ত্রের সংশোধন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায় বিচারের ফলে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
৭. ভারসাম্যের অর্থনীতি : ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রেখে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে এক প্রতিযোগীতা সৃষ্টি করেন। যার ফলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা পায়।
৮. খাল খনন ও বৃক্ষরোপন অভিযান : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খাল খনন ও বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীয়তা প্রেসিডেন্ট জিয়াই সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেন এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে খাল খনন অভিযান পরিচালনা করেন।
৯. স্বনির্ভর গ্রাম সরকার পরিকল্পনা : গ্রামের উন্নতি সাধনের জন্য ১৯৮০ সালে তিনি স্বনির্ভর গ্রাম সরকারের এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং গ্রাম সরকারের কার্যকালও নির্ধারণ করেন।
১০. রাজনৈতিক দল গঠন : ক্ষমতায় আসার পর জিয়াউর রহমান এক দলীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই শর্তসাপেক্ষে রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দেন।
১১. বৈদেশিক সম্পর্ক বৃদ্ধি : বৈদেশিক সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং এতে তিনি যথেষ্ট সাফল্যও লাভ করেন।
১২. দক্ষ সামরিক বাহিনী গঠন : সামরিক বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে তাদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন এবং কয়েকটি নতুন ডিভিশন সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী ও পাকিস্তান হতে প্রত্যাগত কর্মকর্তাদের মাঝে সমঝোতা সৃষ্টি করেন। এর ফলে দেশের সামরিক বাহিনী একটি দক্ষ বাহিনীতে পরিণত হয়।
১৩. উপদেষ্টা পরিষদ গঠন : দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, জ্ঞানী ও টেকনোক্র্যাটদের নিয়ে একটি উদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। যারা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাকে পরামর্শ ও সহযোগতিা প্রদান করে।
১৪. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন : সামরিক সরকারের প্রতি গ্রামীণ প্রভাবশালী মহলের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। যার ফলে ১৯৭৭ সালের ১৩ জানুয়ারী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৫. মন্ত্রীপরিষদ গঠন : সংসদ নির্বাচনের পর সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী, কয়েকজন মন্ত্রী এবং সামরিক ও বেসামরিক এলিটদের নিয়ে এক মন্ত্রীসভা গঠন করেন।
জিয়াউর রহমানের আমলে পঞ্চম সংশোধনী
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮৯ সালের ৫ এপ্রিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনয়ন করেন। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট এবং ১৯৮৯ সালের ৫ এপ্রিলসহ মধ্যবর্তী সময়ে যে সব আইন, নির্দেশ, ঘোষণা, সামরিক আইনবিধি, অধ্যাদেশ সম্পন্ন হয়েছিলো, তার সবকিছুরই বৈধতা দান করা হয়।
পঞ্চম সংশোধনীর প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
১. সংবিধানের প্রস্তাবনার পরিবর্তন : প্রস্তাবনায় দু’টি পরিবর্তন আনা হয়। ক) প্রস্তবনার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ অর্থাৎ পরম করুণাময় অত্যান্ত দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। এ কথাগুলো সংযোজন করা হয়। খ) সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘মুক্তি সংগ্রাম’ শব্দগুচ্ছের পরিবর্তে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ শব্দগুচ্ছ সন্নিবেশিত হয়।
২. রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন : ক) বাঙালী জাতীয়তাবাদকে পরিবর্তন করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নামে আখ্যায়িত করা হয়। খ) ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর আস্থা ও বিশ্বাস কথাগুলো সংযোজন করা হয়। গ) সমাজতন্ত্র নামক অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে পরিবর্তন করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় বিচার এ অর্থে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
৩. ক্ষতিপুরণের ব্যবস্থা : মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সংবিধানের ৪২তম অনুচ্ছেদের ২নং ধারা পরিবর্তন করে ঘোষণা করা হয় যে, সম্পত্তির রাষ্ট্রয়াত্তকরণ ও দখলের ক্ষেত্রে ক্ষতিপুরণ গ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
৪. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর দ্বারা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও পরবর্তী দুজন সিনিয়র বিচারপতির সমন্বয়ে একটি ‘সর্বোচ্চ বিচার পরিষদ’ গঠনের বিধান করা হয়। এ পরিষদ সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারকদের জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন করবেন। পরিষদের সুপারিশ সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের যে কোন বিচারককে তার পদ থেকে অপসারণ করতে পারবেন।
৫. জাতীয় সংসদের অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা হ্রাস : পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা জাতীয় সংসদের অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা হ্রাস করা হয়।
৬. আইনের দ্বারা নাগরিকত্ব নির্ধারণ : ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বরের ঘোষণা মুতাবেক সংশোধনী আনয়ন করা হয় যে, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে এবং বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশী বলে গণ্য হবে।৪
ইসলামী দল
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্ব থেকে এ অঞ্চলে উলামা নেতৃত্বের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, জমায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (মাহমুদ হাজারভী) সক্রিয় ছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর সাংবিধানিক মূলনীতি ও বিধানের আওতায় ধর্ম সংশ্লিষ্ট ও ধর্মভিত্তিক সকল রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী নিষিদ্ধ হওয়ায় উলামা নেতৃত্বের দলগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই সরকার রাজনৈতিক দলবিধি (পলিটিকেল পারটিজ রেগুলেশন্স পিপি আর) ঘোষণা করার পর ১৯৭৬ সালের ২৪ আগষ্ট ঢাকায় এডভোকেট আবদুল জলীলের ঝিকাতলাস্থ বাসভবনে নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রাব্বানী পার্টি, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টি, ইমারত পার্টি এর সমন্বয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডি এল) প্রতিষ্ঠিত হয়। নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা খতীবে আজম সিদ্দীক রহ. কে আইডি এল এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। ১৯৭৭ সালের ২৩ অক্টোবর জমায়েতে ইসলামীর চক্রান্তে আইডি এল ভেঙ্গে যায়।
জিয়াউর রহমানের আমলে নির্বাচন
১. ১৯৭৭ সালের ৩০ মে তার অনুসৃত নীতি, কর্মপন্থা এবং তার প্রতি দেশবাসীর আস্থা যাচাইয়ের জন্য গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।
২. ১৯৭৮ সালের ৩ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেন এবং ৬টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদি ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন। তার বিপরীতে ছিল আওয়ামী লীগসহ ৫টি সেক্যুলার ও বামপন্থি রাজনৈতিক দলের সমন্বয় গঠিত জোট ‘গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট’। এ জোটের প্রার্থী ছিলেন এমএজি ওসমানী।
৩. ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ধর্মবিরোধী কাজ
১. ১৯৭৭ সালের শুরুতে ঢাকা জিপিও-র দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের গোলচত্তরে একটি মানুষ্যমূতির বাস্কর্য নির্মিত হয়। পরে উলামায়ে কেরামের আন্দোলনে সরকার তা অপসারণ করতে বাধ্য হয়।৫
২. অতপর দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংখ্যক ‘প্রাণী মূর্তির’ ভাস্কর্য নির্মিত হয়।৬
৩. প্রেসিডেন্ট জিয়ার শিখা অনির্বান বাংলাদেশে অগ্নিপূঁজার প্রথম উদ্বোধন।৭
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে হাফেজ্জী হুজুর রহ.
মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী সমাজব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যে যখন আন্দোলনের কর্মসূচী হাতে নেন তখন প্রথমে তিনি তৎকালীন শাসকদের ভ্রান্তপথ পরিহার করে এই মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামী হুকুমত কায়েমের আহ্বান জানান। ১৯৭৮ সালের ২৫ মে ১০ সদস্যের একটি উলামা প্রতিনিধি দল নিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে তিন ঘন্টা তার সাথে আলাপ করেন এবং ইসলামী হুকুমত কায়েমের আহ্বান জানান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এ বৃদ্ধ অলির নসীহতে কর্ণপাত কনেনি। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট নৈরাজ্য এবং শাসকদের অন্তর্দ্বন্দ্বের এক পটভূমিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৮০ সালে নিহত হন।৮
এরশাদের শাসনামল
১৯৮২-র ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন এবং দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ বিরোধী দল সমূহের মনোনিত তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
ধর্মীয় কাজে এরশাদ
১. সংবিধান সংশোধন করে ইনলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা, ২. শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা, ৩. রেড ক্রস সোসাইটিকে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে রূপান্তর।
১৯৮১ সালে ইসলামী দল
আরেফ বিল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. ১৯৮১ সালের ১৯ আগষ্ট ঢাকায় শীর্ষস্থানীয় উলামা-মাশায়েখ ও বুদ্ধিজীবীদের এক গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন আহ্বান করেন। ঐ সম্মেলনে দেশের শীর্সস্থানীয়, গণ্যমান্য এবং অনুসরণীয় প্রায় সকল উলামা-মাশায়েখগণই উপস্থিত হয়ে দেশের বিরাজমান সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা করেন। এ সেম্মলনে আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ওলামাদের পক্ষ থেকে একজন একক পার্থী দানের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়। ঐতিহাসিক সম্মেলনে হযরত হাফেজ্জী হুজুরকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যোগ্যতম প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
অতপর ৮১-র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সরকারী ছত্র-ছায়ার ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. ৩ লক্ষ ৮৮ হাজার ৭’শ ৪১ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান দখল করেন। নির্বাচনের পর ২৯ নভেম্বর ১৯৮১ ঢাকায় আহুত কর্মী সম্মেলনের পূর্বে দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামা-মাশায়েখ ও বিশিষ্ট্য ইসলামী চিন্তাবিদদের সাথে তিনদিন ব্যাপী স্থায়ী এক বৈঠকে হাফেজ্জী হুজুর মিলিত হয়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর বিগত নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট দেশের ইসলামী গণজাগরণকে আরো সক্রিয় ও সাংগঠনিক রূপ দানের উদ্দেশ্যে একটি ইসলামী রাজনৈতিক প্লাট ফরম গঠনের উপর গুরুত্বারোপ করেন। সম্মেলনের এই সুপারিশক্রমে ২৯ নভেম্বর ১৯৮১ লালবাগসায়েস্তা খান হলে অনুষ্ঠিত প্রায় দশ হাজার কর্মী ও দেশ-বিদেশের অর্ধশতাধিক সাংবাদিকের জনাকীর্ণ এক সম্মেলনে হাফেজ্জী হুজুর তার সিদ্ধান্তকৃত প্লাট ফরম ‘বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন’ এর নাম ঘোষণা করেন। এ সম্মেলনেই হাফেজ্জী হুজুর রহ. কে সংগঠনের প্রধান আমীরে শরীয়ত নামে অবিহিত করা হয়।
হুজুরের জীবদ্দশায় এ আন্দেলনের প্রধান নায়েবে আমীর ছিলেন তার প্রাণপ্রিয় শাগরেদ ও খলীফা যুগের অবিসংবাদিত নেতা হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই রহ.।৯
১৯৮৬ সালে খেলাফত আন্দোলনের ভাঙ্গন
১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ক ভিন্নমতের প্রেক্ষাপটে হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর দল খেলাফত আন্দোলন থেকে তার দীর্ঘ দিনের সহচর ও সহকর্মী শাইখুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক ও মাওলানা আবদুল গাফফারের নেতৃত্বে নেতাকর্মীদের একটি অংশ খেলাফত আন্দোলনে পৃথকভাবে কার্যক্রম চালাতে থাকেন।১০
বাংলাদেশের হক্কানি উলামায়ে কেরাম ১৯৮৬ সালের খেলাফত আন্দোলন ভাঙ্গার পেছনে যুবশিবিরের নেতা অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বাচ্চুকে দায়ী করেন এবং জমায়াতি চক্রান্তের অংশ মনে করেন।
১৯৮৯ সালে খেলাফত মজলিস প্রতিষ্ঠা
১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর শাইখুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক সাহেবের নেতৃত্বে যুবশিবিরের সাথে যুক্ত হয়ে খেলাফত মজলিস নামে একটি নতুন দল গঠিত হয়।১১
প্রেসিডেন্ট এরশাদের বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া
সামরিক হস্তক্ষেপ যেহেতু সংবিধান পরিপন্থি সেহেতু সামরিক শাসকগণ ক্ষমতা দখলের পর তাদের শাসন প্রক্রিয়াকে বৈধ করার জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাকে বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া বলে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এরশাদ এক সামরিক ঘোষণা দ্বারা রাষ্ট্রের সার্বিক ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করেন এবং দেশব্যাপী সামরিক আইন জারি করেন। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেতার ভাষণে বলেন যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্টা করাই তার প্রধান লক্ষ্য। তার বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া নিম্নরূপ :
১. ১৮ দফা কর্মসূচি ঘোষণা : ১৯৮৩ সালের ১৭ মার্চ তার সরকারের ১৮ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি মনে করেন, এ ১৮ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে দেশের সমস্যাবলির সুষ্ঠু সমাধান এবং জনসাধারণের ভাগ্য উন্নত হবে।
২. ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি প্রদান : ১৯৮৩ সালের ১লা এপ্রিল থেকে তিনি ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি এবং ১৯৮৪ সালের ১লা এপ্রিল প্রকাশ্য রাজনীতির অনুমতি প্রদান করেন।
৩. ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন : ১৯৮৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদ অধ্যাদেশ জারি করেন এবং এ অধ্যাদেশ অনুযায়ী ১৯৮৪ সালের জানুয়ারী মাসে ৪৩৫২ টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া ঐ সময় ৭৬টি পৌরসভা ও ৩টি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
৪. গণভোট অনুষ্ঠান : ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ তার সরকারের প্রতি জনমত যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে গণভোট অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
৫. উপজেলা নির্বাচন : তার ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ নীতি হিসেবে ১৯৮২ সালে থানা পর্যায়ে প্রশাসনিক পুনঃবিন্যাশের কার্যক্রম গ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালে থানাগুলোকে উপজেলায় পরিণত করা হয়। ১৯৮৫ সালের ১৬ ও ২০ মে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
৬. রাজনৈতিক দল গঠন : প্রথমে তারই প্রচেষ্টায় ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে ‘জনদল’ নামে একটি নতুন দল গঠিত হয়। ১৯৮৬ সালের ১লা জানুয়ারী ‘জনদল’ বিলুপ্ত করে ‘জাতীয় পার্টি’ নামে একটি নতুন দল গঠিত হয়।
৭. সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ : ১৯৮৪ সালের ২৭ মে নির্বাচনের তারিখ ধার্য করে। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর বাধায় এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। পরে ১৯৮৪ সালের ৮ ডিসেম্বর ধার্য করা হয়েছিল। একই কারণে সেটাও অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। অতপর ১৯৮৫ সালের ৬ এপ্রিল নির্বাচনের তারিখ ধার্য হয়েছিলো, সেটিও অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।
৮. জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৯৮৬ সালের ৭ মে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
৯. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন : ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১০. সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী : নির্বাচিত জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বিল বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে গৃহীত হয়।
১১. সামরিক আইন প্রত্যাহার : তিনি ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।
১২. নতুন মন্ত্রীসভা গঠন : তিনি স্থগিত সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারা পুনরুজ্জীবিত করে ২৬ সদস্যের এক সন্ত্রিসভা গঠন করেন।
১৩. জাতীয় সংসদের অধিবেশন : তৃতীয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৬ সালের ১০ জুলাই।
১৯৮৭ সালে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন
১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ ঢাকার মতিঝিলস্থ ‘শরীফস ইনে’ অনুষ্ঠিত এক ঐতিহাসিক সাংবাদিক সম্মেলনে ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’ আত্মপ্রকাশ করে। অতপর ১৩ মার্চ ১৯৮৭ প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই, হযরতুল আল্লাম শাইখুল হাদীস মাওলানা আজীজুল হক সাহেব, হযরত মাওলানা আবদুর রহীম সাহেব প্রমূখের নেতৃত্বে বাইতুল মুকাররম জনসমক্ষে আন্দালনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আন্দালনের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এ গণসমাবেশ তৎকালীন এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনীর আক্রমনে আন্দোলনের বহু নেতাকর্মী রক্তাক্ত ও আহত হয় এবং অনেকেই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়। এ আন্দোলনের বিপ্লবী কাফেলা বহু ঘাত-প্রতিঘাত ছড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ আন্দোলনের আমীর হচ্ছেন এদেশে লক্ষ লক্ষ ইসলামপ্রিয় মানুষের প্রাণপ্রিয় আধ্যাত্মিক রাহবার ও ধর্মীয় নেতা কামেল বুযুর্গ হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই। ইতোপূর্বে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রধান নায়েবে আমীর ছিলেন।
সাইদি সাহেবের বিশ্বাসঘাতকতা
ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রখ্যাত বক্তা মাওলানা দেলাওয়ার হুনাইন সাইদি সাহেব প্রথমে উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কেরামের সাথে আন্দোলনে শরিক থাকার ব্যাপারে কুরআন শপথ করে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু পরে তিনি প্রতিষ্ঠার তারিখেই বিশ্বাসঘাতকতা করে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন থেকে সরে পড়েন।
এরশাদের ব্যর্থতা ও তার কারণ
১. বিভিন্ন নির্বাচনে কারচুপি ও সন্ত্রাস : জেনারেল এরশাদ ক্ষমতাকে বৈধ করার লক্ষ্যে গণেেভাট, সংসদ নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক নির্বাচন সম্পন্ন করলেও ব্যাপক সন্ত্রাস ও কারচুপির কারণে এ সব নির্বাচন দেশ বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা হারায়। ফলে তিনি বৈধতার সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়।
২. আদর্শিক ভিত্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থতা : দীর্ঘ শাসনামলে তিনি তার সরকারের জন্য কোন আদর্শিক ভিত্তি গড়ে তুলতে পারেননি।
৩. নির্যাতন ও যুলুম : গণসমর্থন আদায় করতে ব্যর্থ হয়ে নির্যাতন ও জুলুমের আশ্রয় নেয় জেনারেল এরশাদ।
৪. নূর হোসেনের হত্যা : জরুরী অবস্থা অমান্য করে তরুণ যুবক নূর হোসেন “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” এ শ্লোগাণ পিঠে লিখে রাজ পথে বের হলে সেনাবাহিনীর গুলিতে তার বুক ঝাঝরা হয়ে যায়।
৫. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ : তার আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকায় বহু সংবাধিককে জেল জুলুমের শিকার হতে হয়। ফলে এ পেশায় নিয়োজিত লোকজন তার উপর তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে।
৬. অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা : তার সরকারের স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, আত্মসাৎ, দলীয়করণ ইত্যাদির কারণে চরম অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। যা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করে তোলে।
৭. কৃষি খাতে ঋণ ও ভরতুকি হ্রাস : সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করায় কৃষি খাতে ঋণ ও ভরতুকির পরিমাণ হ্রাস পায়।
৮. আইন-শৃঙ্খলার অবনতি : তার আমলে আইন-শৃঙ্খলায় চরম অবনতি ঘটায় নাগরিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে।
৯. ১৯৮৮ সালের বন্যা : ১৯৮৮ সালের বন্যায় বন্যাদুর্গত মানুষের অবস্থা ও ত্রাণ বিতরণে তিনি চরম অবহেলার পরিচয় দেন।
১০. মৌলিক মানবাধিকার হরণ : সন্ত্রাস ও নানারকম নির্যাতনের মাধ্যমে তার শাসনামলে মানবাধিকার চরমভাবে হরণ করা হয়।
১১. জাতীয় পার্টির দুর্বলতা : দলত্যাগী ও সুবিধাভোগী ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় পার্টিকে সমর্থনের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন।
১২. বিচার বিভাগের অবমাননা ও অবক্ষয় : তার আমলে বিচার বিবাগের অবমাননা ও অবক্ষয় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়।
১৩. বেসামরিক প্রশাসনের সামরিকীকরণ : বেসামরিক প্রশাসনে সামরিকীকরণে তার শাসনামলে বেসামরিক আমলারা তার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারেননি।
১৪. সর্বগ্রাসী দুর্নীতি : দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি জিহাদ ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে নিজেই ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তার সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে দারুনভাবে ব্যাহত করে।
১৫. দাতাগোষ্ঠির অসহযোগিতা : দাতাদেশ ও দাতাসংস্থাগুলোর পরামর্শ বিশ্বস্ততার সাথে পালন করে তাদের সন্তুষ্টি বিধানে প্রাথমিকভাবে সমর্থ হলেও পরবর্তীতে তা টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হন।
১৬. সামরিক বাহিনীর অসহযোগিতা : ক্ষমতা গ্রহণের সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর অংশিদারিত্বের প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতা গ্রহণের পর উক্ত প্রতিশ্রুতি পুরোপুরী পালনে ব্যর্থ হন।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য
১. স্বৈরাচারী সরকারের পতন : ৯০ এর গণআন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটান।
২. গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা : এ আন্দোলনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিলো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা।
৩. জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা : তার সময় জাতীয় সংসদ রাবার স্টাপে পরিণত হওয়ায় আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
৪. গণতন্ত্র পতিষ্ঠার পথ চিরস্থায়ী করা : বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ চিরস্থায়ী করা ৯০ এর আন্দোলনের একটি বিশেষ লক্ষ্য ছিলো।
৫. জবাবদিহিমুলক সরকার প্রতিষ্ঠা : তিনি নিজেকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে রাখায় জবাবদিহি মুলক সরকার প্রতিষ্ঠায় গণআন্দেলন অনিবার্য হয়ে উঠে।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনের কারণসমূহ
১. এরশাদ সরকারের স্বৈরাচারিতা : ক্ষমতা দখলের পর এরশাদ এবং তার দল স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে শাসন কার্যক্রম চালানোর ফলে জনগণ বিক্ষুদ্ধ হয়ে তার শাসনের বিরুদ্ধে এক গণআন্দোলনের সূচনা করে
২. প্রহসনমূলক নির্বাচন : ভোট ডাকাতি, কারচুপি ইত্যাদির মাধ্যমে তার আমলে প্রায় সব নির্বাচনই প্রহসনে পরিণত হয়। এর প্রতিবাদে জনগণ গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৩. গণমাধ্যমে ব্যক্তিগত প্রচার : রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র ইত্যাদি গণমাধ্যমগুলো এরশাদ সরকারের এককভাবে ব্যক্তিগত বিষয় প্রচার করে গণমাধ্যকে সরকার আজ্ঞবহ করে রাখায় বিরোধী দল গণআন্দোলনের ডাক দেয়।
৪. সেনাবাহিনীর প্রাধান্য : বেসামরিক জনগণের কোন তোয়াক্কা না করে এরশাদ সরকার সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে সামরিকবাহিনীর লোক নিয়োগ করায় বেসামরিক জনগণের মনে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
৫. সম্পত্তির বিরাষ্ট্রীয়করণ : নীতিহীনভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাধীনে পরিচালিত লাভজনক কারখানাগুলো ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিনাশ করেন। যার কারণে অনেক লোক চাকরি হারায়।
৬. সন্ত্রাস সৃষ্টি : সরকারের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করায় জনজীবন মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়। তাই জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠে।
৭. সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় : তার শাসনামলে দেশ এক মহা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়। মদ, জুয়া, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, টেন্ডার দখলে রাখা ইত্যাদি সচেতন নাগরিকদের বিবেককে নাড়া না দিয়ে পারেনি।
৮. বিরোধী দলের প্রতি অবজ্ঞা : ক্ষমতা ও অর্থের টোপ দিয়ে অনেক নেতা ও কর্মীকে হাত করে রাজনৈতিক দলগুলোকে হেয়-তুচ্ছ করে সেই ফ্যাসীবাদি নীতি- ‘এক নেতা এক দেশ’ অনুশিলনের জন্য ‘জাতীয় পার্টি’ গঠন করলে জনগণ তা মেনে নিতে পারে নি।
৯. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কোন ভলিষ্ঠ প্রদক্ষেপ না নেয়ায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। এতে জনগণ দুর্ভোগের শিকার হয় এবং এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।
১০. আমলাদের ভূমিকা : আন্দোলনের তীব্রতা অনুভব করে দেশের আমলারা জেনারেল এরশাদের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেন।
১১. বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের ভূমিকা : ডাক্তার, ব্যাংক কর্মচারী, উকিল, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক সর্বোপরি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিলে আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে উঠে।
১২. জরুরী অবস্থা ঘোষণা : বিরোধী আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য এরশাদ সরকার দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। শেষ পর্যায়ে আমলাতন্ত্রের উপর সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব তারা মেনে নিতে পারেনি।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনের ফলাফল
১. স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন : এরশাদের স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের জনগণ জেগে উঠে এবং গণআন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে। ফলে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।
২. নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন : এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয় যা গণতন্ত্র চর্চার পথকে সুগম করে।
৩. সরকারের জবাবদিহিতা : এ আন্দোলনের ফলে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং সরকারের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়।
৪. জনগণের বিজয় : এ আন্দোলনের ফলে সার্বভৌম সংসদ গঠনের মাধ্যমে জনগণের বিজয় সূচিত হয়।
৫. তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা : এ আন্দোলনের ফলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
৬. সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা : এ আন্দোলনের ফলে সামরিক বাহিনী সমর্থিত স্বৈরচারী সরকারের পতন ঘটে এবং সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়।
৭. সামরিক সরকারের পরাজয় : এ আন্দোলনের ফলে প্রথমবারের মতো কোন সামরিক সরকার বেসামরিক জনতার দ্বারা উচ্ছেদ হয়।
৮. সামরিক শাসনের অবসান : ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৫ বছরের পত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক শাসনের অবসান ঘটে।
খালেদা জিয়ার শাসনামল
১৯৯০ এর ৬ ডিসেম্বর হতে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি সাহাব উদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীণ সরকার ১৯৯১-র ২৭ ফেব্রুয়ারী পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচন আয়োজনে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ন্যায্যতার সাথে সহযোগীতা করেন। ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি পর্যাপ্ত ঊঁচু মাত্রার স্বচ্ছ ও অবাধ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেম জাতীয়তাবাদি দল (বিএনপি) সংখ্যাগরিষ্ট আসনে বিজয়ী হয় এবং জমায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ (জামাত)- এর নিঃশর্ত সমর্থনে দলটি সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ ১৯৯৪ সালের এক পর্যায়ে ‘গণপ্রদত্যাগ’ করার ফলে এবং একাদিক্রমে ৯০ বৈঠক দিবস অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকার প্রেক্ষাপটে সংসদে বিরোধী দলীয় আসন সমংহ শূণ্য ঘোষিত হয়। বিরোধী সদস্যবৃন্দ বাস্তবে হেবরণের এক মসজিদে ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলী নৃশংসতার প্রতিবাদে সংসদে মুলতবি আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হওয়ায় সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন এবং অতপর অভিযুক্ত মাগুড়া-২ উপনির্বাচনের প্রেক্ষাপটে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক ব্যবস্থার দাবিতে অব্যাহতভাবে সংসদ অধিবেশন বর্জন করতে থাকেন। অব্যাহতভাবে সংসদ অধিবেশন বর্জনের প্রেক্ষাপটেই বিরোধী দলীয় সদস্যবৃন্দের আসন সমূহ শূণ্য ঘোষিত হয়। প্রধানত বিপুল সংখ্যক শূণ্য আসনের উপ-নির্বাচন এড়াবার জন্য বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ ১৯৯৫ সালের ২৪ নভেম্বর ভেঙ্গে দেন। ১৯৯৬-র ১৫ ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসদের ৬ষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামাতসহ প্রধান বিরোধী দল সমূহ অংশ গ্রহণে বিরত থাকে এবং সে নির্বাচনে ভোট না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারীর তারিখের জন্য গণকারফিউ ঘোষণা করে জণগণকে হুশিয়ার করে দেন, ভোট দিতে গিয়ে কেউ আক্রান্ত হলে আওয়ামী লীগ দায়ী থাকবে না। প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা এবং ভোট দিতে গেলে ‘আক্রান্ত হবার’ শেখ হাসিনার হুশিয়ারীর প্রেক্ষাপটে এ নির্বাচনে গড়ে ১৫% ভোটারের উপস্থিতি ঘটেছিলে বলে পর্যবেক্ষক মহল দাবি করে। তবে নির্বাচনী ফলাফলে ৫০% এর বেশী ভোট প্রদানের কথা বলা হয়। অন্য বড় দলগুলোর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার প্রেক্ষাপটে বিএনপি সহজেই ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয়। ১৯ মার্চ ১৯৯৬ তারিখে ৬ষ্ঠ সংসদের প্রথম ও একমাত্র অধিবেশনটি শুরু হয়, ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী গৃহীত হয়, ২৮ মার্চ প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বিলে সম্মতি প্রদান করেন এবং ২৯ মার্চ প্রাধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অনুরোধে প্রেসিডেন্ট ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন। পরদিন ৩০ মার্চ ১৯৯৬ বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বেগম খালেদা জিয়া শাসনামলের অবসান ঘটে।
৯১-র নির্বাচনে বিএনপির বিজয় জমায়েতের সমর্থন ও একটি পর্যলোচনা
৯০ সালের গণআন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অধিনে ৯১ তে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেনা সদস্যদের হাতে নিহত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি গণমানুষের আস্থা ও ভালবাসার প্রতিফলন হিসেবে ৯১-র নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এককভাবে সরকার গঠনের যোগ্যতা লাভ করতে পারেনি। তখন পরিস্থিতিটা ছিল এমন, জমায়াত যদি বিএনপিকে সমর্থন না দেয় তাহলে বিএনপি সরকার গঠন করতে পারবে না অর্থাৎ জমায়াতের হাতে ছিল ক্ষমতার রিমোড়। তখন জামায়াত যদি বিএনপিকে সংবিধানের কুরআন বিরোধী ধারা পাল্টানোর জন্য এবং ইসলামী ধারা প্রবর্তনের জন্য চাপ সৃষ্টি করতো তখন বিএনপি বাধ্য হয়ে তা মেনে নিতো। কিন্তু ইসলামী দলের পরিচয় বহন করা জামায়াত তা করেনি; বরং একটি ইসলামী দলের পরিচয় বহন করে বাংলাদেশে সর্ব প্রথম নারী নেতৃত্বকে সমর্থন করে। আর এভাবে বাংলাদেশে নারী নেতৃত্বের ধারা চালু হয়।
ইসলামী ঐক্যজোট গঠন
১৯৯১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এর আবির্ভাব হয়। এ জোটের শরিক দলগুলো হলো, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, ফরায়েজী আন্দোলন এবং উলামা কমিটি। এ সাতটি দল নিয়ে গঠিত জোট ১৯৯১ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ১টি আসন লাভ করে। এ জোটের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রথম থেকেই শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক সাহেব পালন করে আসছেন। মাঝখানে ১৯৯৪-৯৬ সালে এর চেয়াম্যান ছিলেন আমীরুল মুজাহিদীন হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই। ৯৬ এর নির্বাচনে এ জোট ১টি আসন লাভ করে। জোট গঠিত হওয়ার কিছুকাল পর বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন জোট থেকে বেরিয়ে যায়।১২
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্মলাভের পর ১৯৭২ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা আরোহনের পর ত্রয়োদশ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে। দীর্ঘ ১৫ বছর রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার নামে দেশে স্বৈরশাসন চলতে থাকে। অবশেষে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের মাধ্যমে এদেশে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এদেশের সংসদীয় সসরকার ব্যবস্থার পুনঃজাগরণ ঘটে।১৩
বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার কার্যক্রম
১. ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন, ২. ১৯৯১ সালের ৬ আগষ্ট সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী, ৩. বহু দলীয় গণতন্ত্রের চর্চা, ৪. জবাবদিহিমূলক সরকার কাঠামো প্রতিষ্ঠা, ৫. স্বৈরাচারের স্থায়ী অবসান, ৬. সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, ৭. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ৮. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ৯. শক্তিশালী প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা ও পররাষ্ট্রনীতির অনুসরণ, ১০. নিরক্ষরতা দূরীকরণ, ১১. ঐকমত্যের সরকার গঠন, ১২. সংসদীয় ব্যবস্থা শক্তিশালী করণ, ১৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, ১৪. সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন-উত্তর পর্ব, ১৫. স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার পুনঃবিন্যাস, ১৬. সংবিধানের চতুর্দ্বশ সংশোধনী, ১৭. স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিটি গঠন।
বাংলাদেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার সমস্যাসমূহ
১. বহু দলীয় ব্যবস্থা। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি ক্ষুদ্রতম দেশ হওয়া সত্বেও এদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু থাকার কারণে প্রায় দুইশত রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়, ২. যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, ৩. গঠনমূলক বিরোধীতার অভাব, ৪. সাংগঠনিক দুর্বলতা, ৫. অংশিদারিত্বের অভাব, ৬. পারষ্পরিক ঘৃণা ও অবিশ্বাস, ৭. জাতীয় ঐকমত্যের অভাব, ৮. জনসাধারণের রাজনৈতিক অসচেতনতা, ৯. সংসদীয় রীতি-নীতি চর্চার অভাব, ১০. নীতি নির্ধারণে সংসদকে উপেক্ষ করা, ১১. সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, ১২. নাশকতামূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি, ১৩. দল ভাঙ্গনের রাজনীতির প্রচলন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
১. সহিষ্ণুতার অভাব, ২. প্রতিযোগিতামূলক দল ব্যবস্থা, ৩. যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, ৪. অভ্যন্তরীণ কোন্দল,
৫. নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্বের অভাব, ৬. ঐকমত্যের অভাব, ৭. নিম্নমানের রাজনৈতিক চর্চা, ৮. গণতন্ত্র সম্পর্কে পরষ্পরবিরোধী ধারণা, ৯. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব, ১০. শহরভিত্তিক দল, ১১. ক্ষমতাসীন দলের অনমনীয়তা, ১৩. হরতাল, ধর্মঘট ও অবরোধের পাধান্য, ১৪. বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা, ১৫. ক্যারিসম্যাটিক নেতৃত্ব, ১৬. কৃষক-শ্রমিক সংগঠন, বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক সংগঠনগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্ধভাবে মূল রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকান্ডকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করে থাকে।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত
১. নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি সৎ, দক্ষ ও নির্দলীয় প্রশাসন ব্যবস্থা, ২. নির্বাচনী বিধি-বিধান সঠিকভাবে বিশ্লেষণের জন্য একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, ৩. উপযুক্ত রাজনৈতিক দল যা দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানকল্পে সুষ্ঠু নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারে, ৪. সর্বপোরি সুষ্ঠু পরিবেশ ও জনগণের সহনশীল মানসিকতা।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা
১. নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন, ২. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন, ৩. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কঠোরতা, ৪. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম, ৫. বিদেশী পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা, ৬. নির্বাচনে অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, ৭. আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন, ৮. নির্বাচন কমিশনকে সাহার্য প্রদান, ৯. নির্বাচনে কারচুপি রোধ, ১০. জবাবদিহিতা, ১১. রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিমালা প্রচার, ১২. অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার রোধ, ১৩. প্রচার ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ, ১৪. নির্বাচনের প্রতি জনগণের আস্থা সৃষ্টি, ১৫. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন, ১৬.স্বাধীনভাবে ভোট প্রদানের ব্যবস্থা, ১৭. নির্বাচনী আইনকে কঠোরভাবে মেনে চলা।
খালেদা জিয়ার শাসনামলের ব্যর্থতা
১. সমঝোতার অভাব : একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতাশীন দল হয়েও বিএনপি বিরোধী দলের সাথে সমঝোতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়
২. পেশাজীবী সংগঠনের সাথে বিএনপির বৈরীভাব : বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রমিক সংগঠনের সাথে বিএনপির বৈরীভাব ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিএনপির পতনের পথ তরান্বিত করে।
৩. স্বজনপ্রীতি : স্বজনপ্রীতিতে লিপ্ত থাকার দরুণ প্রজাতন্ত্রের দিকে তেমন নজর না দিতে পারায় জনগণ তাদের থেকে আস্থা হারায়।
৪. দলীয়করণ প্রক্রিয়া : রাষ্ট্রের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিএনপির দলীয়করণ প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। আর এ অসন্তোষ বিএনপির পরাজয় ডেকে আনে।
৫. সরকারী আমলাদের বিদ্রোহ : ক্ষমতাশীন বিএনপির দলীয়করণকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সচিবালয়ের আমলাদের মধ্যে বিদ্রোহের দানা বেঁধে উঠে। ফলে বিএনপির পতন তরান্বিত হয়।
৬. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি : নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য তুলনামুলকভাবে অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় জনজীবন বিধ্বস্ত হয়। যা তার পারজয়ে একটি সূচক হিসেবে কাজ করে।
৭. দুর্নীতি ও অব্যবস্থা : শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দুর্নীতি ও অব্যবস্থার খবর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও বৈদেশিক দাতাগোষ্ঠি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়ে তার সরকারের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়।
৮. উপ-নির্বাচনে কারচুপি : উপ-নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু না হয়ে কারচুপির মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ায় বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে আন্দোলন করে বিএনপির পতন ঘটায়।
৯. নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি : ১৯৯১ সালের নির্বাচনে নানা রকম সুযোগ-সুবিধার কথা বললেও ক্ষমতায় গিয়ে এর উল্টোটাই করেছিলো। আওয়ামী লীগ এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করায় বিএনপির পরাজয় নিশ্চিত হয়।
১০. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি : হত্যা, রাহাজানি, ছিনতাই, বন্ধুকযুদ্ধ নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে যাওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি দেখা দেয়। এ কারণে জনমনে বিএনপির প্রতি বিতৃষ্ণা দেখা দেয়।
১১. গণমাধ্যমের অপব্যবহার : তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী সরকারী গণমাধ্যমকে স্বায়ত্তশাসন দেয়ার কথা থাকলেও ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর তারা গণমাধ্যমকে অপব্যবহার করতে থাকে। ফলে জনগণ অসন্তোষ প্রকাশ করে।
১২. মাগুরা ও বগুড়ার উপ-নির্বাচন : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে তারা উপ-নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় নেয়।
১৩. অত্যাচার-নির্যাতন : দেশের সব বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অকারণে অত্যাচার-নির্যাতন ও জেল-জুলুমের মাধ্যমে হয়রানি করতে থাকায় সব বিরোধী দল তাদের বিরুদ্ধে দানা বেঁধে উঠে।
১৪. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে অগ্রাহ্য করা।
১৫. ছাত্র দলের নেতাদের দালালী ও চাঁদাবাজী।
১৬. ১৫ ফেব্রুয়ারী ভোটার বিহীন নির্বাচন।
১৭. ক্ষমতার অপব্যবহার।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে ধর্মদ্রোহীদের উৎপাত
১. ১৯৯১ সালের প্রায় শুরু থেকে গণতন্ত্রের ‘সাড়ম্বর’ যাত্রা যখন শুরু হয় তখন থেকে মুসলিম নামধারী অনেক মুনাফিকের মুখ থেকে মুখোশ খষে পড়ে। ৯১ সালের পুরোটাই ছিলো এই মুনাফিকদের স্বরূপে আত্মপ্রকাশের বছর।
২. আযানের বিরুদ্ধে কবি শামসুর রহমান ও কবির চৌধুরী গংদের হামলা বিএনপি আমলের আশকারার ফল।
৩. ১লা ফেব্রুয়ারী ১৯৯২ সাল ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’ শুরু হলো, মৌলবাদের তথা ইসলামের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য। এ ছিলো ধর্মদ্রোহিতা ও সহিংসতার সরাসরি উসকানি। সরকার কিছুই বলেনি, প্রদক্ষেপ নেয়া তো দূরের কথা।
৪. ১৯৯২ সালের ৪ মার্চ এর খবর, ইডেন গার্লস কলেজের বদরুন্নেছা হলে মসজিদ কক্ষে জনৈকা হিন্দু ছাত্রীর আবাসিক ব্যবস্থা করা হয়। ফলে নামায কক্ষে ছাত্রীদের নামায আদায় বন্ধ হয়। সরকার এব্যাপারে নিরবতা অবলম্বন করলেন।
৫. ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল ২১ জন মুরতাদ একত্রিত হয়ে ঢাকার লালবাগে প্রতিষ্ঠা করে একটি সংগঠন। তাদের সংগঠনের নাম ছিলো ‘মৌলবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন’। এই কুলাঙ্গাররা সরকারের কাছে দাবি জানায়, মসজিদে মুনাজাত বন্ধের, আর কুরআনের পলিটিক্যাল আয়াত নিষিদ্ধের। দিকে দিকে এর প্রতিবাদ উঠলেও সরকার কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কোন এ্যাকশান নিলেন না।
৬. ২৯ এপ্রিল ১৯৯২ সালের ইত্তেফাক রিপোর্ট : বেতার টেলিভিশন শিল্পি সংসদের সভাপতি আবেদ খানের অভিমত : রাজাকার আল বদর তৈরীর উৎস (মাদরাসা) বন্ধ করতে হবে। বিএনপি সরকার কিছুই বললেন না।
৭. ১৯৯২ সালের ৫ ডিসেম্বর ‘শহীদ বিপ্লবী ও দেশপ্রেম স্মৃতি সংসদ’ নামের একটি সংগঠনের সভা অনুষ্টিত হয় এই রাজধানীতে। সভার সভাপতি হামিদুল হক সভায় প্রস্তাব রাখলেন, রেডিও, টিভিতে কুরআন তেলাওয়াত ও আযান নিষিদ্ধ করা হোক। সরকার তা পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে দেখলেন কিন্তু প্রস্তাবকের বিরুদ্ধে কোন এ্যাকশান নিলেন না।
৮. ১লা ফেব্রুয়ারী ১৯৯৪ সাল অশীতিপর সুফিয়া কামাল বোরকা পরাকে অপচয় বলেই ক্ষান্ত হননি; এই অপচয় তথা বোরকা পরার বিরুদ্ধে আন্দোলনেরও ডাক দিলেন। সরকার এ ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেন।
৯. ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে ‘ইসলাম ও মানবাধিকার’ শিরোনামে মুসলিম নামধারী দুই কুলাঙ্গার এই রাজধানী ঢাকা থেকে একটি বই প্রকাশ করে বিনামূল্যে বিতরণ করে। তাতে তাদের আবেদন ছিলো এই, ১৪’শ বছরের পুরানো ইসলামকে ত্যাগ করা প্রয়োজন। কুরআন হাদীস ত্যাগ করতে হবে এবং এর চর্চাও বন্ধ করতে হবে। এই পুস্তকে রাসূল সা. এর চরিত্রের উপর জঘণ্য ও কটাক্ষ করা হয়। বলা বাহুল্য, অনেক লেখালেখির পর সরকার শুধু পুস্তকটি বাজেয়াপ্ত করেন, লেখকদ্বয়কে গ্রেপ্তার করা তো দূরের কথা, কৈফিয়ত পর্যন্ত তাদের থেকে চাওয়া হয়নি।
১০. ১৯৯৪ সালের ৩ আগষ্ট আদালত থেকে জামিন লাভ করার পর ৯ আগষ্ট মঙ্গলবার আঁধার-ভোরে সুইডেনের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন তাসলিমা নাসরিন সরকারেরই সহযোগিতায়। সরকার তাসলিমার বিরুদ্ধে মুখ খোলা তো দূরের কথা; বরং সর্বপ্রকার সহযোগিতা দিয়ে তাসলিমাকে প্রমিনেন্ট করলেন। তাসলিমা নাসরিনের আবির্ভাব, তার সীমাহীন দৌরাত্ম এরং ইসলাম ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার বড্ড বাড়াবাড়ি বিএনপির শাসনামলের ‘স্বর্ণ ফসল’।
১১. ১৯৯৫ সালের এপ্রিল মাসে ‘রহস্য’ পত্রিকার সম্পাদকের সম্মতিতে প্রকাশিত হলো তারই পত্রিকায় এক খানা চিঠি। সেই চিঠিতে রাসুল কারীম সা. কে‘অবোঝ’ এবং ‘ভুল ব্যাখ্যাকারী’ হিসেবে অপবাদ দেয়া হয়। সরকারের এ ক্ষেত্রেও অতীতের মত চুপ থাকলেন।১৪
খালেদা জিয়ার আমলে জন্ম নেয়া, তাসলিমার তিনটি এসাইনমেন্ট
সাংবাদিক মোবাইদুর রহমানের ভাষায় :
১. ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম এবং বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে সমাজ থেকে উচ্ছেদ করে তার প্রিয় প্রতিবেশী দেশের ধর্মকে এদেশে আমদানী করার পথ সুগম করা।
২. দেশ থেকে শালীনতা, মুল্যবোধ এবং নৈতিক চরিত্রের নাম-নিশানা মুছে ফেলে নৈতিকতার ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা এবং চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করা।
৩. বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তাকে বিলীন করে আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমিকে ভারতের অঙ্গিভূত করা।১৫
শেখ হাসিনার শাসনামল ১৯৯৬ এর ২৩ জুন থেকে ২০০১ এর ১লা অক্টোবর
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবীবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বাবধানে ১৯৯৬-র ১২ জুন জাতীয় সংসদের সপ্তম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাব করে এবং জাতীয় পার্টির সমর্থনে ২৩ জুন ১৯৯৬ সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের চার দলীয় জোট এবং পীর সাহেব চরমোনাইর নেতৃত্বে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন অব্যহত আন্দোলন করে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হয় এবং মধ্য জুলাই-এ ২০০১ বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর জাতীয় সংসদের অষ্টম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে চার দলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশী সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
সপ্তম জাতীয় নির্বাচন
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের অব্যবহিত পর নির্বাচন কমিশন ১৯৯৬ সালের ১২ জুন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সপ্তম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে। দেশের প্রধান দলগুলো ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচনে অংশ গ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিলো ৮১টি। মোট পার্থী ছিল ২,৫৭৪জন, মোট ভোটার ছিল ৫,৬৭,১৬,৯৩৫ জন এবং মোট প্রদত্ত ভোট ৪,১৫, ০০, ০০০ টি। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে খুলনা বিভাগে ৮২% এবং সবচেয়ে কমভোট পড়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে ৬০%।
আওয়ামী লীগের জয়লাভের কারণসমূহ
১. ক্ষমতাশীন দলের ক্ষমতার অপপ্রয়োগের দৃষ্টান্ত জনসম্মুখে তুলে ধরা : আওয়ামী লীগ তৎকালীন ক্ষমতাশীন বিএনপির ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্বাচনে কারচুপি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ করার বিষয়গুলো জনগণের নিকট উন্মাচন করে তাদের আস্থা লাভ করে।
২. দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার প্রতিশ্রুতি : আওয়ামী লীগ প্রধান নির্বাচনী ইশতেহারে গণতন্ত্রকামী বাঙালীর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
৩. শোষিত মানুসের কল্যণার্থে কাজ করার অঙ্গীকার : শোষিত মানুষ তথা কৃষক-শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।
৪. সহনশীলতার রাজনীতি : আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন যাবৎ সহনশীলতার রাজনীতি করছে বলে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট পায়।
৫. অহিংস রাজনীতির পক্ষপাতী : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অহিংস রাজনীতির পক্ষপাতী। দীর্ঘদিন এ দলের মনোভাব পর্যবেক্ষণ করে জনগণ তাদের পক্ষে রায় দেয়।
৬. সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনের প্রতিশ্রুতি : নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ঘোষণা করে যে, বিজয়ী হলে তাদের প্রথম কাজ হবে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমন করা।
৭. নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার চমৎকার অভিজ্ঞতা : আওয়ামী লীগের সকল নেতা-কর্মীই প্রবীণ রাজনীনিবিদ। নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করায় কৌশলগত দিক থেকে তাদের চমৎকার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
৮. বিচার বিভাগ স্বন্ত্রিকরণ নীতি : বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কল্যাণের জন্য আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগকে সতন্ত্র করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে জনগণের আস্থা অর্জন করে ছিলো।
৯. গণযোগাযোগ মাধ্যমের স্বাধীনতা : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে সংবাদপত্র, রেডিও ও টিভির পূর্ণ স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন প্রদান করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলে নিজেদের পক্ষে জনগণের রায় পায়।
১০. মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ : সর্বোপরি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার ওয়াদা ব্যক্ত করে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রীসভা গঠন করেছিল।
১১. সুশীল সমাজকে শক্তিশালী করার প্রত্যয় : সামরিক শাসন বহাল থাকায় বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ সিভিল সমাজ জাঁতাকলে পিষ্ট হয়। সিভিল সমাজকে শক্তিশালী করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলে জনগণ তাদের পক্ষে রায় দেয়।
১২. অতীত ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা প্রার্থণা : ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগ অতীত ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা প্রার্থণা করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়।
১৩. গণজোয়ার : সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ‘একবার ক্ষমতায় যেতে দিন’, ‘একটি বার পরীক্ষা করে দেখুন’ প্রভৃতি অভিনব প্রচার কৌশলে দেশে আওয়ামী লীগের অনুকূলে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। ফলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় সূচিত হয়।
১৪. আওয়ামী নেত্রী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য নানবিধ কৌশল অবলম্বন করেন। যেমন মাথায় পট্টি বাঁধেন, মাজার জেয়ারতের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন, বারবার উমরায় গমন ইত্যাদি।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা
১. চার দলীয় জোট গঠন, ২. সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের সর্বস্তরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ব্যাপক দলীয়করণ, আত্মীয়করণ ও পারিবারিকীকরণ, ৩. ক্ষমতাসীন দলের ছত্র-ছায়ায় সারাদেশে বেশকিছু সন্ত্রাসীগ্রুপ তৈরী এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা, ৪. চরমপন্থী ইসলামী মৌলবাদীদের দমনের নামে ইসলামী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও নিরিহ মাদরাসা শিক্ষক-ছাত্রদের ধরপাকট ও হয়রানী, ৫. বেশ কয়টি ব্যাপক বিধ্বংসী বোমা হামলার দায় তদন্তের পূর্বেই রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক উলামার উপর চাপানো।
শেখ হাসিনার উশৃঙ্খল বক্তব্য
শেখ হাসিনার শাসনামলে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো চট্টগ্রামের ‘এইট মার্ডার’। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব ছিলো এর সুষ্ঠু তদন্তের নির্দেশ দান। কিন্তু তিনি তা না করে প্রতিপক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করলেন এবং তার দলের সন্ত্রাসীদেরকে এ বলে ভৎসনা করলেন যে, তারা এর প্রতিক্রিয়ায় আটজনের বদলে আশিজন খুন করলো না কেন? তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা কি শাড়ি-চুড়ি পরে বসে আছো? তিনি নির্দেশ দিলেন, তারা যেন একটি লাশের বদলে দশটি লাশ ফেলে।
ফেনীর কুখ্যাত সন্ত্রাসী হাজারী সম্পর্কে তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, “হাজারী ছিলো, হাজারী আছে ও হাজারী থাকবে।”
শেখ হাসিনার আমলে গডপাদার
ফেনীর জয়নাল হাজারী, লক্ষীপুরের তাহের, গফরগাঁয়ে আলতাফ গোলন্দাজ, নারয়নগঞ্জের শামীম উসমান, ঢাকায় হাজী সেলিম, ডা. ইকবাল, কামাল মজুমদার ও মাকবুল হোসেন এবং বরিশালের হাসানাত আবদুল্লাহ।
শেখ হাসিনা সরকারের ব্যর্থতা
১. দম্ব ও অহংকার, ২. সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতা, ৩. মন্ত্রিপুত্রদের অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপ, ৪. আলেম-উলামাদের উপর নির্যাতন, ৫. সাংবাদিক নির্যাতন, ৬. বোমা ভীতি, ৭. শেয়ার বাজারে ধস, ৮. দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতা, ৯. অকার্যকর জাতীয় সংসদ, ১০. জননিরাপত্তা আইন প্রণয়ন, ১১. বোর্ড বই ও রাজউক প্লট বরাদ্দে কেলেঙ্কারি, ১২. শেখ মুজিব নামের অপব্যবহার, ১৩. নযীরবিহীন দলীয়করণ, ১৪. দলীয় সন্ত্রাসীদের তান্ডপ, ১৫. আজীবন নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন, ১৬. বহিঃবিশ্বের হস্তক্ষেপ।
শেখ হাসিনার আমলে ধর্মবিরোধী কার্যক্রম
১. বিভিন্ন এনজিওর ধর্মবিদ্বেষী কার্যক্রম। ক) সরকারের এনজিও বিষয়ক দপ্তর ‘এনজিও ব্যুরো’ ১০০’শটি এনজিওর উপর তদন্ত চালিয়ে ৫২টিকেই খিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরের কাজে সরাসরি লিপ্ত হিসেবে দেখতে পায়।১৬ খ) ১৯৯৮ এর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলা শহর বি-বাড়িয়ায় নিয়াজ মুহাম্মদ খান স্টোডিয়ামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশিকাসহ এয়েকটি এনজিও বিজয় মেলার আয়োজন করে। তাদের প্ল্যাকার্ড ও শ্লোগানের ভাষা ছিলো, “ফতোয়াবাদ নিপাত যাক” ‘জজ-ম্যাজিস্ট্রেট থাকে ঘরে, মোল্লা কেন বিচার করে’ ‘হৈ হৈ রৈ রৈ মোল্লারা গেলো কৈ’ গ) ১৯৯৮ এর ৭ ডিসেম্বর বি-বাড়িয়ার উলামাগণ বিজয় মেলা ভেঙ্গে দেয়ার জণ্য অগ্রসর হয়। পরদিন ৮ ডিসেম্বর উক্ত শহরে হরতাল পালিত হয়। উলামাদের পক্ষে মুফতি আবদুর রহীম কাসেমী প্রশিকা প্রধান ও তার সহযোগীদের বিবাদি করে একটি মামলা দায়ের করেন। তারাও উলামাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।১৭
২. ২০০১ সালের ১লা জানুয়ারী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের দুই বিচারপতির একটি বেঞ্চ সব ধরণের ফতোয়া নিষিদ্ধ করে।
৩. মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ শিক্ষণ : বাংলদেশের উলামার কল্পিত ‘গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গি’ সংশোধনের জন্য দুই বিচারপতির ‘তাৎক্ষনিক সুপারিশ’ হলো, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ স্কুল এবং মাদরাসা শিক্ষা কারিকুলামে অবশ্যই অন্তর্ভূক্ত করা হবে এবং সমস্ত মসজিদের খতীবদেরকে তাদের শুক্রবারের খুৎবায় অধ্যাদেশটি আলোচনা করার অবশ্যই নির্দেশ দিতে হবে। উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে উক্ত আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশের উলামা সেই ১৯৬১ সালের সামরিক শাসক জেনারেল আয়ুব খানের লোহ শাসনকে তাচ্ছিল্য দেখিয়ে তার ঘোষিত আইনটিকে সে সময় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ইতোমধ্যে জানা গেছে, খোদ পাকিস্তানেরই পরবর্তী এক সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশটি সে দেশে বাতিল ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশে সেই বাতিল আইনটি শিক্ষার্থী ও দেশ বাসীকে কেন শিখাতে হবে?১৮
৪. মাদরাসা বিলোপ ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রন : ১৯৯৬ থেকে ২০০১ শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রপেসর এম শামসুল হকের নেতৃত্বেও একটি শিক্ষা কমিশন কুদরত-ই খুদা প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রায় অনুরূপ এক ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছিলো। বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মাদরাসা শিক্ষার উপর ঢালাও সমালোচনা না করে সাধারণ শিক্ষার প্রতিস্তরে কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা সংযুক্ত করা হোক।১৯
৫. শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কেরামকে গ্রেপ্তার : শাইখুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক, মুফতি ফজলুল হক আমিনী, মুফতি এজহারুল ইসলাম চৌধুরী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা ইমতিয়াজ আলমসহ শত শত উলামায়ে কেরামকে গ্রেপ্তার করা হয়
৬. বি-বাড়িয়া ট্রাজেডি ২০০১ : ২০০১ এর ৬ ফেব্রুয়ারী উলামায়ে কেরামকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে হরতাল আহ্বান করা হলে শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি করে হত্যা করা হয় ৬জন মাদরাসার ছাত্রকে।২০
৭. রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় আহুত ইমাম সম্মেলনে : ২৬ এপ্রিল ১৯৯৯ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ইমামদের সার্টিফিকেট বিতরণ কালে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারিকৃত ১৩টি আচারণবিধির একটিতে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দেয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।২১
৮. আওয়ামী সরকারের আমলে মূর্তির (স্বরস্বতী দেবী) পায়ের নিছে কুরআনের আয়াত ছাপানো হয়েছে। ইসলামী ভার্সিটিতে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা হিন্দুদের ‘বাণী অর্চনা’ অনুষ্ঠানের দাওয়াত কার্ডে স্বরস্বতীর পায়ের নিছে কুরআনের আয়াত ছাপায়।২২
৯. ‘বাংলাদেশের স্রষ্টা কে?’ ক) আল্লাহ, খ) রাসূল, গ) ফেরেশতা, ঘ) বঙ্গবন্ধু, ময়মনসিংহের মুকুল বিদ্যানিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা ১৯৯৬ এর নবম শ্রেণীর ইসলাম ধর্মের নৈব্যত্তিক বিষয়ে উপরোক্ত প্রশ্নটি করা হয়।২৩
১০. মুসলিম জতির পিতা কে? ক) শেখ মুজিবুর রহমান, খ) উমর রা., গ) ইবরাহীম আ., ঘ) নূহ আ., এমনই একটি প্রশ্ন করা হয় ময়মনসিংহের আরেকটি স্কুলে।২৪
১১. মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক এর বই ‘বাংলা ভাষায় মুসলিম লেখক গ্রন্থপঞ্জী’ শিরোনামের পান্ডুলিপি থেকে মুসলিম শব্দ বাদ না দেয়ায় বাংলা একাডেমি তা প্রত্যাখ্যান করে।২৫
১২. আওয়ামী সরকারের আমলে বিভিন্ন স্থানে কুরআন শরীফ নর্দমায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২ জুন ১৯৯৯ মিরপুরে, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০০ ও ১৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে উল্লেখযোগ্য।২৬
১৩. আওয়ামী ছাত্রলীগের ক্যাডাররা পবিত্র কুরআনকে পোড়াতে মোটেও দিধা করেনি। এর মধ্যে বরিশাল ও মানিকগঞ্জ উল্লেখযোগ্য।২৭
১৪. ২০০০ সালের ১৪ জুলাই ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে হিন্দু-বোদ্ধ-খিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা অবিলম্বে সংবিধান থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ বাতিল করার দাবি জানান। উল্লেখ্য, ঐক্য পরিষদের নেতারা যেমন- মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত, নিমচন্দ্র ভৌমিক, বিচারপতি দেবেশ ভট্রাচার্য আওয়মী ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবেই পরিচিত।২৮
১৫. কুমিল্লা জেলা যুবলীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম শহীন ৯ একর ওয়াক্ফকৃত জমি দখলের উদ্দেশ্যে বাগিচাগাঁও এলাকায় প্রায় সোয়াশ’ বছরের একটি পুরাতন মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে দেয়। জনরোষ থেকে রক্ষার জন্য নামে মাত্র সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। এমনকি পুরাতন মসজিদ কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে জোরপুর্বক নতুন মসজিদ কমিটি গঠন করে। সে এতে স্বঘোষিত সেক্রেটারী হয়।২৯
১৬. ১২ মার্চ ২০০১ গভীর রাতে ফেনীতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ক্যাডাররা শহরের দাউদপুর ব্রিজের দক্ষিণ পার্শে আরামবাগ এলাকায় তিন বছর আগে প্রতিষ্ঠিত একটি পাঞ্জেগানা মসজিদকে রাতারাতি গায়েব করে ফেলে। মসজিদটি খাস জমির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। জমিটি দখল করার জন্য আওয়ামী ক্যাডাররা সম্পূর্ণ মসজিদটি রাতের আধাঁরে গায়েব করে ফেলে।৩০
১৭. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য নির্মিতব্য একটি আবাসিক হলের ডিজাইন থেকে মসজিদ বাদ দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫’শ মুসলিম ছাত্রের জন্য দশ কোটি টাকা ব্যায়ে অমর একুশে নামে এ হলটি নির্মাণ করা হয়েছে। কার্জন হল সংলগ্ন পুরাতন জাদুগরের পাশে নির্মিতব্য এই হলে মূল ডিজাইনার প্রকৌশলী নিশ্চিত করে বলেন, নতুন হলটির ডিজাইনে কোন মসজিদ নেই।৩১
১৮. ৬ জুন ২০০০ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী ঘরানার সংগঠন হিন্দু-বোদ্ধ-খিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা মুসলমানদের নামের আগে ‘মুহাম্মদ’ ও ‘আলহাজ্ব’ বাদ দেয়ার দাবি জানান। উক্ত অনুষ্ঠানে আওয়ামী নেতা সি আর দত্ত, সুধাংশু শেখর হালদার প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।৩২
১৯. বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আলী আজগর হযরত মুহাম্মদ সা. কে সন্ত্রাসী (নাউযুবিল্লাহ) হিসেবে আখ্যায়িত করে। জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী এ. এইচ. এস. কে. সাদেক প্রধান অথিতী হিসেবে উপস্থিত থাকলেও কোন প্রতিবাদ করেননি।৩৩
২০. আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই প্রায় ৩০০টি মাদরাসার অনুদান বন্ধ করে দেয়। উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে ইসলামিক হিস্ট্রি, ইসলামিক স্টাডিজ বিষয় নতুন করে অনুমোদন প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। এ সব বিষয়ে নতুন করে কোন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। ৬ জুলাই ১৯৯৯ দেশে ৩০০টি মাদরাসার অনুদান বন্ধের প্রতিবাদে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে জাতীয় সংসদে তুমুল বাক-বিতন্ডা হয়।৩৪
২১. আওয়ামী সরকার প্রতিটি হত্যাকান্ডে, যেমন যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে হত্যাকান্ড (৬ মার্চ, ১৯৯৯), কবি শামসুর রহমানকে কথিত হত্যার প্রচেষ্টা (২ জানুয়ারী, ১৯৯৯), কাজী আরেফ হত্যাকান্ড (৬ ফেব্রেুয়ারী, ১৯৯৯), সাংবাদিক শামসুর রহমানের হত্যাকান্ড (১৬ জুলাই, ২০০০), সিপিবি-র মহাসমাবেশে বোমা বিষ্ফোরণে হত্যাকান্ড (২০ জানুয়ারী, ২০০১), ১লা বৈশাখে রমনার বটমূলে বোমা বিষ্ফোরণে হত্যাকান্ড (১৪ এপ্রিল, ২০০১), আলেম-উলামাদের জড়িয়ে শত শত আলেম-উলামা ও ইসলাম পন্থীদের গ্রেপ্তার করেছে। এই পর্যন্ত সরকার ৩০ হাজার আলেম-উলামাদের বিরুদ্ধে জননিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছে। অথচ এ সব ঘটনার কোনটিতেই আলেম-উলামা বা ইসলামপন্থীরা জড়িত প্রমাণিত হয়নি।৩৫
২২. ৩ ফেব্রুয়ারী ২০০১ হরতাল চলাকালে পুলিশ আলেম-উলামা, দাঁড়ি-টুপিধারীদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। ৪ ফেব্রুয়ারী ডেইলী স্টারে প্রকাশিত একটি চিত্রে দেখা যায়, পুলিশ একজন আলেমকে উলঙ্গ করে পিচঢালা রাস্তায় টেনে হেচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ বাইতুল মুকাররম মসজিদে ‘আল্লাহু আকবার’ লেখা লেখাগুলোতে টিয়ারগ্যাস ছুঁড়ছে। আরেক দল পুলিশ বুটজুতা পায়ে বীরদর্পে মসজিদ থেকে বের হচ্ছে।৩৬
২৩. চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে হঠাৎ করে কোন কারণ ছাড়াই পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত ও তাফসীর বন্ধ করে দেয়া হয়।৩৭
২৪. ৩১ অক্টোবর’৯৬ বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতীবের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারী করা হয়। মানিক মিয়া এ্যাবিনিউতে এক সমাবেশে বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকারের সহযোগী ইনুপন্থি জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহিল কাইয়ুম তার বিরুদ্ধে সি. এম. এম. আদালতে একটি নালিসী মামলা দায়ের করে।৩৮
২৫. ২৮ জানুয়ারী ২০০ শেখ মুজিবের নামে কটুক্তি করার মিথ্যা অজুহাতে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ফরিদপুর সদর থানার বায়তুল মুকাদ্দাস জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাও নুরুল ইসলামকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। এরপর তারা ইমামকে পুলিশের সোপর্দ করেন।৩৯
২৬. আ’ লীগ সরকার জনগণের নিরাপত্তা দানে ব্যর্থ হলেও পেটোয়া বাহিনী দিয়ে তাফসীর মাহফিল, সীরাত মাহফিল, ওয়াজ মাহফিলে ১৪৪ ধারা জারী করতে বড়ই পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছে।৪০
২৭. ধর্ম ও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে ১৯৯৮ সাল থেকে ১৯৯৯ সালে সরকারী ব্যবস্থাপনায় হজ্বযাত্রীদের সংখ্যা ১ হাজার ৪১জন কম হয়। মক্কা শরীফে বাড়ী ভাড়ার নামে হাজীদের টাকা আত্মসাৎ, হেরেম শরীফের বহু দুরে দুর্গম পাহাড়ের উপর কষ্টকর যাতায়াত, মোটা অংকের ফি দেয়ার পরও হজ্ব অনুষ্ঠানে মুয়াল্লেমদের গাফলতিসহ নানা অনিয়মের ফলে সরকারী ব্যবস্থাপনায় হজ্বযাত্রী ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়।৪১
২৮. পশ্চিম বঙ্গের অনুকরণে (সেখানে মাইকে আযান দেয়া নিষিদ্ধ) রমযানের সময়ই নিলফামারীতে মাইক ব্যবহার করে রোযাদারদের ডাকানো নিষিদ্ধ করা হয়। নিলফামারী জেলা প্রশাসন এই নিষেধাজ্ঞা জারী করে।৪২
২৯. চট্টগাম ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ আয়োজিত ঐতিহাসিক তাফসীর মাহফিল বন্ধের ষঢ়যন্ত্র করে সরকার। এর জন্য ১৪৪ ধারা জারী করে। ১০ নভেম্বর শুক্রবার মুসল্লিরা এর প্রতিবাদে বিভিন্ন মসজিদ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠি চার্জ করে। একপর্যায়ে পুলিশ বুট-জুতা পড়ে চট্টগ্রামে প্রধান মসজিদ আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদে প্রবেশ করে বহু নিরীহ মুসল্লিাকে গ্রেপ্তার করে।৪৩
৩০. ২৭ মার্চ ২০০১ প্রধানমন্ত্রির রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডা. এস. এ. মালেক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রম্মা কালী মন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রম নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে আওয়ামী নেতা শ্রী শুধাংশু শেখর হালদার হুংকার দিয়ে বলেন, ফতোয়াবাজদের (ইসলামপন্থিদের) আমরা সাগরে চুবিয়ে মারবোই। তাদের নিঃশেষ করতে না পারলে কালি মাতা জাগবে না।৪৪
৩১. আওয়মী সরকার অন্যায়ভাবে দেশ বরেণ্য ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম-এ-দীন মাওলানা ওবায়দুল হককে মায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতীব পদ থেকে অব্যাহতি দেয় ২২ এপ্রিল ২০০১। তার অব্যাহতি পত্রে বলা হয়, বয়স ৭৩ বছর তাই তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অথচ পূর্বের সকল খতীবই আমৃত্যু স্বপদে বহাল ছিলেন। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিয়োগকৃত খতীবকে কাদিয়ানী সমর্থক মাওলানা (?) আবদুল আউয়াল এর সাক্ষরে অব্যহতি দেয়া হয়। পরে জনতার দাবিতে এবং আদালতের রায়ে সরকার নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং তিনি স্বপদে ফিরে আসেন।৪৫
৩২. ২২ জুলাই ২০০০ ঢাকার ইস্টার্ণ প্লাজা মসজিদের খতীব ও ঢাকা জেলা ইমাম সমিতির সেক্রেটারী হাফেজ মাসুদুর রহমানকে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা শিবির কর্মী সন্দেহে মারপিট করে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়।৪৬
৩৩. আওয়ামী সন্ত্রাসীরা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার শ্রীপুরের মান্দারিয়া সালেহিয়া দারুস্ সুন্নাহ এতিমখানাটি আগুণে পুড়িয়ে দেয়। স্থানীয় লোকদের মতে এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী কামালের নেতৃত্বে একদল যুবক এতিমখানাটিতে অগ্নি সংযোগ করলে তিনটি ঘর, মাদসার গুদামে ৫০ মন চাউলসহ প্রায় দশ লক্ষ টাকার মালামাল পুড়ে চাই হয়ে যায়।৪৭
৩৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পার্শে জাতীয় কবি নজরুলের মাজার। কবির বিখ্যাত উক্তি ‘মসজিদেরই পার্শে আমায় কবর দিও ভাই’। তার অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পার্শে দাপন করা হয়। কবরের পলকে উৎকীর্ণ ছিলো সেই বিখ্যাত উক্তি “মসজিদেরই পার্শে আমায় কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।” আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৯ সালের ২৫ মে উক্ত পলক ভেঙ্গে নতুন একটি পলক নির্মান করে, যাতে কবির ঐ কবিতাটি স্থান পায়নি।৪৮
৩৫. বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ। শত শত বছর যাবৎ এদেশে হিন্দু-মুুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বিরা প্রতিবেশী হিসেবে সম্প্রীতির সাথে বসবাস করে আসছে। আওয়ামী লীগ কল্পিত মৌলবাদের দানব আবিস্কার করে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছে এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে।৪৯
৩৬. ৮ আগষ্ট ইসলাম বিদ্বেষী লেখিকা তাসলিমা নাসরিনকে বাংলাদেশে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়।৫০
৩৭. ২৮ জানুয়ারী ১৯৯৯ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর দিলীপ কুমার সিনহা এক অনুষ্ঠানে হিন্দুদের মত শেখ হাসিনাকে সিঁথিদে সিঁদুর পরিয়ে দেন। অনুষ্ঠানটির পাঠ শুরু হয় ‘ওঁম শান্তি ওঁম শান্তি’ উচ্চারণের মাধ্যমে।৫১
৩৮. পাঠ্য পুস্তক থেকে ইসলামী শব্দ যেমন আল্লাহ, রাসূল তুলে ফেলে। হযরত মুহাম্মদ সা. এর জীবনী যা অতীতে নবম ও দশম শ্রেণীর সিলেবাসে ছিলো তা বাদ দেয়। ইসলামীয়াতে ১০০ নাম্বারের পরিবর্তে ৫০ নাম্বারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে, পরে জনতার আন্দোলনে তা বাতিল করতে বাধ্য হয়।৫২
পার্বত্য শান্তিচুক্তি
শেখ হাসিনার শাসনামলের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে অন্যতম হলো পার্বত্য শান্তিচুক্তি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্ত লারমার মধ্যে চুক্তিটি সাক্ষরিত হয়। প্রধান বিরোধী দলসহ সব ইসলামী দল পার্বত্য চুক্তিকে কালোচুক্তি আখ্যায়িত করে তা বাতিলের জন্য দাবি জানাতে থাকে। চুক্তিটি পার্বত্য শান্তির জন্য করা হলেও দিনদিন এ অঞ্চলে বেড়েই চলচে অন্তর্ঘাতি কর্মকান্ড। দৈনিক ইনকিলাব ২ ডিসেম্বর ২০১৫ প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারী সূত্র মতে গত ১৮ বছরে পার্বত্য অঞ্চলে সংঘাতে নিহতের সংখ্যা ৮১৬। আহতের সংখ্যা ১০৪৬ জন। অপহরণ হয়েছে ১৬০৪ জন। বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। তবে পাহাড়ের সাধারণ মানুষের ধারণা মতে এ সব সংখ্যা আরো বেশী। সরকারী সূত্রানুযায়ী সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে গ্রেপ্তার হয়েছে প্রায় চার হাজারের মত। গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে ১২৫১টি। নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সন্ত্রাসীদের সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে ৬০টিরও বেশী।৫৩
চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন
আওয়ামী দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে, জয় লাভের আকাঙ্খা নিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০০১ সালের ১লা অক্টোবরের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট চার দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। চারদলীয় জোটে প্রথমে সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি শরিক ছিল। পরে এরশাদের নেতৃত্বের জাতীয় পার্টি চারদলীয় জোট ত্যাগ করলে দলের মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জুর এর নেতৃত্বে দলটির একটি অংশ চারদলীয় জোটে থেকে যায়। চারদলীয় জোট ২০০১ সালের ১লা অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনেও জোটগতভাবে অংশ নেয় এবং দুই-তৃতীয়াংশের বেশী আসনে জয় লাভ করে।
বিডিআর কর্তৃক ১৬ জন বি এস এফ হত্যা
শেখ হাসিনার শাসনামলের শেষ ভাগে এপ্রিল মাসে ভারতের সীমান্ত বাহিনী কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীর বড়াই বাড়ীর উপর হামলা করলে বিডিআর এর দেশপ্রেমিক বাহিনী আক্রমণকারীদের বীর বিক্রমে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং ভারত সীমান্ত বাহিনীর ১৬ জন বিডিআর এর আক্রমণে নিহত হয়। দেশের সর্বস্তরের জনগণ বিডিআর এর বীরত্বে গর্ববোধ করেছে আর শেখ হাসিনা তার বন্ধু দেশের কাছে অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে বাংলাদেশের কপালে কলঙ্ক লেপন করেছে এবং ক্ষমতা হারানোর শেষ পর্যায়ে এসে বিডিআর প্রধানকে রৌমারীর ‘ধৃষ্টতার’ শাস্তি স্বরূপ ঐ পদ থেকে অপসারণ করেছে।
বাঁধনের বস্ত্র হরণ
শেখ হাসিনার শাসনামলে ১৯৯৯ সালের থার্টিফাস নাইটে ঢাকার রাজপথে ‘বাঁধন’ নামে এক তরুণীর বস্ত্র হরণ করে মদ্যপ যুবকেরা। এ নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। ফেনীর জয়নাল হাজারী ‘বাঁধনের বিচার চাই’ নামক বই লিখে বাতাশে আগুণ ধরিয়ে দেয়। এ নিয়ে জাতীয় সংসদেও অনেক বাক-বিতন্ডা হয়।
পীর সাহেব চরমোনাই রহ. এর আওয়ামী বিরোধী আন্দোলন
পীর সাহেব চরমোনাই রহ. আওয়ামী লীগকে একটি কুফরী শক্তি আখ্যায়িত করে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন। তিনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনা যখন হজ্ব করতে যায় তখন তাকে মুসলমান মনে হলেও কিন্তু যখন কলিকাতায় গিয়ে সিঁদুর পরে তখন তাকে হিন্দু মনে হয়। পীর সাহেব আরো বলেন, বিএনপি ভারতের দালাল আর আওয়ামী লীগ সরাসরি ভারত। ফতোয়া বিরোধী রায়ের প্রতিবাদে যখন আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে, শায়খুল হাদীস সাহেব হুজুর এবং আমিনী সাহেব হুজুর গ্রেপ্তার হন তখন পীর সাহেব হুজুর ছিলেন শরিয়ত পুর। আন্দোলনের কয়েকজন নেতা পীর সাহেব হুজুরের নিকট গিয়ে ঢাকার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলে তিনি সফরসূচিকেন্দ্রিক মাহফিল পরিবর্তন করে ঢাকায় চলে আসলেন। রাজপথে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন। পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশে কাফনের কাপড় মাখায় নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার করলেন।
ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণ
‘ইসলামী ঐক্যজোট’ চারদলীয় জোটে যোগদান করলে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে যায়। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণ হলো এই,
১. আদর্শগত বিরোধ, ২. বসুন্ধরা ইসলামিক রিচার্স সেন্টারে আয়োজিত মুফতিদের সম্মেলন থেকে চারদলীয় জোটে যোগদানের বিষয়ে নাজায়েজ ফতোয়া দেয়ায়, ৩. বেগম জিয়া কর্তৃক ইসলামী দাবীকে উপেক্ষা করা, ৪. নারী নেতৃত্ব।
ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন
২০০১ এর ১লা অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করাীম পীর সাহেব চরমোনাই রহ. এর নেতৃত্বে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি মিলে ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়।
পীর সাহেব চরমোনাই কর্তৃক এরশাদের সাথে জোট করার কারণ
১. এরশাদ সাহেব পীর সাহেব চরমোনাই’র নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে, ২. এরশাদ সাহেব অতীতের ভুল স্বীকার করেছে, ৩. পীর সাহেব চরমোনাই ঘোষিত ৮ দফা দাবী মেনে নিয়েছে, ৪. ক্ষমতায় গেলে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছে, ৫. নারী নেতৃত্ব বর্জনের ওয়াদা দিয়েছে, ৬. রোশনা এরশাদসহ দলের নারীদেরকে বোরকা পরাতে সম্মত হয়েছে, ৭. ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতার রিমোর্ড হওয়ার প্রত্যাশা থাকার কারণে।
ইসলাম দেশ ও মানবতার ক্যাল্যাণে পীর সাহেব চরমোনাই ঘোষিত ৮ দফা দাবি

১. কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন পাশ না করা, এবং বিদ্যমান কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন পর্যাক্রমে সংশোধন করা, সেই সাথে সাংবিধানিকভাবে এর গ্যারান্টি ক্লোজ করা।
২. জাতীয় শরীয়া বোর্ড ও বিচার বিভাগে শরীয়া বেঞ্চ গঠন করা এবং আল্লাহ, রাসূল সা. এবং শরীয়াতের বিরুদ্ধে কটুক্তিকারীদের শাস্তির বিধান করা।
৩. আদর্শ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষার সর্বস্তরে প্রয়োজনীয় দীনি শিক্ষা বাধ্যতামুলক রাখা। নতুন প্রজন্মের নৈতিকতা রক্ষাকল্পে চরিত্র বিধ্বংসি অপসংস্কৃতি বন্ধ করা।
৪. ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করা। ভিক্ষুকদের সরকারীভাবে পুণর্বাসণের ব্যবস্থা করা এবং কর্মক্ষমভিক্ষুকদের কর্ম সংস্থান তৈরী করা।
৫. সন্ত্রাস, দুর্নীতি একটি জাতীয় গজব, এ গজব থেকে বাচার জন্য, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি মুক্ত দেশ গড়া। এ লক্ষ্যে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়-পশ্রয় না দিয়ে তাদের সংসোধনের ব্যবস্থা করা। সংসোধন না হলে তদাদের মূলোৎপাটন করা।
৬. বেকারত্ব একটি জাতীয় বোঝা, অনগ্রসরতার প্রতীক। এ বোঝা থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে ব্যাপক শিল্পায়ন ও শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি করে বেকারত্ব দূর করার কার্জকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সার, ঔষধ ও বীজের দাম কমানো এবং গরীব কৃষকদের মাঝে সহজশর্তে ঋণ প্রদান করা।
৭. নারী সমাজের যথাযথ সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, সংখ্যালঘুদের সকল ধর্মীয় নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী ও অধিকারের নিশ্চয়তা, সকল পর্যায়ে সরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সততা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সম্মানজনক বেতন-ভাতা, আনুসাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও প্রদোন্নতির ব্যবস্থ করা।
৮. দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ত রক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা বিধানকল্পে স্বসস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করা।
ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এর প্রত্যাশা পুরণ না হওয়ার কারণ
১. পীর সাহেব চরমোনাই এবং ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের পক্ষে উলামায়ে কেরাম, ইসলামী জনতা, মুসল্লি-মুবাল্লেগ, ইমাম-খতীব, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রকৃত লক্ষ্য বুঝাতে সক্ষম না হওয়া।
২. জমায়াতের অপপ্রচার, ৩. জমায়াতী চক্রান্তের শিকার হয়ে হক্কানী উলামায়ে কেরাম কর্তৃক বিরোধীতা। ৪. আওয়ামী দালালীর অপবাদ, ৫. আওয়ামী দুঃশাসন ও ধর্মবিদ্বেষের মুকাবালায় একবাক্সের প্রয়োজনীয়তা অনুভব।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ
২০০১ এর নির্বাচনে চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী আসন লাভ করার পর এরশাদ সাহেব গ্রেপ্তার এড়াতে বিদেশে চলে যাওয়ার কারণে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব রোশনা এরশাদের হাতে চলে আসায় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ঐক্যফ্রন্ট থেকে সরে যায়।
ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি গঠন
আওয়ামী সরকারের ধর্ম বিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ এবং ফতোয়া বিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার লক্ষ্যে জমায়াত ব্যতীত সব ইসলামী দলের সমন্বয়ে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়। উল্লেখ্য, আদর্শগত কারণে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে গেলে ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে আওয়ামী সরকারের ধর্মবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। অপর দিকে বিএনপি, জমায়াত ধর্মীয় ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলন থেকে বিরত থাকে। তখন আন্দোলনকে গতিশীল করার জন্য ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনকে নিয়ে রাজনৈতিক জোটের বাহিরে জোট গঠনের প্রয়োজন পড়ে। কার্যত ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনই ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ভেতর নিয়ামকের ভুমিকা পালন করে।
ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি স্থীমিত হয়ে যাওয়ার কারণ
ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি অরাজনৈতিক সংগঠন। ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি গঠনের সময় এই শর্ত উল্লেখ ছিলো যে, এর ব্যানারে রাজনৈতিক তথা চারদলীয় ঐক্যজোটের পক্ষে কোন বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া যাবে না। কিন্তু ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি সর্বস্তরের আলেম সমাজ এবং ধর্মপ্রাণ মুুসলানের মধ্যে একটি অবস্থান তৈরীতে সক্ষম হলে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতৃবৃন্দ শর্ত লঙ্গন করে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে চারদলীয় ঐক্য জোটের পক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি দিতে শুরু করেন। এমনকি আমিনী সাহেবদের মুক্তির পর ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউটে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির এক সম্মেলনে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ঢুকতে দেয়নি। সেখান থেকে ফিরে এসে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দীনকে আহ্বায়ক করে নতুনভাবে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ঘোষণা দেয়। এভাবে ইসলমী আইন বাস্তবায়ন কমিটি স্থীমিত হয়ে যায়।
২০০১ এর নির্বাচনে চারদলীয় জোটের বিজয়ের কারণ
২০০১ এর নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩ টি আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার কারণ-
১. আপোষহীন সংগ্রাম : চারদলীয় জোট নানা ইস্যুতে সংগ্রাম পরিচালনা করে জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়। ২. ঐক্যজোট গঠন, ৩. সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনের প্রতিশ্রুতি, ৪. অতীত গৌরব, ৫. চমৎকার পূর্ব অবিজ্ঞতা, ৬. সুন্দর নির্বাচনী পরিবেশ, ৭. আওয়ামী লীগের গড়পাদার ভীতি, ৮. নারী সংগঠন ও এনজিওদের ইতিবাচক ভূমিকা, ৯. গণজোয়ার, ১০. আওয়ামী সরকার কর্তৃক আলেম-উলামার উপর নির্যাতন, ১১. আওয়ামী সরকারের আমলে ফতোয়া বিরোধী রায়, ১২. বি-বাড়িয়া ট্রাজেডি, ১৩. ইসলামী মূল্যবোধের দোহায়।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত চারদলীয় ঐক্যজোট সরকারের সফলতা
১. জাতীয় বেতন স্কেল প্রদান, ২. ভেজাল বিরোধী অভিযান, ৩. মিডিয়ার প্রসার, ৪. পরিবেশ উন্নয়ন, ৫. যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন, ৬. তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, ৭. আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন, ৮. সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রন করার জন্য ২০০৩ সালে র‌্যাব গঠন, ৯. ২০০৫ সালের ১২-১৩ নভেম্বর সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠান, ১০. প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে ২ জানুয়ারী ২০০৩ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক আলাদা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, ১১. কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা, ১২. স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন, ১৩. নারী উন্নয়ন, ১৪. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়ন।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত চারদলীয় ঐক্যজোট সরকারের ব্যর্থতা
১. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ২. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ৩. দারিদ্র বিমোচনে ব্যর্থতা, ৪. প্রায় আড়াই কোটি লোকের বেকারত্বের বোঝা বহণ, ৫. চরম পন্থীদের দমনে ব্যর্থতা : দেশে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা জনযুদ্ধসহ বিভিন্ন চরমপন্থী ও সশস্ত্র গ্রুপ বিদ্যমান রয়েছে। যারা দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। ৬. প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা, ৭. বিচার বিভাগ পৃথকীকরণে ব্যর্থতা, ৮. মানব উন্নয়ন সূচকে পিছিয়ে পড়া, ৯. মূল্যস্ফীতি, ১০. জঙ্গিবাদের উত্থান ও বোমা সন্ত্রাস, ১১. রাজনৈতিক হত্যাকান্ড : পল্টন ময়দানে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ. এস. এম. কিবরিয়া হত্যাকান্ড, গাজিপুরে আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকান্ডসহ অনেক রাজনৈতিক হত্যাকান্ড দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে, ১২. নিষ্প্রাণ সংসদীয় রাজনীতি, ১৩. সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ, ১৪. জনশক্তি রপ্তানী হ্রাস : বিদেশে চাকরী প্রাপ্তির সংখ্যা ৬.৭% কমে যায়, ১৫. বিদ্যুৎ ও সার সংকট : বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে শিল্প কারখানার উৎপাদন, সেচযন্ত্রের ব্যবহার, ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা-পড়া, হাসপাতাল, অফিস-আদালতে কাজকর্মসহ জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কৃষকের কৃষির প্রয়োজনীয় সার উৎপাদন ও সর্বরাহের সমস্যা ছিলো; এমনকি সারের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের নিবৃত্ত করার জন্য গুলিবর্ষণ পর্যন্ত করা হয়। ১৬. নাগরিক সুবিধা প্রদানে ব্যর্থ, ১৭. বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁশ, ১৮. পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যর্থতা, ১৯. যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যর্থতা, ২০. কৃষিখাতে অব্যবস্থাপনা।
চারদলীয় জোট সরকারের ধর্মীয় কাজের ব্যর্থতা
চারদলীয় জোট সরকার ইসলামী মূল্যবোধের নামে ক্ষমতায় এসে অনেক বিধর্মী কাজ করেছে। ইসলামী মূল্যবোধের উপর কুঠারাঘাত করেছে। ইসলামী জোটে সম্পৃক্ত থাকা ইসলামী দলগুলো এর কোন প্রতিবাদ করেনি; বরং ক্ষমতার স্বার্থে তারাও সেগুলোকে সমর্থন দিয়েছেন বাধ্য হয়ে।
১. ফতোয়া বিরোধী রায় বাতিল করেনি, ২. ফতোয়া বিরোধী রায় দানকারী দুই বিচারপতি গোলম রব্বানী ও নাজমুল আরা সোলতানার বিচার করেনি, ৩. ফতোয়া বিরোধী রায় দানকারী দুই বিচারপতি গোলম রব্বানী ও নাজমুল আরা সোলতানার পদোন্নতি করেছে, ৪. মদের দাম কমিয়েছে, ৫. কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করেনি, ৬. বি-বাড়িয়া ট্রাজেডিতে শাহাদাত বরণকারী শহীদদের রক্তের উপর পা দিয়ে ক্ষমতায় এসে হত্যাকারীদের বিচার করেনি, ৭. মালিবাগ বাইতুল আজীম জামে মসজিদের জায়গা দখলকারী বিএনপি খুনি তৌফিকের বিচার করেনি, ৮. মালিবাগ জামে মসজিদ রক্ষার মিছিলে গুলি করে তিনজন হাফেজে কুরআন ও একজন মুসল্লিসহ চারজনকে শহীদ করেছে, ৯. শহীদদের লাশ নিয়ে টালবাহানা করেছে এমনকি এর প্রতিবাদ করারও সুযোগ দেয়নি, ১০. হাফেজে কুরআনদের হত্যাকারীদের কোন বিচার করেনি। ১১. নিজামীর ইসলাম বিরোধী ফতোয়া : ২০০১ সালের ২৬ অক্টোবর টঙ্গিতে এক কর্মী সম্মেলনে মাওলানা নিজামী ফতোয়া জারি করেন, “জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক হারাম নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা মোবাহ বৈধ। তিনি আরো বলেন, ইসলামের দৃষ্টিতে নারী নেতৃত্ব হারাম নয় বরং এরশাদের মত পুরুষ নেতৃত্বের থেকে উত্তম। ১২. মুজাহিদের পূজায় গমন : হিন্দুদের বড় পূজার একটি উৎসবে জমায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল, সরকারের সমাজ কল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন জমায়াতের এই শীর্ষনেতাকে পূজা মন্ডপে হিন্দু রমনী এবং যুবতীরা ফুলের মালা ও পাপড়ি দিয়ে বরণ করেছে। ১৩. ইমাম সম্মেলনে ম্যারির বয়ান : বিশ্ব মুসলিমের এক নাম্বার দুশমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ মহিলা রাষ্ট্রদূত ম্যারি এ্যান পিটার্স অর্ধ উলঙ্গ খ্রিস্টান নারী হাজীক্যাম্পে মুখোমুখি উপস্থিত হয়ে ধর্মগুরু শ্রদ্ধাভাজন ইমাম সাহেবদেরকে নসীহত করলো ইসলামী মূল্যবোধের ঝান্ডাবাহী সরকারের আয়োজনে।
১৪. চারদলীয় ঐক্যজোটের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় ঢাকার একটি কওমী মাদরাসার স্মারকের প্রচ্ছদে বেগম জিয়ার রঙিন ছবি শোভা পেয়েছে। ১৫. ২০০৪ সালের ১৭ জানুয়ারী বরিশালের ম্যাজিস্টেট কোর্ট চরমমোনাই’র হযরত পীর সাহেবের চার ছেলেসহ একটি সাজানো মামলার রায়ে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের ২১ জন নেতা-কর্মীকে পাঁচ বছরের দন্ডাদেশ দিয়েছে। মামলার বাদি চরমোনাই ইউনিয়নের পরাজিত চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা আবদুস সালাম রাঢ়ী।
২০০২ সালের ডিসেম্বর উল্লেখযোগ্য ঘটনা
১. ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে আবদুস সামাদ আজাদের বাসায় রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর গমন। ২. জাপা নেতা কাজী জাফরের ঐক্যফর্মুলার ইফতার পাটি। ৩. শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ১২টি দুর্নীতি মামলা দায়ের। ৪. শেখ মুজিবের জন্ম ও মৃত্যু দিবসে সরকারী ছুটি বাতিল। ৫. মুজিব পরিবারের হেফাজতের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা আইন বাতিল, ৬. উপ-নির্বাচনে নড়াইলে দুই আসনে মুফতি শহীদুল ইসলামের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে শায়খুল হাদীস সাহেব হুজুর ও আমিনী সাহেবের মধ্যে বিতর্ক। ৭. গ্যাস রপ্তানীতে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা। ৮. ঘাদানিক নেতা শাহরিয়ার কবিরের জামিন না মঞ্জুর। ৯. খতীব উবায়দুল হক সাহেবের ব্যাপারে মার্কিন দুতাবাসের অশোভন উক্তি।
১০. দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনীতে মারার হিড়িক। ১১. সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির দায়ে বিলুপ্ত ঘোষিত ছাত্রদল সভাপতি নাসির উদ্দিন পেন্টু এমপি গ্রেপ্তার।
২০০২ সালের ২৯ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে ‘নৈতিক অবক্ষয় রোধ ও জাতীয় উন্নয়নে সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প নেই’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র আন্দোলনের সেমিনারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর এ. কে. এম. মহিউদ্দীন বলেন, “পশ্চিমারা পূর্ব পাকিস্তানকে যে শোষণ করেছে, ঢাকা এর চেয়ে বেশী শোষণ করেছে গোটা দেশকে।”
২০০৩ এর ২২ মে মন্ত্রীসভার ৬০ সদস্যের বিশাল বহর থেকে ৭ জনকে বাদ দেয়া হয়। ১১ জনের দপ্তর পরিবর্তন কারে পুনঃবন্টন করা হয়। এবারও ইসলামী ঐক্যজোট আর বেজিপি ওয়েটিং লিস্টেই থেকে গেল। জমায়াতের আমীর নিজামী সাহেবকে বেগম জিয়া নিজের খেয়াল-খুশি মত কৃষিমন্ত্রী থেকে শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব দিলেন।
২০০৩ এর জুনে জাতীয় বাজেটের সবচেয়ে বড় চমক ছিলো মদের দাম কমানোর প্রস্তাব এবং মন্ত্রী-এমপিদের বেতন বাড়িয়ে ইজ্জত বৃদ্ধি। বিদেশীদের কাছে মন্ত্রী-এমপিদের এত কম বেতন-ভাতার কথা বলতে নাকি লজ্জাবোধ হয়। এজন্য উক্ত বাজেটে মন্ত্রী-এমপিদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়। তখন কেহ কেহ বলেছিল, মন্ত্রীদের চুরি বাটপারীর কথাও তো বিদেশীরা শুনে এবং জানে, এতে আপনাদের শরম লাগে না?
২০০৩ এর জুনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েলের বাংলাদেশ সফর। উল্লেখ্য, তার সফরে বাংলাদেশের মুসলমানরা ক্ষোভে-দুঃখে পেটে পড়ে। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং একটি বাম ঘরানার দল বিক্ষোভ মিছিল করলেও ক্ষমতার শরিক ইসলামী দলগুলো ছিলো নিরব।
২০০৩ এর আগষ্ট মাসে চারদলীয় জোট থেকে মুফতি আমিনী সাহেব হুজুর পদত্যাগ করার হুমকি দেন। অবশ্যই পরে বিষয়টি দফারফা হয়েছে।
২০০৩ এর ডিসেম্বরে সাবেক প্রেসিডেন্ট জনগণের সেন্টিমেন্টকে উপলব্ধি করে দুই শক্তির বাহিরে বিকল্প ধারার ডাক দেন এবং সুশীল সমাজের কান্ডারী সেজে ড. কামাল হোসেন তৃতীয় শক্তির উত্থানের কলকাঠি নাড়েন।
২০০৪ এর ১লা এপ্রিল চট্টগ্রামের সি. ইউ. এস. এল. জেটি ঘাটে ১০ টাক অস্ত্র উদ্ধার হয়। ৩ এপ্রিল এ ঘটনায় মামলা করেন কর্ণফুলী থানার ওসি আহাদুর রহমান। তবে মামলায় কোন বিবাদির নাম উল্লেখ করা হয়নি। ১৩ দফা তদন্তের সময় বাড়ানোর পর ২০১১ এর ২৬ জুন তদন্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান অভিযুক্ত করেন নিজামী, বাবরসহ ১১ জনকে।
২০০৪ এর ২ এপ্রিল ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মহাসমাবেশে দলের আমীর আমীরুল মুজাহিদীন সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন এবং সমাবেশ থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবে মুক্তমঞ্চসহ ৬ বিভাগের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
২০০৪ এর ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। উক্ত গ্রেনেড হামলায় ১৯ তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আয়েশা বেগম রহমানসহ ২৪জন নিহত এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩০০জন আহত হয়। নিহতদের ১২জন ঘটনাস্থলে এবং বাকি ১২জন হাসফাতালে মারা যায়। উক্ত গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন উপ-মন্ত্রী আবদুস সালাম পেন্টু, লুৎফুর রহমান বাবর, হুজিনেতা মুফতি হান্নানকে অভিযুক্ত করে মামলা করা হয়।
২০০৪ সালের ১৮,১৯,২০ মে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও কায়েমী স্বার্থবাদবিরোধী মুক্তমঞ্চ :
দেশ যখন দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের খেতাব অর্জন করে, দেশের রাজত্ব যখন সন্ত্রাসীদের কবলে নিপতিত হয় এবং দু’টি কায়েমী স্বার্থবাদিদের কাছে যখন দেশের মানুষ যিম্মি হয়ে যায় তখন তিনটি জাতীয় সমস্যার বিরুদ্ধে দল, মত ও ধর্ম নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৮, ১৯, ২০ মে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আমীর হযরত পীর সাহেব চরমোনাই’র আহ্বানে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, শ্রমজীবী ও পেশাজীবীদেরকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যমঞ্চের ডাক দেন। পীর সাহেব চরমোনাই’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ৩ দিনের মুক্তমঞ্চে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, শ্রমজীবী ও পেশাজীবীরা বিপুলভাবে সাড়া দেয়।
দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান : বেগম খালাদা জিয়ার আমলে ২০০১-২০০৫ পর্যন্ত ‘ট্রান্সপান্সি ইন্টারন্যাশনাল’ এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের খেতাব লাভ করে।
২০০৫ সালের ২৯ মে বাংলাদেশ দুর্নীতি কমন কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘দুর্নীতির ধরণ ও প্রতিকার শীর্ষক সেমিনারে’ প্রকাশ করা হয়, ২০০৪ সালে বাংলাদেশের ১১ টি প্রশাসনিক বিভাগে ১৫ হাজার ৭’শ ৮২ কোটি টাকা ঘুশ লেনদেন হয়।
২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় জে এমবি কর্তৃক সিরিজ বোমার হামলা হয়।
২০০৬ ড. ইয়াজ উদ্দীন আহমেদ, ২০০৭-৮ ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
বাংলাদেশের সংবিধানানুযায়ী একটি সরকারের কার্যকালের মেয়াদ শেস হওয়ার সময় থেকে একটি নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনায় নিয়োজিত থাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ সল্পস্থায়ী সরকার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে এবং নীতি নির্ধারনী কার্যকাল থেকে বিরত থাকে। যাতে এ সরকারের কার্যাবলী নির্বাচনের ফলাফলে কোন প্রভাব সৃষ্টি না করে। অন্তর্বর্তীকালীন তত্বাবধায়ক সরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করার জন্য নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে।৫৪
২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার
২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং এর বিলুপ্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নিম্নে এ সরকারের বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হলোÑ
১. তত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও উপদেষ্টা নিয়োগ : ২৯ অক্টোবর ২০০৬ সংবিধানের ৫৮ (গ) অনুচ্ছেদের ৬ দফা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজ উদ্দীন আহমদ স্বীয় দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি ও তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজ উদ্দীন আহমেদ তত্বাবধায়ক সরকারের ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ করেন।
২. নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গৃহীত প্রদক্ষেপ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিরোধী দলের দাবী অনুযায়ী ভোটার তালিকা হালনাগাত করে। ২২ জানুয়ারী ২০০৭ তাফসীল ঘোষণা করলে বিরোধী দলীয় মহাজোট তা প্রত্যাহার করে।
৩. নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার বদ্ধপরিকর : উদ্ভুত রাজনৈতিক পরিস্থিতি মুকাবালায় সরকার বিরোধী দলীয় মহাজোটের সাথে আলোচনায় বসে। আলোচনায় ব্যর্থ হলেও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজ উদ্দীন আহমদ যথা সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর থাকেন। এ জন্য তিনি নির্বাচন কমিশনসহ উপদেষ্টাবৃন্দকেও চাপ প্রয়োগ করেন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য।
৪. চার উপদেষ্টার পদত্যাগ ও নতুন চার উপদেষ্টা নিয়োগ : প্রধান উপদেষ্টা তথা ড. ইয়াজ উদ্দীন আহমেদের পক্ষপাত মুলক আচরণ, এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাজনৈতিক সংকট নিরসনে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থতা, রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ড. আনোয়ারা বেগমের অফিসিয়াল তদারকি, তথ্যসচিবের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থিত থাকা, পরবর্তীতে তাকে তথ্যোপদেষ্টা বানানো প্রভৃতি কারণে উপদেষ্টারা দায়িত্ব পালনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন না। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালের ১১ ডিসেম্বর চার উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান, হাসান মাশহুদ চৌধুরী, সি এম শফি সামি ও সুলতানা কামাল পদত্যাগ করেন এবং তাদের শূণ্যপদে নতুন উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন ড. শোয়েব আহমেদ, সফিকুল হক চৌধুরী, প্রফেসর মুহাম্মদ মুঈনুদ্দীন খান এবং মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী।
৫. প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ : মহাজোটের নির্বাচনে বয়কট, লাগাতার আন্দোলন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, সরকারের প্রতি জাতিসংঘের সমর্থন প্রত্যাহার এবং জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তি বন্ধের হুমকির পরিস্থিতিতে তিন বাহিনীর প্রধানগণ রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেন এবং জাতীয় স্বার্থে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করেন। রাষ্ট্রপতি তাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ঐ দিন অর্থাৎ ১১ জানুয়ারী সন্ধায় পদত্যাগ করেন। তিনি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং গভীর রাতে জাতির উদ্দেশ্যে তার ব্যর্থতার দায়ভার স্বীকার করে ভাষন দেন।
২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ড. ইয়াজুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙ্গে যাওয়ার পর ২০০৭ সালে পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। নিম্নে এ সরকারের উল্লেখযোগ্য দিক সমূহ তুলে ধরা হলোÑ
১. তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও উপদেষ্টা নিয়োগ : ১২ জানুয়ারী ২০০৭ নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শফথ গ্রহণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ। নব গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শফথ নেন বেরিষ্টার মুঈনুল হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) এম. এ. মতিন, তপন চৌধুরী, গিতিয়ারা শাফিয়া চৌধুরী, আনোয়ারুল ইকবাল, ড. সি এস করীম, ড. এ. বি. মির্জা আজীজুল ইসলাম, ড. ইফতিখার আহমেদ চৌধুরী, আইয়ুব কাদেরী ও মেজর জেনারেল (অব.) ডা. এ এস মতিউর রহমান।
২. জরুরি অবস্থাকালীন গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার : ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের সরকার জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে গঠিত হয়। এটিই প্রথম বারের মত বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। উল্লেখ্য, বিরোধী দলের আন্দোলনে দেশে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিলো তা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দীন আহমেদ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং ১২ জানুয়ারী ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের সরকার গঠিত হয়।
৩. বিশেষ ধরণের তত্ত্বাবধায়ক সরকার : সংবিধানে উল্লিখিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচিত সরকারের নিকট থেকে ক্ষমতা গ্রহণ এবং নির্বাচিত সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে। কিন্তু ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের সরকার এ থেকে ব্যতিক্রম। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যর্থ হওয়ার পর এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। তাছাড়া সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য ধারাক্রম অনুযায়ী যে সব শর্ত রয়েছে এ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। এ জন্য এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিশেষ ধরণের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা হয়।
৪. দীর্ঘ মেয়াদী তত্ত্বাবধায়ক সরকার : ১৯৯৬ সালের পর থেকে যে সব তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিলো সেগুলো মোটামোটি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের রায় দান করেন এবং নির্বাচিত সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে। কিন্তু ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্যান্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তুলনায় অনেক বেশী দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় রয়েছে।
৫. প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী নিয়োগ : প্রশাসনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় উপদেষ্টা নিয়োগ না করে পতিমন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টা তার বিশেষ সহকারী হিসেবে পাঁচজনকে নিয়োগ দেন। এরা হলেনÑ অধ্যাপক এম তামিম, চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম এ মালেক, মানিক লাল সমাদ্দার ও মাহবুব জামিল।
বাংলাদেশ ২০০৭-’০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সফলতা
১. নির্বাচন কমিশন সংস্কার : নির্বাচন কমিশন দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমের উপর একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নির্ভর করে। জোট সরকার নির্বাচন কমিশনকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলো। যার কারণে বিরোধী দলগুলো বারবার নির্বাচন কমিশন সংস্কারের দাবি জানায়। কিন্তু জোট সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। এমনকি ড. ইয়াজ উদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও নির্বাচন কমিশনকে পুরোপুরি সংস্কার করেনি। কিন্তু ২০০৭-’০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পরই ২২ জানুয়ারী ২০০৭ বিতর্কিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজীজ এবং ২৯ জানুয়ারী সকল নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৫ ফেব্রুয়ারী ২০০৭ নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ আরো দুইজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়। ২০০৭-’০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ ও একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
২. স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা : দুর্নীতি বাংলাদেশে একটি অন্যতম জাতীয় সমস্যা। দুর্নীতি প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। বিগত সরকার স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করলেও দলীয় প্রভাবের কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। কিন্তু ২০০৭-’০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর জোট সরকারের আমলে নিয়োগকৃত চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ পদত্যাগ করেন এবং সরকার সাবেক সেনা প্রধান ও পদত্যাগী উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) হাসান মাশহুদ চৌধুরীকে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন। তার নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন কমিশন নিরল সভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে এবং অনেক দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী ও আমলার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদেরকে জেল-হাজতে পাঠিয়েছে।
৩. বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ কার্যক্রম : বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সুশাসনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। জনগণের কাছে বরাবর প্রতিশ্রুতি দিলেও কোন সরকারই বিচার বিভাগকে পৃথক করতে পারেনি। কিন্তু ২০০৭-’০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়। এতে জনগণের দীর্ঘ দিনের আশা-আকাঙ্খার বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।
৪. পাবলিক সার্ভিস কমিশন সংস্কার : পাবলিক সার্বিস কমিশন (পিএসসি) সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। কারণ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সরকারী প্রতিষ্ঠানে লোক নিয়োগ করা হয়। কিন্তু জোট সরকার এ প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিলো। ২০০৭-’০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর সংস্কার সাধন করে।
৫. সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ : ২০০৭-’০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তার সকল ভাষণে সুশাসন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। সেই সাথেই প্রশাসনে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, অংশ গ্রহণ, দায়িত্বশীলতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারী প্রতিষ্ঠানে সিটিজেন চার্টার প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। সুশাসন গণতন্ত্রের সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সরকারের একটি বড় সফলতা।
৬. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সংস্কার : বিশ্ব্যবিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন দেশের বিশ্ব্যবিদ্যালয়গুলোকে পরিচালনা করে। কিন্তু জোট সরকার এ প্রতিষ্ঠানে দলীয় লোক নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলো। ২০০৭-’০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে সংস্কার করে এবং নতুনভাবে কমিশনকে ঢেলে সাজায়।
৭. দলীয় ভিসিদের পরিবর্তন : দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিগণ ছিলো দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত। তাছাড়া তাদের দুর্নীতি ছিলো পাহাড় পরিমাণ যা পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের মাধ্যমে জানা যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজ ভিসিদের সরিয়ে নতুন ভিসি নিয়োগ করেছে। তাছাড়া ভিসি নিয়োগের জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধিনে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়।
৮. বিতর্কিত নিয়োগের সংস্কার : জোট সরকারের আমলে নিয়োগ ক্ষেত্রে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ ও নিয়োগ বাণিজ্য ঘটেছে। ২৭তম ভিসিএস তার অন্যতম উদাহরণ ২০০৭-’০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে ২৭তম ভিসিএস চুড়ান্ত নিয়োগ বাতিল করে এবং পুনরায় মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করে। তাছাড়া নির্বাচন কমিশনে যেসব দলীয় প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো তা বাতিল করে এবং তাদের পুনরায় পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করে। পুলিশের এসআই পদেও এ সরকার নিয়োগে সংস্কার করে।
৯. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে : ২০০৭-’০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টা সার্ক সম্মেলনে যোগদান করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। তাছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেন এবং ওআইসি সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা যোগদান করেন। এভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছে।
১০. জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকা প্রণয়ন : সঠিক ভোটার তালিকা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। জোট সরকারের শাসনামলে ভোটার তালিকা নিয়ে একটি বিতর্ক সবসময় লেগেই ছিলো। যার কারণে ২০০৭-’০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকা প্রণয়ণের কর্মসূচি শুরু করে যা বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
১১. দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ : ২০০৭-’০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৪ ফেব্রুয়ারী ২০০৭ থেকে শুরু হয় দুর্নীতি বিরোধী অভিযান। সরকার বড় বড় দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের অনেককে শাস্তি প্রদান করেছে। অর্থাৎ যারা নিজেদেরকে আইনের উর্ধ্বে মনে করতো তারা এখন দুর্নীতির দায়ে কারাগারে বন্দি রয়েছে। বিশেষ করে বিগত দুই শাসনামলের সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীসহ প্রায় দুই’শ এর বেশী প্রভাবশালী নেতা দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে। তাছাড়া ব্যবসায়ী, আমলা, চাকরিজীবীসহ সকল ধরণের দুর্নীতিবাজদেরকে সরকার গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
১২. দুর্যোগ মুকাবালায় সাফল্য : ২০০৭ সালে দেশে দুই দফা বন্যা হয়। এতে দেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল প্লাবিত হয়। ১৫ নভেম্বর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে ঘুর্ণিঝড় সিডর। উপর্যুপরি বন্যা ও ঘুর্ণিঝড়ে ফসল ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সিডরে প্রায় ৪ হাজার লোক নিহত হয়। তাছাড়া চট্টগ্রামে পাহাড় ধ্বসে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। দুই দফা বন্যা ও সিডর পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে সরকারের সাফল্য প্রশংসার দাবিদার।
২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যর্থতা
১. দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি : ২০০১-০৬ সালের জোট সরকারের শাসনামলেই দেশে দ্রব্যমুল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি হয়েছিলো। ২০০৭-০৮ সালের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এমনকি সরকার বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রেও সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি।
২. রাজনৈতিক সংস্কারে বর্থতা : এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের পরামর্শ দিতে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো বেশ কয়েকবার সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও তা ব্যর্থ হয়। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক দলগুলোতে সংস্কারের ক্ষেত্রেও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
৩. নির্বাচনকে বিলম্বিত করা : বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানকে বিলম্বিত করেছে। আর নির্বাচন বিলম্বিত হওয়া দেশের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ।
৪. রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের ঘরোয়া রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিছু দিন পর শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দিলেও পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার করে। তাই রাজনীতিতে নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপও বন্ধ হয়। যা গণতন্ত্র চর্চার প্রতিবন্ধক।
৫. গণতান্ত্রি প্রতিষ্ঠান সচল রাখতে ব্যর্থতা : গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যেমনÑ সংসদ, নির্বাচন, রাজনৈতিক দল ইত্যাদিকে সচল রাখতে হবে। দীর্ঘ দিন এগুলোকে অচল রেখে যথার্থ গণতন্ত্রায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
৬. দুই মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাণ্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকার দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে দুই মাসেরও বেশী সময় বন্ধ রাখেন যা কারোরই কাম্য ছিলো না।
৭. খাদ্য সংকট মুকাবালায় ব্যর্থতা : দু’ই দফা বন্যা ও উপকূলীয় এলাকায় ঘুর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে খাদ্য শস্য উৎপাদনে দারুণ ব্যাঘাত ঘটে। এমতাবস্থায় খাদ্যদ্রব্য বিশেষ করে চালের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। কিন্তু সংকট মুকাবালায় ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
৮. সার সংকট : সরকার সার সংকট মুকাবালার জন্য সার আমদানী এবং বন্টনে কঠোরতা অবলম্বন করে। তারপরও সরকার সার সংকট পুরোপুরি দুর করতে পারেনি এবং দেশে পর্যাপ্ত সার উৎপাদনেও সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
৯. বিদ্যুৎ সংকট : ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশে ভয়াবহ বিদ্যুৎু সংকট দেখা দেয়। সরকার চাহিদাু অনুসারে দেশে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ব্যর্থহয়।
১০. নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখা : বাংলাদেশে এমনিতেই দিন দিন বেকার সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তেমন কোন নিয়োগ কার্যক্রম গ্রহণ করেনি।
১১. বিনিয়োগ হ্রাস : সরকারের দুর্নীতি দমন অভিযানের ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় বিনিয়োগ খাতে। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অস্বাভাবিক হারে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ হ্রাস পায়। বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়া সামগ্রিক অর্থনীতিতে মন্দাভাব দেখা যায়।
১২. পুরাকীর্তি কেলেঙ্কারি : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিতর্ক সত্বেও প্যারিসের ঘিমে জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য বাংলাদেশের দুর্লব পুরাকীর্তি প্রেরণ করে। দ্বিতীয় চালান পুরাকীর্তি পাঠানোর সময় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে দুটি মূল্যবান বিষ্ণুমূর্তি চুরি হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালানোর পরে সরকার এগুলোকে ভাঙ্গা অবস্থায় উদ্ধার করে। জনমত উপেক্ষা করে পুরাকীর্তি বিদেশ পাঠানো ও পুরাকীর্তি চুরি হওয়ার ঘটনা সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
১৩. বেকারত্ব বৃদ্ধি : ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের ভয়ে দেশের অনেক কল-কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এছাড়া নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া না হওয়া, হকার উচ্ছেদ প্রভৃতির ফলে এ সরকারের সময়ে দেশে বেকারত্বের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পায়।
২০০৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত শেখ হসিনার শাসনামল
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারী যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো মহা জোট কর্তৃক বর্জনের ঘোষণা দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এবং দু’টি জোটের অনঢ় অবস্থানের কারণে ওয়ান এলিভেনের সূত্রপাত হয়। তারই প্রেক্ষিতে ড. ফখরুদ্দীনরা দুই বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। অতপর ২০০৮ এর ২৯ ডিসেম্বর এক নাটকীয় নির্বাচনের মাধ্যমে মহাজোট দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী আসন অধিকার করে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। দুই জোটের বাহিরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রথম একক নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন এবং ১৬৫ আসনে প্রার্থী দিয়ে প্রায় ৮ লক্ষ ভোট পান। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। সন্ত্রাস, দুর্নীতিতে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। দেশে এক নায়কতন্ত্র কায়েম করে জনগণের বাক স্বাধীনতা হরণ করে। মহাজোটের এ শাসনামলে একের পর এক বহু লৌমহর্ষক ঘটনা ঘটতে থাকে। জোটের শরিক বামদলগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সরকার ইসলাম বিরোধী অনেক কর্মকান্ড চালিয়ে যায়। সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দেয়। বিতর্কিত নারীনীতি, সেক্যুলার শিক্ষানীতি প্রণয়ন, রেলমন্ত্রীর অবৈধ চাকুরি বাণিজ্য, পদ্মাসেতুর দুর্নীতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ৫ মে শাপলা চত্বরে সরকারের পেটোয়া বাহিনীর তান্ডব যা দেখে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো দিবসের কথা মনে পড়ে। ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারী পৃথিবীর ইতিহাসে যার কোন নজির নেই এমন এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন, যা গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাতের শামিল। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই’র ভাষায় “৫ জানুয়ারীর নির্বাচন দ্বারা প্রমাণিত হলো জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস নয়।”
২৫-২৬ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ রক্তাক্ত পিলখানা
পিলখানায় ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ সংঘঠিত সমসাময়িক ইতিহাসের নজিরবিহীন ভয়াবহতম হত্যাকান্ড। অস্তিস্ত বিরোধী শক্তিই ঘটিয়েছে, যা বাংলাদেশের ভিত্তিমূলে চরম ঝাকুনি দিয়ে এর সীমান্ত পাহারা এবং পতিরক্ষা ব্যবস্থাপনাকে নড়বড়ে করে ছিলো। এর উদ্দেশ্য ছিলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অকেজো করা।
২০০৯ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তুলনামূলক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় ২০০৯ সালে গুম ২টি, কারাগারে মৃত্যু ৫০, সাংবাদিক নির্যাতন ১৪৫, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ১৫৪, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ৮৯, বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা ৯৮, রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ২৫১, এসিড সন্ত্রাস ১০১, যৌতুকের দায়ে নির্যাতন ৩১৯, ধর্ষণ ৪৫৬, গণপিটুনিতে নিহত ১২৭, পোষাক-শ্রমিক নিহত ১০৭।৫৫
২০১০ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি
২০১০ সালে গুম ১৮টি, কারাগারে মৃত্যু ৬০, সাংবাদিক নির্যাতন ১৭৮, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ১২৭, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর হেফাজতে নির্যাতন ৬৭, বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা ৭৪, রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ২২০, এসিড সন্ত্রাস ১৩৭, যৌতুকের দায়ে নির্যাতন ৩৭৮, ধর্ষণ ৫৫৯, গণপিটুনিতে নিহত ১৭৪, পোষাক-শ্রমিক নিহত ৭।৫৬
২০১১ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি
২০১১ সালে গুম ৩০টি, কারাগারে মৃত্যু ১০৫, সাংবাদিক নির্যাতন ২০৬, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ৮৪, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর হেফাজতে নির্যাতন ৪৬, বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা ৩১, রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ১৩৫, এসিড সন্ত্রাস ১০১, যৌতুকের দায়ে নির্যাতন ৫১৬, ধর্ষণ ৭১১, গণপিটুনিতে নিহত ১৬১, পোষাক-শ্রমিক নিহত ৪।৫৭
২০১২ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতি
আইন বিচার ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর প্রতিবেদন :
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াছ আলী, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামসহ ৫৬ জন নিখোঁজ, অপহরণ ও গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছে। এ বছর ৫৯৫টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘাতে ৮৪জন নিহত ও ১০ হাজার ৫২৫জন আহত হয়েছে। ২০১১ সালে এ ঘটনার সংখ্যা ছিলো ৩৭৫টি। ২০১২ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে ৯১জন। এ বছর ৩১৯টি সীমান্ত অপরাধের ঘটনা ঘটেছে, হত্যার শিকার হয়েছে ৪৮জন, নির্যাতনে আহত হয়েছে ১০৬জন। এবছর ২৫০জন নারী বখাটেদের হাতে লাঞ্চিত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৬জন আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় ২১৫জন হামলার শিকার হন। এর মধ্যে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন ১৫জন। এ বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১৪৯জন নারী ও শিশু। যার মধ্যে ৭৯জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেন আরো ১৪জন। ৬৮জন নারী এসিড নিক্ষেপের শিকার হন। পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ছিলো ২০১২ সালে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পুলিশের নির্যাতনে কুষ্টিয়ার মাহবুবুল হোসেনের মৃত্যু, বিএর কলেজের ছাত্র মাহমুদুল হক টিটোকে খুলনার কোতয়ালী থানায় ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। এ বছর সাগর-রুনিসহ ৫জন সাংবাদিক খুন হয়েছে। এছাড়াও ৪৪২জন সংবাদকর্মী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হন।৫৮
ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষানীতি : বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই কুদরত-এ-খুদা কমিশন (১৯৭৪) ও শামসুল হক (১৯৯৭) শিক্ষানীতির (২০০০) আলোকে একটি নতুন শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়া (২০০৯) ওয়েবসাইটে প্রদান করে, এ বিষয়ে জনগণের মতামত চাওয়া হয়। বিভিন্ন মহল সে বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনা করে তাদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেন। কিন্তু জনগণের প্রদত্ত সে সব মতামতকে গ্রহণ বা বর্জনের কোন সংখ্যাভিত্তিক তথ্য ও ব্যাখ্যা না দিয়ে এর কিছু শব্দ ও টার্ম পরিবর্তন করে শিক্ষা নীতি ২০১০ চূড়ান্ত করা হয়। আর তা বিগত ৩ অক্টোবর ২০১০ জাতীয় সংসদে পাস করার জন্য বিল আকারে উত্থাপন করা হয়।
শিক্ষানীতি ২০১০ এর প্রাক কথনে দাবি করা হয়েছে ‘এখানে ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারীগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে’। অথচ বাস্তবতা তা নয়। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, শিক্ষানীতি ২০১০ এর কোথাও কোথাও ‘ধর্মশিক্ষা’ ও ‘নৈতিক শিক্ষা’ প্রভৃতি শব্দ যোগ করা হয়েছে এবং ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ নামে একটি অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত জনগণকে বুঝানো হয়েছে যে, ‘শিক্ষানীতি ২০১০-এ ধর্মশিক্ষা রাখা হয়েছে।’ কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় প্রাক-প্রাথমিকের শিশুশ্রেণী থেকে শুরু করে সবোর্”ছ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার কর্মকৌশলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা নেই।৫৯
সাংসদের গাড়িতে যুবলীগ কর্মী ইবরাহীমের লাশ : ২০১০ সালে ১৩ আগষ্ট সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগ দলীয় ভোলা ৩ আসনের সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী সাওনের গাড়িতে তার সহ-কর্মী যুবলীগ কর্মী ইবরাহীমের লাশ পাওয়া যায় তার গাড়িতে। তারই পিস্তলে নিহত হন ইবরাহীম।
ভারতীয় কাঁটাতারে ঝুলছে ফেলানীর লাশ : ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারী বিএসএফ বিশ্বব্যাপী আলোচিত- নিন্দিত এক হত্যাকান্ড ঘটায়। বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে ভারতের কোচবিহার জেলার অন্তর্গত চৌধুরীহাট সীমান্ত চৌকির কাছে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় হত্যা করা হয় ফেলানীকে। প্রায় পাঁছ ঘন্টার মত তার লাশ ঝুলে থাকে কাঁটাতারে। মাটির দিকে মাথার চুল আর উপরের দিকে পা। এমন অবস্থায় কাঁটাতারে ঝুলা ছবিটি অশ্রু ঝরায় বিশ্বের বিবেকমান প্রত্যেক নাগরিকের। বিএসএফের কনস্টেবল অমিয় ঘোষ খুব কাছে থেকে গুলি করে তাকে হত্যা করে। ভারতের কোচবিহার সোনারি বিএসএফ চাউনিতে অমিয় ঘোসের বিচার শুরু হয় ২০১৩ এর ১৩ আগষ্ট। স্বাক্ষ্য দিতে বাংলাদেশ থেকে সেখানে যান ফেলানীর পিতা ও মামা। ৫ সেপ্টেম্বর শেষ হয় বিচার কাজ। আদালত অমিয়কে নির্দোষ বলে রায় দেন। এ রায়ের পর ফেলানী হত্যা নিয়ে আবারও বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় উঠে।৬০
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী : ২০১১ সালের ৩০ জুন ও ৩ জুলাই বাংলাদেশের মুসলমানদের ইতিহাসে কালো দিবস হিসেবে সরণীয় হয়ে থাকবে। ২০১০ এর ২১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটি ২৭টি বৈঠকের মাধ্যমে ৫১ দফা সুপারিশ সম্বলিত সংবিধান সংশোধন প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ জিল্লুর রহমান এর নিকট পেশ করে। ২৫ জুন ২০১১ সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করে। পরবর্তীতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২৯ জুন ২০১১ চার দফা সংশোধনীসহ মোট ৫৫টি দফা সম্বলিত বিলটির প্রতিবেদন পেশ করে। ৩০ জুন ২০১১ জাতীয় সংসদে বিলটি অনুমদিত হয়। এরপর ৩ জুলাই ২০১১ রাষ্ট্রপতি মুহাম্ম জিল্লুর রহমান সেই বিলে সাক্ষর করলে আইনে পুরিণত হয় ‘সংবিধান (পঞ্চদশ) সংশোধনী বিল ২০১১’ এর মাধ্যমে সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর থেকে পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দিয়ে তদস্থলে ‘সেক্যুলারিজম’ তথা ধর্মহীনতা প্রতিস্থাপন করা হয়।৬১
নারী উন্নয়ননীতি ২০১১ : সরকার নারীনীতিমালা ২০১১ এর খসড়া মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করেছেন। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, আলেম সমাজ ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ দাবি করছেন, নারীনীতি সংশোধন কিংবা বাতিল করতে হবে। কারণ, নারীনীতিমালার মূল প্রেরণা ও ভাবধারা ইসলামী জীতনব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে সিডিও সনদের বিতর্কিত অংশগুলো শরীয়ত বিরোধী ভাবধারা সম্বলিত একটি ঘুমন্ত এটাম বোমা। অপর দিকে সরকার বিশেষ করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রী এবং আইন মšী¿ বলেছেন, নারীনীতিমালায় ইসলাম বিরোধী কোন ধারা নেই। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, নারীনীতিতে ইসলাম বিরোধী কিছু নেই। এ নিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যেমন বিভ্রান্ত হয়, আলেম-উলামা ও ইসলামী জনতা বিক্ষোভে পেটে পড়ে। মিছিল-মিটিং, প্রতিবাদ-সমাবেশ এবং হরতালও করে। এটা এক দিকে এ সরকারের আমলের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, সাথে সাথে সরকারের ধর্মবিরোধী প্রদক্ষেপ সমূহেরও অন্যতম।
সাগর-রুনির হত্যাকান্ড : ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি নিজ বাসায় খুন হয়। রাজধানীর পশ্চিম রাজা বাজারের ৫৮/এ/২ নম্বর বাসায় মর্মান্তিক খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সংবাদক সাগর ও তার স্ত্রী এ টি এন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার রুনি।
ইলিয়াছ আলীর গুম : ২০১২ এর ১৭ এপ্রিল রাতে বিএনপি নেতা ইলিয়াছ আলী ও তার গাড়ি চালক আনচার আলী বনানীর সিলেট হাউজের বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন।
কালোবিড়াল : ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল নাটকীয়ভাবে রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক থেকে বিজীবী সদর দপ্তরে প্রকাশ পায় রেলের কালো বিড়াল খ্যাত দুর্নীতি। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিতসেন গুপ্তের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদারের ড্রাইভার আলী আজমের সাহসীকতায় ও সততায় ফাঁস হয়েছে এ দুর্নীতি। এই দুর্নীতির মূল হোতা হলো কালো বিড়াল খ্যাত সাবেক রেলমন্ত্রী বর্তমান খামখা মন্ত্রী সুরঞ্জিতসেন গুপ্ত।৬২
২৪ নভেম্বর ২০১২ : ১. ২৪ নভেম্বর ২০১২ রাতে দু’টি ভয়াবহ দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকার আশুলিয়ায় নিশ্চিন্তপুর এলাকায়। তোবা গ্রুপের তাজরিন ফ্যাশনস নামে একটি গার্মেন্টস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৩৯জন। বেসরকারী হিসেবে এর সংখ্যা আরো বেশী। ২. দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দার হাটে। সেখানে নির্মানাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে কমপক্ষে ১৭জন নিহত হয়েছে।৬৩
ছাত্রলীগের হাতে বিশ্বজিতের হত্যাকান্ড : ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরান ঢাকায় বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে নিহত হন দর্জি বিশ্বজিৎ দাস। বার বার সে নিজেকে হিন্দু বলে চিৎকার করার পরও তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁস : ২০১২ ও ২০১০ সালে বিসিএস পরীরক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে অভিনব কায়দায়। সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেস থেকে এ সব প্রশ্নপত্র ছাপা হয়। ১২ সালের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় জড়িত থাকার কারণে ৩জন বিজি প্রেস কর্মচারিকে অভিযুক্ত করা হয় এবং তাদের শাস্তি দেয়া হয়। এর আগে ২০১০ সালে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার নায়ক হিসেবে অভিযুক্ত করা হয় স্বয়ং সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) এর সহকারী কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনকে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে সে ঘটনায় অনেকের চাকরি গেলেও তিনি ক্ষমতাবলে স্বপদে বহাল থাকেস। ২০১২ সালের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় দৈনিক কালের কন্ঠের এক দীর্ঘ তদন্তে দেখা যায় এর সঙ্গে ছাত্রলীগের কর্মীরা জড়িত।৬৪
চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন : সকল জল্পনা কল্পনা ও উত্তাপ উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালের ১৫ জুন শনিবার দেশের চারটি সিটি কর্পোরেশনে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেনাবাহিনী মোতায়েন ছাড়া শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ চারটি সিটি কর্পোরেশনে একযোগে এমন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। এই কৃতিত্বের জন্য বর্তমান নির্বাচন কমিশন অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করে দায়িত্বশীলতা ও দূরদর্র্শিতার পরিচয় দেয়ায় ক্ষমতাসীন সরকারকেও সাধুবাদ জানাতে হয়। খুলনা সিটি কর্পোরেশনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একজন কর্মীর দুঃখজনক মৃত্যু এবং কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া চারটি সিটি কর্পোরেশনেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করায় সকল পক্ষের কর্মী, সমর্থক এবং সর্বস্তরের ভোটারগণও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। নির্বাচনে চারটি সিটি কর্পোরেশনেই ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত বিএনপি প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। পরাজিত ১৪ দলীয় জোট সমর্থিত আওয়ামী লীগের চারজন প্রার্থীই নির্বাচনী ফলাফল মেনে নিয়েছে। এটিও এ নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য ভালো দিক। আমরা চার সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়রকে শুভেচ্ছা জানাই। পাশাপাশি পরাজিত প্রার্থীদেরও আমরা ধন্যবাদ জানাই পরাজয় মেনে নিয়ে রাজনীতিতে একটি ভাল দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। চারটি সিটি কর্পোরেশনেই সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় এবং বিরোধীদল সমর্থিত প্রার্থীদের বিপুল বিজয় ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য অবশ্যই একটি সতর্কতা।
২০১৩ এর ২২ মে : ২০১৩ সালের ২২ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত উদয়ন স্কুল এন্ড কলেজে ঘটে গেলো এক নির্মম ঘটনা। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজুর স্ত্রী ঐ স্কুলের উপাধ্যক্ষ মাহবুবা খানম কল্পনা ছাত্রীদের ড্রেস-কোডের কথা বলে নবম-দশম-একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্রীর জামার হাতা কেটে দিয়ে চরম দৃষ্টতা দেখিয়েছে।
ঐশী সমাচার : ১৬ আগষ্ট ২০১৩ শুক্রবার পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইন্সúেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তাদের চামেলীবাগের বাসা ‘চামেলী ম্যানসন’ থেকে। এর আগে বুধবার গভীর রাতে তদের নিজ বাসায় খুন করা হয় বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। নিহতদের শরীরে ১৫ থেকে ২০টি করে চুরিকাঘাতের নিদর্শন রয়েছে। রবিবার দিন বেলা ১টায় পল্টন থানায় গিয়ে নিহতদের একমাত্র কন্যা ঐশী হত্যার দায়ী স্বীকার করে আত্ম সমর্পণ করেন।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী থেকে ১৭ সেপ্টেম্বও : ২০১৩ সালের এ সময়টা বাংলাদেশের ইতিহাসে নানাভাবে আলোচিত। ৫ ফেব্রুয়ারী ট্রাইব্যুনাল ২ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগের মধ্যে ৩টিতে ৫বছর করে ১৫ বছরের জেল। চতুর্থটিতে খালাস। ৫ ও ৬ নভেম্বরে যাবজ্জীবন দন্ড। এসব নিয়ে ছিলো টানটান উত্তেজনা বিরাজমান। সাহবাগে এমরানরা জড়ো হয়েছে, সংবিধান সংশোধন হয়েছে, রাজিবরা বিশ্বনবী সা. কে নিয়ে কটুক্তি করেছে, হেফাজত এসেছে, লংমার্চ করেছে, অবরোধ করেছে, শাপলায় অবস্থান নিয়েছে, সরকার গণহত্যা করেছে। ১৭ সেপ্টেম্বর আপিলের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়। সর্বোচ্ছ শাস্তির আদেশ হয় কাদের মোল্লার। ৬ নাম্বার অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের রায়ে ফাঁসি আর খালাস পাওয়া ৪ নাম্বার অভিযোগে যাবজ্জীবন দন্ড দেন আপিল বিভাগ।
মন্ত্রীদের পদত্যাগ ও সাংবিধানিক বিতর্ক : ১১ নভেম্বর ২০১৩ জাতি দেখলো সংবিধানিক ধারাকে অবজ্ঞা করে কীভাবে মহাজোট সরকার তামাশা করলো! টেলিভিশনে লাইভ প্রচারিত হলো, মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। ১১ নভেম্বর ২০১৩ প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অপর সব মন্ত্রীর পদত্যাগের তথ্য সরকারীভাবে ঘোষণা করেছেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব মুহাম্মদ মোশররফ হোসেন ভূঁঞা। ১৪ নভেম্বর ২০১৩ পদত্যাগের পর সুযোগ-সুবিধা এবং প্রটোকল না নিতে ৩৯জন মন্ত্রী-পতিমন্ত্রীকে লিগেল নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. তুহিন মালিক। সংবিধানের ৫৮ (১) অনুচ্ছেদের বিবরণ দিয়ে নোটিশের এক অংশে বলা হয়েছে, এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দাখিলের পর মন্ত্রী-পতিমন্ত্রীরা আর তাদের পদে বহাল নেই। কিন্তু পদত্যাগের পরও জাতীয় পতাকাবাহী সরকারী গাড়ী ব্যবহার করেন মন্ত্রীরা। নিজ নিজ দপ্তরে গিয়ে অফিসের কাজও যথারীতি সম্পাদন করেন তারা।৬৫
২০১৪ এর ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতি
১. ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রফিক উদ্দীন আহমেদ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ৫ জানুয়ারীর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। তার এই ঘোষণা যে দেশকে অনিবার্য সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয় তাতে কোন সন্দেহ নেই।
২. তথাকথিত এই তফসীল ঘোষণার পরপরই ৪৮ ঘন্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি।
৩. এইচ এম এরশাদ মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়ায় তাকে সামরিক হাসফাতালে আটকে রেখে রোশনা এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়।
৪. জাতিসংঘ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, কানাড়া, সুইডেন, অষ্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্নদেশ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতেও বাংলাদেশের সংকট নিরসনে সব দলের অংশ গ্রহণে নির্বাচনের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
৫. ২০১৩ এর ১৩ ডিসেম্বর পূর্বঘোষিত নির্বাচনী নির্ঘন্ট অনসারে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে দেখা গেলো বাংলাদেশ সংসদের ৩০০ টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি কেন্দ্রে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় হয়েছেন। অথচ এর আগে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৬ সালের নির্বাচনে একজন প্রার্থীও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হননি।
৬. ২৬ নভেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণতন্ত্রের অভিযাত্রা নামে ৫ দফা অরোধ কর্মসূচি পালন করে জোট সরকার।
৭. ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারীকে গণতন্ত্রের বিজয় দিবস আখ্যা দিয়ে বিজয় উৎসব করার কর্মসূচি দিয়ে ছিলো আওয়ামী লীগ। আর দিনটিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করতে নয়া পল্টনে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে সরকারের বাধায় তা পালন করতে পারেনি বিএনপি।
২০১৪ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি
২০১৪ সালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত ১০৮ জন, রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৭৫ জন, সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ১০৫, ধর্ষণের শিকার ১১২ জন।৬৬
২০১৫ সালের জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মানবাধিকার পরিস্থিতি
বাংলাদেশে মহিলা পরিষদের তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালের জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনাসহ মোট ৩ হাজার ৩৩৬ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৮২৬ জন, গণধর্ষণের শিকার ১৫৮ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭১ জনকে। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার ১১১ জন, শ্লীলতাহানীর শিকার ৭৯ জন, অগ্নিদগ্ধ হয়েছে ১৭ জন নারী ও শিশু।৬৭

তথ্যপঞ্জী
১. আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা- পৃষ্ঠা- ১৯৩
২. ডিগ্রি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তৃতীয় পত্র, বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা-২৩৯-৪২
৩. মাসূদুল হক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’ এবং সিআইএ, ঢাকা : প্রকাশক-মাহমূদ কলি, ১৯৯১, পৃষ্ঠা-১০১-১০২
৪. ডিগ্রি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তৃতীয় পত্র, বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা-৪২৮
৫. বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজের ভূমিকা ও প্রভাব-১০৮
৬. বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজের ভূমিকা ও প্রভাব-১১০
৭. অপসংস্কৃতির বিভীষিকা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠ-২৭
৮. জিহাদ ও ইসলামী আন্দোলন যুগে যুগে-২৭৬-৭৭
৯. জিহাদ ও ইসলামী আন্দোলন যুগে যুগে-২৭৭-৭৮
১০. বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলিমসমাজ ভূমিকা ও প্রভাব-৭৮
১১. প্রাগুক্ত
১২. জিহাদ ও ইসলামী আন্দোলন যুগে যুগে-২৮৩-৮৪
১৩. ডিগ্রি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তৃতীয় পত্র, বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা-৩১৬
১৪. অপসংসস্কৃতির বিভীষিকা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৭-২৯
১৫. সাপ্তাহিক পূর্ণিমা, ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৩
১৬. মুজাদ্দেদ হাসান তাদনান, বি বাড়িয়া ট্রাজেডি, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০০১, ঢাকা, হৃদয় প্রকাশন, ২০০১, পৃষ্ঠা-১৬
১৭. মুজাদ্দেদ হাসান তাদনান, বি বাড়িয়া ট্রাজেডি, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০০১, ঢাকা, হৃদয় প্রকাশন, ২০০১, পৃষ্ঠা-১৮
১৮. খতীব মাওলানা ওবায়দুল হক, সাক্ষাৎকার, মানবজমিন, ১৩.১.২০০১, মুফতি ফজলুল হক আমিনী, সাক্ষাৎকার, মানবজমিন, ৫.১.২০০১
১৯. সাক্ষাৎকার, দৈনিক ইনকিলাব, ১৭ জানুয়ারী ২০০১
২০. মুজাদ্দেদ হাসান তাদনান, বি-বাড়িয়া ট্রাজেডি, পৃষ্ঠা-৩১
২১. দৈনিক সংগ্রাম, ৪ মে, ১৯৯৯
২২. দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ জানুয়ারী, ১৯৯৯
২৩. দৈনিক ইনকিলাব, ১২ ডিসেম্বর, ১৯৯৬
২৪. দৈনিক ইনকিলাব, ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৯৬
২৫. দৈনিক ইনকিলাব ও দৈনিক সংগ্রাম, ৫ অক্টোবর, ১৯৯৭
২৬. বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্ট
২৭. দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ জুলাই, ২০০০
২৮. দৈনিক ইনকিলাব, ১৫ জুলাই, ২০০০
২৯. দৈনিক মানবজমিন, ৯ নভেম্বর, ২০০০
৩০. দৈনিক মানবজমিন ও দৈনিক যুগান্তর, ১৫ মার্চ, ২০০১
৩১. দৈনিক ইনকিলাব, ৬ নভেম্বর, ১৯৯৯
৩২. দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক ইনকিলাব, ৭ জুন, ২০০০
৩৩. সংবাদ ভাষ্য
৩৪. দৈনিক ইনকিলাব, ২৭ আগষ্ট, ১৯৯৯ ও দৈনিক দিনকাল, ৭ জুলাই, ১৯৯৯
৩৫. দৈনিক দিনকাল, ২৫ মার্চ, ২০০১
৩৬. দৈনিক মানবজমিন, ৪ফেব্রুয়ারী, ২০০১
৩৭. দৈনিক ইনকিলাব, ৯ অক্টোবর,১৯৯৬
৩৮. দৈনিক সংগ্রাম, ১ নভেম্বর, ১৯৯৬
৩৯. দৈনিক ইনকিলাব, ২৯ জানুয়ারী, ২০০২১
৪০. দৈনিক যুগান্তর, ১২ নবেম্বর, ২০০০ ও দৈনিক মানবজমিন, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০০১
৪১. দৈনিক দিনকাল, ২০ফেব্রুয়ারী, ২০০০
৪২. দৈনিক সংগ্রাম, ২৪ ডিসেম্বর,১৯৯৯
৪৩. দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ নভেম্বর, ২০০০
৪৪. দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক ইনকিলাব, ২৮ মার্চ, ২০০১
৪৫. দৈনিক সংগ্রাম ও দৈনিক যুগান্তর, ১৩ এপ্রিল, ২০০১
৪৬. দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ জুলাই, ২০০০
৪৭. দৈনিক আজকের কাগজ, ১৪ মে, ২০০১
৪৮. দৈনিক সংগ্রাম, ২৩মে, ২০০১
৪৯. দৈনিক মানবজমিন, ১৭ জুলাই, ২০০১
৫০. দৈনিক ইনকিলাব, ৯ আগষ্ট, ১৯৯৬
৫১. ২৮জানুয়ারী, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে
৫২. দৈনিক ইনকিলাব, ২৪ আগষ্ট, ১৯৯৬
৫৩. দৈনিক ইনকিলাব, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫
৫৪. ডিগ্রি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তৃতীয় পত্র, বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা- ৩৭১
৫৫. সাপ্তাহিক লিখনী, ২৮ মে, ২০১৩
৫৬. সাপ্তাহিক লিখনী, ২৮ মে, ২০১৩
৫৭. সাপ্তাহিক লিখনী, ২৮ মে, ২০১৩
৫৮. সাপ্তাহিক লিখনী, ২৮ মে, ২০১৩
৫৯. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ পর্যালোচনা মন্তব্য ও পরামর্শ, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক পরিষদ, পৃষ্ঠা-৪
৬০. সাপ্তাহিক লিখনী, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩)
৬১. সম্পাদকীয়, ছাত্র সমাচার, অক্টোবর-নভেম্বর, ২০১১
৬২. সাপ্তাহিক লিখনী, ২৮ মে, ২০১৩
৬৩. সম্পাদকীয়, মাসিক আন্ নাবা, ডিসেম্বর, ২০১২
৬৪. সাপ্তাহিক লিখনী, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩
৬৫. প্রাগুক্ত, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩
৬৬. সাপ্তাহিক লিখনী, ৩ মার্চ, ২০১৫
৬৭. দৈনিক ইনকিলাব, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫

লেখক : মাওলানা আবদুর রাজ্জাক

Leave a Comment

লগইন অথবা নিবন্ধন করুন

লগইন
নিবন্ধন