পবিত্র কুরআনের যেসব শব্দ মৌলিকত্বের দাবী রাখে ইলাহ إله শব্দটি এর মাঝে অন্যতম। শব্দটি পবিত্র কুরআনে বহুল ব্যবহৃত শব্দসমূহের একটি। মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারীমের প্রায় স্থানেই ইলাহ নিয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন।
ইসলামের প্রাথমিক যুগ কুরআন নাজিলের সময় থেকে নিয়ে হিজরী ১৩ শতাব্দীকাল পর্যন্ত শব্দটির অর্থ, ভাবার্থ ও মর্মার্থ নিয়ে কোন মুফাসিসর, মুহাদ্দিস, ফকীহ বা ভাষাবিদ কেউই ভিন্নমত পোষণ করেন নি। হিজরী ১৪ শতাব্দীতে এসে ভারতীয় অন্যতম মুসলিম দার্শনিক মাওলানা মওদূদী-ই প্রথম এ শব্দটি নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তিনি পূর্ববর্তী সকল ইসলামী দার্শনিকদের ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে শব্দটির বিভিন্ন শাব্দিক অর্থ মিলিয়ে একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাখ্যা তৈরি করেন। এবং এর মাধ্যমে সূচনা করলেন নতুন এক বিতর্কের। আর কেউ কেউ ইলাহের ব্যাখ্যা এভাবে করেন যে, ইসলামের পূর্ণাঙ্গরূপটি অবশিষ্ট থাকেনা।
শব্দটির অর্থ কি? পবিত্র কুরআন ও হাদীসে শব্দটি কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং সালফে সালেহীন শব্দটির কি ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইত্যাদি নিয়ে বক্ষমান প্রবন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হবে ইনশাআল্লাহ।
শাব্দিক ব্যাখ্যা
আরবীতে إله শব্দটি পুঃলিঙ্গ। স্ত্রীলিঙ্গ হলো إلهة বহুবচন হিসেবে آلهة ব্যবহার হয়।
ইলাহ إله এর ধাতুমূল أ- ل – ه (আলিফ লাম হা)। আরবী ভাষায় উক্ত ধাতুমূল হতে নির্গত ক্রিয়াপদের বিভিন্ন অর্থ হয়ে থাকে। অবস্থাভেদে এসব অর্থ পরিবর্তন হয়। নি¤েœ কয়েকটি অর্থ উল্লেখ করা হলো:-
এক. أله (تحير)দিশেহারা হওয়া, হতবুদ্ধি হওয়া, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া।
দুই. أله (عبد) উপাসনা করা।
তিন. (لجأ الى) أله الىআশ্রয় গ্রহণ করা।
চার. أله جاره)/ (آمنনিরাপত্তা দেয়া, আশ্রয় দেয়া।
পাঁচ. (أقام) أله بِ প্রতিষ্ঠা করা।
ছয়. أله على (اشتدّ جزعه) রাগ বা ক্রোধ বৃদ্ধি হওয়া।
সাত. ألّهه (اتخذه معبوداً) কাউকে উপাস্য হিসেবে ¯^ীকার করা।
আট. ألهه (اتخذه عابداً)কাউকে উপাসনাকারী বানানো।
নয়. কোন কোন ভাষাবিদের মতে إله শব্দটি মূলত ولاه ছিল। “و” (ওয়াও) কে “إ” (হামযাহ) দ্বারা পরিবর্তন করা হয়েছে। ولاه শব্দের অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, গোপন রাখা, আশ্রয় চাওয়া, দূর্বল হওয়া।
আল্লাহ এবং ইলাহ
الله শব্দটি إله ইলাহ থেকে নির্গত কিনা এ নিয়ে আরবী ভাষাবিদরা মতবিরোধ করেছেন। কোন কোন ভাষাবিদের মতানুযায়ী ألله (মহান আল্লাহর অস্তিত্ববাচক) শব্দটি ইলাহ إله মূলধাতু থেকে নির্গত। কিন্তু প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী আল্লাহ ألله শব্দটি কোন ধাতু থেকে নির্গত নয়।
আল্লাহ এবং ইলাহ উভয় শব্দ দিয়ে সকল গুণ ও প্রশংসার আধার মহান সৃষ্টিকর্তাকে বুঝানো হলেও উভয়ের মাঝে রয়েছে শব্দগত ও অর্থগত পার্থক্য।
শব্দগত পার্থক্য
আল্লাহ শব্দটির কোন স্ত্রীলিঙ্গ, দ্বি-বচন বা বহুবচন কিছুই নেই। পক্ষান্তরে ইলাহ শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গ, দ্বি-বচন ও বহুবচন ব্যবহৃত হয়।
অর্থগত পার্থক্য
ইলাহ শব্দটি সত্য ও মিথ্যা, প্রকৃত ও ভ্রান্ত সবধরণের উপাস্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। পক্ষান্তরে আল্লাহ শব্দটি কেবলমাত্র সত্য ও প্রকৃত ইলাহ সকল গুণাবলী ও সু-বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মহান সৃষ্টিকর্তার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।
পরিভাষায় ইলাহ
পারিভাষিক অর্থে ইলাহ হলো মানব ও দানবপ্রকৃতির ঊর্ধ্বে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন অতি প্রাকৃতিক এক সত্ত¡া যার দিকে বিনয়ী ও মস্তকাবনত হয়ে উপাসনা করা হয়। অর্থাৎ যার উপাসনা করা হয় তিনিই ইলাহ। তিনি সত্য হোক কিংবা ভ্রান্ত হোক। সে হিসেবে প্রতিটি ধর্মে যার উপাসনা করা হয় সে ধর্মের বিশ্বাসানুযায়ী তিনি হন সে ধর্মাবল¤^ীদের ইলাহ বা উপাস্য। ইসলাম ধর্মে ইলাহ হলেন কেবল ঐ সত্ত¡া যিনি ¯^ীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য বলে ইবাদাতের উপযুক্ততা রাখেন। আর তিনি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নন।
ইলাহ নিয়ে বিভিন্ন ধারণা
ইলাহ নিয়ে মৌলিকভাবে চারটি ধারণা পাওয়া যায়।
১. নিরীশ্বরবাদী ধারণা
এমন একটি ধারণা যাতে জগতে কোন সৃষ্টিকর্তা, ইলাহ বা উপাস্য-এর অস্তিত্ব ¯^ীকার করা হয় না। বিশ্বাস করা হয় জগতে সবকিছুই প্রাকৃতিক। এ ধারণাটিকে নাস্তিক্যবাদী ধারণাও বলে। অনেক ধর্মতত্ত¡বিদরা বৌদ্ধধর্মকে নিরীশ্বরবাদী ধর্ম আখ্যা দিয়েছেন।
২. সর্বেশ্বরবাদী ধারণা
এমন একটি ধারণা, যাতে সম্পূর্ণ এ মহাবিশ্বকে তথা পরিবেশ প্রকৃতিকে ইশ্বর সম বলে গণ্য করা হয়। অথবা আমাদের আশেপাশে পরিবেষ্টিত সকল বস্তুর ভেতরেই ইশ্বর বা উপাস্য অন্তর্নিহিত রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
৩. বহু-ইশ্বরবাদী ধারণা
এমন একটি ধারণা যাতে একাধিক ইলাহ বা উপাস্য-এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা হয়। এতে শক্তিশালী ও অলৌকিক কোন বস্তুকেই বিশেষত উপাসনা করা হয়।
বিশ্বে বহু-ইশ্বরবাদে বিশ্বাসীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো:-
ক. ৩৩ কোটি দেবতায় বিশ্বাসী হিন্দু ধর্মাবল¤^ীরা।
খ. কাবার অভ্যান্তরে ৩৬০ দেবতাসহ বহু ইলাহের উপাসনাকারী আরব পৌত্তলিকরা।
গ. পুরাণ গ্রীক অনুসারীরা।
৪. একেশ্বরবাদী ধারণা
এমন একটি ধারণা যাতে ইলাহ হিসেবে একজনকেই বিশ্বাস করা হয়। সৃষ্টিকর্তা, ত্রাণকর্তা, লালন-পালনকর্তা ও সংহারকর্তা ইত্যাদী একজনই। এবং উপাসনাও হবে কেবলমাত্র একজনের। একে তাওহীদ বা একত্ববাদও বলা হয়।
একেশ্বরবাদী ধর্মসমূহের মধ্যে প্রসিদ্ধ হলো:-
ইসলাম, ইয়াহুদী ও খৃস্টান ধর্ম। এর মধ্যে ইয়াহুদী ও খৃস্টান ধর্ম একেশ্বরবাদী হিসেবে প্রসিদ্ধ হলেও একত্ববাদের মূল দাবী এখানে অনুপস্থিত। কেননা ইয়াহুদীরা হযরত ওযায়ের আ. কে ও খৃস্টানরা হযরত ঈসা আ. কে আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করে নাউযুবিল্লাহ। যা মহান আল্লাহর একত্ববাদের পরিপন্থি। সে হিসেবে বিশ্বে নিরেট একত্ববাদী ধর্ম কেবলমাত্র ইসলাম।
পবিত্র কুরআনে ইলাহ শব্দের অর্থ
পবিত্র কুরআনুল কারীমে إله শব্দটি দ্বারা মৌলিকভাবে দু’টি অর্থ বুঝানো হয়েছে।
এক. ইলাহ إله বা আÑলিহাতুন آلهة বলে প্রকৃত উপাস্য মহান আল্লাহ ছাড়া মানুষের বানানো মিথ্যা ও ভ্রান্ত উপাস্য বুঝানো হয়েছে। যেখানে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে আরব্য মূর্তি, চন্দ্র-সূর্য, মিথ্যা খোদা দাবীদার অবাধ্য, মানবীয় নফস ও প্রবৃত্তিসহ মানুষের বানানো সকল মিথ্যা উপাস্য।
যেমন- মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
أم لهم الهٌ غيرالله سبحان الله عمّايشركون.
নাকি তাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ বা উপাস্য আছে? তারা যা শিরক করে আল্লাহ তা হতে পবিত্র। (সূরা তূর : ৪৩)
وأتخذوا من دون الله آلهة لعلّهم ينصرون.
অথচ তারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যসব ইলাহ গ্রহণ করেছে এই প্রত্যাশায় যে তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। (সূরা ইয়াসিন : ৭৪)
أأنت قلت للناس اتخذونى وأمى إلهين من دون الله.
হে মারইয়াম পুত্র ঈসা, তুমি কি মানুষদেরকে বলেছিলে তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাতাকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর? (মায়েদা : ১১৬)
قَالُوۡۤا ءَاَنۡتَ فَعَلۡتَ ہٰذَا بِاٰلِہَتِنَا یٰۤـاِبۡرٰہِیۡمُ
তারা বলল, ‘হে ইবরাহীম, তুমিই কি আমাদের ইলাহসমূহের সাথে এরূপ করেছ’?
(সূরা আ¤ি^য়া : ৬২)
قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ اِنۡ اَخَذَ اللّٰہُ سَمۡعَکُمۡ وَ اَبۡصَارَکُمۡ وَ خَتَمَ عَلٰی قُلُوۡبِکُمۡ مَّنۡ اِلٰہٌ غَیۡرُ اللّٰہِ یَاۡتِیۡکُمۡ بِہٖ ؕ اُنۡظُرۡ کَیۡفَ نُصَرِّفُ الۡاٰیٰتِ ثُمَّ ہُمۡ یَصۡدِفُوۡنَ
বল, ‘তোমাদের কি ধারণা, যদি আল্লাহ তোমাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেন এবং তোমাদের অন্তরসমূহে মোহর এঁটে দেন, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ আছে, যে তোমাদের এগুলো ফিরিয়ে দিবে’? লক্ষ্য কর, কীভাবে আমি বিভিন্নরূপে নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করি, তারপরও তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়।’
(সূরা আনআম : ৪৬)
وَ قَالَ اللّٰہُ لَا تَتَّخِذُوۡۤا اِلٰـہَیۡنِ اثۡنَیۡنِ ۚ اِنَّمَا ہُوَ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ ۚ فَاِیَّایَ فَارۡہَبُوۡنِ
আর আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা দুই ইলাহ গ্রহণ করো না। তিনি তো কেবল এক ইলাহ। সুতরাং তোমরা আমাকেই ভয় কর।’
(সূরা নাহল : ৫১)
দুই. ইলাহ إله বলে সত্য ও প্রকৃত উপাস্য হিসেবে মহান সৃষ্টিকর্তা, পরম দয়ালু ও সর্বশক্তিমান আল্লাহকে বুঝানো হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে
قالوا نعبد الهك واله آبائك ابراهيم واسماعيل واسحاق الهاً واحداً
তারা বলল,‘ আমরা ইবাদাত করব আপনার ইলাহের, আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহের। যিনি এক ইলাহ।’ (সূরা বাকারা : ১৩৩)
انماالله اله واحد سبحانه أن يّكون له ولدٌ
আল্লাহই কেবল এক ইলাহ। তিনি পবিত্র ও মহান এ থেকে যে, তাঁর কোন সন্তান হবে।
(সূরা নিসা : ১৭১)
وَ اِلٰـہُکُمۡ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ ۚ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ الرَّحۡمٰنُ الرَّحِیۡمُ
আর তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি অতি দয়াময়, পরম দয়ালু। (সূরা বাকারা : ১৬৩)
قُلۡ اِنَّمَاۤ اَنَا بَشَرٌ مِّثۡلُکُمۡ یُوۡحٰۤی اِلَیَّ اَنَّمَاۤ اِلٰـہُکُمۡ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ ۚ فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّہٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ رَبِّہٖۤ اَحَدًا ﴿۱۱۰﴾
বল, ‘আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার নিকট ওহী প্রেরণ করা হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ। সুতরাং যে তার রবের সা¶াৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে’। (সূরা কাহ্ফ : ১১০)
وَ ہُوَ الَّذِیۡ فِی السَّمَآءِ اِلٰہٌ وَّ فِی الۡاَرۡضِ اِلٰہٌ ؕ وَ ہُوَ الۡحَکِیۡمُ الۡعَلِیۡمُ ﴿۸۴﴾
আর তিনিই আসমানে ইলাহ এবং যমীনেও তিনিই ইলাহ; আর তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।
(সূরা যুখরুফ : ৮৪)
اِلٰہِ النَّاسِ
মানুষের ইলাহ্ এর কাছে। (সূরা নাস : ০৩)
হাদীস শরীফে ইলাহ শব্দের অর্থ
পবিত্র কুরআনের ন্যায় হাদীস শরীফেও ইলাহ শব্দটি মৌলিকভাবে দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
(এক) ইলাহ إله বা আÑলিহাতুন آلهة বলে প্রকৃত উপাস্য মহান আল্লাহ ছাড়া মিথ্যা-বানোয়াট ও ভ্রান্ত উপাস্য বুঝানো হয়েছে।
যেমন- হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে,
عن أبي سعيدنالخدري رضي الله عنه قال- … رسول الله صلى الله عليه وسلم … قال ينادي منادٍ ليذهب كلّ قومٍ الى ماكانوا يعبدون فيذهب أصحاب الصليب مع صليبهم وأصحاب الأوثان مع أوثانهم، وأصحاب كلّ آلهة مع آلهتهم حتى يبقى من كان يعبد الله.
(الصحيح البخارى ১১০৭/২ كتاب التوحيد- باب قول الله تعالى وجوه يومئذ ناضرة الى ربها ناظرة)
হযরত আবু সায়ীদ খুদ্রী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সেদিন একজন ঘোষক ঘোষণা করবেন, যারা যে জিনিসের ইবাদাত করতে তারা সে জিনিসের কাছে গমন কর। এরপর যারা ক্রুশপুজারী ছিল তারা যাবে তাদের ক্রুশের কাছে। মূর্তিপুজারীরা যাবে তাদের মূর্তির সঙ্গে। সকলেই তাদের উপাস্যের সঙ্গে যাবে। বাকী থাকবে একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদাতকারীরা। (বুখারী খ.২ পৃ.১১০৭ হা.৭১৩৯ তাওহীদ অধ্যায়)
(দুই) ইলাহ إله বলে সত্য ও প্রকৃত উপাস্য হিসেবে মহান সৃষ্টিকর্তা, পরম দয়ালু ও সর্বশক্তিমান আল্লাহকে বুঝানো হয়েছে।
হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে,
عن ابن عباس رضي الله عنه قال كان النبى صلى الله عليه وسلم يدعو من الليل … فاغفرلي ماقدمت وماأخرتُ وأسررتُ وأعلنتُ أنت الهى لااله لي غيرك- (الصحيح البخارى ১০৯৯/২ كتاب التوحيد- باب وهوالذى خلق السموات والأرض)
হযরত ইবনু আব্বাস রাযি. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত্রিকালে এ দুআ করতেন ……….. সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। ক্ষমা করে দিন আমার আগের ও পরের গুনাহসমূহ যা আমি গোপনে ও প্রকাশ্যে করেছি। এবং আপনিই আমার ইলাহ। আপনি ছাড়া আমার কোন ইলাহ নেই। (বুখারী খ.২ পৃ.১০৯৯ হা.৭০৮৮)¬¬
আল-কুরআনে ইলাহ শব্দের ব্যবহার
পবিত্র কুরআনে ইলাহ শব্দ ব্যবহারের মূল কারণ ছিল অন্যসকল ইলাহ বাদ দিয়ে কেবল এক উপাস্যের অস্তিত্বকেই ফুটিয়ে তোলা। যে কয়টি পন্থায় মহান আল্লাহ তা ফুটিয়ে তোলেন তার কয়েকটি নিম্নে উদ্ধৃত হলো
(এক) কি উদ্দেশ্যে মিথ্যা উপাস্যদের উপাসনা করা হতো তা উল্লেখ করে তাদের ভ্রষ্টতা, ভ্রান্ততা ও ব্যর্থতা স্পষ্ট করা হয়েছে।
وَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اٰلِہَۃً لَّعَلَّہُمۡ یُنۡصَرُوۡنَ .لَا یَسۡتَطِیۡعُوۡنَ نَصۡرَہُمۡ ۙ وَ ہُمۡ لَہُمۡ جُنۡدٌ مُّحۡضَرُوۡن
অথচ তারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্য সব ইলাহ গ্রহণ করেছে, এই প্রত্যাশায় যে, তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। এরা তাদের কোন সাহায্য করতে স¶ম হবে না, বরং এগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে বাহিনীরূপে হাযির করা হবে।
(সূরা ইয়াসীন : ৭৪,৭৫)
(দুই) মহান আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহ থাকলে কি সমস্যা হতো তা স্পষ্ট করা হয়েছে।
لَوۡ کَانَ فِیۡہِمَاۤ اٰلِہَۃٌ اِلَّا اللّٰہُ لَفَسَدَتَا ۚ فَسُبۡحٰنَ اللّٰہِ رَبِّ الۡعَرۡشِ عَمَّا یَصِفُوۡنَ
যদি আসমান ও যমীনে আল্লাহ ছাড়া বহু ইলাহ থাকত তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত, সুতরাং তারা যা বলে, আরশের রব আল্লাহ তা থেকে পবিত্র। (সূরা আ¤ি^য়া : ২২)
مَا اتَّخَذَ اللّٰہُ مِنۡ وَّلَدٍ وَّ مَا کَانَ مَعَہٗ مِنۡ اِلٰہٍ اِذًا لَّذَہَبَ کُلُّ اِلٰہٍۭ بِمَا خَلَقَ وَ لَعَلَا بَعۡضُہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ ؕ سُبۡحٰنَ اللّٰہِ عَمَّا یَصِفُوۡنَ
আল্লাহ কোন সন্তান গ্রহণ করেননি, তাঁর সাথে অন্য কোন ইলাহও নেই। (যদি থাকত) তবে প্রত্যেক ইলাহ নিজের সৃষ্টিকে নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একে অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করত; তারা যা বর্ণনা করে তা থেকে আল্লাহ কত পবিত্র! (সূরা মুমিনুন : ৯১)
(তিন) আল্লাহ ছাড়া ভিন্ন কাউকে ইলাহ মানলে আযাবের কথা উল্লেখ হয়েছে।
ذٰلِکَ مِمَّاۤ اَوۡحٰۤی اِلَیۡکَ رَبُّکَ مِنَ الۡحِکۡمَۃِ ؕ وَ لَا تَجۡعَلۡ مَعَ اللّٰہِ اِلٰـہًا اٰخَرَ فَتُلۡقٰی فِیۡ جَہَنَّمَ مَلُوۡمًا مَّدۡحُوۡرًا
এগুলো সেই হিকমতভুক্ত, যা তোমার রব তোমার নিকট ওহীরূপে পাঠিয়েছেন। আর তুমি আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য নির্ধারণ করো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও বিতাড়িত হয়ে জাহান্নামে নি¶িপ্ত হবে । (সূরা বানী-ইসরাঈল : ৩৯)
لَا تَجۡعَلۡ مَعَ اللّٰہِ اِلٰـہًا اٰخَرَ فَتَقۡعُدَ مَذۡمُوۡمًا مَّخۡذُوۡلًا
আল্লাহর সাথে অপর কোন ইলাহ নির্ধারণ করো না। তাহলে তুমি নিন্দিত ও লাঞ্ছিত হয়ে যাবে। (সূরা বনী-ইসরাঈল : ২২)
(চার) ইলাহ হিসেবে কেবলমাত্র আল্লাহর অস্তিত্বকেই জোর তাকীদ দিয়ে বুঝানো হয়েছে।
اِنَّ اِلٰـہَکُمۡ لَوَاحِدٌ
নিশ্চয় তোমাদের ইলাহ এক। (সূরা সাফফাত : ৪)
اِلٰـہُکُمۡ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ ۚ فَالَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ قُلُوۡبُہُمۡ مُّنۡکِرَۃٌ وَّ ہُمۡ مُّسۡتَکۡبِرُوۡنَ
তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। অতঃপর যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর অ¯^ীকারকারী এবং তারা অহংকারী। (সূরা নাহল : ২২)
(পাঁচ) অন্যসব ইলাহ(?) কে অ¯^ীকার ও প্রত্যাখ্যান করে এক আল্লাহকেই কেবলমাত্র ইলাহ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। (পবিত্র কুরআনে ইলাহ শব্দটি এ পদ্ধতিতেই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।)
اَللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَۚ اَلۡحَیُّ الۡقَیُّوۡمُ
আল্লাহ! তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সব কিছুর ধারক। (সূরা বাকারা : ২৫৫)
اِنَّ ہٰذَا لَہُوَ الۡقَصَصُ الۡحَقُّ ۚ وَ مَا مِنۡ اِلٰہٍ اِلَّا اللّٰہُ ؕ وَ اِنَّ اللّٰہَ لَہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ
নিশ্চয় এটি সত্য বিবরণ। আর আল্লাহ ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই এবং নিশ্চয় আল্লাহ, তিনিই হলেন পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাপূর্ণ। (সূরা আলে ইমরান : ৬২)
ইলাহের দ্বি-প্রান্তিক ব্যাখ্যা
মধ্যপন্থা থেকে দূরে সরে ও সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে সত্য ও প্রকৃত ইলাহ বা উপাস্য আল্লাহকে দু’ভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে।
এক. আল্লাহ-ই কেবলমাত্র ইলাহ যিনি ইবাদাত বা উপাসনার যোগ্য। উলূহিয়াতের দাবীর প্রে¶িতে তার-ই ইবাদাত করতে হয়। তিনি ভিন্ন কারো ইবাদাত করা যায় না। তবে ইবাদাত হিসেবে ইসলামের স্তম্ভ খ্যাত নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও তাসবীহ, তাহলিল, তাহমীদ ইত্যাদী জিকির-আজকার সহ ব্যক্তিজীবনে অবশ্য পালনীয় আল্লাহর বিধানাবলী মানলেই যথেষ্ট।
উলূহিয়াতের দাবী হিসেবে এতটুকুন ইবাদাতেই ¶ান্ত ব্যক্তিবর্গ ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ¶েত্রে ইলাহের যে বিধান বা নির্দেশনা আছে তা পালন করা বা মানার প্রতি তেমন গুরুত্বারোপ করেন না।
উক্ত ব্যাখ্যানুসারে ইলাহকে এমন ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করা হয়েছে যে কেবলমাত্র ব্যক্তিজীবনেই তাঁর ইবাদাত করতে হবে। ব্যক্তিজীবনে দেয়া তাঁর নির্দেশনাগুলিই পালনীয়। ভিন্ন কোন ¶েত্রে নয়।
উক্ত ব্যাখ্যাগ্রহণে সমস্যাবলী
(এক) উক্ত ব্যাখ্যাটি অনেকটা বৈরাগ্যবাদী ধারণার সাথে সাজুয্যপূর্ণ। অথচ ইসলামে বৈরাগ্যবাদ ধারণার কোন ভিত্তি নেই।
(দুই) উক্ত ব্যাখ্যানুসারে ইসলাম শুধু ব্যক্তিজীবনে সীমাবদ্ধ হয়ে অপরাপর ধর্মের ন্যায় উপস্থাপিত হবে। অথচ ইসলাম অপরাপর ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
(তিন) ইসলামের রাজনৈতিক দিকটি সম্পূর্ণ মুছে যাবে। ইসলাম উপস্থাপিত হবে রাজনীতি বিমুখ ধর্ম হিসেবে। যা মূলত ধর্মনিরপে¶তাবাদীদের রাষ্ট্র থেকে ধর্ম কে আলাদা করার আন্দোলনেরই অন্যতম বহিঃপ্রকাশ।
(চার) ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। উক্ত ব্যাখ্যানুসারে ইসলাম ব্যক্তিজীবনে সীমাবদ্ধ হয়ে তার পূর্ণাঙ্গতা হারাবে।
দুই. ইলাহের ব্যখ্যা করা হয়েছে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ভঙ্গিতে। ইলাহ কে উপস্থাপন করা হয়েছে শুধুমাত্র একজন শাসক বা রাজা হিসেবে। যিনি অধীনস্থদের দিয়ে কাজ করান আর অধীনস্থরাও ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাঁর কাজ করে দেয়। এ ব্যাখ্যায় ইলাহের যে মূল পরিচয়গুলো আছে তিনি অতি মেহেরবান, পরম দয়ালু ইত্যাদী কে উপে¶া করা হয়েছে। সর্বপ্রথম এ ব্যাখ্যা করেন ভারতীয় মুসলিম লেখক মাওলানা মওদূদী। পরবর্তীতে মিসরের সাইয়েদ কুতুবও এ ব্যাখ্যার সমর্থন করেছিলেন।
ইলাহের ব্যাখ্যায় মাওলানা মওদূদী লিখেন “সুতরাং উলূহিয়াতের মূল স্পিরিট হলো ¶মতা। বিশ্ব জাহানের ব্যবস্থাপনায় তাঁর কর্তৃত্ব অতি প্রাকৃতিক ধরনের বা বৈষয়িক জীবনে মানুষ তাঁর নির্দেশের অধীন। আর তাঁর নির্দেশ যথাস্থানে অবশ্য পালনীয়। এর যে কোন অর্থেই সে ¶মতাকে ¯^ীকার করে নেয়া হোক না কেন। ¶মতার এ ধারণার ভিত্তিতেই গায়রুল্লাহর অ¯^ীকার এবং কেবল আল্লাহর উলূহিয়াত প্রতিষ্ঠা করার জন্যই কুরআন সর্বশক্তি নিয়োজিত করে।”
উক্ত ব্যাখ্যাগ্রহণে সমস্যাবলী
(এক) উক্ত ব্যাখ্যাগ্রহণে ইলাহ উপস্থাপিত হবে নিছক একজন শাসক বা মনিব হিসেবে। যিনি ¯^ীয় কর্মচারী দিয়ে কাজ করিয়ে তৃপ্ত হন। এবং কর্মচারীরাও ইচ্ছা-অনিচ্ছায় দায়সারাভাবে কাজগুলো করে মনিবকে খুশি করে। এতে উভয়ের মাঝে হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা, প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্কের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত থাকে ভীতিকর এক সম্পর্ক।
যদ্দরূণ ইবাদাত পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য অন্যতম যে শর্ত ‘বান্দাহ ইলাহকে পরিপূর্ণ ভালোবাসা’ তা অনুপস্থিত থাকবে। ফলে বান্দাহ কর্তৃক ইলাহের ইবাদাতটিও পূর্ণাঙ্গরূপে হবে না।
(দুই) রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষিত হাদীসে বর্ণিত ইসলামের মূল স্তম্ভ খ্যাত নামাজ -রোজা ইত্যাদী গুরুত্বহীনভাবে উপস্থাপিত হবে।
(বস্তুত মাওলানা মওদূদী করেছেনও তাই। ইসলামের মূল স্তম্ভ নামাজ রোজা ইত্যাদী কে প্রশি¶ণ কোর্স বলে রাজনীতিকেই ইসলামের মূল প্রাণ আখ্যা দিয়েছেন। যা স্পষ্টত হাদীস বিরোধী তথা ইসলাম বিরোধী )
(তিন) প্রায় ১৪০০ বছর ধরে মুফাস্সিরীনে কেরাম ইলাহের যে ব্যাখ্যা করেছেন তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে। ফলে সর্বযুগে আল কুরআনের শব্দ ও মর্ম হিফাজত থাকার যে মুজিযা আছে তাও অবশিষ্ট থাকবে না।
(চার) ইসলাম একটি রাজনীতি-সর্ব¯^ ধর্ম হিসেবে উপস্থাপিত হবে। অথচ রাজনীতিই ইসলাম নয়, বরং ইসলামের একটি অংশ।
(পাঁচ) ইসলামকে রাজনীতি সর্ব¯^ ধর্ম আখ্যা দেওয়ায় ল¶াধিক আ¤ি^য়া কেরামের যে মূল মিশন মানুষকে মূর্তি, চন্দ্র-সূর্য, ন¶ত্র ইত্যাদীর পূজা-অর্চনা থেকে বিরত রাখা তা গুরুত্বহীন হয়ে যাবে।
(ছয়) ব্যক্তিজীবনে ইসলাম পালনের যে প্রথম কাজ তা সম্পূর্ণ গুরুত্বহীনভাবে উপস্থাপিত হবে।
(বাস্তবে হয়েছেও তাই। এ ব্যাখ্যাগ্রহণকারীদের ব্যক্তিজীবনে তেমন ইসলামী নির্দেশনাবলী দেখা যায় না।)
ইলাহের প্রকৃত ব্যাখ্যা ও উলূহিয়্যাতের দাবী:
ইলাহের উপরোল্লিখিত দ্বি-প্রান্তিক ব্যাখ্যার মাঝামাঝিই হলো ইলাহের প্রকৃত ব্যাখ্যা ও উলূহিয়াতের ন্যায়ানুগ দাবী। পবিত্র কুরআন-হাদীসে ইলাহের ব্যবহার ও ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা বিবেচনায় ইলাহের প্রকৃত ব্যাখ্যা এরূপ মাঝামাঝি পর্যায়ে হওয়াই ন্যায়সঙ্গত।
কেননা উলূহিয়াতের দাবী হিসেবে যদি শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনে অবশ্য পালনীয় ইবাদাতকেই যথেষ্ট ভাবা হয় এবং ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দীন হিসেবে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহ ব্যক্তিজীবনের বাইরেও যে মহান আল্লাহর নির্দেশনা আছে তা যদি অ¯^ীকার বা অপ্রয়োজন মনে করা হয় তবে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে মানা হবে না। উলূহিয়াতের ঐকান্তিক যে দাবী ইলাহের ইবাদত বা উপাসনা করা তাও পূর্ণাঙ্গরূপে সম্ভব হবে না।
অপরদিকে যদি রাজনৈতিক ভঙ্গিতে ইলাহের ব্যাখ্যা করে ইলাহের হাকিমিয়্যাতকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। এবং একেই ইসলামের মূল ও মূখ্য আখ্যা দেওয়া হয় তবে ইসলামের মূল স্তম্ভ ও প্রাণ নামাজ, রোজা ইত্যাদীর প্রতি অনীহা সৃষ্টি হবে। আল্লাহর স্মরণে রাত্রিজাগরণ, তার জিকিরে প্রশান্তি অনুধাবন ইত্যাদী থেকে মন দূরে সরে যাবে। তাঁর প্রতি ইখলাস ও আত্মত্যাগের মানসিকতা লোপ পেয়ে যাবে। বান্দাহ ও ইলাহের মাঝে আন্তরিকতা ও হৃদ্যতা, প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক মুছে যাবে। রাব্বুল আলামিনের যে মূল পরিচয় তা দৃষ্টি-আড়াল হয়ে যাবে। উভয়ের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হবে শাসক শাসিতের মতো ভীতিকর এক সম্পর্ক। যদ্দরূণ কুরআনের অসংখ্য আয়াত ও হাদীস দ্বারা উভয়ের মাঝে যে ভালোবাসা ও হৃদ্যতার সম্পর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণিত তা প্রকারান্তরে অ¯^ীকার করা হবে। ফলে উলূহিয়াতের দাবীর প্রেক্ষিতে বান্দাহ কর্তৃক ইলাহের যে ইবাদাত তাও পরিপূর্ণ হবে না।
এ ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি ইলাহের জন্য যেই উবূদিয়াত ¯^াভাবিক প্রাপ্য সেই উবূদিয়াতের ক্ষেত্রে আবদ্ বা উপাসনাকারী শাসক-শাসিতের ন্যায় মা’বুদের অনুগত বা অধীনে হওয়াকেই যথেষ্ট মনে করতেন না। বরং এর পাশাপাশি মা’বুদের প্রতি নিখাদ ভালোবাসারও শর্তারোপ করেছেন। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল উবূদিয়্যাহ’য় লিখেন-
لكنّ العبادة المأمور بها تتضمّن معنى الذلّ ومعنى الحبّ فهى تتضمن غاية الذلّ لله تعالى بغاية المحبة له
“কিন্তু শরিয়ত কতৃক আদিষ্ট ইবাদাতের মাঝে অনুগত হওয়া ও ভালোবাসাবোধ করা উভয়টিই অন্তর্ভূক্ত। কাজেই ইবাদাতের ভাষ্যের মাঝে আল্লাহ তা’আলার পরিপূর্ণ অধীনতার সাথে সাথে তার প্রতি প্রচন্ড নিখাদ ভালোবাসাও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।”
এরপর তিনি বলেন, ‘যদি কোন ব্যাক্তি কারও প্রতি বিদ্বেষ রাখা সত্তে¡ও তার অনুগত থাকে তাহলে তাকে উপাসনাকারী বলা যাবে না। তদ্রƒপ যদি কেউ কোন কিছু ভালোবাসে তবে তার বড়ত্ব ¯^ীকার না করে তখনো সে উপাসনাকারী হবে না। কাজেই আল্লাহর ইবাদাতের ক্ষেত্রে এ দু’টির একটি যথেষ্ট নয়। বরং আবশ্যক হলো বান্দাহর কাছে আল্লাহ হবেন সবচে বড় ও সবচে প্রিয়।’
ইলাহের ব্যাখ্যায় পূর্বাপর ওলামায়ে কেরামের মতামত :
পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরাম ¯^ ¯^ স্থান থেকে ইলাহের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মনেরভাব ব্যক্তকরণে তাদের শব্দ ও ধরণ ভিন্ন হলেও সকলের উদ্দেশ্য ছিল এক।
ইলাহের সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে;
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
ইলাহ হলো ঐ সত্ত¡া যিনি ¯^ীয় গুণবাচক বিশেষণসমূহের কারণে ইবাদাতের উপযুক্ততা রাখেন। আর এ গুণগুলো মানুষকে বাধ্য করে তাকে মন-দিল উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসতে ও তাঁর প্রতি বিনয়ী ও মস্তকাবনত হতে। কেননা ইলাহ তো তিনিই হবেন, প্রগাঢ় ভালবাসা ও অগাধ ভক্তি নিয়ে মানুষ যার উপাসনা করে। তাঁর প্রতি বিনয়ী ও নিচু হয়। আপন অক্ষমতা প্রকাশ করে। তাঁর শক্তি ও সামর্থ্যরে ¯^ীকারোক্তি দেয়। তিনি রাগাšি^ত হওয়াকে ভয় করে ও তাঁর রহমতের আশা করে। তাঁর জিকিরে প্রশান্তি লাভ করে ও তাঁর ভালোবাসায় ¯^স্তি খুঁজে পায়। আর এহেন/এরূপ গুণ ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সত্ত¡া এক আল্লাহ ব্যাতিরেকে ভিন্ন কেউ নেই।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘ইলাহ হলেন ঐ সত্ত¡া মানবাত্মা যার উপাসনা করে তাকে ভালোবেসে। তাঁর প্রতি বিনয়ী ও মস্তকাবনত হয়ে তাঁকে ভয় করে ও তাঁর বড়ত্ব অনুধাবন করে। তাঁর প্রতি আশা ও ভরসা নিয়ে।’
শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রহ. বলেন,
ইলাহ হলো মানবাত্মার পরম পাওয়া, আস্থার সর্বশেষ ঠিকানা ও নির্ভরতার সর্বোচ্চ চূড়া। নির্বোধ ও মূর্খদের কাছে বিষয়টি তুচ্ছ হলেও বোধ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জ্ঞানীদের নিকট তা অনেক কিছু। ইবাদাতের উপযুক্ত কেবলমাত্র তিনিই। তিনিই একমাত্র ইলাহ বা উপাস্য। তিনি আল্লাহ। আল্লাহ ব্যাতিত মানুষের বানানো মনগড়া যত উপাস্য আছে সবই ভ্রান্ত।
আল্লামা ইবনে রজব হা¤^লী রহ. বলেন,
ইলাহ হলো ঐ সত্ত¡া যার আনুগত্য করতে হয়। তার অবাধ্য হওয়া যায় না। আনুগত্য করতে হয় পরম ভক্তি ও গভীর শ্রদ্ধার সাথে। তাঁর বড়ত্ব বুঝে ও তাঁকে ভালোবেসে। তাঁর প্রতি আশা ও আস্থা রেখে। আর এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য আল্লাহ ছাড়া কারো মাঝে বিদ্যমান নেই বিধায় আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই।
শায়খ আব্দুল্লাহ আবূ বুত্বাইন রহ. বলেন,
ইলাহ হলো মা’বুদ, আর ইলাহিয়াত হলো ইবাদাত। ইবাদাত এমন সব কর্মকান্ড ও কথাবার্তাকে বলা হয়- যা আল্লাহ পছন্দ করেন ও যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন।
মোদ্দাকথা ইলাহ হলেন সর্বগুণে গুণাšি^ত এক মহান সত্ত¡া। তিনি শুধু দয়ালু নন, পরম দয়ালু। তিনি সৃষ্টিকর্তা ও সংহারকর্তা। তিনি পালনকর্তা ও ত্রাণকর্তা। তিনি একক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই ইত্যাদী। তিনি মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট আবয়বে সৃষ্টি করেছেন। তাকে বানিয়েছেন আশরাফুল মাখলূকাত। এই গোটা বিশ্ব চরাচর সৃজন করেছেন ভালোবাসার এই বনী আদমকে সেবা করার জন্য। তিনি বান্দাহকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। বান্দাহর সর্বোচ্চ ভালোবাসা পাওয়ার অধিকারও একমাত্র তাঁর। তাকেই সর্বোচ্চ ভালোবাসতে হবে। গভীর রজনীতে কায়মনোবাক্যে আবেগভরা প্রেমময়ী অশ্রæ মুনাজাত তিনি খুবই পছন্দ করেন। তিনি পছন্দ করেন তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেয়াকে। ইবাদাতের যোগ্য কেবলমাত্র তিনি। তিনি ব্যাতীত আর কারো ইবাদাত করা যাবে না। ব্যাক্তি জীবন থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত তিনি যে নির্দেশনা দিয়েছেন তার সবই মানতে হবে। তাঁকে সর্বোচ্চ ভালোবেসে, তাঁর নৈকট্যলাভের আশায়, তাঁর আযাবকে ভয় করে ও রহমতের আশা নিয়ে।
তথ্যসূত্র:-
১.আল-কুরআন
২.তাফসীরে ইবনে কাসীর- হাফেজ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীর
৩.তাফসীরে ফাতহুল মজিদ- আব্দুল মু’তী আস-সাখাভী
৪.তাফসীরে মা’আরেফুল কুরআন- মুফতি শফি
৫.তাফসীরে আহসানুল বয়ান- হাফেজ সালাহ উদ্দীন ইউসুফ
৬.তাফসীরে আবূ বকর জাকারিয়া- হাফেজ আবু বকর জাকারিয়া
৭.তাফসীরে জালালাইন- আল্লামা জালালুদ্দীন সূয়ুতী, আল্লামা জালালুদ্দীন মহল্লী
৮.তাফসীরে মোয়াস্সার- বাদশা ফাহাদ কুরআন প্রেস প্রকাশিত
৯.সহীহ্ বুখারী- আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী
১০.সহীহ্ মুসলিম- আল্লামা মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল কুশাইরী
১১.লিসানুল আরব- আল্লামা জামাল উদ্দীন আবুল ফজল ইবনে মনজুর
১২. মু’জামুর রায়েদ- আল্লামা জিবরান মাসউদ
১৩.মু’জামুল ওয়াসীত- মাজমাউল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ কায়রো, মিশর
১৪.মু’জামুল গনী- ড. আব্দুল গণী আবুল আযম
১৫.ইসলামের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা- সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী
১৬.ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ- মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন
১৭.মাওলানা মওদূদীর সাথে আমার সাহচর্যের ইতিবৃত্ত- মাওলানা মনযূর নূমানী
১৮.কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা- সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
১৯.তা’বীর কি গলত্বিয়াঁ- মাওলানা ওয়াহিদ উদ্দীন খান
২০.কালিমায়ে তায়্যিবার দাবি- মাওলানা গাজী আতাউর রহমান
২১.উইকিপিডিয়া
লেখক : মুহাম্মাদ মিশকাতুল ইসলাম
কলেমায় ব্যবহৃত ‘ইলাহ’ শব্দের প্রকৃত অর্থ, ‘যাঁর হুকুম মানতে হবে’ (He who is to be obeyed)। শতাব্দীর পর শতাব্দীর কাল পরিক্রমায় যেভাবেই হোক এই শব্দটির অর্থ ‘হুকুম মানা বা আনুগত্য’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে গেছে ‘উপাসনা, বন্দনা, ভক্তি বা পূজা করা (He who is to be worshiped)।
ঠিক বলেছেন।
আচ্ছা ইলাহ অর্থ হুকুমদ্বাতা এই একটা অর্থই বাকি সমস্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে পূর্ণতা দেয় কি না?
আপনাদের কী মনে হয়?
জ্বী পূর্ণতা দেয়। আলহামদুলিল্লাহ
ক্বলান নাবিউ( সঃ) আখলিস দীনাকা ইয়াকপিকাল আ’ মালুল ক্বলীল। সুতরাং আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে সব কাজ করতে হব।