عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ بَلِّغُوْا عَنِّيْ وَلَوْ آيَةً وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ وَلَا حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ-
হাদিসের অনুবাদ :
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন- আমার পক্ষ হতে লোকদের নিকট পৌঁছিয়ে দাও। যদিও তা একটি মাত্র বাক্য হয়। আর বনী ইসরাঈল থেকে শোনা কথা বর্ণনা করতে পার। তাতে কোন দোষ নেই। কিন্তু যে ব্যাক্তি ইচ্ছাকৃত আমার উপর মিথ্যারোপ করে সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে প্রস্তুত করে নেয়। [বুখারী-৪৩৬১]
রাবী পরিচিতি :
তাঁর নাম আবদুল্লাহ। উপনাম আবু মুহাম্মাদ ও আবু আব্দুর রহমান। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তার নাম ছিলো আল আস। তার পিতার নাম আমর ইবনুল আস। মাতার নাম রীতা বিনতুল মুনাব্বেহ। (www.iscabd.org)
তিনি তার পিতার পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার পিতা ৫ম অথবা ৮ম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তার পিতার বয়স তার থেকে ১০-১২ বছর বেশি ছিলো। কিন্তু ওয়াকিদীর মতে, পুত্র অপেক্ষা পিতার বয়স ২০ বছর বেশি ছিলো।
রাসুল সা. এর যুগে সংগঠিত সকল যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধের সময় সাধারণত সোয়ারী পশু সংগ্রহ করা ও জিনিসপত্র পরিবহনের দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হতো। ইয়ারমুকের যুদ্ধে তার বিশেষ কৃতিত্ব ছিলো। এই যুদ্ধে তার পিতা আমর ইবনুল আস রা. নিজের নেতৃত্বের ঝাণ্ডা তার হাতে তুলে দেন।
হাদিস শাস্রে তার বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি হাদিস শাস্রের লেখক ছিলেন। হাদিস শাস্রে তার লিখিত ‘সাদেকা’ নামের একটি রিসালা রয়েছে। তিনি ৬০০ বা মতান্তরে ৭০০ হাদিস বর্ণনা করেছেন। (www.icabdlibrary.com)
তিনি একজন আলেম, আবেদ ও হাফেজে কোরআন ছিলেন। আল্লাহর ভয়ে অধিক কান্নার ফলে তার চোখের পাতা নষ্ট হয়ে যায়।
গ্রন্থ পরিচিতি :
উক্ত হাদিসটি প্রসিদ্ধ হাদিস বিষয়ক গ্রন্থ صحیح البخاری এর باب ما ذکر عن بنی اسراءیل পরিচ্ছদে বর্ণিত হয়েছে। সহিহ বুখারীর আসল ও পৃরো নাম হলো-
الجامع المسند الصحیح المختصر من امور رسول صلی الله علیه وسلم وسننه وایامه
এটি হাদিস গ্রন্থ সমূহের মধ্যে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হাদিসের কিতাব। মুহাম্মাদ সা. এর বাণী সংবলিত এই গ্রন্থটি ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আল বুখারী রচনা করেন। তিনি ২১৭ হিজরী সনে মাত্র ২৩ বছর বয়সে মক্কার হারাম শরীফে বসে এই গ্রন্থ রচনা করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২৩৩ হিজরী সনে সংকলন সমাপ্ত হয়। বিখ্যাত এই গ্রন্থে ৭৫৬৩ টি হাদিস রয়েছে।
এছাড়াও হাদিসটি প্রসিদ্ধ হাদিসের কিতাব ‘মিশকাতুল মাসাবীহ’ এর کتاب العلم অধ্যায়ের প্রথম হাদিস হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। [মিশকাতুল মাসাবীহ-১৮৭]
হাদিস বর্ণনার প্রেক্ষাপট :
শায়খ ইবনে হামযাহ রচিত البیان والتعریف কিতাবে আলোচ্য হাদিসের পটভূমি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, একদা এক ব্যাক্তি রাসুল সা. এর অনুরূপ পোশাক পরিধান করে মদিনার কোন এক পরিবারে গিয়ে বলেন, নবী কারীম সা. আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তুমি যে কোন পরিবারের দায়িত্বশীল হতে পার। তখন উক্ত পরিবারের লোকজন তার জন্য একটি ঘর প্রস্তুত করে দেয়। (www.facebook.com/iscabd91)
এ খবর রাসুল সা. শোনা মাত্র হযরত আবু বকর রা. ও ওমর রা.-কে নির্দেশ দিয়েছেন তোমরা তাকে জীবিত পেলে হত্যা করবে। আর মৃত পেলে তোমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী ব্যাবহার করবে। এ সময় হুজুর সা. ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, আমার বিশ্বাস তোমরা তাকে মৃত পাবে। অতঃপর তারা তার নিকট এসে দেখলেন, রাতে প্রশ্রাব করার জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার পর তাকে বিষাক্ত সাপ দংশন করে মেরে ফেলে। তারা এ সংবাদ রাসুল সা. এর নিকট এসে জানালেন। তখন রাসুল সা. আলোচ্য বক্তব্য প্রদান করেন।
ব্যাখ্যা :
মুহাম্মাদ সা. কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্বের সকল জাতি ও মানুষের জন্য নবী ও রাসুল হিসেবে তাদেরকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে পথ দেখাতে আগমণ করেছেন। তার অমীয় বাণী হতে কেউ যাতে বঞ্চিত না হয় এজন্য তার বাণীসমূহ অধিক প্রচার করার তাকিদ দিয়েছেন। কেননা, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীন প্রচারের জন্য তাশরীফ এনেছেন। তিনি তার নবুয়তি যিন্দেগিতে যা বলেছেন এবং করেছেন সবই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো অন্যের নিকট পৌঁছানো না হলে তাদের পক্ষে দ্বীন অনুযায়ী চলা সম্ভব হবে না। তাই তো রাসুল সা. বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছিলেন- فلیبلغ الشاهد الغاءب
অর্থাৎ উপস্থিত লোক যেন অনুপস্থিত লোককে পৌঁছিয়ে দেয়।
ولو ایة-
দ্বারা তাবলীগের মধ্যে মুবালাগা করা হয়েছে। অন্যদিকে এর দ্বারা তাবলীগের মধ্যে ন্যূনতম সীমারেখা চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং এক হাদিসের সামান্য অংশও প্রচার করা জায়েয। যেহেতু আল্লাহ তায়া’লা انا نحن نزلنا الذکر وانا له لحافظون বলে পবিত্র কোরআন হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। সেহেতু বলা যায় রাসুল সা. بلغوا عنی ولو ایة দ্বারা হাদিস সংরক্ষণ ও প্রচারের তাকিদ দিয়েছেন।
উক্ত হাদিসে রাসুল সা. বনী ইসরাঈল থেকে জ্ঞানের কথা বর্ণনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু অপর এক হাদিসে আছে ওমরা রা. তাওরাত অধ্যায়ন করায় রাসুল সা. রাগান্বিত হয়েছিলেন। এতে উভয় হাদিসের মধ্যে বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়। এর সমাধানে সাইয়েদ জামালুদ্দীন রহ. বলেছেন- বনী ইসরাঈল থেকে নবীদের কাহিনী, অতীত জাতি সমূহের শাস্তির বর্ণনা ও ঘটনাবলী বর্ণনা করা জায়েয। তবে তাদের বর্ণনা কোরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অত্র হাদিসে এ কথাই বুঝানো হয়েছে।
আর যে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে সেখানে মূলত তাওরাতের আহকাম বর্ণনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা, কোরআন অবতীর্ণের মাধ্যমে পূর্ববর্তি সকল শরিয়ত মানসুখ হয়ে গেছে।
হাদিসের শেষাংশে রাসুল সা. এর উপর যে কোন ধরণের মিথ্যারোপের ভয়াবহতা বর্ণনা করে বলা হয়েছে- من کذب علی متعمدا فلیتبواء مقعده من النار
অতএব যারা দ্বীনের প্রতি অতি উৎসাহ দেওয়ার জন্য এবং আল্লাহর প্রতি ভয় প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বা যে কোন ভালো বা খারাপ উদ্দেশ্যে মিথ্যা হাদিস তৈরী করে বা মিথ্যা হাদিস তৈরী করা জায়েয মনে করে থাকে তাদের ব্যাপারে এই হাদিসে কঠোর হুঁশিয়ারি প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং বলা যায়- সর্বাবস্থায় রাসুল সা. এর নামে মিথ্যা ছড়ানো হারাম। (www.twitter.com/iscabd)
শিক্ষা :
উক্ত হাদিস অধ্যায়ন করে আমরা নিম্মলিখিত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। যথা:-
ক. রাসুল সা. এর বাণী প্রচারে তৎপর থাকতে হবে।
খ. আহলে কিতাবের থেকে কোরআনের সাথে সংগতিশীল ঐতিহাসিক ঘটনাবলি বর্ণনা করা জায়েয।
গ. মিথ্যা হাদিস বর্ণনা থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।
এই তিনটি কাজ মুসলিম উম্মাহ সঠিকভাবে আঞ্জাম দিতে পারলে ইসলাম ও দ্বীন অক্ষত থাকবে।
তথ্য সূত্র :
১. সহিহ বুখারী
২. মিশকাতুল মাসাবীহ ১ম খণ্ড (ইসলামিয়া কুতুবখানা।)
৩. মিশকাতুল মাসবীহ ১ম খণ্ড (আল বারাকা লাইব্রেরী)
৪. উইকিপিডিয়া
৫. হাদিস বিডি
লেখক : সালাহ উদ্দিন শিহাব. কর্মী, কুমিল্লা দক্ষিণ