উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসে বালাকোট একটি স্মরণীয় নাম। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলমানদের স্বাধীনতা, অস্তিত্ব ও জাগরণের ইতিবৃত্ত; পথহারা উম্মতের সঠিক পথের নির্দেশনা। ইংরেজ আমলের পরবর্তী সময়ে সংঘটিত প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থান বালাকোটের চেতনার ফসল। বালাকোটের ঐতিহাসিক ট্রাজেডির মাধ্যমে সূচিত সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়েই এ দেশের মুসলমানরা ফিরে পেয়েছিল তাদের স্বাধীনতা।
বাংলা উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে- “১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে ইংরেজ বণিকরা এ অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে বৃটিশ রাজদণ্ডের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে এবং স্থানীয় অধিবাসীদের উপর জোরজবরদস্তিমূলক আধিপত্যবাদী শাসন কায়েম করে। একদিকে এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অন্যদিকে স্বয়ং মুসলিম সমাজের ইসলামী জীবনাচরণে দীর্ঘকাল যাবৎ বিপুল অনৈসলামিক আক্বীদা-বিশ্বাসের শক্ত অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই এ অঞ্চলে এক সর্বব্যাপী সংস্কারমূলক বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল। সেই অনাগত বিপ্লবের হাতছানিই যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রহ.-এর ‘তরীকায়ে মুহাম্মাদিয়া’ আন্দোলনের হাত ধরে উপমহাদেশের শিরক-বিদ‘আতী জঞ্জালের অন্ধকার গহ্বরে তাওহীদী নবপ্রভাতের সূচনা ঘটায়। এই আন্দোলনেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে ঘটে যায় বালাকোট যুদ্ধ। ১৮৩১ সালের ৬ মে সংঘটিত ঐতিহাসিক এই বালাকোট যুদ্ধ একদিকে যেমন ছিল এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের জন্য চরম বিপর্যয়ের, অপরদিকে বিদেশী বেনিয়াদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য উপমহাদেশের বুকে পরিচালিত সর্বপ্রথম সুসংঘবদ্ধ রণডঙ্কা।”
বালাকোটের অবস্থান
বালাকোট শহর পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খাইবার-পাখতুন (সাবেক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) হাযারা অঞ্চলভুক্ত মানসেহরা জেলা থেকে ৩৮ কি. মি. পূর্ব-উত্তরে অবস্থিত। চারিদিকে উচ্চ পাহাড়ঘেরা দুর্গম এই ঐতিহাসিক শহরটি আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল হিসাবে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। শহরটি কাগান উপত্যাকার প্রবেশমুখ। লালসার লেক থেকে উৎসারিত কুনহার নদী এই শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে ঝিলাম নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। জনৈক বালাপীরের নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় বলে জানা যায়। প্রাচীন বালাকোটে যেখানে ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা ছিল পার্শ্ববর্তী মেটিকোট টিলা ও ঝর্ণা এলাকায়।
বালাকোট আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রহ.। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রহ. সফর ১২০১ হিজরী মুতাবিক ২৯ই নভেম্বর ১৭৮৬ খৃষ্টাব্দে ভারতের অযোধ্যা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বংশতালিকা চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রা.-এর সাথে মিলিত হয়েছে।
তৎকালীন উপমহাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা
তৎকালীন উপমহাদেশের মুসলমানগণ সত্যের পথ থেকে বহু দূরে সরে যায়। কুকর্ম আর অসত্যের পথে তারা বিরামহীন ভাবে ছুটে চলে। আরাম-আয়েশ এবং হীন মনোবৃত্তি চরিতার্থ করার উপকরণ সংগ্রহ করা ব্যতীত আমীর-ওমারাদের আর কোনো কাজ ছিল না। এর পরিণাম সম্পর্কে তারা ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। মোগল শক্তি তখন প্রায় বিধ্বস্ত। আড়ইশত বছরের আপ্রাণ চেষ্টা সাধনার পর একটুকরা একটুকরা করে মোগলরা যে বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেছিল, কাবুল থেকে আসাম, আরাকান এবং কারাকোরাম থেকে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত এই পুরো অঞ্চলে মোগলদের বিজয় পতাকা উড্ডীন ছিল। ভোগ-বিলাস, গৃহবিবাদ এবং অরাজকতার মাধ্যমে এক একটি রাজ্য কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে যে কয়জন সচেতন তাজা প্রাণ এই নিরাশার অন্ধকারকে দূর করে আশার আলো জ্বালাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল হায়দার আলী এবং টিপু সুলতান ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। মহীশুরের হায়দার আলী যে নতুন শক্তির পত্তন করলেন টিপু সুলতান তার শিরায় ইসলামের তাজা রক্ত প্রবাহিত করেন। কিন্তু বিরোধ এবং স্বার্থপরতার এত উপকরণ সঞ্চিত হয়েছিল যে, এই মুজাহিদদ্বয়ের প্রাণপণ চেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি। শুধুমাত্র ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং উৎসর্গের দুটি প্রদীপ শিখা হিসেবে তাঁদের কর্মতৎপরতা ইতিহাসে স্থান লাভ করলো। নিজেদের দুর্বলতার কারণে সে শক্তি মৃত্যুমুখে পতিত হলো।
এই সময় মোগল সাম্রাজ্যের এক বিরাট অংশে মারাঠাগণ হাঁটু গেড়ে বসে। একবার মোগল সিংহাসনই প্রায় তাদের দখলে চলে গিয়েছিল। পানিপথের যুদ্ধে আহমদ শাহ আব্দালী মারাঠাদের উপর চরম আঘাত হানেন। এরপর যদিও মারাঠাগণ ৪০/৫০ বছর টিকে ছিল, কিন্তু পূর্বাবস্থা আর ফিরে পায়নি এবং ক্রমে ক্রমে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। পাঞ্জাবে রনজিৎ সিং শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে তথাকথিত একটি রাষ্ট্রের নামে ত্রাস সৃষ্টিকারী এক বাহিনী গঠন করে। রনজিৎ সিং-এর মৃত্যুর চার পাঁচ বছরের মধ্যে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সিন্ধুর শাসন ক্ষমতা চার জন আমীরের অধীনে ছিল। অযোধ্যায় শুজাউদ্দৌলা, দাক্ষিণাত্যে নিযাম এবং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় নবাব আলীবর্দী খান। এদের ধারণা ছিল, সম্পূর্ণ উপমহাদেশ মুসলমানদের অধীনে না থাকলেও অন্ততপক্ষে নিজেদের এলাকাগুলো থাকলেই যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে সায়াদাত আলী খান লোভের বশবর্তী হয়ে অযোধ্যার অধিকাংশই ছেড়ে দিলেন। বাকী অংশও পরে তাঁর বংশধরদের হস্তচ্যুত হয়ে যায়। অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং অরাজকতার দরুন ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে দাক্ষিণাত্যের সীমানাও প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। নবাব আলীবর্দী খানের ইন্তেকালের এক বছরের মধ্যেই বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা ইংরেজদের হাতে চলে গেল। উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্বের ভিত্তিপ্রস্তর এখানেই স্থাপিত হলো। পরে ইংরেজগণ মারাঠা এবং নিযামের সাথে মিলিত হয়ে মহিশুরের পতন ঘটালো। একাজ শেষ করে অল্প দিনের মধ্যেই মারাঠা, নিযাম এবং অযোধ্যাকে সাহায্যকারী হিসেবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে বাকী সকলকে পুতুলে পরিণত করে। এর পরপরই উপমহাদেশের কেন্দ্রস্থল দিল্লী হস্তগত করে ইংরেজগণ জেঁকে বসলো।
এই সময় উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য মাত্র তিনটি পথ খোলা ছিল। প্রথমত: সত্যের পথ ত্যাগ করে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা। দ্বিতীয়ত: সত্যের পথ পরিত্যাগ না করা এবং এ কারণে যত বিপদই আসুক না কেন ধৈর্যের সাথে তা সহ্য করে করে শেষ হয়ে যাওয়া। তৃতীয়ত: অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। প্রথম পথ ছিল মৃত মুসলমানদের জন্য। দ্বিতীয় পথ ছিল মুসলমান হিসেবে বেঁচে থাকার আশায় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। তৃতীয় পথ হচ্ছে পৌরুষের পথ।
মোঘল সালতানাতের পতনের সঙ্গে সঙ্গে উপমহাদেশের মুসলমানরা নিপতিত হয় চতুর্মুখী সমস্যায়। একদিকে জাঠ-মারাঠা-শিখ প্রভৃতি মুসলিমবিদ্বেষী শক্তির ব্যাপক অভ্যুত্থান, মুসলিম শাসন ক্ষমতায় ইংরেজ বণিকদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ, মসজিদে আজান এবং জুমার জামাত বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ভয়াবহতা। অপরদিকে সমগ্র উপমহাদেশব্যপী মুসলমানদের ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনে নেমে আসে মারাত্মক অধঃপতন। ঈমান-আকীদার স্থান দকল করে নেয় নানা কুসংস্কার ও বিজাতীয় ধ্যান-ধারণা। মুসলিম জনগণ পরিণত হয় নামসর্বস্ব মুসলমানে। সমাজের উচ্চবিত্তদের মধ্যে শিয়া ধ্যান-ধারণা, পীরপূজা, গোরপূজাসহ অগণীত শিরক-বিদআত স্থায়ীভাবে শিকড় গেঁড়ে বসে। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নেমে আসা ক্রমবর্ধমান অবনতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ হয়ে এরা ভোগ-বিলাসের আত্মঘাতি পথে গা ভাসিয়ে দেয়। আবার নিমানবিত্ত শ্রেণীর মুসলিমরা পার্শ্ববর্তি হিন্দু সমাজের নানা আচরণে ব্যাপকভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেক এলাকার মুসলিমরা নামের সঙ্গে হিন্দু পদবী গ্রহণ করাকে গৌরবজনক বলে বিবেচনা করতো।
ঘুনেধরা ভারত উপমহাদেশীয় সমাজ ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণের অগ্রপথিক হযরত আবুল ফায়াজ আহমাদ শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. গ্রহণ করেছিলেন যুগপৎ কর্মসূচি। তিনি আকীদার সংশোধন ও কুরআনের পথে দাওয়াত, হাদীস ও সুন্নাতের ব্যাপক প্রচার-প্রসার, ইসলামী শরীয়তকে পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন, ইসলামী খিলাফতের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা এবং খিলাফতের আবশ্যকতা প্রমাণ, সমকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মুসলিম জাতিকে উদ্ধারের জন্য জিহাদী ভূমিকা গ্রহণ, উম্মতে মুহাম্মদির সর্বশ্রেণিকে সংশোধন ও বিপ্লবের দাওয়াত প্রদান, তারবিয়াত ও প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে ভবিষ্যত আন্দোলনের যোগ্য ব্যক্তিগঠনের মাধ্যমে জনমত গঠন ও সচেতনতা সৃষ্টি, ব্যক্তিগঠন, জিহাদের প্রশিক্ষণ দান ও মজবুত সংগঠন গড়ে তোলার যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন তারই সুযোগ্য উত্তরসূরী হযরত শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. আপন পিতার রেখে যাওয়া কর্মসূচির আলোকে তিনিও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থার আমূল সংশোধনের জন্যে পবিত্র কুরআনের আবেদন সার্বজনীনভাবে প্রচার ও প্রসার, ইলমে হাদীসের ব্যাপক প্রচার, হকের প্রতিষ্ঠা ও বাতিলের খণ্ডন, জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা ও জাগরণ সৃষ্টি, রূহানিয়াতের প্রশিক্ষণ দান ও কর্মী বাহিনী গঠন ও জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহকে পুনর্জীবিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিগন্ত উন্মোচন করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন।
মুজাদ্দিদে আলফে সানী ও ওয়ালী উল্লাহী চেতনার সুযোগ্য উত্তরসূরি শাহ আবদুল আযীয রহ. কর্তৃক গঠিত জিহাদ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ.-এর কর্মতৎপরতা মুসলমানদের মাঝে এক বিস্ময়কর জাগরণের সৃষ্টি করে। তাঁর আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল মূলত দুটি উদ্দেশ্যে-
এক. পারিপার্শ্বিক নানা প্রভাবে কলুষিত মুসলিম জাতির ঈমান-আকিদাকে শিরকমুক্ত করা।
দুই. মুসলিম জীবনধারা ও জাগরণের অন্তরায় অশুভ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। অস্তিত্ব হারাতে বসা মুসলিম জাতির জন্য তখন এ দুটি কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত যুগোপযোগী ও প্রয়োজনীয়।
এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. হাতে নিয়েছিলেন চার দফা কর্মসূচি।
১. দাওয়াত ও ইসলাহী তৎপরতা।
২. স্বাধীনতার লক্ষ্যে জিহাদী চেতনা সৃষ্টি ও মুজাহিদ সংগ্রহ।
৩. সংস্কারমূলক তৎপরতা।
৪. জিহাদের ময়দানে সশস্ত্র তৎপরতা।
এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে আহমদ শহীদ রহ. ইমাম শাহ আবদুল আযীয রহ. এর নির্দেশক্রমে তিনবার গোটা দেশ সফর করেন। এ তিনটি সফর তাঁর সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
প্রথম সফরে তিনি মুসলিম সর্ব সাধারণের আকীদা ও আমল বিশুদ্ধ করতে সচেষ্ট হন এবং জানমাল দিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণের ওপর বায়আত নেন। সফরে বায়আত গ্রহণকারী মুজাহিদদেরকে ত্যাগ ও কুরবানীর আদর্শ শিক্ষাদান এবং সাংগঠনিক নীতি প্রক্রিয়া অনুশীলনের জন্য তাদেরকে নিয়ে ২য় সফরে হজ্বে যান। জিহাদ শুরু করার আগে বায়তুল্লাহর যিয়ারত দ্বারা রূহানী শক্তি সঞ্চয় করা ছিল এ সফরের প্রধান উদ্দেশ্য। তৃতীয় বারের সফরে তিনি আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার মহান উদ্দেশ্যে জিহাদে বেরিয়ে পড়েন। এ সফরই ছিল শেষ সফর। এ সফর থেকে তিনি আর বাড়ি ফিরে আসেননি।
প্রথম সফর
১৮১৮ সালে তিনি মাত্র পঞ্চাশ জন সহযাত্রীসহ দিল্লী থেকে সফর শুরু করেন। চার মাস ব্যাপী এ সফরের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল:
১. রূহানিয়াত ও জিহাদের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা
সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. একটি সুদূর প্রসারী আদর্শিক বিপ্লবের পথ তৈরি করার লক্ষ্যে গণমানুষকে আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার কর্মসূচি হাতে নেন। তিনি মানুষকে ইসলামের সুমহান আদর্শের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জনের জিহাদে অংশগ্রহণের দাওয়াত দিতে থাকেন। পাশাপাশি স্বদেশকে মুক্ত করতে জিহাদে অংশগ্রহণের জন্যও দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। সফরে তিনি মানুষের কাছ থেকে জিহাদ ও আত্মশুদ্ধির বায়আত গ্রহণ করতেন। মূলত: সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. এর কর্মধারার মূল বৈশিষ্ট্যই ছিল- তিনি তরীকতের বায়আত ও জিহাদের বায়আত একসাথে গ্রহণ করতেন।
সে সময় আধ্যাত্মবাদী সুফীরা তরীকতের ধারাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, জিহাদকে তারা তাসাউফের পরিপন্থী মনে করত। হযরত শহীদ রহ. এ ধারার অপনোদন করেন। তিনি আত্ম-সাধনা ও জিহাদের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে প্রচলিত ধারার বিপরীতে একটি স্বতন্ত্র ধারার সূচনা করেন। তিনি তার নাম দিয়েছেন- ‘তরীকায়ে মুহাম্মাদিয়্যাহ’। তিনি বায়আত করানোর সময় ‘আওর মুহাম্মাদিয়্যাহ’ বলে জিহাদী চেতনার প্রতি ইঙ্গিত করতেন।
২. মারকায গঠন
মুরিদদের ইসলাহ, তারবিয়াত দান ও জিহাদী কার্যক্রম সুচারুরূপে আঞ্জাম দেয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন স্থানে মারকায তৈরি করেন। তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করার পর মানুষের মাঝে যে দীনি জযবা ও ঈমানী চেতনা সৃষ্টি হতো তাকে ধরে রাখার জন্যই এসব কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
দ্বিতীয় সফর
১৮২১ সালে হযরত শহীদ রহ. হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় সফর শুরু করেন। আটশ সঙ্গীসহ সাত হাজার মাইলের এ সফর ছিল তাঁর জীবনের বৃহত্তম সফর। এ ঐতিহাসিক সফরের কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল। তা হলো-
১. বাতিলপন্থী আলেমদের মিথ্যা ফতওয়ার আমলী জবাব দেয়া। কারণ পথের নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে তৎকালীন বাতিলপন্থী আলেমরা ভারতীয়দের জন্য হজ্ব ফরজ নয় বলে ফতওয়া দিত। তিনি হজ্বের গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য বিরাট এক কাফেলা নিয়ে হজ্বে গমন করেন।
২. বায়তুল্লাহ যিয়ারতের মাধ্যমে জিহাদ সূচনার পূর্বে রূহানী শক্তি অর্জন করা এবং জিহাদের দৃঢ় শপথ গ্রহণ করানো। তিনি ঐতিহাসিক “আকাবা” প্রান্তরে যেখানে আনসারদের প্রথম দল রাসূল সা. এর হাতে হাত দিয়ে বায়আত হয়েছিলেন, সেখানে তাঁর অনুসারীদের থেকে ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহর জন্য সবার্ত্মক জিহাদের বাইয়াত গ্রহণ করেন।
৩. ইউরোপীয় আগ্রাসনের বিপরীতে এশিয়ার শক্তিগুলোর মাঝে সংহতি কায়েম।
হযরত শহীদ রহ. দীর্ঘ দুই বছর দশ মাস অবস্থানের পর ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল স্বদেশে ফিরে আসেন।
এই যাত্রাপথে তিনি বাংলার যুবকদেরও তাঁর আন্দোলনে শরীক করেন। বাংলাদেশ থেকেও অনেক মুজাহিদ এ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে মাওলানা ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী ও সুফি নূর মুহাম্মদ ছিলেন শীর্ষ পর্যায়ে। বাংলার সীমান্তে সাইয়েদ সাহেরে কাফেলার আগমনের বর্ণনা করতে গিয়ে ‘ওয়াকিয়া-এ আহমাদিয়া‘র’ লেখক বলেন, প্রতিদিন শত শত লোক এসে মুন্সী আমিনুদ্দীন এর বাগান বাড়ীতে সমবেত হতো। মুন্সী আমিনুদ্দীন কলকাতার একজন প্রভাবশালী ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার বাগান বাড়ীতে সাইয়েদ সাহেব ওয়াজ-নসীহত করতেন এবয় শিরক-বিদআত থেকে তাওবা করিয়ে বাইআত গ্রহণ করতেন।
বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সাইয়েদ সাহেবের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য মাওলানা ইমামুদ্দীন তার জন্মভূমি নোয়াখালী এবং সূফি নূর মোহাম্মাদ চট্টগ্রাম এলাকায় রাওয়ানা হন। তাঁরা নোয়াখালী, কুমিল্লা, মোমেনশাহী, সিলেট ও চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তি এলাকায় দাওয়াত ও সাংগঠনিক তৎপরতা চালান। ইংরেজ আমলা হান্টারের ভাষায়- “বাংলায় এমন কোন জনপদ ছিল না, যেখানকার মানুষদের মাঝে সাইয়েদ সাহেবের সংস্কারের বাণী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। প্রতিটি পরিবারের যুবকরা সীমান্তে গিয়ে জিহাদ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো। তাঁদের অনেকেই বালাকোটের যুদ্ধে শহীদ হন।
তৃতীয় সফর
১২৪১ হিজরী মুতাবিক ১৭ জানুয়ারি ১৮২৬ সনে হযরত শহীদ রহ. এর তৃতীয় সফর শুরু হয়। এটি ছিল তাঁর জিহাদে যাত্রার সফর এবং তাঁর জীবনের শেষ সফর। তিনি তাঁর অভিযান উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে শুরু করার অভিপ্রায়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অভিমুখে রওয়ানা হন।
দু’বছর এগার মাসের হজের সফর সমাপ্ত করে সাইয়েদ আহমাদ রহ. তাঁর জন্মস্থান রায়বেরেলি পৌঁছেন। ততদিনে বার্মা সীমান্ত থেকে দিল্লী পর্যন্ত তার দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল। দেশে এসে তিনি তাঁর আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেন সর্বত্র। জনগণের জন্য মুক্ত স্বাধীন দেশে আল্লাহর বন্দেগি করার মতো মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার দৃঢ় প্রত্যয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন। নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে তাঁর আন্দোলনে শরীক হতে থাকে।
উপমহাদেশে আন্দোলনের গভীরতা, ময়দানে কর্মীদের চরিত্র ও মনোবল এবং সংগঠনের ব্যাপকতা ও মজবুতি সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রহ. একবার সারা উপমহাদেশে প্রায় বছরাধিককাল ধরে এক জরিপ সফর সম্পন্ন করেন। এই জরিপ সফরের পরপরই তিনি কোনো পার্থিব ধন-সম্পদ এবং উপকরণ ব্যতিরেকেই শুধুমাত্র দ্বীনের দাওয়াত, ঈমানী চেতনা, ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলন এবং জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর বলিষ্ঠ প্রত্যয়কে সম্বল করে ময়দানে নেমে পড়েন। কর্মী ও সহযোগীদের সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্দোলনের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রহ. পুরো উপমহাদেশকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করেন। পাটনায় আন্দোলনের কেন্দ্র স্থাপিত হয়। নিজের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাগরেদকে তিনি আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। নিজে পাটনায় থেকেই আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সারা উপমহাদেশে আন্দোলন পরিচালনা করেন। বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রতিনিধি ছিলেন মাওলানা বেলায়েত আলী।
ব্যাপক দাওয়াতী অভিযানের ফলে উপমহাদেশের বিস্তৃত অঞ্চলে ত্বরীকায়ে মুহাম্মদীয়া আন্দোলনের শিকড় মাটির গভীরে সুদূর প্রসারীভাবে বিস্তার লাভ করে। পুরো উপমহাদেশকে আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের মধ্যে সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় বণ্টন করে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রহ. একটা ছায়া সরকার গঠন করেন। সাংগঠনিক সুশৃঙ্খলার কারণে ৪০ বছর পরেও বৃটিশ সরকার এই ছায়া সরকার সম্পর্কে জানতে পারেননি।
আদর্শের চাহিদা ও মেজাজ অনুযায়ী কর্মী গঠন করা ছিল এ আন্দোলনের এক বিশেষ কাজ। সৈয়দ সাহেব গতানুগতিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সবসময়ই বলতেন, আন্দোলনের মেজাজ অনুযায়ী কর্মী তৈরী না হলে সফলতা আসবেনা। সংগঠনের জেলা সদর দপ্তরগুলোতে সাধারণ বাইয়াত গ্রহণকারীদের প্রশিক্ষণের পর কর্মী বাছাই করা হতো। এরপর কর্মীদের মধ্যে চলতো প্রশিক্ষণ। তুলনামূলকভাবে অগ্রসর কর্মীদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য এখান থেকে পাটনার কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠানো হতো। এখান থেকে অপেক্ষাকৃত নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদেরকে আরো দীর্ঘ প্রশিক্ষণের পর নিজ নিজ অঞ্চলে আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করা হতো।
সাইয়েদ সাহেব সরাসরি আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন এবং তাদেরকে পরিচালনা করতেন। সাংগঠনিক ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সাধারণ মুসলমান থেকে যারা বাইয়াত গ্রহণ করেছেন, তাঁরা আন্দোলনের সদস্য। পরের স্তর হচ্ছে অগ্রসর কর্মী এরপর মুজাহিদ।
ব্যাপকভাবে দাওয়াত প্রদান, কর্মী গঠন, আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার এবং সাংগঠনিক মজবুতির জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রচুর ইসলামী সাহিত্য প্রকাশ করা হয়েছে। এই সাহিত্যভাণ্ডার ত্বরীকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলনকে বহুগুণে অগ্রসর করে দিয়েছে। অসংখ্য ইসলামী সাহিত্যে মধ্যে সীরাতুল মুস্তাকীম, কাসিদা, সির‘ই ওয়াকেয়া, তাওয়ারিখ কায়সার রুম, আসার মাহ্শার, হিদায়াতুল মুসলিমিন, তানভীরুল আইনাইন, তাকবিয়াতুল ঈমান, নাসীহাতুল মুসলিমীন, তামবীহুল গাফেলীন ইত্যাদি গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এ সময় ব্যাপক গণসংযোগের দ্বারা তিনি প্রায় ছয় হাজার সঙ্গী-সাথী সংগ্রহ করেন। তাদের সংগঠিত করে সীমান্ত এলাকায় চলতে থাকা মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ইংরেজ রাজশক্তির মদদপুষ্ট শিখ রাজার শোষণ প্রতিরোধকল্পে ১৮২৬ খৃস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। শিখ রাজা রঞ্জিত সিংকে প্রথমে পত্র মারফত মুসলিম নির্যাতন বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। শিখ রাজা পত্রের কোনো জবাব না দিয়ে মুজাহিদদের কাফেলাকে শায়েস্তা করার জন্য সরদার বুধসিংয়ের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দেয়। মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে এটাই ছিল শিখদের সর্বপ্রথম মোকাবেলা। এতে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। এরপর ‘হাযারা’ নামক স্থানে দ্বিতীয়বার সংঘর্ষ হয়। এতেও শিখরা সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়। এই বিজয়ের ফলে মুসলমানদের মধ্যে আত্মপ্রত্যয়ের সৃষ্টি হয়। এসব যুদ্ধের পেছনে কারণ ছিল মুসলমানদের জীবন নিপীড়নমুক্ত করা, ইংরেজ ও ইংরেজপোষ্য শাসকদের কাবু করা। সম্প্রদায়গতভাবে শিখদের সঙ্গে লড়াই করা এর লক্ষ্য ছিল না। সে সময় মুজাহিদীন ও উপজাতীয় সরদারদের এক সমাবেশে সাইয়েদ আহমাদ শহীদকে ‘আমিরুল মু‘মিনীন’ করে ইসলামী খেলাফতের গোড়াপত্তন করা হয়। মুজাহিদ বাহিনীর আন্দোলন এতে নতুন মোড় লাভ করে।
কিন্তু সাইয়েদ আহমাদ রহ.-এর এই আন্দোলনে উপজাতীয় পাঠানদের সমর্থন ছিল না। কারণ, শিখদের সঙ্গে এদের নানা ধরনের বৈষয়িক স্বার্থ জড়িত ছিল। যুগ যুগ ধরে তারা গদি দখল করে সাধারণ জনগণকে শোষণ করে আসছিল। তাই সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে তাদের একটি সুস্পষ্ট বিরোধ জন্ম নেয়। ফলে তারা শিখদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গোপন চক্রান্তে মেতে উঠে। সংঘটিত হয় ‘সিদুর’ যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধে মুজাহিদদের আংশিক পরাজয় ঘটে। নানামুখী প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্রের কারণে তারা কিছুটা দমে যান। এরই মধ্যে ঘটে এক করুণ ঘটনা। একদিন মুজাহিদরা এশার নামাজ আদায় করছিলেন। এ সময় তাদের ওপর এক অতর্কিত হামলা হয়। এতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুজাহিদ নির্মমভাবে শহীদ হন। এই ঘটনায় মুজাহিদদের মনোবল অনেকটা ভেঙ্গে যায়। সৈয়দ আহমদ রহ. প্রত্যেককে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যাবার অনুমতি দেন। কিন্তু অনেকেই তাকে ছেড়ে যেতে রাজি হননি। অবশিষ্ট মুজাহিদদের নিয়ে সাইয়েদ আহমাদ রহ. পেশোয়ার উপত্যকা থেকে কাগানের পার্বত্য এলাকা দিয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু বালাকোটের কাছে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সরদার সেরসিংয়ের নেতৃত্বে একটি বিরাট শিখ সৈন্যবাহিনী এসে সমগ্র এলাকা ঘিরে ফেলে। মূলত পাঠানদেরই একটি গ্রুপ শিখদের এখানে নিয়ে আসে। ফলে বালাকোটের ময়দানে সংঘটিত হয় চূড়ান্ত ও শেষ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ে মুজাহিদ বাহিনী বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। কিন্তু কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতায় সৈয়দ আহমদ রহ., শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ.সহ প্রায় দু‘শ মুজাহিদ শাহাদাতবরণ করেন। দিনটি ছিল ১৮৩১ খৃস্টাব্দের ৬ মে।
এর মাধ্যমে সমাপ্ত হয় দীর্ঘ জিহাদি আন্দোলনের অবিস্মরণীয় একটি অধ্যায়। দীর্ঘ সংগ্রামের প্রবাহিত ধারা এখানে এসে থমকে দাঁড়ায়। রক্তের আঁখড়ে লেখা হয় বালাকোটের ঐতিহাসিক ট্রাজেডির কথা। তবে সৈয়দ আহমদ রহ. তাঁর লক্ষ্য অর্জনে অনেকাংশেই সফল হয়েছিলেন। সীমান্তের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের মানুষেরা শিখদের নির্যাতনের যাঁতাকল থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছিলেন। উপরন্তু পেশোয়ারকেন্দ্রিক একটি ইসলামী খেলাফত কায়েম করে চার বছরাধিককাল তা পরিচালনা করে সফল দৃষ্টান্তও তিনি স্থাপন করেছেন। যা পরবর্তী যুগের ঈমানদীপ্ত মুসলমানদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। পরবর্তী সময়ে সংঘটিত সিপাহী বিপ্লব, রেশমি রুমাল আন্দোলন, আযাদী আন্দোলন ও ফরায়েজী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লবই বালাকোটের প্রেরণা ফসল।
উপসংহার : বালাকোট মূলত একটি চেতনার নাম। এই নামটি ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের উজ্জীবিত করে। এর চেতনা আমাদেরকে সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়। বালাকোটের শিক্ষাও এই অঞ্চলের মুসলমানদের বিশেষ পাথেয়। ঝলসে ওঠা একটি আন্দোলনকে মুখোশধারী মুনাফিকরা কিভাবে আপাত ব্যর্থ করতে পারে এর জ্বলন্ত উদাহরণ বালাকোট। এজন্য সব সময় সজাগ থাকতে হবে, চেতনার সিঁড়ি বেয়ে ছড়িয়ে পড়া কোনো আন্দোলন ও সংগ্রাম যেন গুটিকতক মুনাফিক ও স্বার্থান্বেষী মানুষের জন্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়। বালাকোটের অবিনাশী চেতনা শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদেরকে পথ দেখাবে এগিয়ে চলার। চেতনার বাতিঘর অনুসরণ করে চললে মুসলিম জাতি কখনও পথ হারাবে না।
তথ্যসূত্র :
১. বাংলা উইকিপিডিয়া
২. ঈমান যখন জাগলো/সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী
৩. জিহাদ আন্দোলনে বাংলার ভূমিকা/মাওলানা মহিউদ্দীন খান
৪. কেন্দ্রীয় সম্মেলন স্মারক-২০১৪ইং
৫. চেতনায় বালাকোট/জহির উদ্দীন বাবর
লেখক : নূরুল করীম আকরাম