অবতরণিকা
সতীর্থ ও সহযোদ্ধাগণ সচরাচর এশটি প্রশ্ন করেন। কোন অমুসলিম কে, দ্বীনহীন মুসলিম কে বা বিপথগামী কোন দ্বীনি ভাইকে দাওয়াত দেয়ার পদ্ধতি কী হতে পারে?
এক্ষেত্রে আমি মনে করি, ট্র্যাডিশনাল কোন পদ্ধতিই শিখে রাখা বা কাউকে শিখিয়ে দেয়া উচিৎ নয়। কারণ, দাওয়াত হলো একটি ব্যাপক বিষয়। উম্মাহর প্রতি এক দরদি আবেগ ও ভালবাসা থেকে সৃষ্ট আহ্বানের নাম। যা (দাঈ) দাওয়াত যিনি দিবেন, তার হৃদয়ে উদ্রেক হবে। (মাদ’উ) যাকে দাওয়াত দেয়া হবে তার অবস্থার আলোকে পদ্ধতি নির্ণিত হবে। তাই ‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা’ নিয়েই দাওয়াত দিতে হয়।
একটি ঘঃনা উদ্বৃত করি, মাওলানা তারিক জামিল দামাত বারকাতুহুম এর একটা কারগুজারি আলোচনায় তিনি বলিউড সুপারস্টারদের কে কিভাবে কনভেন্স করেন তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তাঁর ভাষায়- “একবার আমি আমির খানের সাক্ষাৎপ্রার্থী হলাম। সিডিউল অনুযায়ী কথা বলার জন্য নির্দিষ্ট তারিখে আধা ঘন্টা সময় পেলাম। আমি যখন আমির খানের কাছে গেলাম তখন তিনি একেবারে তটস্থ। তিনি হয়তো মনে মনে ভাবছেন, মাওলানা সাহেব তো আজকে আমাকে একেবারে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিবে। মনে হয় কুরআন কিতাব ছুইয়ে সিনেমা না করার শপথ পড়াবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তারিক জামিল সাহেব বলেন, কিন্তু আমি এসবের কিছুই করলামনা। কুশল বিনিময়ের পর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে গল্প ধরলাম। দেখলাম, সত্তর ও আশির দশকের সিনেমা জগৎ সম্পর্কে আমি তার থেকে ভাল জানি। তখন গল্প আরও জমে উঠলো। আধা ঘন্টা শেষ হলে আমি উঠতে চাইলে তিনি আমাকে টেনে বসালেন। আপ্যায়ন করলেন। পাক্কা দু‘ঘন্টা গল্প হলো। অন্যত্র প্রোগ্রামের তাড়া থাকায় তিনিই আমার কাছে ছুটি চেয়ে পরবর্তি সাক্ষাতের জন্য সময় নির্ধারণ করে নিলেন।”
দাওয়াত কোন গদবাধা নিয়মের নাম নয়; বরং মাদ’উর প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন, সম্পর্ক তৈরী ও মানসিকতা বুঝে কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করাই হলো দাওয়াত।
যে ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তাকেইকেই স্বীকার করেনা তার জন্য এক পদ্ধতি, অমুসলিমকে দাওয়াতের ভিন্ন পদ্ধতি আবার বিপথগামী কোন মুমিনকে সুপথে আনার জন্য আলাদা পদ্ধতি। একজন পথচারিকে চলতিপথে দাওয়াত দেয়ার এক কৌশল, বাসে-ট্রেনে-বিমানে পাশের সীটের যাত্রীকে স্বল্প সময়ে দাওয়াত দেয়ার আরেক কৌশল, স্থায়ী পড়শিকে দাওয়াত দেয়ার আলাদা কৌশল। বন্ধুকে দাওয়াত দিতে একরকম আবার শত্রুকে দাওয়াত দিতে অন্যরকম। পুরুষকে দাওয়াত দেয়ার এক ধরণ আবার মহিলাকে দাওয়াত দেয়ার অন্য ধরণ। ছোটদের জন্য এক নিয়ম, সমবয়েসীদের জন্য অন্য নিয়ম আবার বড়দের জন্য ভিন্ন নিয়ম। সরাসরি হলে এক ব্যবস্থা আর সরাসরি না হলে অন্য ব্যবস্থা।
যে কোন স্যোসাল সাইটকে আমরা দাওয়াতের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু কোন ভিন্ন মতাবলম্বীকে আমরা যেভাবে পেয়ে বসি, সেটা কখনও দাওয়াতের নববী শিষ্টাচারের মধ্যে পড়েনা। কুরআন বর্ণিত পদ্ধতি ‘ওয়াজাদিলহুম বিল্লাতি হিয়া আহসান’ তথা উত্তম পন্থায় বিতর্ক এ জায়গাতেই সবচে’ বেশি প্রনিধানযোগ্য।
সুতরাং দাওয়াতের ক্ষেত্রে শরীয়তসম্মত কৌশল, সুন্দর দরদমাখা আলোচনা ও উত্তম পন্থায় মার্জিত বিতর্কের কোন বিকল্প নেই। এগুলোই নিয়ম এগুলোই পদ্ধতি। শুধু অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করাটাই দা‘ঈকে রপ্ত করতে হবে।
অতএব, দাঈ যিনি হবেন তার মাঝে উম্মাহর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি মানুষকে বুঝে তার চাহিদা মোতাবেক আচরণ করার ক্যারিশমাটিক গুণাবলীর সমাহার অবশ্যই থাকতে হবে। সাথে থাকবে উন্নত আমল ও জ্ঞানগত দক্ষতা। তার সাথে বাগ্নিতা বা কথা বলার যাদুকরি দক্ষতা দাওয়াতকে নিয়ে যাবে এক অনন্য উচ্চতায়।
আর পুরো বিষয়টিই নির্ভর করছে মনস্তত্ত্ব জ্ঞান বা মনোবিজ্ঞানের ওপর। মনোবিজ্ঞানের মাধ্যমেই মানুষের মনের গতি প্রকৃতি ভাব ইচ্ছা ভাললাগা না লাগা সবকিছুর কারণ বিশ্লেষণ ও মনস্তাত্ত্বিক সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। তাই এই নিবন্ধে দাওয়াতের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা ও দাওয়াতদানের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রারম্ভিকা
দেহ আর মন এই দুইয়ের সমষ্টি হল মানুষ। মন হল পরিচালক দেহ হল মন কর্তৃক পরিচালিত। দেহের আচার আচরণ, গতি-প্রকৃতি সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে এই মনের দ্বারা। অতএব বলা যায়, কেউ মনকে ঠিক করতে পারলেই তার সমস্ত কথাবার্তা, আচার-আচরণ সঠিক পথে চালিত হবে। হাদীস এই পরিচালিকা শক্তি- ‘মন’ সম্পর্কে বলেছে।
ألا إن فى الجسد مضغة، فإذا صلخت صلح الجسد كله وإذا فسدت فسدالجسد كله،
অর্থাৎ, জেনে রাখ! দেহের অভ্যন্তরে একটা মাংসপিণ্ড রয়েছে, যদি সেটা ঠিক হয়ে যায়, তাহলে পুরো দেহ ঠিক হয়ে যাবে। আর যদি সেটা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে পুরো দেহে ফ্যাসাদ ঘটবে। জেনে রাখ- সেটি হল মন বা আত্মা। [বোখারী ও মুসলিম]
হাদিসে যে মন বা আত্মা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেই মন বা আত্মা সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞানকেই বলা হয় মনোবিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞান পাঠ করলে জানা যায় মনের কোন ধরনের আবেগ অনুভূতি থেকে কোন ধরনের আচরণ সৃষ্টি হয়। আবার কোন ধরনের কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও পরিবেশ প্রকৃতি মনের উপর কোন ধরনের প্রভাব ফেলে থাকে। এটা জানলে সঠিক আচরণ সৃষ্টির জন্য নিজের মনকে সঠিক পথে পরিচালিত করা যায়। আবার অন্যের মনের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে- এমন আচরণ থেকে বিরত থাকা যায় এবং অন্যের মানসিক গতিকে অনুকূলে আনা সম্ভব হয়।
ইসলামের শিক্ষানীতি, দাওয়াতের পদ্ধতি, ইবাদত এবং মু’আমাণ! মু’আশারা সর্বক্ষেত্রেই মনস্তাত্ত্বিক আনুকূল্য সৃষ্টি ও তা ধরে রাখার বিষয়ে দৃষ্টি রাখা হয়েছে। মনকে গঠন করার জন্য যেমন সর্ব প্রথম ঈমানের দিকটাকে অগ্রগণ্য বিবেচনা করা হয়েছে, তেমনিভাবে ইবাদত, মুআমালা, মু’আশারা সব কিছুর শিক্ষা ও দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে এমন সব নীতিমালা ও পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে যা মনের গঠন ও গ্রহণ প্রক্রিয়াকে অনুকূল করতে পারে। মনোবিজ্ঞান বা মনস্তত্ত্ব পাঠ করলে কেউ মুখ দেখে মনের কথা বলে দিতে পারবে না, বশীকরণ বিদ্যাও আয়ত্ত্ব করা যাবে না। মূলতঃ এগুলো মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্তও নয়; বরং ইসলামের দেয়া বিধি-বিধান ও নীতিমালার মধ্যে কতখানি মনস্তু¡ রয়েছে, মনের উপর ইসলামী বিধি-বিধান ও নীতিমালার কতটুকু প্রভাব রয়েছে এবং এ দিকটার প্রতি কতখানি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, ইসলামী বিধি-বিধান ও নীতিমালার মনোবৈজ্ঞানিক কার্যকারিতা এবং ইসলামে মনোবিজ্ঞানের অবস্থান সম্পর্কিত আলোচনা ও বর্ণনাই ইসলামী মনোবিজ্ঞান বা মনস্তত্ত্বক পাঠের উদ্দেশ্য।
মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা
মনোবিজ্ঞান কে ইংরেজীতে বলা হয় চংুপযড়ষড়মু. শব্দটি গ্রীক শব্দ চংুপযব (মন বা আত্মা) এবং খড়মড়ং (বিজ্ঞান) থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আরবীতে মনোবিজ্ঞানকে বলা হয় ইলমুন-নাফ্স। এখানে ইলম শব্দটি বিজ্ঞান অর্থে এবং নাফস শব্দটি মন বা আত্মা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং আক্ষরিক অর্থে মনোবিজ্ঞানকে মন বা আত্মা সম্পর্কীয় বিজ্ঞান বলা যায়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের মতে মনোবিজ্ঞান হল আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়াসমূহের বিজ্ঞান সম্মত পর্যালোচনা।
আলোচ্য বিষয়
আত্মা বা মন, চেতনা ও প্রাণীর আচরণ হল মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। মনোবিজ্ঞানে প্রাণীর চিন্তা-চেতনা, আবেগ, অনুভূতি, বিশ্বাস ইত্যাদি মানসিক প্রক্রিয়া এবং তার ফলে কি আচরণ প্রকাশ পেয়ে থাকে, আবার কোন ধরনের আচার-আচরণে কি মানসিক প্রক্রিয়া ঘটে থাকে তা নিয়ে বিজ্ঞান সম্মত আলোচনা পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে।
উদ্দেশ্য
প্রাণীর আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বিচার বিশ্লেষণ করে কতগুলি সর্ববাদী সম্মত নিয়ম আবিষ্কার করা এবং ঐসব নিয়মাবলী দ্বারা মানুষের আচরণকে ব্যাখ্যা করা এবং এ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধিশালী করা।
উপকারিতা
মনোবিজ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ নিজের আবেগ অনুভূতি ও আচরণ সম্বন্ধে জানতে পারে এবং নিজের কোন আচরণ অন্যের মধ্যে কি মানসিক প্রতিক্রয়া সৃষ্টি করবে সে সম্বন্ধে অবহিত হতে পারে। এর ফলে নিজের আবেগ অনুভূতিকে সঠিকভাবে পরিচালিত করে মানসিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারে এবং অন্যের সঙ্গেও উপযুক্ত আচরণ করতে পারে। এভাবে মনোবিজ্ঞান ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষকে প্রজ্ঞার সাথে চলতে সাহায্য করে। মনোবিজ্ঞান দ্বারা আচরণকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য পাওয়া যায়।
ইতিহাস
অতীতে মনোবিজ্ঞান’ নামে বিজ্ঞানের কোন স্বতন্ত্র শাখা ছিল না। প্রথমে মনোবিজ্ঞান দর্শনেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকগণই তখন মনোবিজ্ঞান বিষয়ক কিছু কিছু আলোচনা করতেন। সেই প্রাচীন যুগের মনোবিজ্ঞানে যাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তারা হলেন এরিস্টটল (অৎরংঃড়ঃষব) খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২, প্লেটো (চষধঃড়) ৪২৭-৩৪৭, হিপোক্রেটিস (ঐরঢ়ড়পৎধঃবং) ও সক্রেটিস ৪৭০-৩৯৯। এরিস্টটল তার রচিত উব অহরসধ (আত্মা সম্বন্ধে) নামক পুস্তকে আত্মা সম্বন্ধে তৎকালীন প্রচলিত ধারণা সমূহকে সুসংবদ্ধ করেন। হিপোক্রেটিস খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সালে সর্ব প্রথম মানুষের ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলোচ করেন। প্লেটো এবং সক্রেটিসের লেখায়ও মানুষের মন বা আত্মা সম্পর্কে আলোচনা পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ফরাসী দার্শনিক ডেকা (১৫৬৯-১৬৫০) দার্শনিক লক (১৬৩২-১৭০৪) জীব বিজ্ঞানী ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) প্রমুখ অনেকে মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, যার অনেকটা পরবর্তীকালের মনোবিজ্ঞানীরা প্রত্যাখ্যানও করেছেন।
মনোবিজ্ঞানের সত্যিকার পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয় ১৮৭৯ সাল থেকে। এই সময় জার্মানীর দার্শনিক ও চিকিৎসক উন্ড (ডঁহফ ১৮৩২-১৯২০) মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধীয় একটি গবেষণাগার স্থাপন করেন। এখান থেকেই মনোবিজ্ঞানের আধুনিক যুগ ধরা হয়। ইতোপূর্বে গ্রীক দর্শনের যুগ থেকে উনবিংশ শতাব্দির শেষার্ধ পর্যন্ত সময়কে মনোবিজ্ঞানের প্রাচীন যুগ বা প্রাক বৈজ্ঞানিক যুগ বলা যায়। উন্ডের গবেষণাগার স্থাপনের পর পরই আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য আরও কিছু গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই সব গবেষণাগারে কার্যত মনোবিজ্ঞানীরা নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর সূত্রপাত করেন। এভাবে মনোবৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্বগুলো গবেষণা ও আলোচনা পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হতে হতে বর্তমান স্তরে এসে উন্নীত হয়েছে। এ হল সাধারণ মনোবিজ্ঞানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
ইসলাম তথা কুরআন সুন্নায় মনোবৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্বের পর্যাপ্ত সমাহার রয়েছে এবং বিভিন্ন হুকুম-আহকাম ও মাসআলা-মাসায়েল এর উপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয়েছে; যা মানব জীবনের কথাবার্তা, চলা-ফেরা, আচার-আচরণ আকীদা-বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি সার্বিক ক্ষেত্রে কার্যকর রয়েছে। তবে এসব মনস্তাত্ত্বিক নিয়ম-নীতি ও মনোবৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোকে স্বতন্ত্রভাবে শাস্ত্র আকারে রূপায়ণ ও সংকলনের কাজে তেমন কেউ এগিয়ে আসেননি বা এগুলোর উপর গবেষণার জন্য কোন গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার কথাও শোনা যায় না।
আধুনিক মনোবিজ্ঞান এক জটিল ও বিস্তৃত ক্ষেত্র। আধুনিক মনোজ্ঞানীরা আজ শুধু মানুষের কাজকর্ম, চিন্তা, আবেগ, অনুভূতি, ইচ্ছা, অনুরাগই নয়; প্রাণীর আচরণকেও তারা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করছেন। এছাড়াও আজকাল তারা নানা গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন। কেউ গবেষণা করছেন সামরিক বাহিনী ও বিমানবাহিনীর লোকদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কিভাবে মনোবিজ্ঞানকে কাজে লাগানো যায়। কেউ গবেষণা করছেন প্রচারের মাধ্যমে দ্রব্য সামগ্রীর চাহিদা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিভাবে মনোবিজ্ঞানকে প্রয়োগ করা যায়। কেউ কেউ আবিষ্কার করতে চাচ্ছেন কলকারখানার শ্রমিক বিদ্রোহ দমন ও অধিক উৎপাদনের জন্য শ্রমিকদের উৎসাহ সৃষ্টির লক্ষ্যে কি কি মনস্তাত্ত্বিক কৌশল উদ্ভাবন করা যায়। আবার কেউ গবেষণা করছেন ওজনহীন ও প্রচণ্ড গতিশীল অবস্থায় মহাশুন্যচারীর দৈহিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া কেমন হয় এবং কেন হয় তা নিয়ে। ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের আলোচনার মাধ্যমে আজকের মনোবিজ্ঞান এক বিরাট পরিধিতে বিস্তৃত।
দ্বীনী দাওয়াতের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞান
[উধ’ধিয চংুপযড়ষড়মু]
কুরআন-হাদিসের বিভিন্ন স্থানে দাওয়াত সম্পর্কিত যে সকল নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে, মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করলে মৌলিকভাবে তিনটি মূলনীতি পাওয়া যায়। যথা : ১. ব্যক্তি নির্বাচন, ২. মেজায নির্বাচন ও ৩. সময় নির্বাচন।
এক. ব্যক্তি নির্বাচন
ইসলাম কোন দেশ, অঞ্চল বা কোন গোষ্ঠি বিশেষের জন্য আসেনি; বরং ইসলাম সারা বিশ্বের সকল যুগের সকল মানুষের ধর্ম। এজন্য দাওয়াত ও তাবলীগকে ফরয করে দেয়া হয়েছে, যেন সমগ্র বিশ্বের সমস্ত মানুষের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে যায়। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
يايها الرسول بلغ ما انزل اليك من ربك، وان لم تفعل فما بلغت رسالته
হে রাসূল! আপনার প্রতি আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা প্রচার করুন, অন্যথায় আপনার প্রতি রিসালাতের যে দায়িত্ব অবতীর্ণ হয়েছে (কেমন যেন) তা প্রচার করলেন না। [সূরা মায়িদা-৬৭]
তবে এই প্রচার বা আল্লাহর পথে দাওয়াত নিছক যেনতেনভাবে আল্লাহ তা’য়ালার কাম্য নয়; রবং ইসলাহ ও হিদায়াতই দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য। আর এটা নির্ভর করছে দাওয়াতের সৌন্দর্যের উপর। অর্থাৎ, দাওয়াতের বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনা পদ্ধতি এমন হওয়া- যাতে শ্রোতা দাওয়াতের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তার মনঃপুত হওয়ায় দাওয়াতের প্রতিপাদ্য বিষয়াবলীকে সে মানতে উদ্বুদ্ধ হয়। অতএব দাওয়াতকার্য পরিচালনার জন্য প্রথমতঃ শ্রোতাদের শ্রেণি নির্ধারণ করে নিতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে সে প্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত নীতিমালার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
১. যোগ্যতা অনুসারে শ্রোতাদের শ্রেণী নির্ধারণ
শ্রোতা বিভিন্ন যোগ্যতার বিভিন্ন মন-মেজাযের এবং বিভিন্ন ধারণ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকে। অতএব শ্রোতা ব্যক্তিটির ভিত্তিতে দাওয়াতের বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। শ্রোতা যদি তীক্ষè বুদ্ধির অধিকারী হন, যদি তিনি অন্তরালোক সম্পন্ন জ্ঞানী ও সুধী শ্রেণীর লোক হন, তাহলে তার মধ্যে জ্ঞানের সত্যিকার পিপাসা ও প্রতিটি কথার দলীল প্রমাণ অনুসন্ধানের মনেবৃত্তি থাকবে। এ ধরনের শ্রোতার সামনে আলোচনা গুরুত্ত্ব ও দলীল প্রমাণ সহকারে হওয়ার প্রয়োজন হবে। আর যদি শ্রোতা সরল প্রকৃতির হন, নিরীহ এবং শান্তি প্রিয় লোক হন, তাহলে তাদেরকে দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে সহজ সরল ভাষায় উপদেশমূলক কথাবার্তাই যথেষ্ট হবে। আর যদি শ্রোতা বক্র প্রকৃতির বা বিকৃত মানসিকতার কিংবা বিতর্ক ও কলহপ্রিয় হন, তাহলে তাকে দাওয়াতের ক্ষেত্রে তার সাথে তর্ক-বিতর্কের আশ্রয় গ্রহণের প্রয়োজন হয়ে থাকবে। কুরআনে কারীমে দাওয়াত সম্পর্কিত আয়াতে এই ত্রিবিধ পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-৯
ادع إلى سبيل ربك بالحكمة والموعظة الحسنة وجادلهم بالتي هي احسن
অর্থাৎ, তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক কর সদ্ভাবে। [সূরা নাহল-১২৫]
অত্র আয়াতে ত্রিবিধ পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যথা হিকমত, সদুপদেশ ও সদ্ভাবে তর্ক-বিতর্ক। এই পদ্ধতিত্রয় উল্লেখিত তিন শ্রেণীর জন্য ভিন্ন-ভিন্ন ভাবে প্রযোজ্য হবে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে ব্যক্তি নির্বাচনপূর্বক সংশ্লিষ্ট পদ্ধতিটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে গ্রহণ করতে হবে। একজনের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিটি বাঞ্ছনীয় অন্য পদ্ধতিটি তার ক্ষেত্রে শুধু অকার্যকরীই নয়; বরং হিতে পরীতও ঘটাতে পারে। যেমন বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর লোকদেরকে তৃপ্ত করতে কিংবা দাওয়াতকে তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হলে চিন্তা-গবেষণামূলক, যুক্তি ও পান্ডিত্বমূলক আলোচনা দ্বারাই সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে সাদামাটা আলোচনা তাদের সামনে কোন আবেদন সৃষ্টি করবে না। আবার বিতর্কও তাদের নিকট বিড়ম্বনাকর ও অপাংক্তেয় মনে হবে।
তেমনিভাবে তর্ক-বিতর্ক ও কথা কাটাকাটির রোগ জীবাণুতে যারা ভরপুর, বাস্তব ও প্রাকৃতিক কোন যুক্তি বা দলীলকে তারা সহ্য করেন না। তাদেরকে একমাত্র তাদেরই স্বীকৃত কোন বিষয় থেকে একটা দমনমূলক উত্তর দ্বারা কোন বিষয় গ্রহণ করানো যেতে পারে। আর স্থুল বুদ্ধির ও শান্তি প্রিয় লোক যারা, তারা কোন কুটতর্ক পছন্দ করেন না। কিংবা গুঢ়তত্ত্বমূলক আলোচনা বা যুক্তিও তাদের ধারণ ক্ষমতার বাইরে। এ শ্রেণীর লোকদের জন্য সহজ সরল ভাষায় ও সাদামাটা উপদেশই সব থেকে বেশি কার্যকরী। মনস্তাত্ত্বিকভাবেই এই তিন শ্রেণীর লোকদের জন্য এই তিনটি পদ্ধতির কার্যকারিতা ও অপরিহার্যতা স্বীকৃত।
(হিকমত শব্দটি আরবী অভিধানে একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যথা : সত্যে উপনীত হওয়া, ন্যায় ও সুবিচার, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, গুঢ়তত্ত্ব ইত্যাদি।)
২. বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনা পদ্ধতির বিভিন্নতা।
দাওয়াতের ক্ষেত্রে হিকমতের পদ্ধতি হোক বা উপদেশের পদ্ধতি হোক কিংবা তর্ক-বিতকের পদ্ধতি হোক সর্বক্ষেত্রেই এমন উপস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে জড়তা, অসংলগ্নতা কিংবা শ্রোতার পরিভাষার সাথে বৈপরিত্য না থাকে। অন্যথায় কোন বাক্য বা উপস্থাপনা বোধগম্য না হওয়ার ফলে দাওয়াতই ব্যর্থ হবে। এই কারণে হাদিসে এ জাতীয় বাক্য ব্যবহারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। বর্ণিত হয়েছে-
نھی رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الاغلوطات ۔ مشكاة
অর্থাৎ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জটিল ও ভ্রমোদ্দীপক (ধাঁধাঁ জাতীয়) বাক্য ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। [মেশকাত]
কুরআনে কারীমে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
وانزلنا اليك الذكرلتبين للناس
অর্থাৎ, আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। [সূরা নাহল-৪৪]
৩. ধারণ ক্ষমতা অনুসারে বিষয়বস্তু নির্বাচন ও উপস্থাপন
বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে শ্রোতার ধারণ ক্ষমতাও লক্ষণীয়। বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর জন্য যে দার্শনিক ও তাত্ত্বিক আলোচনা চলবে, সাধাসিধে লোকদের ক্ষেত্রে তা পরিহার করে চলতে হবে। অন্যথায় ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় তাদের পক্ষে দাওয়াতের বিষয়বস্তু আয়ত্ত্ব করা সম্ভব হবেনা। অধিকন্তু বিভ্রাট দেখা দিতে পারে।
হযরত ইবনে মাসউদ রা. বলেন- যখন তুমি কোন সম্প্রদায়ের কাছে এমন কোন হাদিস বর্ণনা করবে, যা তাদের জ্ঞানের অগম্য; তখন তা তাদের কারো কারো পক্ষে ফিৎনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। [মুকাদ্দামায়ে মুসলিম]
মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় বক্তব্য যখন শ্রোতার ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন শ্রোতা নিজের মধ্যে এক রকম অপূর্ণতা বা ত্রুটি অনুভব করে, কিংবা বক্তব্য যখন শ্রোতার আবেগ অনুভূতি ও কামনার বিপরীত হয়, তখন প্রেষণা ও পরিতৃপ্তির পথে অন্তরায় হওয়ায় বক্তব্যের প্রতি আকর্ষণের পরিবর্তে সে বিকর্ষণ অনুভব করে এবং তার মধ্যে একটা দ্বন্দ্বমূলক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আর এসব অনুভূতি মানুষের জীবনে ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা নিয়ে আসে।
৪. বাগ্মিতা ও অলংকারের প্রয়োজনীয়তা
শ্রোতার কাছে বক্তব্যকে আকর্ষণীয় করার আর একটি উপকরণ হল ভাষায় বাগ্মিতা ও অলংকার। বাকপটুতা ও অলংকারের সজ্জা বক্তব্যের মাঝে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে। ভাষার এই অসাধারণ ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত করে রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন- “নিশ্চয় কতক বর্ণনা যাদু স্বরূপ। [মিশকাত]
মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় উদ্দীপকের স্বাতন্ত্র বা বিশেষ বৈশিষ্ট্য মনোযোগ আকর্ষণের একটি উল্লেখযোগ্য শর্ত। কোন উদ্দীপকে একটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকলে তা উদ্দীপকটিকে অন্যান্য উদ্দীপক থেকে আলাদা করে ফেলে। এর ফলে তা সহজে মনোযোগ আকর্ষণ করে।
(প্রেষণা শব্দটি মনোবিজ্ঞানের একটি পরিভাষা। প্রেষণা (গড়ঃরাব) বলতে বোঝায় মানুষ বা প্রাণীর এমন একটি অবস্থা যা তাদেরকে কাজে প্রবৃত্ত করায়। কামনা-বাসনা, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, ইচ্ছা, অভিলাস, প্রয়োজন সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত।)
অতএব ভাষার অলংকার ও বাগ্মিতার দ্বারা মনস্তাত্ত্বিক আনুকূল্য সৃষ্টির বিষয়টি সহজেই অনুমেয়। এ কারণেই হযরত মূসা আ. যখন দাওয়াত পরম্পরায় তাঁর ভ্রাতা হযরত হারূন আ. কে সাথে রাখার দরখাস্ত করেছিলেন, তখন তার কারণ স্বরূপ উল্লেখ করেছিলেন যে, সে আমার থেকে আধিক বাকপটু ও বাগ্নি। এ সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতটি নিম্নরূপ :
واخي هارون هوافصح منی لسانا فارسله معي ردئا يصدقی انی أخاف أن یکذبون
অর্থাৎ, আমার ভ্রাতা হারূন, সে আমার চেয়ে বাগ্মী; অতএব তাকে আমার সাহায্যকারীরূপে প্রেরণ করুন। সে আমাকে সাহায্য করবে। আমি আশংকা করছি তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে। [সূরা কাসাস-৩৪]
দুই. মেজায নির্বাচন
দাওয়াতকে কার্যকরী এবং শ্রোতার মনে প্রতিক্রিয়াশীল করতে হলে শ্রোতার মন মেজাযের প্রতিও লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। দাওয়াত সম্পর্কে পূর্বোল্লিখিত আয়াতটিতেও মৌলিকভাবে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কিত কুরআন ও হাদিসের বিচ্ছিন্নভাবে বর্ণিত তথ্যসমূহকে একত্রিট্ট করলে নিম্নোক্ত নীতিমালা প্রতীয়মান হয়।
১. দাওয়াতের সময় শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করা
দাওয়াতের বিষয়বস্তুর প্রতি যেন মনোযোগ আকৃষ্ট হয় এবং কোনভাবেই যেন দাওয়াতী বিষয়বস্তুর প্রতি তার মনোযোগ নষ্ট না হয় কিংবা বিকর্ষণ সৃষ্টি না হয় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়ার যে সব শর্ত রয়েছে তা দুই প্রকার। ১. আভ্যন্তরীণ ২. বাহ্যিক।
আভ্যন্তরীণ শর্ত বলতে বোঝায়- ব্যক্তির ইচ্ছা, আগ্রহ, প্রেষণা ও অনুরাগ সৃষ্টি হওয়া। দাওয়াতী বিষয়বস্তুর ব্যাপারে যেন শ্রোতার আগ্রহ সৃষ্টি হয়, সে যেন সেটাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়- এমন পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই ইচ্ছা, অনুরাগ ও প্রস্তুতি এমন এক বিষয় যা সহজেই মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে। যে সমস্ত জিনিস আমরা দেখতে বা শুনতে আগ্রহী কিংবা যে সমস্ত জিনিস আমরা দেখতে বা শুনতে প্রস্তুত থাকি, সেগুলো আমরা খুব সহজে দেখতে বা শুনতে পাই। এ সম্বন্ধে একজন চিকিৎসক ও তার পত্নীর একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। রাত্রে নিদ্রিত অবস্থায় রোগীর টেলিফোন এলে ডাক্তার তা খুব সহজেই শুনতে পান কিন্তু ডাক্তার পত্নীর তাতে নিদ্রার কোনই ব্যাঘাত হয় না। আবার ডাক্তার পত্নীর শিশু সন্তানটি কেঁদে উঠলে পত্নী সহজেই জেগে ওঠেন অথচ এতে তার ডাক্তার স্বামীর নিদ্রার কোনই অসুবিধা হয় না। এর কারণ হল রোগীর ব্যাপারে ডাক্তারের যে আগ্রহ থাকে, শিশুর ব্যাপারে তার সে আগ্রহ থাকে না। আর তার পত্নীর অবস্থা এর বিপরীত।
কোন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ তখনই জন্মায় যখন উক্ত বিষয়ে তার লাভ রয়েছে সেটা জানতে পারে। অতএব দাওয়াতী বিষয়বস্তুর প্রতি শ্রোতার আগ্রহ এবং তার জন্য তখনই প্রস্তুত হবে যখন তার মধ্যে সে তার লাভ অনুভব করবে। এই প্রস্ততি সৃষ্টির জন্য নিম্নোক্ত নীতি গ্রহণ করতে হবে।
২. শ্রোতার প্রতি কল্যাণকামিতা ও হিতৈষণা প্রকাশ
এজন্য দায়ীকে দাওয়াতের সময় দাওয়াতের বিষয়বস্তু দ্বারা শ্রোতার কল্যাণ হবে এমন ভাব প্রকাশ করতে হবে, কথার দ্বারা যেমন আচরণের দ্বারাও তেমন। আম্বিয়ায়ে কেরাম সাধারণত দাওয়াতের সময় বলতেন-
يا أيها الناس قولوا لا إله الا الله تفلحو
অর্থাৎ, হে লোক সকল! তোমরা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু বল, তোমাদের কল্যাণ হবে, তোমরা কামিয়াব হবে।
সন্তানের প্রতি পিতার যেমন বাৎসল্য ও কল্যাণকামিতা, দাওয়াতের ক্ষেত্রে দায়ীকেও শ্রোতার প্রতি তেমন কল্যাণকামিতা প্রদর্শন করতে হবে। রাসূল সা. নিজের প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
اعلمكم كما يعلم ابائکم۔
অর্থাৎ, তোমাদের পিতারা যেমন তোমাদেরকে শিক্ষা দেয়, আমিও তোমাদেরকে অনুরূপভাবে শিক্ষা দেই।
দাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূল সা. করুণার এমন মূর্ত প্রতীক ছিলেন যে, যারা তার দাওয়াত ও হিদায়াত গ্রহণ করতনা তাদের জন্য চিন্তায়, দুঃখে তিনি ভেঙ্গে পড়তেন। অস্বাভাবিক কল্যাণ কামনা থেকেই এই পরিস্থিতির উদ্ভব হত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ ইরশাদ হচ্ছে-
لعلك باخع نفسك أن لا يكونوا مؤمنین ۔
অর্থাৎ, তারা ঈমান আনে না বলে আপনি যেন মনোকষ্টে আত্মঘাতী হয়ে পড়ছেন। [সূরা শু’আরা-০৩]
দায়ীর এই করুণা মনস্তাত্ত্বিকভাবে শ্রোতার মনে নিদারুণ প্রভাব ফেলে। ফলে দাওয়াতী বিষয়বস্তুর মধ্যে তার কল্যাণ রয়েছে ভেবে সে তার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
মাদউ বা শ্রোতার প্রতি হিতৈষণা, কল্যাণকামিতা, নম্রতা ও কমনীয়তার বহিঃপ্রকাশ এবং কঠোরতা ও রুক্ষ্মতা পরিহার দায়ীর জন্য অন্যতম শর্ত। ফকীহ আবুল লায়ছ সমরকন্দী দায়ীর জন্য পাঁচটি শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন- ১. দাওয়াত সংশ্লিষ্ট জ্ঞানার্জন। ২. আল্লাহর দ্বীন বুলন্দ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দাওয়াত প্রদান। ৩. মাদউর প্রতি কল্যাণকামিতা ও নম্রতা। ৪. ধৈর্য ও সহনশীলতা। ৫. দাওয়াতের বিষয়ে নিজে আমল করা। [তামবীহুল গাফিলীন ৫৮-৫৯]
৩. শ্রোতার প্রতি নম্রতা ও কমনীয়তা
নম্রতা ও কমনীয়তা দায়ীর এমন একটি গুণ যা শ্রোতার হৃদয়কে তার প্রতি সহজে আকর্ষণ করতে পারে। পক্ষান্তরে কর্কশ আওয়াজ, ধারালো ভাষা ও রুক্ষ্ম স্বভাব শ্রোতার মনকে আহত করে। ফলে শ্রোতা শুধু এরূপ দাওয়াতদানকারী থেকে দূরেই সরে যায় না, তার প্রতি রীতিমত বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠে। এজন্যই রাসূল সা.-এর প্রতি কোমল হৃদয় হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে-
فبما رحمة من الله لنت لهم، ولو کنت فظا غليظ القلب لانفضوا من حولك
অর্থাৎ, আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছেন। যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ হতে সরে পড়ত। সুতরাং আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। [সূরা আলে ইমরান-১৫৯]
দায়ীর নম্রতা ও কমনীয়তা উদ্ধত অহংকারীর শীরকেও তার দাওয়াতের সম্মুখে নত করাতে পারে। অবশ্য যদি হিদায়াত শ্রোতার তকদীরে না থাকে তবে ভিন্ন কথা। ফিরাউনের ন্যায় উদ্ধত অহংকারীকে দাওয়াত দেয়ার সময় তাই হযরত মূসা আ. ও হারূন আ. কে নম্র কথা বলার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। এ সম্পর্কিত কুরআনে কারীমের বর্ণনা নিম্নরূপ-
۔ فقولا له قولا لينا لعله يتذكر او يخشی ۔
অর্থাৎ তোমরা দুজন ফিরাউনের নিকট যাও, সে সীমালংঘন করেছে। তারপর তার সাথে নম্র কথা বল। হয়ত সে উপদেশ গ্রহণ করবে বা ভয় করবে। [সূরা ত্বাহা ৪৩-৪৪]
এ আয়াতের তাফসীরে মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. “নবী সুলভ দাওয়াতের একটি গুরত্বপূর্ণ মূলনীতি” শিরোনামে বলেছেন যে, প্রতিপক্ষ যতই অবাধ্য এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারার বাহক হোক না কেন; তার সাথে সংস্কার ও পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব পালনকারীদের হিতৈষণার ভঙ্গিতে এবং নম্রভাবে কথা-বার্তা বলতে হবে। হয়ত এরই ফলশ্রুতিতে সে কিছু চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য হবে এবং তার অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হবে। পরে তিনি লিখেছেন-আজকাল বহু জ্ঞানীজন নিজেদের মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে একে অপরের বিরুদ্ধে কটুবাক্য প্রয়োগ ও দোষারোপ করাকে ইসলামের সেবা মনে করে বসেছেন; তাদের এ বিষয়ে বিশদ চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। [মাআরিফুল কুরআন ৬ষ্ঠ খণ্ড ১০৯ ও ১১০ পৃষ্ঠা]
৪. কঠোরতা ও রুক্ষ্মতা পরিহার
নম্রতা ও কমনীয়তার প্রয়োজনীয়তা থেকে নেতিবাচকভাবে কঠোরতা ও রুক্ষ্মতা পরিহারের অপরিহার্যতাও প্রমাণিত হয়। দায়ীকে ব্যবহারে, ভাষায় বা বিষয়বস্তুতে যে কোনরূপে কঠোরতা ও রুক্ষ্মতা অবশ্য পরিহার করে চলতে হবে। কোন ব্যক্তি বা দলের প্রতি আক্রমণাত্মক বা বিদ্রুপাত্মক যে কোন ভাষা তাকে পরিত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় তার দাওয়াতকে গোঁড়ামী, পক্ষপাতদুষ্ট, অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করা হবে কিংবা কঠিন মনে করে তা থেকে মানুষ পালিয়ে যাবে। এ কারণে রাসূল সা. হযরত আবু মূসা আশআরী ও মুআয ইবনে জাবাল রা. কে দাওয়াতের কাজে ইয়ামানে প্রেরণ করার সময় এই নীতির ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করে বলেছিলেন-
يسرا ولا تعسرا وبشرا ولا تنفرا وتطاوعا…. الخ
অথাৎ তোমরা সহজ করবে, কঠিন করবে না। সুসংবাদ শোনাবে, পালিয়ে যেতে বাধ্য করবে না এবং পরস্পরে ঐকমত্য (ও সহানুভূতি) বজায় রাখবে। [সহীহ বোখারী ২য় খণ্ড, ৯০৪ পৃষ্ঠা]
হযরত আনাস রা. বলেন, আমরা একদা রাসূল সা. এর সাথে বসা ছিলাম। ইত্যবসরে এক বেদুঈন এল এবং মসজিদে দাঁড়িয়ে পেশাব করতে শুরু করল। তখন রাসূল সা.-এর সাহাবীগণ তাকে বললেন থাম থাম! রাসূল সা. বললেন তাকে বাধা দিওনা, তাকে ছেড়ে দাও। সাহাবীগণ তাকে ছেড়ে দিলেন। সে পেশাব সম্পন্ন করল। তারপর রাসূল সা. ডাকলেন এবং বললেন, এই সমস্ত মসজিদ এগুলো পেশাব পায়খানার জন্য না; এগুলো শুধু আল্লাহর যিক্র, সালাত ও কুরআন তিলাওয়াতের জন্য। [সহীহ মুসলিম ১ম খণ্ড, ১৩৭ পৃষ্ঠা]
আল্লামা নববী এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এই হাদিস দ্বারা প্রমানিত হয় যে, অজ্ঞ লোকদেরকে নম্রতার সাথে শিক্ষা প্রদান করতে হবে। তবে কেউ যদি গোয়ার্তুমী কিংবা তাচ্ছিল্যভরে এ জাতীয় কাজ করে, তাহলে তা ভিন্ন কথা। এ হাদিসে উল্লেখিত রাসূল সা. এর নম্র ব্যবহারে মনস্তাত্ত্বিক সকল লাভের বিষয়টি সুস্পষ্ট। অজ্ঞ এই বেদুঈন লোকটির সাথে কঠোর ব্যবহার পূর্বক তাকে মসজিদ থেকে বের করে দিলে হয়তোবা সে মনঃক্ষুণ্ন্ন হয়ে ফিরে যেত এবং পরিণামে দ্বীন থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। পক্ষান্তরে রাসূল সা. এর এই কমনীয় ব্যবহারে বেদুঈন লোকটি এতখানি মুগ্ধ হয়েছিল যে, পরবর্তীতে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে সে বলেছিল, আল্লাহর কসম! তার থেকে উত্তম শিক্ষক আমি আর দেখিনি। আল্লাহর কসম তিনি আমাকে তিরস্কার করলেন না, আমাকে ধমক দিলেন না, আমাকে প্রহার করলেন না, আমাকে বকা দিলেন না; অথচ কত সুন্দরভাবে আমাকে শিক্ষা প্রদান করলেন। মুর্রখদে সাথে অহেতুক তর্কে কিংবা অসার আলোচনায় প্রবৃত্ত না হওয়া এবং তাদের থেকে নিবৃত্ত থাকা ও তাদেরকে ক্ষমা করার কথা কুরআনের বহু আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
خذ العفو وامر بالعرف واعرض عن الجاهلين
অর্থাৎ, তুমি ক্ষমা পরায়ণতা অবলম্বন কর, সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং মূর্খদেরকে উপেক্ষা কর। [সূরা আ‘রাফ-১৯৯]
৫. মাঝে মাঝে বিরতি প্রদান
দাওয়াত এবং ওয়াজ নসীহতের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে বিরতি প্রদান করা শ্রোতার মন-মেজাযকে অনুকুল রাখার অধিকতর উপযোগী। লাগাতার ও নিরবচ্ছিন্নভাবে দাওয়াত ও ওয়াজ-নসীহত শ্রোতার মনে বিরক্তি বা ত্যক্ততা সৃষ্টি করতে পারে। ইসলামের শিক্ষাদান পদ্ধতির ক্ষেত্রেও এ নীতিটি প্রযোজ্য।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে- “অনেক ধরনের শিক্ষণে কিছু সময় অনুশীলনের পর কিছু সময় বিরতি প্রদান করলে শিক্ষণ ভাল হয়। একটানা অনুশীলনের চেয়ে মাঝে মাঝে বিরতি ও বিশ্রাম গ্রহণ মনস্তাত্তিক নীতি অনুসারে অধিকতর উপযোগী।”
এতে করে শ্রোতাদের মধ্যে একঘেয়েমি সৃষ্টি হবে না নতুনত্ব অনুভব করতে থাকবে। আর এই নতুনত্বকে মনোবিজ্ঞারীরা মনযোগ আকর্ষণের একটি শর্ত হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন।
হযরত শাকীক বালখী রহ. বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. সপ্তাহে একদিন (প্রতি বৃহস্পতিবার) ওয়াজ-নসীহত করতেন। জনৈক ব্যক্তি আরয করল, আপনি যদি প্রতিদিন আমাদেরকে ওয়াজ-নসীহত করতেন তাহলে কতইনা সুন্দর হত। তখন তিনি বললেন-
“শোন! প্রতিদিন নসীহত করায় আমার বাধা আছে। আমি তোমাদেরকে বিরক্ত করতে চাই না। ওয়াজের মাঝে মাঝে আমি বিরতি দিয়ে থাকি যেমন রাসূল সা. আমাদের বিরক্তির আশংকায় মাঝে মাঝে বিরতি প্রদান করতেন। [বোখারী ও মুসলিম]
কারী মুহাম্মাদ তাইয়্যিব রহ. তার দ্বীনী দাওয়াত এর কুরআনী উসূল শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, লক্ষণীয় বিয়ষ যে, যেখানে ভক্ত এবং নিবেদিত প্রাণ মানুষের মধ্যেও যখন প্রতিদিন ওয়াজ করার ফলে বিরক্তি সষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল; যার ফলে সপ্তাহে একদিন ওয়াজের ব্যবস্থা করা হত, সেখানে অপরিচিত অমুসলিমদের ক্ষেত্রে এই আশংকা আরো প্রবল হওয়াটাই স্বাভাবিক। অতএব তাবলীগ এবং দাওয়াতও ধীরলয়ে এবং সময়ে সময়ে হতে হবে। যেন ধীরে ধীরে মানববৃত্তি জাগরিত হতে থাকে এবং আগ্রহ অক্ষণ্ন থাকে।
অনেকে জযবার আতিশয্যে বক্তব্য এত দীর্ঘ করে ফেলেন যে, শ্রোতা মনে মনে তার থেকে মুক্তি কামনা আরম্ভ করে, এটা ইসলামের মনস্তাত্ত্বিক নীতির পরিপন্থী। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসের রা. থেকে বর্ণিত একটি রিওয়ায়েতে তিনি বলেন, আমি রাসূল সা. কে বলতে শুনেছি।
“কোন ব্যক্তি কর্তৃক নামায দীর্ঘায়িত ও আলোচনা সংক্ষিপ্ত করণ তার বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
অতএব বক্তব্য আলোচনা এবং ওয়াজ হতে হবে নাতিদীর্ঘ ও আগ্রহের সীমানার মধ্যে সমাপ্ত।
৬. পর্যায়ক্রমে এবং অল্প অল্প করে দাওয়াত প্রদান
দাওয়াতের ক্ষেত্রে অল্প অল্প করে পর্যায়ক্রমে দাওয়াতের বিষয়বস্তুকে পেশ করতে হবে। একটি বিষয় উপস্থাপনের পর আরেকটি বিষয় উপস্থাপন করতে হবে। একই সাথে অনেকগুলো বিষয় পেশ করলে শ্রোতার কাছে তখন কঠিন মনে হবে। ফলে সে দাওয়াতের বিষয়কে পরিত্যাগ করে বসতে পারে।
হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. বলেন, রাসূল সা. আমাকে ইয়ামানবাসীর নিকট প্রশাসক নিযুক্ত করে পাঠালেন। তিনি বললেন, তুমি আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ। তাদের সাথে সাক্ষাৎ হলে এ কথার আহ্বান জানাবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। যদি তারা তা মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দিবে যে, আল্লাহ তাদের উপর প্রতিদিন নামায ফরয করেছেন। যদি তারা তা মেনে নেয়, তাহলে তাদের বলে দিবে যে, আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, ধনীদের থেকে আদায় করা হবে এবং তাদের দরিদ্রদের মাঝে তা বন্টন করা হবে। সাবধান! যাকাত হিসেবে তোমরা তাদের থেকে শুধু উত্তমগুলো নিবে না। মাজলুমের বদ দুআ থেকে সাবধান! মনে রেখা! আল্লাহর ও মাজলুমের দু’আর মাঝখানে কোন অন্তরায় নেই। [সহীহ মুসলিম-৩৬]
এ হাদিসে স্পষ্টভাবেই একটি বিষয় মেনে নেয়ার পর অন্য একটি বিষয় পেশ করার কথা বলা হয়েছে। আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, এতে করে দাওয়াতের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমিকতা ও অল্প-অল্প করে দাওয়াত পেশ করার নীতি প্রমাণিত হয়। [ফাতহুল মুলহিম ১ম খণ্ড]
৭. দাওয়াতের পূর্বে নিজের মধ্যে আমল সৃষ্টি করা
দাওয়াতের ক্ষেত্রে আরও এক ধরনের পর্যায়ক্রমিকতা বা বিন্যাস রয়েছে। তা হল- দাওয়াত সর্বপ্রথম দায়ীর ব্যক্তি থেকে শুরু হবে, তারপর তার পরিবারবর্গ, তারপর বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজন, তারপর দেশবাসী, তারপর বহির্বিশ্ব। দাওয়াত প্রদানকারী প্রথমে তার নিজেকে দাওয়াত তথা আমলের বাস্তব প্রতীক বানাবে, অতঃপর তার পরিবার-পরিজনকে বন্ধু-বান্ধবদের নমুনা হিসেবে দেশবাসীর সম্মুখে পেশ করবে। এমনিভাবে পরের স্তর পরবর্তী স্তরের জন্য নমূনা হয়ে দাঁড়াবে। তাতে করে পরবর্তী স্তরের দাওয়াতী বিষয়বস্তুর প্রতি মানসিক প্রশ্নের জন্ম নিবে না কিংবা কষ্টকর হলে বক্তাকে তার সাথে জড়িত দেখে সেটাকে অনেকটা স্বাভাবিক বলে মনে হবে।
দাওয়াত দানকারীর মধ্যে যদি আমল না থাকে, সে ক্ষেত্রে তার দাওয়াতের পশ্চাতে কোন অসদুদ্দেশ্য (যেমন-উপদেশকারী হিসেবে সম্মান লাভের আশা, অন্যকে হেয় পতিপন্ন করা ইত্যাদি) রয়েছে বলে সন্দেহ হতে পারে। মানসিকভাবে তাই লোকেরা সাধারণতঃ ঐ সব উপদেশকারীর কথাই মানতে উদ্বুদ্ধ হয়, যাদের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আমল বিদ্যমান থাকে। এজন্যই কুরআনে কারীমে উপদেশকারীকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আমলকারী হওয়ার ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছে এবং যারা এর বিপরীত তাদেরকে ভৎসনাস্বরূপ বলা হয়েছে-
يائها الذين آمنوا لم تقولون ما لا تفعلون – كبر مقتا عند الله أن تقولوا ما لا تفعلون ۔
অর্থাৎ, হে মুমিনগণ! তোমরা যা কর না, তা তোমরা কেন বল? তোমরা যা কর না তোমাদের তা বলা আল্লাহর কাছে অতিশয় অসন্তোষজনক। [সূরা সাফ ২-৩]
এখানে উল্লেখ্য যে, কারও মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আমল না থাকলে তার পক্ষে অন্যকে সে বিষয়ের দাওয়াত বা নির্দেশ দেয়া নিষেধ তা নয়; তবে অন্যান্য ফায়দাসহ মনস্তাত্ত্বিক আনুকূল্য সৃষ্টির লক্ষ্যে তৎসংশ্লিষ্ট আমল বাঞ্চনীয়।
মুফতী শফী রহ. তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনে উল্লেখিত আয়াতের তাফসীরে বলেন, “কোন আমলহীনের পক্ষে অপরকে উপদেশ দান করা জায়েয নয় এবং কোন ব্যক্তি যদি কোন পাপে লিপ্ত থাকে, তবে সে অপরকে উক্ত পাপ হতে বিরত থাকার উপদেশ দিতে পারবে না। এরূপ বোঝা ঠিক নয়। কারণ, সৎ কাজের জন্য ভিন্ন নেকী এবং সৎ কাজের প্রচার প্রসারের জন্য পৃথক নেকী। তাছাড়া এক নেকী পরিহারের ফলে অপর নেকীও পরিহার করতে হবে এমন কোন কথা নেই। একটি পাপ কাজ করছে বলে অপর পাপও করতে হবে এমন কোন বাধ্য-বাধকতা নেই।
যদি প্রত্যেক মানুষ নিজে পাপী বলে সৎ কাজের নির্দেশ দান ও অসৎ কাজ হতে বাধা দান করা ছেড়ে দেয় এবং বলে যে, যখন সে নিজে নিষ্পাপ হতে পারবে, তখনই অপরকে উপদেশ দিবে। তাহলে ফল দাড়াবে এই যে, কোন তাবলীগকারী আর অবশিষ্ট থাকবে না। হযরত হাসান রা. বলেন, শয়তান তো তাই চায় যে, মানুষ এ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে তাবলীগের দায়িত্ব পালন না করে বসে থাক। [মাআরিফুল কুরআন ১ম খণ্ড]
অতএব নিজের মধ্যে আমল সৃষ্টি করার পূর্বেও দাওয়াত প্রদান করা যাবে।
হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত একটি হাদিসে নবী সা. ইরশাদ করেন-
مروا بالمعروف وان لم تعملوا به ، وانهوا عن المنكر وان لم تنتهوا
অর্থাৎ তোমরা সৎ কাজের আদেশ দাও যদিও তোমরা তা আমল না কর। ও মন্দ কাজে বাধা দাও যদিও তা থেকে তোমরা বিরত নও। [তামবীহুল গাফিলীন-৫৫]
তদুপরি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমল সৃষ্টি না হলেও দাওয়াত প্রদান অব্যাহত রাখার পেছনে একটি মনস্তাত্ত্বিক আনুকূল্য নিহিত আছে। অন্যকে বারবার সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কর্মে বাধা দিতে দিতে দায়ীর নিজের মনেও একটি অনুকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। কেননা কেউ যখন কোন আদর্শের প্রতি বার বার অন্যকে আহ্বান জানাতে থাকে, তখন নিজে সেই আদর্শের বিপরীত কাজে লিপ্ত হতে গেলে নিজের বিবেকের কাছে সে অপরাধী সাব্যস্ত হয়, নিজের বিবেকের প্রশ্নবাণে সে নিজেই জর্জরিত হয়।
৮. দায়ীর নিজের অবস্থানকে পরিচ্ছন্ন রাখা
দায়ীকে লক্ষ্য রাখতে হবে তার কোন উক্তি, আচরণ বা কর্ম যেন তার প্রতি অন্যের মনে অহেতুক সন্দেহের সৃষ্টি না করে। সমাজের সামনে তার অবস্থানকে পরিস্কার রাখতে হবে। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টিকে স্পষ্ট করা যাক। “একবার রমযানের শেষ দশকে রাসূল সা. মসজিদে ই‘তেকাফ রত ছিলেন। তখন রাসূল সা.-এর স্ত্রী সাফিয়্যা বিনতে হুইয়াই রাতের বেলায় রাসূল সা.-এর কাছে এলেন এবং কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর গৃহে প্রত্যাগমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। রাসূল সা. ও তাকে ঘর পর্যন্ত পৌছে দেয়ার উদ্দেশ্যে সঙ্গে চললেন। তারা উভয়ে উম্মে সালমার ঘরের সন্নিকটস্থ মসজিদের দুয়ার পর্যন্ত উপনীত হয়েছেন, ইত্যবসরে দু‘জন আনসারী সাহাবী সেখান দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহ সা. কে সালাম দিলেন এবং সামনে অগ্রসর হতে থাকলেন। রাসূল সা. তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন থামো! এ হল সাফিয়্যা (অর্থাৎ, আমার স্ত্রী)। তারা বললেন, সুবহানাল্লাহ! ইয়া রাসূলাল্লাহ!
(রাসূলের কথায় তারা বুঝতে পেলেন যে, রাসূল সা. হয়ত মনে করেছেন আমরা তাঁর প্রতি এই মর্মে সন্দিহান হব যে, তিনি কোন বেগানা নারীর সাথে কথাবার্তা বলছেন)
রাসূল সা. বললেন ইরশাদ এরন-
ان الشيطان يجرى من ابن ادم مبلغ الدم واني خشيت ان يقدف في قلو بكما۔
অর্থাৎ, শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরা দিয়ে চলাচল করতে পারে। আমার আশংকা হল যে, সে তোমাদের মনে প্রক্ষেপণ করবে। [বোখারী ১ম খন্ড, ২৭২ পৃষ্ঠা ও ২য় খণ্ড ৯১৮ পৃষ্ঠা]
এ হাদিসে সাহাবীদ্বয়কে ডেকে “এ আমার স্ত্রী সাফিয়্যা” কথাটি বলা একান্তভাবেই মনস্তাত্ত্বিক কারণে। কেননা শয়তানের প্ররোচনায় রাসূল সা.-এর চরিত্র সম্পর্কে তাদের মনে অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টির আশংকা বিদ্যমান ছিল। এমনটি হলে তাদের দীনচ্যুত হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। তদুপরি এতে করে রাসূলের চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয়ায় তার দাওয়াতও প্রভাবহীন হয়ে পড়ত। তাই নিজের অবস্থানকে পরিস্কার রাখার উদ্দেশ্যেই রাসূল সা. তাদেরকে ডেকে তাদের সম্ভাব্য সন্দেহের অপনোদন করলেন। এমনিভাবে হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, মানুষের অহেতুক বিরূপ ধারণাকে প্রতিহত করা এবং নিজের অবস্থানকে নির্মল রাখার ব্যাপারে রাসূল সা. যত্নবান ছিলেন। বলা বাহুল্য- নিজের অবস্থান পরিষ্কার ও নির্মল রাখার উদ্দেশেই তিন এই নীতি অবলম্বন করেছিলেন।
একবার ইমাম বোখারী রহ. ছাত্র জীবনে সমুদ্র সফরে ছিলেন। তার কাছে তখন এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা ছিল। জাহাজে জনৈক আরোহী তার সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিকতা প্রদর্শন করল এবং তার ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল। ইমাম বোখারী এক পর্যায়ে তাকে নিজের কাছে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা থাকার বিষয়টি প্রকাশ করে ফেললেন। তারপর একদিন প্রত্যুষে ঐ ভদ্র লোকটি হৈ চৈ জুড়ে দিয়ে বলতে লাগলো, আমার এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা হারিয়ে গেছে। তার কথামত জাহাজে তল্লাশী আরম্ভ হল। ইমাম বোখারী সকলের অগোচরে তার থলেটি স্বর্ণমুদ্রাসহ সমুদ্রে ফেলে দিলেন। এক পর্যায়ে ইমাম বোখারীর কাছেও তল্লাশী চালানো হল। জাহাজের কারও নিকট যখন কথিত স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেল না, তখন লোকেরা তাকে অপমান করল। অবশেষে সফর শেষে যখন সকলে জাহাজ থেকে অবতরণ করল তখন লোকটি নির্জনে ইমাম বোখারীকে জিজ্ঞেস করল আপনার স্বর্ণমুদ্রাগুলো কোথায়? ইমাম সাহেব জানালেন সমুদ্রে ফেলে দিয়েছি। এতগুলো স্বর্ণমুদ্রা সমুদ্রে ফেলে দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, সারাটি জীবনের মূল্যবান সময় রাসূল সা.-এর হাদিস সংকলন ও লিপিবদ্ধ করণের কাজে ব্যয় করে আমার জীবনের প্রতি মানুষের যে আস্থা ও নির্ভরযোগ্যতা লাভ করেছি, অহেতুক চুরির সন্দেহ দ্বারা সেই মূল্যবান সংগ্রহকে আমি বিসর্জন দিতে চাই না। [ফাতুহুল বারী]
বলা বাহুল্য- দ্বীনী কাজের স্বার্থে নিজের জীবন ও অবস্থানকে নির্মল রাখার উদ্দেশ্যেই তিনি এত বড় ক্ষতি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এ পদক্ষেপটি ছিল তার একটি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক সতর্কতা।
অনেকে বলে থাকেন, আমি অন্যায় কাজ করিনি অতএব কেউ আমার প্রতি বিরূপ ধারণা করলে আমার কিছু করণীয় নেই। তাদের এই বক্তব্য ইসলামের মনস্তাত্ত্বিক নীতির পরিপন্থী। আল্লামা নববী বলেন- “আলিম, মুআল্লিম, বিচারক, মুফতী, দাঈ ও শায়খ প্রমুখ অনুস্মরণীয় ব্যক্তির জন্য এমন সব উক্তি, কর্ম ও আচরণ পরিহার করা উচিৎ, বাহ্যিক দৃষ্টে যা গর্হিত মনে হয়। যদিও প্রকৃত বিচারে তা সঠিক হয়ে থাকে। বহু দর্শক বাহ্যিক রূপকেই সঠিক মনে করে বসবে। আবার অনেকেই তার সমালোচনায় লিপ্ত হবে। সুতরাং এগুলোর উৎসকে পরিহার করা উচিত। যদি একান্তভাবেই তা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাহলে তা গোপনে করবে; প্রকাশ্যে নয়। যদি কেউ প্রকাশ্যে করেন কিংবা প্রকাশ হয়ে পড়ে অথবা তার বৈধতা ও তৎ সম্পর্কিত শরীআতের প্রকৃত বিধান জনসম্মুখে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে তা করা শ্রেয় মনে করেন, তাহলে তার উচিত হবে সে কাজ করার বা সে কথা বলার পর একথা বলে দেয়া যে, আমার এই উক্তি বা কর্ম অবৈধ নয় কিংবা এর দ্বারা আমার উদ্দেশ্য হল যাতে তোমরা জানতে পার যে, আমি যেভাবে এটা করলাম তা অবৈধ নয় বরং প্রকৃত পক্ষে এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা এই এবং তার দলীল এই। [কিতাবুল আযকার]
৯. দোষ ত্রুটির সম্পর্ক নিজের দিকে করে কথা বলা
মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রতিটি মানুষই অন্যের কাছে ভাল প্রতিপন্ন হতে চায়। এজন্যেই নিজের যোগ্যতার স্বীকতি পেলে সে আনন্দিত হয়, নিজের প্রশংসা শুনলে মুগ্ধ হয় আর যারা তার যোগ্যতার মূল্যায়ন করে ও স্বীকৃতি দেয় তাদের প্রতি সে প্রীত হয়ে পড়ে এবং তাদেরকে নিজের অনুকূলে মনে করে থাকে। ফলে তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ ও তা মানার জন্য তার মধ্যে মানসিক আনুকূল্য সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে নিজের দোষ-ত্রুটি ও নিন্দা-মন্দ শুনলে তার আবেগ-অনুভুতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তার সংবেদন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়, তার স্নায়ুগুলো বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই যাদের থেকে এই মন্দ ও দোষ-ত্রুটি শুনতে পায়, তাদের প্রতি সে মনক্ষুন্ন হয় এবং সম্প্রীতি বজায় রাখা ও তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শোনার জন্য প্রস্তুত হতে পারে না।
রাসূল সা. নির্দিষ্ট ব্যক্তির দোষত্রুটি জেনেও তার প্রতি সে দোষ সম্পৃক্ত করে কথা বলেননি; বরং বলতেন- “মানুষের কী হল যে, তারা এমন কর্ম করে?” রাসূল সা.-এর ভাষণ, বর্ণিত হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে এটা জানা যায়।
দাওয়াতের ক্ষেত্রে মাদউ বা শ্রোতার প্রতি দোষ সম্পৃক্ত না করে নিজেদের প্রতি দোষ সম্পৃক্ত করার একটি স্পষ্ট বর্ণনা কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে বিধৃত হয়েছে-
وما لنا ألا نتوكل على الله
অর্থাৎ, আমাদের কী হল যে, আমরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করব না।
অন্য এক আয়াতে এসেছে-
“আমার কি যুক্তি আছে যে, আমি তার ইবাদত করব না, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার নিকট প্রত্যাবর্তন হবে। [সূরা ইয়াসীন-২৩]
এখানে লক্ষণীয় যে, আয়াতে এরূপ ভঙ্গিতে বলা হয়নি যে, “তুমি কেন তার ইবাদত কর না যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন (এটা যে নিতান্তই কৃতঘ্নতা) তার পরিবর্তে এমন ইলাহ কেন গ্রহণ কর (যে এতই গুরুত্বহীন) যে, তার সুপারিশ কোন কাজে আসবে না। (এবং এতই অপদার্থ) যে তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে না? এরূপ করলে তুমি অবশ্যই বিভ্রান্ত।”
মোটকথা- দোষগুলো দোষী ব্যক্তির প্রতি সম্পৃক্ত করে কথা বলা হয়নি। কেননা, এতে তার আঘাত লাগতে পারে, ফলে দাওয়াতের উদ্দেশ্য বিপন্ন হওয়ার আশংকা দেখা দিবে। তাই দোষ-ত্রুটির নেসবত নিজের দিকে করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে আমি কেন করব না? আমি তাহলে বিভ্রান্ত হব ইত্যাদি।
এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক দিক নির্দেশনা রয়েছে। তা হল প্রতিপক্ষের কোন দোষ প্রকাশ মনস্তাত্ত্বিকভাবে তাকে জেদী ও হটকারী করে তুলতে পারে।
তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন সপ্তম খণ্ডে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শফী সাহেব রহ. লিখেছেন : বর্তমান যুগের দাওয়াত ও প্রচারকর্ম সংস্কারকগণ এই পয়গম্বর অনুসৃত নীতি পরিত্যাগ করেছেন। ফলে মাঝে মধ্যে তাদের দাওয়াত ও প্রচার নিষ্ফল হয়ে পড়ে। বক্তৃতা-বিবৃতিতে ঝাল মেটানো এবং প্রতিপক্ষের প্রতি বিদ্রুপাত্মক বাক্য বর্ষণ করাকে আজকাল বাহাদুরী মনে করা হয়, যা প্রতিপক্ষকে আরও বেশি জেদী ও হটকারী করে তোলে।
প্রতিপক্ষের মধ্যে এরূপ জেদ ও হটকারিতা সৃষ্টির উদাহরণ স্বরূপ একটি আয়াতে বলা হয়েছে-
ولا تسبوا الذين يدعون من دون الله فیسبوا الله عدوا بغير علم
অর্থাৎ, আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে, তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তাহলে তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞতা বশতঃ আল্লাহকেও গালি দিবে। [সূরা আনআম-১০৮]
উল্লেখ্য যে, প্রয়োজনে সমালোচনার নীতি ইসলামে স্বীকৃত, তবে সেক্ষেত্রেও শালীনতা বর্জন বা অতিরঞ্জন ইসলামের দৃষ্টিতে গর্হিত। আলোচ্য আয়াতে প্রয়োজন ও শালীনতার বাইরে সীমা লংঘনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। বিশেষতঃ দাওয়াতের ক্ষেত্রে সমালোচানর নীতি পরিহার ও ইতিবাচক বক্তব্যই অধিকতর কার্যকরী হয়ে থাকে।
যেখানে সমালোচনার তথা অন্যের দোষ ব্যক্ত করার প্রয়োজন পড়বে সেক্ষেত্রেও শ্রোতার মনোকষ্ট না হয় কিংবা তার মধ্যে জেদ ও উত্তেজনা সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, অন্যথায় সমালোচনার কার্যকারিতা বিনষ্ট হবে।
পৌত্তলিক ধর্মের অন্ধ অনুসারী মক্কার মুশরিকদের সমালোচনা প্রসঙ্গে কুরআনে কারীমের বর্ণনা লক্ষণীয়-
واذا قيل لهم تعالوا إلى ما أنزل الله والى الرسول قالوا حسبنا ما وجدنا عليه ابائنا ، أولو كان ابائهم لا يعلمون شيئا ولا يهتدون.
অর্থাৎ, যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে ও রাসূলের দিকে আস। তারা বলে, আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের যার ওপর পেয়েছি, তা-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট। যদিও তাদের পূর্ব পুরুষগণ কিছুই জানত না এবং সৎপথ প্রাপ্তও ছিল না। [সূরা মায়িদা-১০৪]
এখানে লক্ষণীয় যে, পৌত্তলিক ধর্মানুসারীদের জবাবে একথা বলা হয়নি যে, তোমাদের পিতপুরুষ অজ্ঞ ও পথভ্রষ্ট ছিল, সুতরাং তাদের অন্ধ অনুকরণ করায় তোমরাও অজ্ঞ ও ভ্রান্ত বৈ কিছুইনা; বরং প্রশ্নমূলক শিরোনামে বলা হয়েছে যে, পিতৃপুরুষগণ যদি জ্ঞান ও সৎ পথের অধিকারী না হন এমতাবস্থা তাদের অনুসরণ কি যুক্তিযুক্ত হতে পারে? সমালোচনার এই মার্জিত রূপ মনস্তাত্ত্বিক প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে না। তবে কোন ক্ষেত্রে যদি মাদউর ভ্রষ্টতা এতই সুস্পষ্ট হয় যে, তা অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করার উপায় না থাকে, সে ক্ষেত্রে ভ্রান্তির প্রতি দ্ব্যর্থহীন মনোভাব প্রকাশ করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে এবং শক্ত শব্দ প্রয়োগে তার সমালোচনা করা যেতে পারে।
যেমন হযরত ইব্রাহীম আ. মূর্তি পূজা সম্পর্কে তার পিতাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন-
واذ قال ابراهيم لابيه ازر اتتخذ اصناما الهة اني اراك وقومك في ضلال مبين،
অর্থাৎ,স্মরণ কর, ইব্রাহীম যখন তার পিতা আযরকে বলেছিল; আপনি কি মূর্তিকে ইলাহ রূপে গ্রহণ করেন? আমি তো আপনাকে ও আপনার সম্প্রদায়কে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখছি। [সূরা আনআম-৭৪]
স্বহস্তে নির্মিত মূর্তির উপাসনা যে অসার, তা সকলেই জানেন এবং এরূপ উপাসনাকারীর ভ্রান্তি সকলের কাছেই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। তাই দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট ভাষায় ইব্রাহীম আ. তাদেরকে ভ্রান্ত বলেছেন। এরূপ ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট সমালোচনা কোন মনস্তাত্ত্বিক প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে না। কারণ, ভ্রান্তিটা সুস্পষ্ট হওয়ায় সমালোচনার ক্ষেত্রে বক্তার বক্তব্যের নতুন কোন আবেদন থাকে না। শুধু বক্তার দ্ব্যর্থহীন মনোভাবই এতে ব্যক্ত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে যেখানে এরূপ সুস্পষ্ট নয় সেখানে এক বাক্যে এরূপ দ্ব্যর্থহীন সমালোচনা সমীচীন নয়। স্বয়ং ইবরাহীম আ.-ই যখন নক্ষত্র পূজার বিপরীতে তার সম্প্রদায়ের সম্মুখে প্রমাণ পেশ করেছিলেন তখন একবাক্যে তাদের নক্ষত্র পূজাকে গোমরাহী বলে ব্যাখ্যা দেননি; বরং পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে তাদের নক্ষত্র পূজার অসারতা ফুটিয়ে তুলেছিলেন। যেহেতু নক্ষত্র পূজার অসারতা স্বহস্তে নির্মিত মূর্তি পূজার অসারতার ন্যায় সুস্পষ্ট ও জাজ্বল্যমান ছিল না। তাই নক্ষত্র পূজার সমালোচনার ও মূর্তিপূজার সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনি সেটাকে একবাক্যে ভ্রান্তি না বলে এমন এক নীতি গ্রহণ করেছিলেন যাতে জ্ঞানী শ্রোতাদের মন-মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে গঠিত সত্য অনুধাবনে প্রবৃত্ত হতে পারে। নক্ষত্র পূজার অসারতা ও অযৌক্তিকতা সাধারণ্যে সুস্পষ্ট না হওয়ার কারণে প্রথম বারেই সে ক্ষেত্রে কঠোর শব্দ প্রয়োগ করলে মনস্তাত্ত্বিক নীতি অনুসারে লোকদের মধ্যে জেদ ও হটকারিতা সষ্টির সম্ভাবনা ছিল। নক্ষত্র পূজা সম্পর্কে হযরত ইবরাহীম আ. তাঁর সম্প্রদায়ের সাথে যে মুনাজারা (বিতর্ক) করেছিলেন, কুরআনে প্রদত্ত তার বিবরণ একবার লক্ষ্য করা যেতে পারে।
فلماجن عليه اليل را كوكبا ، قال هذا ربي، فلما أفل قال لا أحب الأفلين – فلا را القمر بازغا قال هذا ربي، فلما اقل قال لئن لم يهدنی ربي لا كونن من القوم الضالين – كما را الشمس بازغة قال هذا ربي هذا آكبر، فلما افلت قال يقوم انی بريئ مما تشر گون۔
অর্থাৎ, অতপর রাতের অন্ধকার যখন তাকে আচ্ছন্ন করল, তখন সে নক্ষত্র দেখে বলল, এ-ই আমার প্রতিপালক (?)। অতপর যখন তা অস্তমিত হল তখন সে বলল, যা অস্তমিত হয় তা আমি পছন্দ করি না। অতপর যখন সে চন্দ্রকে সমুজ্জ্বলরূপে উদিত হতে দেখল, তখন সে বলল, এ আমার প্রতিপালক (?)। যখন তা-ও অস্তমিত হল, তখন সে বলল, আমাকে আমার প্রতিপালক সৎ পথ প্রদর্শন না করলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হব। পরে যখন সে সূর্যকে দীপ্তিমানরূপে উদিত হতে দেখল, তখন সে বলল, এ আমার প্রতিপালক (?) এ সর্ববৃহৎ! যখন তা-ও অস্তমিত হল, তখন সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাকে আল্লাহর সাথে শরীক কর তার সাথে আমার কোন সংশ্রব নেই। আমি একনিষ্ঠভাবে তার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি, যিনি আস মান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশিরকদের অন্তর্ভুক্ত নই।
দাওয়াতের ক্ষেত্রে পয়গম্বরদের এসব নীতি আমাদের জন্য শাশ্বত নির্দেশনা দান করে থাকে।
১০. মাদউর যোগ্যতার অকুণ্ঠ স্বীকৃতি
নবী কারীম সা. অনেক ক্ষেত্রেই অকুণ্ঠচিত্তে মাদউর যোগ্যতার স্বীকতি দিয়েছেন। যেমন আবদুল কাছেয় গোত্রের প্রতিনিধি দল আগমন করলে তাদের দলনেতা ‘আশাজ্জ’-কে লক্ষ্য করে রাসূল সা. বলেছিলেন-
ان فيك لخصلتين يحبهما الله، الحلم والاناة
অর্থাৎ, তোমার মধ্যে দু‘টি বিশেষ গুণ রয়েছে যা আল্লাহ পছন্দ করেন- ধৈর্য ও গাম্ভীর্য ।
উপরোক্ত হাদিসের শুরুতে রয়েছে এই প্রতিনিধি দলটি আগমন করলে রাসূল সা. তাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন এবং মোবারকবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন। [মুসলিম ১ম খণ্ড ৩৫ পৃষ্ঠা]
বলা বাহুল্য- এই অভ্যর্থনা, এই মোবারকবাদ ও এই যোগ্যতার স্বীকৃতি ছিল তাদেরকে প্রীত করার উদ্দেশ্যে এবং যেন তাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক আনুকূল্য সৃষ্টি হয়।
তাবুকের যুদ্ধে থাকাকালীন ইয়ামানবাসীর এক প্রতিনিধি দল রাসূল সা.-এর কাছে আগমন করলে তাদের সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছিলেন-
جاء اهل اليمن، هم ارق افئدة، الإيمان يمان، الفقه يمان والحكمة يمانية
অর্থাৎ, ইয়ামানের অধিবাসীরা এসেছে। তাদের হৃদয় বড়ই কোমল। ঈমান রয়েছে ইয়ামানবাসীদের মধ্যে, ধর্মীয় প্রজ্ঞা রয়েছে ইয়ামানবাসীদের মধ্যে এবং হিকমতও রয়েছে ইয়ামানবাসীদের মধ্যে। [মুসলিম১ম খণ্ড]
রাসূল সা.-এর দাওয়াতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মাদউর যোগ্যতার অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক আনুকূল্য লাভের সুযোগ তিনি অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণ করেছেন। সপ্তম হিজরীর শুরুতে পূর্ব রোমক বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধিপতি হেরাক্লিয়াসের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে যে পত্র তিনি লিখেছিলেন, তার শুরুর কথাগুলো ছিল এমন-
بسم الله الرحمن الرحيم من محمد عبد الله ورسوله الى هرقل عظیم الر و م سلام علی من اتبع الهدی
অর্থাৎ, পরম দয়ালু ও করুণাময় আল্লাহর নামে। আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূর মুহাম্মাদ এর পক্ষ থেকে রোমক প্রধান-হেরাক্লিয়াসের প্রতি। যে সরল পথ অবলম্বন করবে তার জন্য শান্তি।
আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী রহ. বলেন, রাসূল সা. রোমক প্রধান বলে সম্বোধন করেছেন। হেরাক্লিয়াস যেহেতু রোম অধিবাসীদের দৃষ্টিতে এরূপ মর্যাদার উপাধীতে ভূষিত ছিলেন, তাই তাকে এরূপ শব্দে সম্বোধন করা হয়েছে। এতে করে বোঝা গেল যে, কোন সম্মানী লোকের সাথে পত্রালাপ বা আলাপ আলোচনাকালে ভাল ও প্রকৃত সম্মানসূচক খেতাব প্রদান ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী নয়। এতে আরও একটি উপকারিতা রয়েছে যে, এরূপ করা হলে শক্র বন্ধু না হলেও অন্তত তার শত্রুতা হ্রাস পাবে। [ফযলুল বারী/শরহে বোখারী ১ম খণ্ড ২২৭ পৃষ্ঠা]
তিন. সময় নির্বাচন
যেনতেনভাবে দাওয়াত প্রদান করে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করা বা দায়সারা মতো দাওয়াত প্রদান ইসলামের কাম্য নয়। দাওয়াতকে ফলপ্রসু করাই কাম্য। তাই দাওয়াত প্রদানের পূর্বে সময় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কতগুলো নীতি অবলম্বন অপরিহার্য। সব সময়ই কথা গ্রহণ করার মনোভাব থাকে না, দাওয়াত দিতে গিয়েও তাই এমন সময় নির্বাচন করতে হবে যখন মাদউ বা শ্রোতার মধ্যে কথা বা দাওয়াত গ্রহণ করার মত মানসিক আনুকুল্য লাভ করা যাবে। সময় নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
১. সময় ও পরিস্থিতির আনুকল্য যাচাই করা
নবী কারীম সা. শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে সময় ও পরিস্থিতি এবং শ্রোতার আগ্রহ-অনাগ্রহের বিষয়টির প্রতিও অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। হযরত মুআয ইবনে জাবাল ও আবু মুসা আশআরী রা. কে যখন ইয়ামানে প্রেরণ করেন, তখন তাদেরকে নবী করীম সা. উপদেশ দিয়েছিলেন যে, দ্বীনকে সহজভাবে পেশ করবে কঠিন বানিয়ে নয়, লোকদেরকে দ্বীন-এর নিকটবর্তী করবে দূর করবে না। এই উপদেশে অতি সংক্ষিপ্ত ভাষায় খুব দীর্ঘ ও সুক্ষ্ম নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে।
রাসূল সা.-এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাহাবী হযরত আলী রা. তার ভাষায় রাসূল সা.-এর এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে বলেন, মানুষের মনের বিভিন্ন ঝোঁক থাকে এবং কখনও সে কথা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকে আবার কখনো থাকে না। অতএব মানুষের মনের এই আগ্রহ ও ঝোঁক বুঝে তখনই কথা বলতে হবে, যখন সে শোনার জন্য প্রস্তুত থাকে। কারণ স্বভাব হল যখন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কথা তার উপর চাপিয়ে দেয়া হয় তখন সে বেঁকে বসে এবং সে কথা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে ফেলে। [তা’লীম ও তারবিয়াত প্রবন্ধ, মাহনামা দারুল উলুম, ১৯৭৪, সেপ্টেম্বর সংখ্যা]
২. মাদউকে তার কথাবার্তা ও কাজকর্ম থেকে ফারেগ করে নেয়া
কোন বিষয়বস্তু হৃদয়ে রেখাপাত করার জন্য সেদিকে পূর্ণ মনোযোগিতা নিবিষ্ট হওয়া একান্ত আবশ্যক। যখন কেউ কোন কথাবার্তা বা কাজ-কর্মে লিপ্ত থাকে, তখন সে ব্যাপারেই তার মন কাজ করতে থাকে। সেই মুহূর্তে যদি তাকে দাওয়াত দেয়া হয়, তাহলে দাওয়াত তার মনে আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে না। কারণ একই সাথে মানুষ একাধিক বিষয়ে পূর্ণ মনোযোগিতা নিবদ্ধ করতে সক্ষম হয় না। কারণ, মনোযোগিতা বলা হয় একাধিক বিষয় থেকে সরিয়ে এনে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে চেতনাকে সীমাবদ্ধ করা। অথবা কোন একটি নির্বাচিত বিষয়কে চেতনার কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসার মানসিক প্রক্রিয়াই হল মনোযোগ। যদিও একই সঙ্গে আমরা কয়েকটি বিষয়ে মনঃসংযোগ করতে পারি, যখন আমরা কারও সঙ্গে কথা বলি তখন তার প্রতি মনোযোগ থাকে, আবার সামনে কি কথা বলব, তার মনে আমার কথা কিরূপ প্রতিক্রিয়া করছে ইত্যকার বিষয়াদি সম্পর্কে ভাবতে থাকি। এ থেকে মনে হতে পারে যে, মানুষ একই সঙ্গে একাধিক বিষয়ে মনোযোগী হতে পারে। কিন্তু পারতপক্ষে চেতনার কেন্দ্রস্থলে একটি বিষয়ই থাকা সম্ভব। একই সময়ে একটি মাত্র বিষয়েই পূর্ণ মনোযোগী হওয়া সম্ভব। অন্যান্য যেসব বিষয়ে মনসংযোগ হয়ে থাকে সেগুলো চেতনার ক্ষেত্র অধিকার করে থাকলেও চেতনার কেন্দ্রস্থলে স্থান পায় না। ফলে অন্যান্য বিষয়গুলোর প্রতি পূর্ণ মনোযোগী হওয়া যায় না। কুরআনে কারীমের একটি আয়াতে এর প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে-
ماجعل الله لرجل من قلبين في جوفه
অর্থাৎ, আল্লাহ কোন মানুষের অভ্যন্তরে দুইটি হৃদয় সৃষ্টি করেননি। [সূরা আহযাব-০৪]
সুতরাং দাওয়াতের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে মাদউর সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টির লক্ষ্যেই মাদউকে তার কথাবার্তা এবং কাজ-কর্ম থেকে ফারেগ করে নিতে হবে। বিদায় হজ্জে যখন রাসূল সা. ভাষণ শুরু করবেন, তখন হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রা. কে বললেন, তুমি লোকদেরকে কথাবার্তা থেকে নিবৃত্ত কর। অতপর তিনি ভাষণ দিলেন। [বোখারী ও মুসলিম]
আল্লামা নববী এ হাদিস থেকে দাওয়াতের এই নীতি উদ্ভাবন করেছেন যে, আলেম ও ওয়ায়েজীন (তথা দাওয়াত প্রদানকারীর) কর্তব্য শ্রোতাদেরকে কথাবার্তা থেকে নিবৃত্ত করে নেয়া, যাতে তারা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার বক্তব্য শোনে। [কিতাবুল আযকার-২৮৬]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হযরত ইকরামা রা. কে উপদেশ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, কখনও যেন এমন না হয় যে, তুমি মানুষের কাছে গেলে এবং তাদেরকে কোন কথাবার্তায় লিপ্ত পেলে আর তুমি তাদের কথার মধ্যে ছেদ টেনে তাদেরকে ওয়াজ-নসীহত করতে শুরু করলে। এরূপ করলে ওয়াজ-নসীহতের প্রতি তারা বিতৃষ্ণ হবে; বরং এরূপ ক্ষেত্রে তুমি অপেক্ষা করতে থাক, যখন তারা কথা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করবে কিংবা তাদের হাবভাবে অনুভব হবে যে, এখন তারা কথা শুনতে প্রস্তুত, তখন তোমার বক্তব্য পেশ কর।
নবী কারীম সা. ও আলোচনার পূর্বে বিভিন্নভাবে মনযোগ আকর্ষণ করে নিতেন। কখনও প্রশ্নের মাধ্যমে শ্রোতার মনযোগ নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে নিতেন, আবার কখনও কিছুটা অসম্পূর্ণ কথা বলে চুপ করে যেতেন, তারপর যখন শ্রোতাদের মধ্যে অবশিষ্ট কথা শোনার ঔৎসুক্য সৃষ্টি হত তখন সম্মুখে অগ্রসর হতেন।
এ দুটি পদ্ধতির ওপর দুটি উপমা তুলে ধরছিঃ
একদা রাসূল সা. সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা জান কি দরিদ্র কাকে বলে? সাহাবাগণ জওয়াব দিলেনঃ আমরা দরিদ্র তাকে বলি যার দেরহাম দীনার (টাকা-পয়সা) নেই। রাসূল সা. (এভাবে তাদের নাযোগ আকর্ষণ করার পর) বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত দরিদ্র সে, যে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে, তার নিকট নামায, রোজা ও যাকাত (নেক আমলের ভান্ডার) থাকবে, কিন্তু এতদসঙ্গে তার আমল নামায় এ-ও থাকবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারও উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে, কারও অর্থ আত্মসাৎ করেছে, কারও রক্তপাত ঘটিয়েছে, কাউকে প্রহার করেছে। তখন তার নেকী কিছু এই মাজলুমকে দিয়ে দেয়া হবে, কিছু ঐ মাজলুমকে দিয়ে দেয়া হবে। আর যদি অপরের অধিকারসমূহ আদায়ের পূর্বে তার নেকীসমূহ শেষ হয়ে যায়, তাহলে হকদারদের পাপসমূহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
একবার রাসূল সা. ভাষণ প্রদানের উদ্দেশ্যে মিম্বরে আরোহণ করলেন, প্রথম ধাপে পা রেখে বললেন আমীন, দ্বিতীয় ধাপে পা রেখেও বললেন আমীন, তৃতীয় ধাপে পা রাখার সময়ও অনুরূপ আমীন বললেন। এটা ছিল একটা অসম্পূর্ণ কথা এবং এ জাতীয় কথা আর কখনও তিনি বলেননি। তাই সাহাবীদের মধ্যে এরূপ কথা বলার কারণ জানার জন্য ঔৎসুক্য দেখা দেয়। ভাষণ থেকে ফারেগ হওয়ার পর মিম্বর থেকে নীচে নেমে আসলে তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন হে আল্লাহর রাসূল! আজ আমরা মিম্বরে আরোহনের সময় আপনার থেকে এমন একটা কথা শুনলাম যা ইতিপূর্বে কখনও শুনিনি। রাসূল সা. সাহাবাদের আগ্রহ এবং মনোযোগ দেখে কারণ ব্যাখ্যা করলেন যে, তখন জিব্রাঈল আমার সম্মুখে ছিলেন। যখন আমি প্রথম ধাপে পা রাখলাম তিনি বললেন : যে ব্যক্তি রমযানের মোবারক মাস পেল তবুও তার মাগফিরাত হলোনা তার ধ্বংস হোক! আমি বললাম আমীন। যখন আমি দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলাম তখন বললেন, ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি যার সম্মুখে আপনার নাম আসার পর দরুদ পাঠ করল না। আমি বললাম আমীন। তারপর যখন তৃতীয় ধাপে পা রাখলাম, তখন তিনি বললেন, ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি, যে তার মাতা-পিতা অথবা উভয়ের কোন এক জনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল অথচ তাদের খেদমত করে জান্নাত অর্জন করতে পারল না। আমি বললাম আমীন।
কখনও কখনও কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণনার পূর্বে রাসূল সা. কয়েকবার শ্রোতাকে নাম ধরে ডেকে তার পূর্ণ মনোযোগ আকর্ষণপূর্বক বিষয়টি ব্যক্ত করতেন। হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. বলেন, একদা আমি নবী কারীম সা.-এর বাহনের পিছনে বসা ছিলাম। আমার ও নবী সা.-এর মাঝে হাওদার (উটের পিঠের আসনের) কাষ্ঠখণ্ড ছাড়া আর কোন ব্যবধান ছিল না। নবী সা. বললেন, হে মুআয ইবনে জাবাল! আমি আরয। করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বান্দা হাজির; আপনার আনুগত্য শিরোধার্য। তারপর তিনি কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আবার বললেন, হে মুআয ইবনে জাবাল! আমি আরয করলাম, বান্দা আপনার খিদমতে হাজির; আপনার আনুগত্য শিরোধার্য হে আল্লাহর রাসূল! তারপর তিনি কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আবার বললেন, হে মুআয ইবনে জাবাল! আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! বান্দা আপনার খিদমতে হাজির; আপনার আনুগত্য শিরোধার্য। তিনি বললেন তুমি কি জানো বান্দার উপর আল্লাহ জাল্লা শানুহুর কি হক রয়েছে? আমি আরয করলাম, আল্লাহ এবং তার রাসূলই ভাল জানেন। নবী সা. বললেন, বান্দর উপর আল্লাহর হক এই যে, তারা তার ইবাদত করবে এবং তার সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করবে না। তারপর কিছুদূর চললেন। নবী সা. আবার বললেন, হে মুআয ইবনে জাবাল! আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! বান্দা আপনার খিদমতে হাজির; আপনার আনুগত্য শিরোধার্য। নবী সা. বললেন তুমি কি জান, এগুলো করলে আল্লাহর কাছে বান্দার কি হক আছে? আমি আরয করলাম আল্লাহ ও তার রাসূল ভাল জানেন। নবী সা. বললেন, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিবেন না।
দাওয়াতী কাজে হতাশা ও স্থবিরতা রোধের মনস্তাত্ত্বিক ব্যবস্থাপত্র
দাওয়াত কর্মে হতাশা ও স্থবিরতা দেখা দেয়ার কয়েকটি কারণ হতে পারে।
এক. দাওয়াত একটি সময় ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনা সাপেক্ষ কাজ। এ কাজে তড়িৎ ও তাৎক্ষণিকভাবে ইপ্সিত ফল লাভ হয় না। ফলে তাড়াহুড়ার মেজায সম্পন্ন দায়ীর মধ্যে প্রেষণা অপূর্ণ থাকার কারণে হতাশা ও স্থবিরতা দেখা দিতে পারে।
দুই. দায়ীকে একটি বিরূপ মন-মানসিকতা সম্পন্ন সমাজের পরিশুদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করতে হয়। তাই অনেক সময়ই তাকে কায়েমী স্বার্থবাদীদের হুমকি, বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়। অনেকের নিন্দা, তিরস্কার ও সমালোচনার মুখােমুখী হতে হয়। এটাও দায়ীর মধ্যে। হতাশা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তিন. কখনো বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে লোভ-লালসা বা স্বার্থের আকর্ষণ দ্বারা দায়ীকে তার স্থির লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করার অপচেষ্টা চালানো হয়। এসব তিক্ত ও বিড়ম্বনাকর পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই দায়ীর মধ্যে দাওয়াত কর্মে স্থবিরতা দেখা দিতে পারে কিংবা দৃঢ়তার অভাব দুষ্ট দায়ী আপন লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে দাওয়াতী কাজের অব্যাহত গতিতে অবাঞ্ছিত স্থবিরতা সৃষ্টি করতে পারে। সম্ভাব্য এই হতাশা ও তা রোধকল্পে ইসলাম যে সব মনস্তাত্ত্বিক ব্যবস্থাপত্র দান করেছে তা নিম্নরূপ :
১. দায়ী প্রথমত মনে করবে যে, যতটুকু কাজ করবে তার ছওয়াব সে পেয়ে যাবে, তার দাওয়াতের ফলাফলের ওপর তার ছওয়াবকে নির্ভরশীল রাখা হয়নি। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে-
الدال على الخير كفاعله
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি কোন ভাল কাজের পথ দেখায়, সে ঐ ভাল কাজ করার মতো সাওয়াব পায়। [আল-মাকাসিদুল হাছানা]
২. বাহ্যিক ফলাফল লাভ হওয়া না হওয়ার উপর ব্যক্তির সফলতা ব্যর্থতা নির্ভরশীল নয়; বরং ব্যক্তি কতটুকু কাজ করতে পারল বা পারলনা এরই নিরিখে তার সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ণিত হবে।
হযরত নূহ আ. নয়শত বৎসর দাওয়াত দিয়েছিলেন, অথচ তার অনুসারী হয়েছিলেন খুবই অল্প সংখ্যক লোক। তাই বলে কি তিনি ব্যর্থ ছিলেন? কুরআনে কারীমে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
وما امن معه الا قليل
অর্থাৎ, তার সঙ্গে ঈমান এনেছিল মাত্র অল্প কয়েকজন। [সূরা হুদ-০৪]
হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় কোন কোন নবীর অনুসারী ছিলেন দশের কম, কোন কোন নবীর অনুসারী মাত্র পাঁচজন এবং কোন কোন নবী এমনও অতিবাহিত হয়েছেন যাদের সারা জীবনে একজনও অনুসারী হয়নি। কিয়ামতের দিন তিনি একাই উঠবেন। [বোখারী ২য় খণ্ড, ৯৬৮ পৃষ্ঠা]
অতএব নিজের দাওয়াতের ফলাফল প্রকাশ না হতে দেখে ব্যর্থতা অনুভব করা আদৌ ঠিক নয়। কুরআনে কারীমে এই মানসিকতা সৃষ্টিকল্পে রাসূল সা. কে সম্বােধন করে বলা হয়েছে-
فان اعرضوا فما ارسلناك عليهم حفيظا، إن عليك الا البلاغ
অর্থাৎ, তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে (তুমি দুঃখিত বা হতাশ হবে না) তোমাকে তো আমি তাদের রক্ষক করে পাঠাইনি, তোমার কাজতো কেবল প্রচার করে যাওয়া। [সূরা শুরা-৪৮]
অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
انك لاتهدى من احببت ولكن الله يهدي من يشاء
অর্থাৎ, তুমি যাকে ভালবাস (ইচ্ছা করলেই) তাকে সৎ পথে আনতে পারবে না, তবে আল্লাহই যাকে ইচ্ছা সৎ পথে আনয়ন করেন। [সূরা কাসাস-৫৬]
৩. যারা বিরোধিতা, ষড়যন্ত্র ও নির্যাতন বা নিন্দা ও সমালোচনার মুখে পড়ে মন ভেঙ্গে বসেন এমনকি ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিপক্ষের জন্য অকল্যাণও কামনা করে বসতে পারেন, তাদের মানসিক স্বস্তির জন্য ইসলাম নিম্নোক্ত মনস্তাত্ত্বিক ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেছে।
এক. হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব এক চিরাচরিত ও স্বাভাবিক নিয়ম, বাতিলের বিরোধিতা, ষড়যন্ত্র, দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন বা নিন্দা আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। পৃথিবীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত হকপন্থীগণ এসব অবাঞ্চিত বিষয়ের শিকার হয়ে আসছেন।
অতএব এটা চিরাচরিত বিষয়- এরূপ মনে করে নিতে হবে। তাহলে কষ্টবোধ লাঘব হবে। কেননা মানুষ যখন কোন কষ্টকর বিষয়ে অনেককে জড়িত দেখতে পায় তখন তার কষ্টবোধ অনেকটা সাধারণ ও স্বাভাবিক মনে হয়। বিভিন্ন কষ্টকর বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সান্ত্বনা প্রদান নীতি কুরআন-হাদিসে অনুসৃত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ রোযা একটা কষ্টকর ইবাদত, এই রোযার বিধান বর্ণনা করে বলা হয়েছে-
کما کتب على الذين من قبلکم۔
অর্থাৎ, যেরূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর। [বাকারা-১৮৬]
অন্যত্র কুরবানীর বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে-
ولكل امة جعلنا منسکا۔
অর্থাৎ, আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি। [সূরা হজ্জ-৩৪]
অনুরূপভাবে দাওয়াতের অঙ্গনেও নানারূপ বিরোধিতা, ষড়যন্ত্র, নির্যাতন ও নিন্দা-সমালোচনার মুখোমুখী হওয়া স্বাভাবিক। এটা কোন নতুন পরিস্থিতি নয়, সকল নবী ও হক পন্থীরাই এর শিকার হয়েছেন। এটা বোঝানোর জন্য কুরআনে নবীদের প্রতিপক্ষের বিরোধীতা, নির্যাতন ও নিন্দা সমালোচনার শিকার হওয়ার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যাতে দাঈ এটাকে স্বাভাবিক ও সাধারণ মনে করে মানসিক সান্তনা লাভ করতে পারে এবং মান ইজ্জত সব বিসর্জন দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ-
ان الذین اجرموا كانوا من الذين آمنوا يضحكون، واذا مروابهم يتغامزون، واذا نقلبوا الى أهلهم ان قلبوا فكهين، واذا را هم قالو إن هؤلاء لضالون ۔
অর্থাৎ, যারা অপরাধী তারাতো মুমিনদেরকে উপহাস করত এবং তারা যখন মুমিনদের নিকট দিয়ে যেত, তখন চক্ষু টিপে ইশারা করত এবং যখন নিজেদের আপনজনদের নিকট ফিরে আসত তখন তারা ফিরত উৎফুল হয়ে। আর যখন তাদেরকে (মুমিনদেরকে) দেখতো, তখন বলতো, এরাই তো পথভ্রষ্ট। [সূরা মুতাফফিফীন ২৯-৩২]
والی عاد أخاهم هودا، قال يقوم اعبدوا الله ما لكم من إله غيره إن أنتم إلا مترفون، قالوايا
هود ما جتنا ببينة وما نحن بتارکى الهتناعن قولك وما نحن لك بمؤمنین، ان نقول الا اعتراك بعض الهتنا بسوء
অর্থাৎ, আদ জাতির নিকট তাদের ভ্রাতা হুদকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন ইলাহ নেই। তোমরা তো কেবল মিথ্যা উদ্ভাবনকারী।
তারা বলল, হে হুদ! তুমি আমাদের নিকট কোন স্পষ্ট প্রমাণ আনয়ন করনি, তোমার কথায় আমরা আমাদের ইলাহদের পরিত্যাগ করছি না এবং তোমাতে আমাদের বিশ্বাস নেই। আমরাতো এই বলি যে, আমাদের ইলাহদের মধ্যে কেউ তোমাকে অশুভ শক্কি দ্বারা আবিষ্ট করেছে। (অর্থাৎ, তোমার মাথা খারাপ করে। দিয়েছে।) [সূরা হুদ ৫০-৫৪]
قالوا ياشعيب ما نفقه كثيرا مما تقول وإنا لنراك فينا ضعيفا، ولولا رهطك لر جمناك وما أنت علينا بعزیز،
অর্থাৎ, তারা বলল হে শুআইব! তুমি যা বল তার অনেক কথা আমরা বুঝি না এবং আমাদের মধ্যে তোমাকে আমরা দুর্বলই দেখছি। তোমার স্বজনবর্গ না থাকলে আমরা তোমাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলতাম। আমাদের উপর তুমি শক্তিশালী নও। [সূরা হুদ-৯১]
এরকম বহু আয়াতে বিভিন্ন নবীর প্রতি তাদের সম্প্রদায়ের নিন্দা ও তিরষ্কারের বিষয় বর্ণিত হয়েছে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- হযরত যাকারিয়া আ. কে এই দাওয়াতেরই কারণে করাত দিয়ে দ্বিখন্ডিত করে ফেলা হয়েছিল। কোন নবীকে জীবন্ত প্রোথিত করে দেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য-এসব বর্ণনা দায়ীর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিকভাবে সান্তনা সৃষ্টি করবে নিঃসন্দেহে।
দুই. প্রতিপক্ষের থেকে যেসব নির্যাতন, কটুক্তি ও নিন্দা সমালোচনা হয়। এটা তাদের নির্বুদ্ধিতার কারণেই হয়ে থাকে, কেননা তাদের সত্যিকার বোধোদয় হলে তারা কখনও এমন আচরণ করত না। মহানবী সা. তায়েফে গিয়ে সেখানকার লোকদের দ্বারা নিগৃহীত ও নির্যাতি হওয়ার পর কাতর কণ্ঠে আল্লাহর দরবারে দু’আ করে বললেন-
اللهم اهد قومى فإنهم لا يعلمون۔
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমার (এই অবুঝ) সম্প্রদায়কে হেদায়াত দান কর, কেননা তারব অবুঝ।
তায়েফ বাসীদের প্রতি ক্ষিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে তাদের প্রতি মহানবীর করুণা আরও উদ্বেলিত হয়ে উঠল। এই চেতনা সৃষ্টি হলে যুলুম-নির্যাতন, নিন্দা গালমন্দ কখনো দায়ীকে হতোদ্যম করতে পারবে না; বরং নির্যাতন, নিপীড়ন, কটুক্তি, সমালোচনা যতই তীব্র হবে, তাদের প্রতি করুণা ততই বৃদ্ধি পাবে। ফলে দাওয়াতও পূর্বাপেক্ষা জোরালো হতে থাকবে। দায়ী তখন নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাওয়ার মত এক অদম্য স্পৃহা লাভ করবে।
মাদউকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আরও একটা কারণ এই যে, সে প্রতিনিয়ত শয়তানের প্ররোচনার শিকার হয়ে চলছে, শয়তানই তার কুকর্মকে তার কাছে সুন্দররূপে প্রতিভাত করে দেখাচ্ছে। অতএব তাকে দাওয়াত দেয়া থেকে বিরত না হয়ে বরং তাকে আরও অধিক বোঝানোর প্রচেষ্টায় রত হওয়া উচিৎ। তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে তার জন্য বদ দু‘আর পরিবর্তে বরং তার প্রতি করুণা সিক্ত হয়ে তার জন্য দু’আ করা উচিৎ। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
الم تر انا ارسلنا الشياطين على الكافرين تؤزهم ازّا ، فلا تعجل عليهم
অর্থাৎ, তুমি কি লক্ষ্য করনি যে, আমি কাফেরদের উপর শয়তানদের ছেড়ে দিয়েছি। তারা তাদেরকে বিশেষভাবে (মন্দ কর্মে) উৎসাহিত করে, সুতরাং তাদের জন্য তাড়াহুড়া (করে আযাবের দরখাস্ত) করোনা। [সরা মায়া ৮৩-৮৪]
তিন. নিন্দা, সমালোচনা, কটুক্তি, নির্যাতন, নিপীড়ন যারই সম্মখীন এ দায়ীকে হতে হয়, এসব কিছুরই বিনিময়ে রয়েছে তার জন্য অফুরন্ত পুরস্কার। প্রতিকূলতার মুখে ধৈর্যের পরিচয় দিতে পারলে সেই ধৈর্যের বিনিময়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে অফুরন্ত নেয়ামত সমৃদ্ধ জান্নাত। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-
والصبر ثوابه الجنة
অর্থাৎ, আর সবর; তার পুরস্কার জান্নাত।
মহা পুরস্কারের এই বিশ্বাস যদি দায়ীর অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায়, তাহলে প্রতিকুলতা দেখে সে কর্মে ক্ষ্যান্ত দিবে না, নিন্দা তিরস্কার ও সমালোচনার মুখে সে কুষ্ঠিত হবে না, নির্যাতন নিপীড়ন কোন কিছুই তাকে হতোদ্যম করতে পারবে না। ভবিষ্যত ফসল প্রাপ্তির আশায় কৃষক যেমন রোদ, বৃষ্টি, ঝড় অকাতরে সয়ে যায়, সুস্থতা লাভের বাসনায় রোগী যেমন তিক্ত বিস্বাদ ঔষধ স্মিতচিত্তে গলধকরণ করতে দ্বিধাবোধ করে না, সুন্দর ফুটফুটে একটি সন্তানের নতুন মুখ দর্শনের স্বপ্নে জননী যেমন গর্ভধারণের কষ্টে আবেগ উৎফুল্লতা বোধ করে, তেমনিভাবে অনন্ত অফুরন্ত পুরস্কারের বিশ্বাস দায়ীর মধ্যেও সব প্রতিকূলতা বরদাশত করার এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি সৃষ্টি করবে। হতোদ্যম ও স্থবিরতা রোধের এ এক অনন্য মনস্তাত্ত্বিক ব্যবস্থাপত্র।
দায়ীর সামনে যখন স্বার্থের হাতছানি দেখা দেয়, লোভ-লালসা যখন তার দৃঢ়তায় চিড় ধরাতে চেষ্টা করে, শয়তানী কুমন্ত্রণা নাফরমানী ও খাহেশাত মানস্পটে পদার্থকে লোভনীয় করে তোলে, তখন মনস্তাত্তিকভাবে তাকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দায়ীকে তখন আল্লাহ প্রদত্ত্ব মহান মর্যাদার আসন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। দুনিয়ার হেয়তা, পদার্থের তুচ্ছতা, সম্পদ ঐশ্বর্যের নগন্যতা এবং আল্লাহ প্রদত্ত পুরস্কারের শাশ্বত্ব ও অনন্যতার অনুভূতি অন্তরে জাগ্রত করে তুলতে হবে।
হযরত সুলায়মান আ. যখন রাণী বিলকিসের কাছে দাওয়াতপত্র প্রেরণ করেন এবং রাণী বিলকিস সুলায়মান আ.-এর হাক্কানিয়াতকে পরীক্ষা করার জন্য হাদিয়া উপঢৌকন প্রেরণ করেছিল, তখন সুলায়মান আ. তার জবাবে বলেছিলেন,
اتمدوننی بمال، فما أتاني الله خير مما آتاكم ۔
অর্থাৎ, তোমরা ধন-সম্পদ দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। সূরা নাম্ল-৩৬]
আপনার সম্পদ ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে এই স্বকীয়তার অনুভূতি, এই আত্মমর্যাদাবোধ দায়ীর সামনে বিস্তৃত লালসার প্রসারিত হাতকে গুড়িয়ে দিবে; বরং তার সামনে যেন এরূপ হস্ত প্রসারিত হতে না পারে, এরূপ মানসিক বিড়ম্বনার সম্মুখীন যেন তাকে হতে না হয়, সে জন্য প্রথম থেকেই তাকে যেমন নিঃস্বার্থ মনোভাব নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে তেমনিভাবে প্রতিপক্ষকে এ কথা বুঝিয়ে দিতে হবে যে, তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান আমাদের চাওয়ার নেই। আম্বিয়ায়ে কেরাম আ. তাই দাওয়াতের সময় উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করতেন-
لا أسألكم عليه أجرا أن أجرى الا على الله –
অর্থাৎ, আমি এর পরিবর্তে তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান আশা করিনা, আমার প্রতিদান তো রয়েছে আল্লাহর নিকট।
কুরআনে কারীমের বহু সংখ্যক আয়াতে বিভিন্ন নবীদের দাওয়াত প্রসঙ্গে একথা উল্লেখিত হয়েছে। নবীদের উসওয়া জীবনের সকল ক্ষেত্রের জন্যেই প্রযোজ্য।
[স্বীকারোক্তি : এই নিবন্ধের বেশিরভাগ অংশই মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন দা. বা. রচিত ইসলামী মনোবিজ্ঞান বই থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।]
নূরুল করীম আকরাম, একজন দাঈ-ইলাল্লাহ