আজ ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ বৃহস্পতিবার | ১৭ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি | ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

এখন সময়- সন্ধ্যা ৬:৩৬

আজ ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ বৃহস্পতিবার | ১৭ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি | ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

তাসাওউফ তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ

শাব্দিক বিশ্লেষণ
তাসাওউফ শব্দটি মূল ধাতু সূফ হতে উৎপন্ন। সূফ অর্থ পশম আর তাসাওউফের অর্থ পশমী বস্ত্র পরিধানের অভ্যাস (লাবসু আস-সূফ)। মরমী তত্ত¡ ও আধ্যত্মিক সাধনায় কারো জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি নিজেকে এরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন, ইসলামের পরিভাষায় তিনি সূফী নামে অভিহিত হন। বর্ণিত আছে এ মরমী তত্তে¡র সাধনায় যারা নিয়োজিত থাকতেন তারা সাধারণত সূফ বা পশমী কপড় পরিধান করতেন বলে তাদের কে সূফী হিসেবে অভিহিত করা হতো।১ অথবা তাসাওউফ শব্দটি صفى (সফিয়্যূন) থেকে উৎপন্ন। যার অর্থ হলো পাক-সাফ, পরিচ্ছন্ন করা। মরমী তত্তে¡র সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করে সে তার অন্তরাত্মাকে সকল প্রকার গর্হিত-অন্যায় ও পাপ পঙ্কিলতা থেকে পাক, পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে ফলে তিনি সূফী (পরিচ্ছন্নতা অর্জনকারী) নামে খ্যাত হন।
অতীত ও বর্তমান যুগে ‘সূফী’ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে আরও যেসব উক্তি করা হয় তার সবই প্রত্যাখ্যানযোগ্য। যেমন আহলুস সুফ্ফা (নববী যুগে মদীনার মসজিদ সংলগ্ন স্থানে অবস্থানরত সংসার-নির্লিপ্ত সাধকগণ। কেউ কেউ বলেছেন, সাফফাল আওয়াল (সালাতে দন্ডায়মান মুসল্লীদের প্রথম কাতার) থেকে এর উৎপত্তি। অনেকে বলেছেন, বানূ সূফা (একটি বেদুইন গোত্র) থেকে উৎপন্ন। অনেকে বলেছেন, সাওফানা (এক প্রকার শাকসবজী)। কেউ বলেছেন, সাফওয়াত আলকফা (মাথার পিছনে ঘাড়ের দিকের কেশগুচ্ছ) থেকে এর উৎপত্তি।

পারিভাষিক সংজ্ঞায়ন
তাসাওউফের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ইবনে আবেদীন আল্লামা শামী বলেছেন,
علم القلب اى علم الاخلاق وهو علم يعرف به انواع الفضائل وكيفية الكشابها وانواع الرزائل وكيفيته اجتنا بها-
যে জ্ঞানের সাহায্যে মানুষের সদগুণ সমূহের প্রকারভেদ এবং তা উপার্জনের পন্থা ও অসৎগুণ সমূহের শ্রেণীবিভাগ এবং তা থেকে আত্মরক্ষার পন্থা অবগত হওয়া যায়; তাকে ইলমে ক্বালব বা ইলমে তাসাওউফ বলে।২ ব্যক্তি বিশেষ নামের সাথে আস-সূফী উপনাম বা উপাধির প্রথম প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। এ সময় কুফার প্রসিদ্ধ পদার্থ বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়্যান এবং সে শহরেরই ¯^নামখ্যাত মরমী আবু হাসিম ব্যক্তিগতভাবে আস সূফী উপনামে পরিচিত হন। প্রথমোক্ত ব্যক্তি তার নিজ¯^ বৈরাগ্যসূচক মত প্রকাশ করেন। আলেকজান্দ্রিয়ায় একটি ক্ষুদ্র অভ্যুত্থান উপলক্ষে ৮১৪ খ্রিস্টাব্দে সূফির বহুবচন সুফিয়্যা শব্দের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়।৩
আল্লামা জাহিজ তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল-বায়ানে বলেন, ঐ সময় কুফায় আবির্ভূত একটি মরমীবাদী আধাশিয়া সম্প্রদায়ের উপরও এর প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়। এ সময় পর্যন্ত সূফী শব্দের ব্যবহার কুফার সীমান্তেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু সূফীবাদ সম্ভাবনাময় এক ভবিষ্যতের জন্য প্রতীক্ষমান ছিল। ৫০ বছর পর্যন্ত সূফী বলতে ইরাকের মালামাতীয়া মরমীদের বিপরীত সকল মরমীদেরকে বোঝাত। দু’শত বছর পর সুফিয়্যা (বহুবচন) শব্দ সমগ্র মুসলিম মরমী সম্প্রদায়ের উপর প্রযুক্ত হতে লাগলো। যেমন আধুনিক কালে ইংরেজি ভাষায় ‟টঋও ও ঝটঋওঝগ” শব্দদ্বয় এখনও ব্যবহৃত হয়। দু’শ বছর পর হতে এ পর্যন্ত এটি একটি অন্যতম মত বিশেষ মুসলিম জীবনরীতি রূপে ¯^ীকৃতি লাভ করেছে।৪
আল্লামা ইবনে তায়মিয়্যা (রহ.) বলেন, ‘সূফী’ শব্দটি ইসলামের প্রাথমিক তিন যুগ তথা রাসূল সা. সাহাবী ও তাবিয়ীদের যুগে প্রসিদ্ধ ছিলনা। এ তিন যুগের পরে এটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। এ ব্যাপারে শুরুর দিকে ইমাম ও ফকীহ যেমন ইমাম আহমদ ইবনে হা¤^ল, আবু সুলায়মান দারানী প্রমূখ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। তবে সুফিয়ান সাওরি ও হাসান বসরী থেকে এ ব্যাপারে মতামত পাওয়া যায়। ৫
তাসাওউফের যে উদ্দেশ্য- ‘নিজেকে পরিচ্ছন্ন করা’, ‘আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা’ এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে ‘তাজকিয়া’ ও ‘ইহসান’ শব্দ প্রয়োগ হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে- قد افلح من تزكى সফলকাম সে ব্যক্তি, যে নিজেকে পাক-পবিত্র করেছে।৬
হাদীসে ইহসান সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাসূল সা. বলেছেন, ان تعبد الله كأنك تراه তুমি এমনভাবে ইবাদত কর যেন আল্লাহকে দেখছো।৭

১. মাজমু‘য়াতুল ফাতাওয়া, তকীউদ্দীন আহমদ ইবনে ইমাম তায়মিয়্যাহ-খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ০৬
২. রদ্দুল মুহতার, ইবনে আবেদীন আশশামী-খণ্ড ০১, পৃষ্ঠা ৩১
৩. কুদাত (মিসর), আলকিন্দী-পৃষ্ঠা ১৬২
৪. বায়ান-খণ্ড ০১, পৃষ্ঠা: ১৯৪
৫. মাজমুয়াতুল ফাতাওয়া, তকীউদ্দীন আহমদ ইবনে ইমাম তায়মিয়্যাহ-খণ্ড ১১,পৃষ্ঠা ৫-৬
৬. সূরা আ’লা, আয়াত-১৪
৭. মুসলিম-খণ্ড ০১ পৃষ্ঠা ২৯

উৎপত্তি ও প্রসার
কুরআনের সূফী তাত্তি¡ক তাফসীর এবং রাসুল সা. এর অন্তর্জগৎ সম্পর্কীয় তত্ত¡গর্ভ হাদীস সমূহ অপেক্ষাকৃত পরবর্তী যুগের সংকলন। কিন্তু পৃথিবীর সব দেশ ও জাতির ভেতর মরমী জীবনের প্রতি যে প্রবণতা পরিদৃষ্ট হয়, হিজরী সনের প্রথম দুই শতাব্দীও তা থেকে মুক্ত ছিলনা। আমরা দেখতে পাই আল্লামা জাহিয ও ইবনে জাওযী এ যুগের চল্লিশজন নিষ্ট সংসার বিরাগী সূফীর নাম আমাদের জন্য সংরক্ষণ করে গেছেন। ইবাদত-উপাসনার আনুষ্ঠানিক আচার-পদ্ধতির অন্তর্নিহীত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপই ছিল তাদের মরমী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কারণ ইসলাম সংসার বৈরাগ্য অনুমোদন দেয়না। রাসুল সা. বলেছেন, “লা রাহবানিয়্যাতা ফিল ইসলাম” তথা ইসলামে বৈরাগ্যের স্থান নেই। এ হাদীসটি মূলতঃ কুরআনে কারীমের সূরা হাদীদের ২৭ নং আয়াতেরই ব্যাখ্যা। সেখানে বলা হয়েছে, “বৈরাগ্য আমি তাদের (খ্রিস্টানদের) জন্য বিধিবদ্ধ করিনি। তারাই তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে পালন করেনি। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, ইসলাম সম্মত যুহুদ (দুনিয়াবিমুখতা) হল, নফলসহ সকল ইবাদতসমূহ যথাযথভাবে সম্পাদন ও সর্বপ্রকার জাগতিক বস্তুর প্রতি আকর্ষণ না থাকা। যাতে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়। সুতরাং নফল ইবাদতেও সীমাতীত বাড়াবাড়ি; যথা সারা জীবন নফল সিয়াম পালন, স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যকে অবহেলা করে সারারাত সালাতে রত থাকা, সংসার বিরাগী হয়ে বিবাহ না করা ইত্যাদি কোনো কালেই ইসলাম সমর্থন করেনি।৮
পক্ষান্তরে খ্রিস্টীয় বৈরাগ্য বলতে বুঝায়, কতগুলো মানুষ (নারী-পুরুষ) বিবাহ না করে নিজেকে কোনো গির্জার সাথে সংশ্লিষ্ট করা। এদের পুরুষদেরকে গড়হশ বা সন্ন্যাসী আর নারীদেরকে ঘঁহ বা সন্ন্যাসিনী বলা হয়। (হিন্দুদের মাঝে কিয়দাংশে বিকৃত রূপে এ প্রথা চালু আছে) এরা আজীবন কুমার-কুমারী থাকে। পবিত্র বিবাহ বন্ধন ও ¯^ামী-স্ত্রীর যৌন মিলনকে খ্রিষ্ট ধর্মে ঘৃনার চোখে দেখা হয় বলে এ প্রথার উদ্ভব। তাছাড়া ‘সন্তান উৎপাদন করে আদি মানবের পাপ বাহকের সংখ্যা বৃদ্ধি না করা’র মনোবৃত্তিও এই মনোভাবের অন্যতম কারণ।
কিন্তু বাস্তবে খ্রিস্ট জগতের ভেতরগত অবস্থা খুবই ভয়াবহ। প্রকৃত তথ্যানুন্ধানে দেখা যায়, ইউরোপ-আমেরিকার বহু গির্জা যৌন চাহিদা চরিতার্থের কেন্দ্র-বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বাহ্যিকভাবে এখানের কুমার-কুমারী, ফাদার-মাদাররা যৌন খেলায় মেতে ওঠে। বিগত বছরে বিবিসির প্রতিবেদক মিজানুর রহমানের এক তথ্যমূলক প্রতিবেদনে এ চিত্রের অনেকটাই ফোটে উঠেছে। উল্লেখ্য যে, বর্তমান পোপের সদ্য পূর্বসূরী পোপ তার দায়িত্ব মেয়াদকাল পূর্ণ না করেই পদত্যাগ করেন। এর প্রকৃত কারণ খ্রিস্ট জগত প্রকাশ না করলেও মিডিয়াজগত খুঁজে বের করেছে। তার পদত্যাগের পেছনে ছিল গির্জাগুলোর ভেতরগত যৌন নষ্টামি। তাই তিনি মর্মাহত হয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। আর হিন্দু সন্ন্যাসীদের কথা তো গুরুমিত রাম রহিম সকলকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
ইসলাম এ প্রকার সন্ন্যাসকেই নিষেধ করেছে। রাসুল সা. বলেছেন, النكاح من سنتى فمن رغب عن سنتى فليس منى “বিবাহ আমার সুন্নাত, যে আমার সুন্নাত অবহেলা করে এ থেকে বিমুখ হবে সে আমার দলভুক্ত নয়।” উপরে উদ্ধৃত হাদীস থেকে বোঝা যায়, খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসবাদকে তাদের নিজেদের উদ্ভাবিত বলে নিন্দা করা হয়েছে। তা আল্লাহকর্তৃক বিধিবদ্ধ জীবন ব্যবস্থা নয়। ইসলামের প্রসিদ্ধ সুফীগণের অনেকেই বিবাহিত ও সংসারী অথচ কঠোর সংযমীও যাহিদ ছিলেন।
সাহাবীদের মাঝে হযরত আবু যার গিফারি, হযরত হুযায়ফা ও হযরত আলী রা. কে সুফী মতবাদের প্রকৃত অগ্রদূত বলা যেতে পারে। তাদের পর একের পর এক বহু তাপস (নসসাক, যুহহাদ) অনুশোচক বা বিলাপকারী (বাকাউন) এবং কথক ধর্মপ্রচারকের আবির্ভাব ঘটে। শুরুতে জনসমাজ হতে বিচ্ছিন্ন থাকলেও পরে ধীরে ধীরে মুসলিম চিন্তাধারার অন্যান্য শাখার সুদক্ষ ব্যক্তিদের মত প্রধানত দুটি পৃথক সম্প্রদায়ে তারা বিভক্ত হন। আরবীয় মরু অঞ্চলের মেসোপটেমিয়া সীমান্তের বর্ধিষ্ণু দুটো শহর ‘বসরা এবং কুফা’য় দু সম্প্রদায়ের পৃথক কর্মকেন্দ্র গড়ে উঠে।
বসরার আরব্য উপনিবেশিকগণ ছিলেন তামীমী (গোত্র) মূলোদ্ভূত, প্রকৃতিগতভাবে বাস্তববাদী সমালোচক। তারা হাদীস ও সুন্নাহয় বিচার বিশ্লেষণের পক্ষপাতী ছিলেন। এদের সূফীদের প্রধান ছিলেন হাসান বসরী, মালিক ইবনে দীনার, ফাদল রাককাশী, সালিহ মুররী এবং আব্দুল ওয়াহিদ ইবনে যায়েদ। অপর দিকে কুফার আরবীয় ঔপনিবেশিকগণ ইয়ামানী মূলোদ্ভূত। তারা ছিলেন আদর্শবাদী এবং প্রকৃতিগত ভাবে ঐতিহ্যানুরাগী। হাদীসের প্রকাশ্য অর্থের প্রতি অনুরাগী, ধর্ম বিশ^াসে মুজিযা প্রবণতাযুক্ত শীয়াপন্থী। তাদের সূফী তত্তে¡র উস্তাদ ছিলেন রাবী ইবনে খায়ছাম, (৬৭/৬৮৬) আবু ইসরাঈল মূলাঈ (১৪০/৭৫৭) জাবির ইবনে হাইয়্যান, কুলায়ব আস্সরদানী, মানসুর ইবনে আম্মার, আবু আল আতাহিয়্যা এবং আবদক। শেষের তিনজন তাদের শেষ জীবন অতিবাহিত করেন মুসলিম সা¤্রাজ্যের (তৎকালীন) রাজধানী বাগদাদে। বাগদাদ ২৫/৮৬৪ এর পর মুসলিম মরমী আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এসময়ই সর্ব প্রথম ধর্মীয় আলোচনা এবং যিকর আযকারের হালকা অনুষ্ঠানের জন্য মিলনায়তনের উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া মসজিদ গুলোতেও সুফীবাদের উপর প্রকাশ্য আলোচনা এবং বক্তৃতা দানের সূচনা হয়। এ যুগেই শরীয়তপন্থী ধর্মতাত্তি¡কদের সাথে মরমী সূফীদের মতবিরোধ প্রকাশিত হয়। ক্রমে এ বিরোধ চরমে পৌঁছায়। ফলে যুননুন মিসরী, (২৪০/৮৫৪) নুরী ও আবু হামযা (২৬২/৮৭৫), এবং হাল্লাজ বাগদাদের কাযীদের নিকট অভিযুক্ত হন।৯

৮. মিশকাত-পৃষ্ঠা ২৭, বুখারী-খণ্ড ০২, পৃষ্ঠা ৭৫৭
৯. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, খণ্ড ০১, পৃষ্ঠা ৪৯৬

আধ্যাত্মিক মিলনবাদের বিবর্তন
দু’টি ¯^ীকার্য বিষয়ের উপর আদি সূফীবাদ প্রতিষ্ঠিত।
১. ইবাদতের ঐকান্তিক অনুশীলন আত্মাতে এমন কিছু মঙ্গলজনক অবস্থা সৃষ্টি করে; যা অশরীরী কিন্তু বোধগম্য সত্য।
২. আধ্যাত্মবিদ্যা (ইলমুল কুলুব) আত্মাতে প্রজ্ঞা (মারিফাত) জন্মায়। এতে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের জন্য সাধকের ইচ্ছে শক্তি উদ্দীপ্ত হয়। (এ ¯^ীকার্য মুতাযিলীগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত, তারা তাত্তি¡ক মনস্তত্তে¡ সন্তুষ্ট)
সুফীগণের বক্তব্য হলো, আধ্যাত্মবিদ্যার প্রগতিশীল প্রকৃতি সাধকের খোদা প্রাপ্তির সফরকে নির্দিষ্ট করে দেয় এবং এ যাত্রা পথকে বারটি মঞ্জিল (মাকামাত) ও স্তরে বিভক্ত করে। এ আধ্যাত্মিক সফরের অভিজ্ঞান সম্পর্কে ব্যক্তিগত মতবৈষম্যের উপর গুরুত্বারোপ না করে চ‚ড়ান্ত লক্ষ্যের পরিচয় প্রদানই ছিল সুফীদের প্রধান উদ্দেশ্য। এ সফরের মাধ্যমেই জড়হেদের প্রতি আকর্ষণকে দমিত বিজিত করে আত্মা যে সত্যকে পাওয়ার জন্য ব্যগ্র সে পরম সত্যকে (আলহাক্ব) পায়। (আল-হাক্ব শব্দটি সূফী সাহিত্যে তৃতীয় শতাব্দীতে পাওয়া যায়)
এক পর্যায়ে গিয়ে প্রাথমিক মুসলিম সূফীগণ আদি কালাম শাস্ত্রবিদদের দর্শন শাস্ত্রের ফাঁদে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলেন। আদি কালাম শাস্ত্রবিদদের ফাঁদ হলো দর্শনে পরমানুতত্ত¡, জড়বাদ ও আকস্মিকতা। এ ফাঁদে পড়ে তারা আত্মার আধ্যাত্মিকতা এমনকি তার অমরত্বের কথাও অ¯^ীকার করে বসেন। ফলে তারা অধিবিদ্যার তত্ত¡গত একত্বের সাথে সংখ্যাগত এককত্বের তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। এ কারণেই আদি সূফী সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যামূলক বক্তব্যকে (হুলুলিয়্যাহ বা আল্লাহর অবতারবাদ) কুফরের পর্যায়ভূক্ত করা হয়।
মরমীবাদে গ্রীক দর্শনের যে অনুপ্রবেশ ক্রমশঃ বর্ধিত হচ্ছিল (প্রাথমিক তাত্তি¡কগণ ও চিকিৎসক রাযী থেকে শুরু করে ইবনে সীনা পর্যন্ত) যার ফলে হিজরী চতুর্থ শতাব্দী থেকে সূফীবাদে অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ ও যথার্থ অর্থবহ দার্শনিক শব্দমালার আমদানী ঘটে। কিন্তু এ ধরণের শব্দাবলী এরিস্টটলের কল্পিত ধর্মতত্ত¡, প্লেটোর আদর্শবাদিতা এবং প্লোটিনাসের নির্গমন মতবাদের সাথে সংমিশ্রিত থাকায় সুফীবাদকে তার উত্তরোত্তর বিকাশে গভীরভাবে প্রভাবাšি^ত করে। আলোচ্য যুগের মরমীগণ আধ্যাত্মিক মিলনের তিন প্রকার ব্যাখ্যায় দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব প্রকাশ করেছেন।

ইত্তিহাদিয়্যা
ইবনে মাসাররা ও ইখওয়ান আল সাফা থেকে ফারাবী পর্যন্ত প্রদত্ত ব্যাখ্যার আধ্যাত্মিক মিলনের অর্থ সক্রিয় বুদ্ধির অভ্যন্তরীণ সক্রিয়তায় ধারণার সংগঠন। নিষ্ক্রিয় আত্মার উপর ঐশী নির্গমনের আবতারণা। মানবাত্মা ও পরমাত্মার এ সংযোজনই ইত্তিহাদিয়া আত্মিক মিলন।

ইশরাকিয়া
সোহরাওয়ার্দী, হালাবী থেকে দাওয়ানী এবং সাদরুদ্দীন সিরাজী পর্যন্ত তারা আধ্যাত্মিক মিলনের অর্থ বুঝাতে চান যে, আত্মাতে বুদ্ধির রশ্মির দ্বারা স্ফুলিঙ্গের প্রজ¦লন ঘটায় এবং তা আল্লাহর সত্তায় একীভূত হয়। (তাজাওহুর)

উসুলিয়্যা
ইবনে সীনা থেকে ইবনে তুফাইল ও ইবনে সাবঈন পর্যন্ত তারা কেবল এ কথা বলে নিরবতা অবল¤^ন করেন যে, আত্মা তার সাধনার যাত্রা শেষ করে আল্লাহর নিকট পৌঁছার পর এমন চেতনা লাভ করে, যে চেতনা অনুভূতিতে একাধিক কোনো অস্তিত্ব কিংবা প্রভেদত্বের কোনো চিহ্ন পরিদৃষ্ট হয় না।১০
প্রকাশ থাকে যে, ইমাম গাযালী তার মাকসাদ গ্রন্থের ৭৪ পৃষ্ঠায় ইত্তিহাদিয়্যা মতবাদ খণ্ডন করেছেন। ইবনে সীনা তার নাজাত গ্রন্থে এ মতবাদ গ্রহণ করেছেন আবার তার ইমারাত গ্রন্থের নবম অধ্যায়ের ১১৮ পৃষ্ঠায় একে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর ইবনে সাবঈন আল্লাহর ভেতর সকল সৃষ্টির আকার (সুরাত) অনুধাবন করেছেন।

সূফীবাদ বিকাশের তৃতীয় যুগ শুরু হয় ১৩ শতাব্দীতে। সূফীবাদের সে সময়ের সম্প্রদায়কে নামকরণ করা হয় ওয়াহদাতীয়া বা উজুদীয়া বলে। কারণ তা কেবল সত্তার একত্বের (ওয়াহদাতুল উজুদ) মতবাদ প্রচার করে থাকেন। এবং এ ব্যাপারে তারা কুরআনের বেশ কিছু আয়াত পেশ করে থাকেন। প্রকৃত পক্ষে সে সময় মুসলিম আধ্যাত্মবাদীদের প্রস্তাবিত “নূরে মুহাম্মদী” মতবাদের সাথে গ্রীক দর্শন নির্গমন (ঊসধহধঃরড়হ) মতবাদের সক্রিয় বুদ্ধির অভিন্নতা প্রদর্শনের প্রচেষ্টায় ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’ শব্দের আমদানী ঘটে। মহিউদ্দিন ইবনে আরাবী সর্ব প্রথম এ অভিন্নতার মতবাদকে সুনির্দিষ্টভাবে উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, সৃষ্টিসত্তা ও ¯্রষ্টা-সত্তার কোনো পাথর্ক্য নেই। তা এক ও অভিন্ন (উজুদুল মাখলুকাত আন উজুদিল খালেক) এ মতবাদেরই প্রবক্তা ছিলেন ইবনে রুশদ। এ মতের তাৎপর্য হচ্ছে সমূদয় সৃষ্টির অন্তরে আল্লাহর পূর্ণ পরিব্যপ্তি। সৃষ্টিতে ¯্রষ্টা বিদ্যমান।১১
১০. এনসাইক্লোপিডিয়া-খণ্ড ০১, পৃষ্ঠা ৪৯৮
১১. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ^কোষ-খণ্ড ০১

সূফীবাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বিশ^াস। নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রহরারত তাপসমণ্ডলীর মিলিত সুপারিশের প্রেক্ষিতে বিশ^জগৎ বিদ্যমান রয়েছে। তাদের একজনের মহাপ্রয়াণ ঘটলে অতিসত্তর তার শূন্যস্থান পূর্ণ করা হয়। তাদের ভেতর আছেন ৩০০ জন নুকাবা, ৪০ জন আবদাল, ৭ জন উমানা, ৪ জন আমুদ এবং তাদের কুতুব (মরমী-মেরু-অক্ষ= গাওছ)।১২

মুসলিম সমাজে সূফীবাদের ভূমিকা
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, সূফীরা প্রথমদিকে বাগদাদে রাষ্ট্রীয় বিচারক বা কাযীদের কাছে অভিযুক্ত হন। কিন্তু তারা এ কথা ভাবতেই পারেননি যে, তাদেরকে মুসলিম সমাজের শাসন কর্তৃপক্ষীয় এবং ধর্মতাত্তি¡কদের সাথে মতবিরোধ এবং সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে। কারণ তাদের ¯ে^চ্ছাকৃত দারিদ্রের মাঝে সংসার, নির্লিপ্ত জীবন অতিবাহনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যে ছিল আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের বাসনায় কুরআনের (তাকাররায়া, তাসাওউফের সাবেক প্রতিশব্দ) উপর ধ্যান ও অনুধাবন করার অধিকতর সুযোগ ও সামর্থ্য অর্জন। সূফীব্রত অবল¤^ন সাধারণত সামাজিক অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে বিবেকের অন্তর্বিদ্রোহেরই ফলশ্রæতি। এ বিদ্রোহ শুধু সমাজের অপরাপর লোকের আচারের বিরুদ্ধেই নয়; বরং প্রথমত এবং প্রধানত নিজের দোষ ত্রæটির বিরুদ্ধেই। অভ্যন্তরীণ পরিশোধনের পরপ্রকৃত সূফী যে কোনো মূল্যে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য পাগল পারা হয়ে উঠে। এ আকুল বাসনা হাসান বসরীর জীবনী, দৃষ্টান্ত ও তার ভাষণাবলীর মাঝে পরিষ্কারভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু সূফীবাদে গ্রীক দর্শনের প্রভাব এবং অনেক সূফীর এমন প্রচারণা যে, ধর্মের আচার অনুষ্ঠান পালন অপেক্ষা সংকল্পই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এবং বাহ্যিক ক্রিয়া কলাপের চেয়ে অন্তর দ্বারা আনুগত্য করণই অধিকতর শ্রেয়।
এরূপ বিশ^াস আচরণকে স্পষ্টই কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আখ্যায়িত করে ফিকহ ও কালামশাস্ত্র বিশেষজ্ঞগণ একথা প্রমাণের চেষ্টা করলেন যে, সূফীদের এ মতবাদ এর আচারিত জীবন পদ্ধতির শেষ পরিণতি কুফর ভিন্ন কিছুই নয়। ইমাম আহমদ ইবনে হা¤^ল সূফীদের এ মতবাদের চরম বিরোধিতা করেন এবং সঠিক মত ও পথ তুলে ধরার নিরন্তর প্রচেষ্টা করেন। কিন্তু খারিজী ও শিয়া সম্প্রদায় পূর্ণ সূফী মতবাদ ও তাসাওউফের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে এবং তাসাওউফের পূর্ণ মতবাদকেই তারা অ¯^ীকার করে বসে। তবে প্রকৃত প্রস্তাবে মধ্যপন্থী সূফীবাদ বা সহীহ তাসাওউফ শরীয়তের প্রকৃত ধারক-বাহক কর্তৃক কোনো দিনই ইসলামের গণ্ডি বহিভর্‚ত বিবেচিত হয়নি; বরং ইবনে আবীদ দুনিয়ার (২৮১/৮৯৪) জনপ্রিয় ক্ষুদ্র পুস্তিকাসমূহ থেকে শুরু করে আবু তালিব মক্কীর (৩৮৬/৯৯৬) প্রণীত কুতুল কুলুব এর ন্যায় মহাগ্রন্থ থেকে শুরু করে বিশেষ করে ইমাম গাজালীর ইহয়া গ্রন্থে তাসাওউফ ও সুফীদের ব্যবহারিক নীতি ও প্রার্থনার নতুন জীবন লাভ করেছে। ইবনে জাওযী, ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কায়্যিমের মত মনীষীগণ সূফীবাদের ঘোর বিরোধী হলেও মৌল তাসাওউফের ¯^ীকৃতি ও প্রয়োজনীয়তা ¯^ীকার করেছেন।১৩

সূফীবাদ ও তাসাওউফের ক্ষেত্রে গ্রীক দর্শন ও ভাববদীদের প্রভাবে শরীয়ত ও কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী যে সব বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তা থেকে তাসাওউফকে মুক্ত করার জন্য ইমাম গাজালী, ইবনে আবিদ দুনিয়া, আবু তালিব মক্কীসহ তৎকালে মনীষীগণ সর্বোপরি চেষ্টা করেছেন। পরবর্তিতে ইমামুল হিন্দ প্রখ্যাত ধর্মতত্ত¡বিদ দার্শনিক আলেম শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. লেখনীর মাধ্যমে প্রকৃত সূফীবাদ ও সুন্নাহ ভিত্তিক তাসাওউফের পরিচ্ছন্ন তরীকত তুলে ধরেন। তাঁর পদাংক অনুসরণ করে পরবর্তীতে শায়খ আহমদ সেরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফে সানী, হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী, কাসেমুল উলুম ওয়াল খায়রাত হযরত কাসেম নানুতবী, কুতুবে আলম রশীদ আহমদ গাঙ্গোহী, মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত থানবী, শায়খুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানীসহ ওলামায়ে দেওবন্দ তাসাওউফের প্রকৃত ও বস্তুনিষ্ঠ দিক তুলে ধরেন। সূফীবাদ ও তাসাওউফের প্রকৃত ধারা আজও এর উপর প্রতিষ্ঠিত।

তাসাওউফের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য
আল্ল¬াহ তা’য়ালা মানুষকে দু’টি বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।
১. ফেরেশতাসূলভ গুণাবলী বা আখলাকে হামীদা। যেমন ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সত্যবাদিতা, এখলাস ও আন্তরিকতা, তাওয়াক্কুল, কানা‘আত বা ¯^ল্পে তুষ্টি। শোকর ও রিযা তথা সর্ববিষয়ে আল্ল¬াহ তা’য়ালার উপর সন্তুষ্ট থাকা ইত্যাদি সৎ গুণাবলী।
২. কু-প্রবৃত্তি বা আখলাকে জামীমা অর্থাৎ যাবতীয় খারাপ ও নিন্দনীয় গুণাবলী। যেমন লোভ-লালসা, ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, পরনিন্দা, অহংকার আত্মম্ভরিতা ইত্যাদি। প্রথম বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ আখলাকে হামিদা যদি আখলাকে যামীমার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে তখন সে হতে পারে প্রকৃত মানুষ। আশ্রাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা ইনসানে কামেল। তার মর্যাদা হয় তখন ফেরেশতার চেয়ে ঊর্ধ্বে। প¶ান্তরে দ্বিতীয় প্রকার বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ আখলাকে যামীমা যদি আখলাকে হামীদার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে তখন সে হয়ে যায় নরপশু, মানুষ নামের কলঙ্ক। তখন থাকেনা তার মনুষ্যত্ব-মানবিকতা, হিতাহীত জ্ঞান। সে হয়ে পড়ে তখন পশুর চেয়ে অধম। এদিকে ইঙ্গিত করেই ইরশাদ হয়েছে, “তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তদ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চ¶ু আছে তদ্বারা দেখে না এবং তাদের কর্ণ আছে তদ্বারা তারা শ্রবণ করে না, এরা পশুর মত, বরং তার চেয়েও বেশি বিভ্রান্ত। তারাই গাফিল।১৪
১২. এনসাইক্লোপিডিয়া-খণ্ড ০১
১৩. মাজমুয়াতুল ফাতাওয়া-খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ১-৩০
১৪. সূরা আরাফ, আয়াত-১৩
আখলাকে হামীদা অর্জন ও আখলাকে যামীমা থেকে বাঁচার জন্যে প্রয়োজন হলো তাযকিয়ায়ে নফস বা আধ্যাত্মিক সাধনা। এ সাধনা মানুষকে সকল প্রকার দোষত্রæটি ও অব¶য়ের হাত থেকে মুক্ত করে সকল প্রকার উত্তম গুণের অধিকারী করে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলে। এর ফলে সকল অনিয়ম-উচ্ছৃক্সখলতা, অন্যায় ও পাপাচার থেকে মুক্ত হয়ে সত্য-সুন্দর ও আদর্শের আলোতে তার অন্তরাত্মা হয় বিকশিত। সৃষ্টি হয় আল্লাহর সাথে প্রেমময় ও মধুর সম্পর্ক। সে পৌঁছতে পারে সফলতার শীর্ষ পর্যায়ে। তাই আল্ল¬াহ তা’য়ালা তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে বলেছেন, “যে পবিত্রতা অর্জন করেছে (আত্মশুদ্ধি করেছে) সে হয়েছে সফলকাম।”১৫
এ ব্যাপারে রাসূল সা. বলেছেন, “নিশ্চয়ই প্রতিটি শরীরে একটা গোশতের টুকরো রয়েছে, সে গোশতের টুকরো যদি ঠিক থাকে তাহলে গোটা দেহ ঠিক থাকে আর সে গোশতের টুকরো যদি বিনষ্ট হয়ে যায় তাহলে পুরো শরীর নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে গোশতের টুকরো হলো ‘কলব’ (অন্তর)।”১৬ এ হাদীসে রাসূল সা. যে আত্মশুদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছন তা বলার অপে¶া রাখে না।

শরীয়ত, তরীকত, মারিফত ও হাকীকত
মানুষকে ইহ-পরলৌকিক সর্বোপরি সফলতার চরম বিন্দুতে পৌঁছানোর জন্যে ইসলাম যেসব বিধি-বিধান দিয়েছে ইসলামী পরিভাষায় তাকে বলা হয় ‘শরীয়ত’। শরীয়তের কিছু বিষয় আছে বাহ্যিক, যাকে ‘আহকামে জাহেরী’ বা ‘ফিকাহ’ বলা হয়। আর কিছু বিষয় আছে আত্মিক যাকে ‘আহকামে বাতেনী’ বা ‘তাসাওউফ’ বলা হয়। এ বাহ্যিক ও আত্মিক বিধি-বিধান বাস্তবায়ন পদ্ধতিকে বলা হয় ‘তরীকত’। আর এসব বাস্তবায়ন করে অন্তর পরিশুদ্ধ হলে বহু তত্ত¡ ও রহস্য অন্তরে উদ্ভাসিত হয়, সে তত্ত¡ ও রহস্যকে বলা হয় ‘হাকীকত’, আর এ সকল তত্ত¡ ও রহস্য জ্ঞানের দ্বার উদঘাটনকে বলা হয় ‘মারিফত’।

তাসাওউফের প্রয়োজনীয়তা বা হুকুম
অবস্থা ভেদে ইলমে তাসাওউফ শিক্ষা করা কখনো ফরজে আইন, কখনো ফরজে কেফায়া, আবার কখনো মুবাহ বা মুস্তাহাব। যে পরিমাণ ইলমে আখলাক বা তাসাওউফ শিক্ষা করলে মানুষের ¯^ভাব-চরিত্র পরিশুদ্ধ, মার্জিত ও শীলিত হয় এতটুকু তাসাওউফ শিক্ষা করা ফরজে আইন। আর যে পরিমাণ শিখলে অন্যকেও শিক্ষা দেয়া যায় সে পরিমাণ শিক্ষা করা ফরজে কেফায়া। আবার যে পরিমাণ শিখলে তাসাওউফে পারদর্শী ও অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায়, সে পরিমাণ শেখা মুস্তাহাব বা মুবাহ।১৭
ইমাম আযম হযরত আবু হানিফা রহ. বলেছেন- الشريعة هو العقائد والفقه والتصفية الباطن শরীয়ত হলো সুদূঢ় বিশ^াস, ফিকহ্ ও অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধির সমন্ময়।১৮
জামেউল উলূম গ্রন্থে এসেছে, اعلم ان العلم الباطن الذى هو من اعظم المنجيات والسلوك والرياضات والمجاهدات فرض عين على من لم يرزق قلبا سليما بالجزب الهى- জেনে রেখো আল্লাহ তা’য়ালা যাকে বিশুদ্ধ হৃদয় ও জযবায়ে ইলাহী প্রদান করেননি, তার জন্য ইলমে তাসাওউফ শিক্ষা করা ফরজ। কেননা এ তাসাওউফ আল্লাহর পথে সব ধরণের সাধনা যথা রিয়াযত, মুজাহাদা ও সুলুক অপেক্ষা অতি উত্তম।১৯
রাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেছেন,عن الحسن قال العلم علمان نعلم القلب فذلك العلم النافع وعلم اللسان ذالك حجة الله عز وجل على ابن ادم- হযরত হাসান রা. সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইলম দু’প্রকার। প্রথমটি হলো কলব বা আত্মিক ইলম এবং এটা সবচেয়ে উপকারী ইলম, আর দ্বিতীয়টি বাহ্যিক বা মৌখিক ইলম, যা বনী আদমের উপর মহান আল্লাহ তা’য়ালার দলীল ¯^রূপ।২০
১৫. সূরা আ’লা, আয়াত-১৪
১৬.বুখারী শরীফ-খণ্ড ০১, পৃষ্ঠা ১৩
১৭. দুররে মুখতার ২-৩১
১৮.ফিকহুল আকবর-ইমাম আবু হানিফা
১৯. জামেউল উসুল-পৃষ্ঠা ২২৬
২০. মিরকাত (কিতাবুল ইলম) মোল্লা আলী কারী রহ.

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী রহ. তার বিখ্যাত গ্রন্থ মিরকাতে বর্ণনা করেছেন, ইলম দু প্রকার (১) ইলমে শরীয়ত (২) ইলমে মারিফাত। তিনি আরো বলেছেন, শরীয়তের বিধি-বিধান যথাযথভাবে পালন না করে মারিফাত লাভ যেমন সম্ভব না, অনুরূপ ইলমে মারিফাত সঠিকভাবে না শিখলে শরীয়তের হুকুম আহকাম ঠিক মতো আদায় করা যায়না। একটা আরেকটার পরিপূরক।২১
আবু তালিব মক্কী বলেছেন, উভয় প্রকার ইলমই আসল। একটি ছাড়া অপরটি অসম্পূর্ণ। যেমন ইসলাম ও ঈমান। এ দুটির মাঝে একটি দেহ অপরটি আত্মা ¯^রূপ। এর একটির অভাবে মানুষ যেমন বাঁচতে পারেন না, অনুরূপ শরীয়ত ব্যতীত মারিফাতেরও কল্পনা করা যায় না।
তিনি আরো বলেছেন, من لم يكن الشرع رفيقه فى جميع احواله فهو هالك مع الهالكين- “যে তরীকত পন্থীর সাথে সর্বাবস্থায় শরীয়ত সঙ্গী না থাকে, সে তরীকত পন্থী জাহান্নামীদের সাথে জাহান্নামী হবে।২২
হাদীসে জিব্রীলে জিব্রীল আ. এর ইহসান সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে রাসূল সা. ইরশাদ করলেন, ان تعبد الله كانك تراه فان لم تكن تراه فانه يراك- “তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তুমি তাঁকে (তোমার অন্তর দৃষ্টি দিয়ে) দেখতে না পাও, তাহলে (বিশ^াস করবে) নিশ্চয় তিনি তোমাকে দেখছেন।২৩ এখানে দেখার অর্থ আত্মিক দর্শন। বাহ্যিক চোখ দিয়ে দেখা উদ্দেশ্য নয়। এ দেখাই প্রকৃত দেখা।
মোটকথা, শরীয়ত ও তাসাওউফ বা মারিফাত ওতপ্রতোভাবে জড়িত। একটা বাদ দিয়ে আরেকটা আদৌ পূর্ণমাত্রায় অর্জন করা সম্ভব না। সুতরাং যারা ইলমে তাসাওউফকে অ¯^ীকার করছে, নিশ্চিতভাবে বলা যায় তারা অজ্ঞতা বশত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অ¯^ীকার করছে। অপর দিকে যারা মারিফাতের দোহাই দিয়ে শরীয়তের বিধি-বিধান পালন করছেনা বা পালন করাকে অহেতুক মনে করছে। কারণ যে যতই তাসাওউফের উচ্চমার্গে আসীন হোকনা কেন শরীয়তের বিধান কোনোদিন মওকুফ হবেনা। নবী-রাসূল, গাওস-কুতুব কারো জন্য মওকুফ হয়নি। কিয়ামত পর্যন্ত হবেও না। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে সঠিক বিষয় উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

২১. মালফুযাতে আবু তালিব মক্কী রহ.
২২. মালফুযাতে আবু তালিব মক্কী রহ.
২৩. মুসলিম- প্রথম খণ্ড কিতাবুল ঈমান

লেখক : মুফতি জহির ইবনে মুসলিম
মুহাদ্দিস, খতীব, গবেষক ও কলাম

Leave a Comment

লগইন অথবা নিবন্ধন করুন

লগইন
নিবন্ধন