পৃথিবীর বয়স কত? এ প্রশ্নের জবাবে বিভিন্ন উত্তর আসতে পারে। তবে আনুমানিকভাবে ধরা হয় আজ থেকে প্রায় ৪.৫৪ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী নামের গ্রহটি আকৃতি পায়। সৌরজগতের একমাত্র পৃথিবীতেই প্রাণের আস্তিত্ব টিকে আছে। সহাবস্থান করছে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীক‚ল। বর্তমান এই পরিবর্তিত বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের যুগে এসে পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে। ফলে ঝড় ঝাপটা বাড়ছে, ঘূর্ণি-ঝড় বাড়ছে, বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠ উচুঁ হচ্ছে। এ সবই হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিফলন। যা বিগত কয়েক দশক যাবৎ খুবই আলোচিত বিষয়।
আবহাওয়া ও জলবায়ু
কোনো স্থানের দৈনিক বৃষ্টিপাত, উষ্ণতা, আর্দ্রতা, বায়ু প্রবাহ ও চাপ, সূর্যালোক প্রভৃতির সামগ্রিক অবস্থাকে ঐ স্থানের আবহাওয়া বলে। বৃষ্টিপাত, উষ্ণতা, আর্দ্রতা ইত্যাদি সর্বদাই পরিবতনশীল হওয়ায় আবহাওয়াও পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে কোনো স্থানের বায়ুর তাপ, বায়ুর চাপ, বায়ু প্রবাহ, বায়ুর আদ্রর্তা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদির ৩০-৪০ বছরের গড় অবস্থাকে সে স্থানের জলবায়ু (ঈষরসধঃব) বলে। আবহাওয়ার ন্যায় জলবায়ুর উপাদানসমূহ নিয়ন্ত্রিত হয় বিভিন্ন নিয়ামক দ্বারা। যেমন অক্ষাংশ, ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা, সমুদ্র থেকে দূরত্ব, বায়ূ প্রবাহের দিক, সমুদ্র¯্রােত, পর্বতের অবস্থান, বনভূমি, ভূমির ঢাল, মাটির বিশেষত্ব ইত্যাদি। আবহাওয়া অল্প সময়ের মধ্যে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ এটা নিয়মিত পরিবর্তনশীল। আবহাওয়ার উপাদানসমূহ ও এদের নিয়ন্ত্রনকারী নিয়ামক সমূহ পরিবর্তনের সাথে সাথে জলবায়ুও পরিবর্তন হয়। উদাহরণ¯^রূপ-
অক্ষাংশ অনুযায়ী সূর্যকিরণ পতনের তারতম্য ঘটে। কোথাও ল¤^ভাবে, কোথাও তির্যকভাবে পড়ে।
ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে তাপমাত্রা হ্রাস পায়। প্রতি ১০০০ মিটার উচ্চতায় তাপমাত্রা ৬০ করে হ্রাস পায়।
কোন স্থান সমুদ্র থেকে কতটা দূরে তার উপর বাতাসের আর্দ্রতা নির্ভর করে এবং আর্দ্রতার উপর জলবায়ুর উষ্ণতা অনেকাংশে নির্ভরশীল।
জলবায়ুর গুরুত্ব ও প্রভাব
অন্যান্য পরিবেশের ন্যায় জলবায়ুও মানব জীবনের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। জলবায়ুর উপাদানগুলোর বিভিন্নতার জন্য পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু অঞ্চল দেখা যায়। আর এ কারণেই পৃথিবীর সর্বত্র জলবায়ু একই রূপ নয়। জলবায়ুর বিভিন্নতার দরুণ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলী ও সাংস্কৃতিক জীবনের মধ্যেও পার্থক্য দেখা যায়। এছাড়াও জলবায়ু কোনো অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশও নির্ধারণ করে। জলবায়ুর প্রভাবসমূহ নি¤œরূপ-
কৃষিকাজ : কৃষির ওপর জলবায়ুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জলবায়ুর জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন প্রকার ফসল উৎপন্ন হয়। কৃষি কেবল মানুষের খাদ্যই যোগায় না- এটি বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালও সরবরাহ করে থাকে।
বনভূমি : বনভূমি মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলী ও ব্যবসা বানিজ্যের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। এ বনভূমির উৎপত্তি এবং উন্নতি আবার জলবায়ুর উপর নির্ভর করে।
মৎসচারণ ক্ষেত্রে- আদিকাল থেকে মৎস্য শিকার ও মৎস্য ব্যবসা মানুষের একটি প্রধান উপজীবিকা। জলবায়ু মৎস্য শিকার ও ব্যবসায়ের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক জীবনের উপর প্রভাব রাখে।
পরিবহন ও যোগাযোগ : সুলভ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া ব্যবসা বানিজ্যের উন্নতি হয় না। প্রতিকূল জলবায়ু পরিবহন ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে থাকে।
খনিজ সম্পদ : খনিজ সম্পদের উত্তোলনের উপর জলবায়ুর প্রভাব রয়েছে। জলবায়ুর প্রভাবে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অধিবাসীগণ খনিজ সম্পদের উত্তোলন ও খনিজ সম্পদ রপ্তানিতে খুবই সফলতা লাভ করে।
শিল্প কারখানা : শিল্পের উপর জলবায়ুর পরোক্ষ প্রভাবই অধিক দেখা যায়। যেমন আর্দ্র জলবায়ু বস্ত্র শিল্পের জন্য আবশ্যক ও ময়দা শিল্পের জন্য শুষ্ক জলবায়ুর প্রয়োজন।
পশুপালন : পশুপালনে তৃণভূমির প্রয়োজন। মহাদেশীয় জলবায়ুর প্রভাবে বিস্তৃত তৃণভূমি হয়। ফলে তৃনভূমিতে পশুপালন গড়ে উঠে।
বসতি ও বাসস্থান : বসতি ও বাসগৃহের ওপর জলবায়ুর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। অত্যাধিক উষ্ণ বা শীতল অঞ্চলে মানুষের বসবাস করা খুবই কষ্টকর। তাই নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে ঘনবসতি গড়ে উঠছে।
শারীরিক ও মানুষিক শক্তির বিকাশ : জলবায়ু মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তির বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। ¯^াস্থ্যকর জলবায়ুতে লালিত পালিত মানুষ কর্মতৎপর, অধ্যবসায়ী ও সুনিপুণ হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন
গড় জলবায়ুর দীর্ঘ মেয়াদী ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তনকে জলবায়ু পরিবর্তন বলে। প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে থেকে এই পর্যন্ত জলবায়ু বরাবরই বদলেছে। প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবতির্ত হয়ে আসছে। তাই এটিকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াও বলা হয়। জলবায়ুর পরিবর্তন বিভিন্ন নিয়ামকের ওপর নির্ভরশীল। যেমন জৈব প্রক্রিয়াসমূহ, পৃথিবী কর্তৃক গৃহীত সৌর বিকিরণের পরিবর্তন, প্লেট টেকনিক, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি। বর্তমানকালে সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে জলবায়ু পবিরর্তন বললে সারা পৃথিবীর ইদানিং সময়ের মানবিক কার্যক্রমের কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনকে বোঝায়। জলবায়ু পরিবর্তন এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। এ আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন ১৮৯৬ সালে সুইডিশ কেমিস্ট সেভানতে অরহেনিয়াস। তিনি বলেছিলেন, দ্রুত শিল্প বিল্পবের ফলে জীবাশ্ম জ¦ালানী ব্যাপক পোড়ানোর ফলে নির্গত কার্বনডাই-অ·াইড বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে পৃথিবীকে মানুষের জন্য বিপজ্জনক করে তুলতে পারে। তিনিই প্রথম ‘গ্রীন হাউস ইফেক্ট’ শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রায় ৬০ বছর পর ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনষ্টিটিউট অব অসেনোগ্রাফি অরহেনিয়াসের দাবির সত্যতার প্রমান পায়। তার পর থেকেই হৈ চৈ শুরু হয়। গবেষণায় আজ এটা প্রমানিত যে, প্রাকৃতিক ও মানব কর্মকান্ডের যৌথ ক্রিয়ায় বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা জলবায়ুর অন্য উপাদানগুলোর তারতম্য ঘটিয়ে এক অ¯^াভাবিক পরিবতর্নের ধারা সৃষ্টি করেছে। এ পরিবর্তন আমাদের উন্নয়নের এমনকি অস্তিত্বের জন্যও এক বিরাট হুমকি।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ
জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়টি এক সময় মানুষের চিন্তার পরিধিতেই ছিল না। কিন্তু জলবায়ু পবিরর্তন বর্তমান বিশে^র সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপনীত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনসমূহ নি¤œরূপ :
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারন বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি। আর এই উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে বৈশি^ক উষ্ণায়ন বলা হচ্ছে।
গ্রীন হাউস ইফেক্ট বা প্রতিক্রিয়া বলতে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অ·াইড (ঈঙ২) নিঃসরণের ফলে পৃথিবীর দীর্ঘমেয়াদী উত্তপ্ত হওয়াকে বোঝায়। কার্বন-ডাই-অ·াইড (ঈঙ২) গ্রীন হাউসের কাঁচের মতো কাজ করে।
কার্বন-ডাই-অ·াইড (ঈঙ২) এর ধর্ম হল ক্ষুদ্র তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যরে বিকিরণ এর ভেতর দিয়ে যেতে পারে কিন্তু দীর্ঘ তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যরে বিকিরণ এর ভেতর দিয়ে যেতে পারে না। সূর্যের ক্ষুদ্র তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যরে বিকিরণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড (ঈঙ২) এর ভেতর দিয়ে পৃথিবীতে সহজে আসতে পারে না। পৃথিবী এই তাপ শোষণ করে পুনরায় তাপ নিঃসরণ করে। পুনঃনিসৃত দীর্ঘ তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যরে বিকিরণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড (ঈঙ২) এর ফাদঁকে ভেদ করতে পারে না। এতে তাপ আটকে পড়ে। ফলে গ্রীন হাউস সংঘটিত হয়ে পৃথিবীর উষ্ণায়ন ঘটায়।
পৃথিবীব্যাপী বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি বা বিশ^ উষ্ণায়নের জন্য যে গ্যাস সমূহকে দায়ী করা হয় তাদেরকে গ্রীন হাউস গ্যাস বলা হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম গ্যাসসমূহ হল :
– কার্বন-ডাই-অ·াইড (ঈঙ২)
– মিথেন (ঈঐ৪)
– নাইট্রাস অ·াইড (ঘ২ঙ)
– সালফার হে·ারাইড (ঝঋ৩)
– নাইট্রোজেন ট্রাই ফ্লুরাইড (ঘঋ৩)
– হাইড্রোফ্লুরো কার্বন (ঐঋঈ)
– পার ফ্লুরো কার্বন(চঋঈ)
– ক্লে¬ারো ফ্লোরো কার্বন (ঈঋঈ)
এদের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড (ঈঙ২) বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ষ্ট্রাটোস্ফিয়ারে ওজোন স্তর রয়েছে। যা পৃথিবীতে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি প্রবেশ করতে বাধা দেয় ও পুনরায় নিঃসৃত তাপ মহাশূন্যে ফিরে যেতে সহায়তা করে। কিন্তু গ্রীন হাউস গ্যাসসমূহের জন্য ওজোন স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। পুনারায় নিঃসৃত তাপ মহাশূন্যে ফিরে যেতে সহায়তা করে। ফলে বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশ^ব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্থায়ী বা স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। টঘঋঈঈঈ বৈশি^ক উষ্ণায়নকে মানুষের কারণে সৃষ্ট এবং জলবায়ুর বিভিন্নতাকে অন্য কারণে সৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তন বোঝাতে ব্যবহার করে। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব সত্যিই পড়ছে কিনা তা চারটি মানদণ্ডে বিবেচনা করা হয়।
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ।
কোথায় প্রাকৃতিক দূর্যোগ বেশি হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা কোথায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্থ দেশটি ক্ষতি মোকাবেলার জন্য এর মধ্যেই কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের আগের শর্তটি হলো পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ৫টি ঘটনা ঘটবে।
দক্ষিণ মেরু, পর্বতের চ‚ড়া ও হিমবাহে যে বরফ আছে তা গলে যাবে।
সমুদ্রের উপরিভাগ গরম হয়ে নি¤œচাপ ও ঘূর্নিঝড় হবে।
সমুদ্রের পানি বাষ্প হয়ে অতিরিক্ত মেঘ ও বৃষ্টিপাত হবে।
বর্ষাকালে তুমূল বৃষ্টি ও শীতকালে তীব্র খরা হবে।
সমুদ্রের পানি বেড়ে গেলে জোয়ারের পানির উচ্চতা বাড়বে ও জলোচ্ছ¡াসের পরিমান বেড়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তা
নানা কারণে পৃথিবীর সব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সর্বদাই এক বিশাল চ্যালেঞ্জিং বিষয় হিসেবে বিবেচিত ছিল। বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল বলেছিলেন, “মৃত্যুর পর স্মৃতিসৌধের মর্যাদা লাভের চেয়ে বেঁচে থাকার জন্য উদরের চাহিদা পূরণে যতœবান হওয়াকে শ্রেয়তর মনে করি।” সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য নিরাপত্তা। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে পৃথিবীতে এখনো গড়ে শতকরা ৫০ভাগ মানুষ খাদ্যাভাবে ক্ষুধার যন্ত্রনায় ভুগছে। খাদ্য ও কৃষির গুরুত্ব বোঝাতে সবুজ বিপ্লবের জনক নোবেল বিজয়ী নরম্যান বোরলগ ২০০০ সালে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “নিঃসন্দেহে ‘ক্ষুধা’ উন্নয়ন ও শান্তির অন্যতম বাধা।” বিজ্ঞানভিত্তিক বানিজ্যিক কৃষির ব্যাপক প্রচলন ঘটে বিংশ শতাব্দীতে। উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি চালু হওয়ার আগে কৃষিতে অন্তত চারবার উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন বা বিপ্লব সংঘটিত হয়। তন্মধ্যে গত শতাব্দীতে সংঘটিত সবুজ বিপ্লব সমধিক উল্লেখযোগ্য। ডারউহন প্রকাশিত বিভিন্ন জীবের প্রজাতির মধ্যকার পার্থক্য এবং মেন্ডেল উদ্ভাবিত বংশগত স্থানান্তর সূত্র ছিল সবুজ বিপ্লবের মূল প্রেরণা। শিল্প বিল্পবের পর সবুজ বিপ্লবই হচ্ছে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লব। দানাশস্যের ফলন বিস্ময়করভাবে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। সবুজ বিপ্লবের অর্থনীবিদ ম্যালথাসের ভবিষ্যদ্বাণীকে ভূল প্রমানিত করেছিল। সবুজ বিপ্লবের জন্য ব্যবহৃত কৃষি প্রযুক্তিগুলো অর্থাৎ উচ্চ ফলনশীল জাতের নিবিড় চাষ, অধিক হারে সিনথেটিক রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার, পানি সেচ এবং কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার নতুন উপসর্গ তথা পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি করছে। মৃত্তিকার উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবর্তিত বিশ্ব
পরিবেশগত সমস্যা একুশ শতকে এসে বড় ধরণের সমস্যা হিসেবে দেখা দিলেও মূলত বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই এই সমস্যাটি বিশ^ নেতৃবৃন্দকে ভাবিয়ে তোলে। নানাবিধ কারণে বিশ^ পরিবেশ আজ হুমকির মুখে। একটা বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে বিশে^র উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে। গত নভে¤^রে (২০০৭) বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল প্রচন্ড ঘূর্নিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াস সিডরের আঘাতে বড় ধরণের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বলা হচ্ছে বিশে^র উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণেই এমনটি ঘটেছে। ১৯৯২ সালে রিওডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন। ওই সম্মেলনের মধ্য দিয়েই পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বিশ^বাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে শতাব্দী শেষ হবার আগেই একাধিক পরিবেশগত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি সম্মেলনেই বিশ^ যে বড় ধরণের পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, সে ব্যাপারে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয় এবং পরিবেশ বিপর্যয় রোধে করনীয় নির্ধারন করা হয়। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)। বিশে^র বিভিন্ন দেশের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আইপিসিসির সাথে জড়িত। গত নভে¤^র (০৭) আইপিসিসির এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিশে^ অ¯^াভাবিক দ্রুত গতিতে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে পরিণতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সাবেক মহাসচিব বান কি মুন স্পেনের ভ্যালেনসিয়া থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন।
রির্পোটে বলা হয়েছিল, এক দশক আগে যে হারে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হতো, এখন তার পরিমান অনেক বেড়ে গেছে। রির্পোটে বলা হয়েছে, পৃথিবী যে পরিমান গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করে তার ৯০ ভাগই মানুষের সৃষ্টি। এর প্রভাবে উভয় মেরুর বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে এবং বহু প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। রির্পোটে বলা হয় পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা যদি দেড় থেকে আড়াই ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায় তাহলে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পড়বে। পৃথিবীতে বিশুদ্ধ পানির সংকটও বাড়বে। সংকট বর্তমানের তুলনায় ৭৫ থেকে আড়াই গুন বাড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। সমুদ্রে যেসব প্রবাল প্রাচীর রয়েছে সেগুলোও এর ফলে ধ্বংসের মুখে পড়বে। একই সাথে অ্যান্টার্কটিকায় প্রাগৈতিহাসিক কালের বরফ স্তর গলতে শুরু করেছে এবং বর্তমান পৃথিবীর অন্য যে কোন এলাকা থেকে দ্রুত গতিতে উষ্ণ হচ্ছে অ্যান্টার্কটিকা। এখানকার বর্তমান তাপমাত্রা গত ১৮০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ৮০ হাজার অস্থায়ী বাসিন্দার এই মহাদেশের আয়তন ইউরোপের চেয়ে ২৫গুন বড়। আর এখানকার বরফ জমে আছে ভূস্তরের ৯০ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি। অ্যান্টার্কটিকার বরফ স্তর এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার পুরু থাকলেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেখানে জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে দায় কার?
শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে এই বিশ^ এক নব যুগের সূচনা করেছিল। সামন্তবাদকে বিদায় দিয়ে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নতুন ¯্রােতকে কাজে লাগিয়ে এই বিশ^ শিল্পের যুগকে আলিঙ্গন করে। এরপর থেকেই মূলত শুরু হয় এক লাগামহীন পথচলা। একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এক অসুস্থ প্রতিযোগীতা। যার সবচে’ করুণ পরিণতি আমরা দেখতে পাই ২য় বিশ^ যুদ্ধে লিটলবয় ও ফ্যাটম্যান এর ন্যাক্কারজনক ব্যবহারের মাধ্যমে। যা শুধুমাত্র হিরোসীমা ও নাগসাকীকেই নয় গোটা মানবজাতির উপর ছিল এক চরম আঘাত। বিশে^ নানাভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এবং উন্নয়নশীল বিশে^র দেশগুলোর চেয়ে উন্নত বিশে^ই পরিবেশ দূষনের মাত্রা বেশি। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা গ্রীন হাউজ গ্যাসের যে কথা বলেছেন, সেই গ্রীন হাউস গ্যাস পৃথিবীর উত্তাপ বাড়ার অন্যতম কারণ। বায়ুমণ্ডলে বিরাজমান এই গ্যাসের কারণে বহির্গামী তাপ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসছে। আর তাতে করে বাড়ছে পৃথিবীর উত্তাপ। এসব গ্রীন হাউজ গ্যাসের মধ্যে রয়েছে কার্বন ডাই অ·াইড, ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন, মিথেন, নাইট্রাস অ·াইড ইত্যাদি। জ¦ালানি, বন উজাড়, মানুষের অন্যান্য কার্যক্রমের কারণে কার্বন ডাই-অ·াইড এর পরিমান বাড়ছে। বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাস দীর্ঘকাল অবস্থান করে। প্রায় ৫০ থেকে ২০০ বছর পর্যন্ত। আন্তজার্তিক পরিবেশবাদী সংগঠন। গ্রীন পিস এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার বছরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই অ·াইড এর পরিমান যত বেড়েছে। তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি বেড়েছে গত তিনশ পঁচিশ বছরে। এক্ষেত্রে উন্নত বিশে^র পাল্লা ভারী।
টঘঊচ (টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঊহারৎড়হসবহঃ চৎড়মৎধস) এর প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে ১৮০০-১৯৮৮ সময়সীমায় উন্নত দেশসমূহে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর নির্গমনের হার শতকরা ৮৩.৭ ভাগ। আর ¯^ল্পোন্নত দেশসমূহে এর হার মাত্র ১৬.৩ ভাগ। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, উন্নত দেশ সমূহের নির্গমনকৃত ৮৫ শতাংশ ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন (যা শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয়) ও ৫০ শতাংশ কার্বন ডাই অ·াইড থেকেই ওজোন স্তরে ক্ষয় ও ভূমণ্ডলীয় উত্তাপের মতো পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। গত একশ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ০.৩ ডিগ্রি থেকে ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ১০ হাজার বছরের ইতিহাসে তাপবৃদ্ধির এই মাত্রাটিই সর্ব্বোচ। এটা আগামি ২০৩০ সাল নাগাদ ১ ডিগ্রি থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বাড়বে সমুদ্রতলের উচ্চতা। গত শতাব্দীতে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমান ছিল ১-২ সেন্টিমিটার। ভূমণ্ডলীয় উত্তাপের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়বে ৩০-৫০ সেন্টিমিটার। এর ফলে সমুদ্রের কাছাকাছি অঞ্চলগুলো নিমজ্জিত হবে। নদ নদীতে লোনা পানির পরিমান বাড়বে। বাড়বে শরনার্থীর সংখ্যা। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবার ফলে গ্রীষ্মকালীন রোগ বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে হেপাটাইপিটস বি, সংক্রামক সেরিব্রাল, মেনিন জাইটিস রোগ বৃদ্ধি পাবে এবং একই সঙ্গে সূর্যের বিকিরণকৃত আলাট্রাভায়োলেট রশ্মির অনুপ্রবেশ বৃদ্ধির কারণে চামড়ার ক্যান্সার ও চোখের ছানিপড়া রোগ বৃদ্ধি পাবে। বিশে^র তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবার আরেকটি কারণ হচ্ছে ব্যাপকভাবে গাছপালা কেটে ফেলা। অথচ এই গাছপালা আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ। পৃথিবীর মোট বনের পরিমান ৪ কোটি ৩০ লাখ বর্গ কিলোমিটার। অথচ প্রতি মিনিটে বিশে^ প্রায় একশ একর বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর এ যাবৎ বিশে^র প্রায় অর্ধেক রেইন ফরেষ্ট উৎপাটিত হয়েছে। অথচ এই রেইন ফরেস্টে রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৫শ জাতের ফুলগাছ, ২শ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জন্তু, ৬শ প্রজাতির পাখি, ১৪০ প্রজাতির সাপ, ১শ প্রজাতির ব্যাঙ হাজার হাজার প্রজাতির পোকামাকড়ের বাস। যা এ পৃথিবীর পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশে^ এখন এই রেইন ফরেস্টের পরিমান মাত্র শতকরা ৬ ভাগ, আগে যা ছিল ১৪ভাগ। বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাবার কারণে বিশে^ মরুকরণ প্রবনতা বাড়ছে। বিশে^র এক চতুর্থাংশ ভূমি ও এক ষষ্ঠাংশ জনগোষ্ঠী আজ এর প্রতিক্রিয়ার শিকার। ১৯৭৭ সালে মরুকরণের ফলে বিশে^ ক্ষতিগ্রস্থ লোকের সংখ্যা ছিল ৫৭ মিলিয়ন। আর ১৯৮৪ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩৫ মিলিয়ন। এশিয়াতে মরুকরণ প্রক্রিয়ায় ক্ষতির পরিমান বেশি। বার্ষিক ক্ষতির পরিমান এখানে ২০ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার।
বিশে^ উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্যে শিল্পোন্নত দেশগুলো মূলত দায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলা যেতে পারে। বিশে^ যত কার্বন ডাই অ·াইড গ্যাস নিঃসরণ হয়, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিঃসৃত হয় শতকরা ২৫ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস খনিগুলো এর জন্য দায়ী। ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ^ পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউট তাদের ১৯৯৭ সালের বিশ^ পরিবেশ পরিস্থিতি সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বিশে^র ৮টি দেশের একটি তালিকা প্রণয়ন করেছিল। যেখানে বলা হয় পরিবেশ দূষণ পরিস্থিতি অত্যন্ত মারাত্মক। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, রাশিয়া, জাপান, জার্মানি ইত্যাদি। এই দেশগুলোর নামকরণ করা হয়েছে ঊ-৮। গোটা বিশে^ সর্বমোট যত কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয় তার শতকরা ৫৮ ভাগ নির্গত হয় এই দেশগুলোতে। ইতোমধ্যে ধরিত্রী সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ও সুপারিশমালা বাস্তবায়নের অগ্রগতি তদারকির মধ্যে গঠিত হয়েছে ধরিত্রী পরিষদ। এই পরিষদ তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ১৯৯০ সালের পর পৃথিবীর অনেক দেশেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমান শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ১শ ৫০ কোটি লোক বিশুদ্ধ বাতাস থেকে বঞ্চিত। ১৯৮৭ সালে মনট্রিলে পরিবেশ সংক্রান্ত যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে ওজোন স্তর বিনষ্টকারী দূষিত রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত কাগজে কলমেই থেকে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও গৃহীত চুক্তি সমূহ
কিয়াটো প্রটোকল :
পরিবেশ বিপর্যের কথা বললে আমাদের প্রথমে কিয়াটো প্রটোকলের কথা বলতে হবে। ১৯৯৭ সালে ডিসে¤^রে জাপানের প্রাচীন রাজধানী কিয়াটোতে বিশ^ তাপমাত্রা রোধ সম্পর্কিত একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিশে^র ১৬০টি দেশের শীর্ষ স্থানীয় প্রতিনিধিরা এই শীর্ষ সম্মেলেনে উপস্থিত ছিলেন। জাতিসংঘের উদ্যোগেই এই শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। শীর্ষ সম্মেলনে ‘কিয়াটো প্রটোকল’ ¯^াক্ষরিত হয়েছিল। ওই চুক্তিতে বেশ কিছু সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছিল, যা উন্নত তথা উন্নয়নশীল বিশে^র দেশগুলো পালন করবে এবং যা কিনা ভবিষ্যতে বিশে^র তাপমাত্রা রোধ করতে সাহায্য করবে। এখানে বলা ভালো- বিশে^র উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রীন হাউস গ্যাসকে দায়ী করা হয়। এ কারণেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর মাত্রা হ্রাস করার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসা জরুরি ছিল। কিয়াটোতে বিশ^ নেতারা দীর্ঘ ১১দিন সময় নিয়েছিলেন একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। কিয়াটোতে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশুগুলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা ১৯৯০ সালের মাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ৭ শতাংশ, জাপান ৬ শতাংশ হ্রাস করবে। তাছাড়া সার্বিকভাবে ৫২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সবগুলো দেশকে ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবার পর দেশগুলো গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা আরো হ্রাস করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল। কিন্তু প্রথম থেকেই কিয়াটো চুক্তি নিয়ে শঙ্কা ছিল। গত ২৯ মার্চ (২০০১) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ কিয়াটো প্রটোকল প্রত্যাখান করায় ওই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি বড় ধরণের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বুশের অন্যতম প্রতিদ্বন্ধী আল-গোর।
মার্কিন তেল ও গ্যাস কোম্পানীগুলো প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিল তারা কিয়াটো চুক্তির বাধ্যবাধকতা মানবে না। পরিবেশবাদী সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল-গোর মার্কিন তেল ও গ্যাস কোম্পানীগুলোর বিরুদ্ধে বালিষ্ঠ ভূমিকা নিলেও প্রেসিডেন্ট বুশের সিদ্ধান্তের পর এটাই প্রমানিত যে, বুশ মার্কিন তেল গ্যাস কোম্পানীগুলোর ¯^ার্থরক্ষাই করেছেন।
প্যারিস সমঝোতা
কিয়াটো প্রটোকলের ব্যর্থতার পর প্যারিসে একটি জলবায়ু চুক্তি ¯^াক্ষর হয়েছে। যা কিনা বিশে^র উষ্ণতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য।
প্যারিসে ডিসে¤^রে (২০১৫) বিশে^র উষ্ণতা হ্রাস করার লক্ষ্যে সমঝোতা হয়েছিল। তার প্রায় চার মাস পর বিশে^র ১৭১ দেশ জাতিসংঘের দফতরে একটি চুক্তি ¯^াক্ষর করলো। চুক্তিতে বিশে^র তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বিশ^। ১৮ ফেব্রæয়ারী ২০১৮ তথ্য অনুযায়ী টঘঋঈঈঈ (টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঋৎধসবড়িৎশ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঈষরসধঃব ঈযধহমব) এর ১৯৫ সদস্য রাষ্ট্র এই চুক্তি ¯^াক্ষর করেছে। এই চুক্তিটি এখনই কার্যকর হবে না। প্রতিটি দেশের সংসদ তা অনুমোদন করবে এবং ২০২০ সালের পর এই চুক্তি একটি আন্তজার্তিক আইনে পরিণত হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নিয়ে নানা প্রশ্ন করলেও বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিগমনের হার এক এক দেশে এক এক রকম। বিশে^র দেশগুলো এখন বিভিন্ন গ্রæপে বিভিক্ত আছে। বিশে^র উষ্ণতা রোধকল্পে এক এক গ্রæপের এক এক এজেন্ডা রয়েছে। উন্নত বিশ^ কিংবা উন্নয়নশীল বিশে^র যে দাবী, তার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ^ও এক এক গ্রæপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেস্ত্রু-১-এ অন্তর্ভূক্ত। বিশে^র জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগই এই দেশগুলোর। অথচ লোকসংখ্যা মাত্র বিশে^র ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রæপ-৭৭ এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশে^র জনসংখ্যার ৭৫ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন উদগিরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগর পাড়ের দেশগুলো যারা বিশে^র জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ১ ভাগ, তাদের দাবি ছিল ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমান বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভূক্ত দেশগুলো, যারা ‘রেইন ফরেষ্ট কোয়ালিশ’ হিসেবে পরিচিত, তারা বিশ^ জনগোষ্টীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের। তারা মাত্র ৪ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র একক কার্বন নিঃসরসরণ করে ২০ ভাগ। জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা মাত্র বিশে^র ৫ ভাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত দেশগুলো বিশ^ জিডিপির ২ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ^ জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের। প্রতিটি গ্রæপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজ¯^ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ এটাকে বলছে কার্বন ঘনত্ব। অর্থাৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীন উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উদগিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রীন হাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়।
কার্বন নিঃসরণের হার কমানো উচিত, এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, সে প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সাথে ভারতও) বিশে^ সবচেয়ে বেশি দূষণ ছাড়ায়। সে কারণে এই দুটো দেশের কাছ থেকে ‘কমিটমেন্ট’ আশা করেছিল বিশ^। চীন প্রস্তাব করেছিল ২০০৫ সালের কার্বন ঘনত্বের চাইতে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাবে রাজী হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বন ঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১.৮ টন। চীন ও ভারত দুটো দেশই বড় অর্থনীতির দেশে পরিনত হয়েছে এই শতাব্দীতেই। বিশ^ ব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলীর মতে আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশে^র অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ ডলার থেকে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে। ২০০৭ সালে বিশ^ অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ, ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। তবে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়, তাদের কার্বন ঘনত্ব বাড়বে। কেননা প্রবৃদ্ধি বাড়তে হলে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। আর তাতে করে কার্বন নিঃসরণের পরিমান বাড়বে। আসলে প্যারিসে যে সমঝোতা হয়েছে এর কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় বিশে^র উষ্ণতা রোধ কল্পে এই চুক্তি কতটুকু কার্যকর হয়, তা নিয়ে বড় ধরণের অনিশচয়তা থেকেই গেল।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ
বিশে^র তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বাংলাদেশ নানা ধরণের পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হবে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জেনেরোতে বিশ^ ধরিত্রী সম্মেলনে বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পানির উচ্চতা বাড়লে পৃথিবীর যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশকে অধিকতর ঝুঁকি সম্পন্ন দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশে এর প্রভাব কি হবে, তা নিচের ছক থেকে বোঝা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের উডহোল গবেষক জন ডি মিলিম্যানের গবেষণা থেকে এই সারনিটি তৈরী করা হয়েছে।
সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশে এর প্রভাব
সাল বিশ^ব্যাপী সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি ভূমিতলের অধিঃগমন স্থানীয় সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ জমির পরিমান ক্ষতিগ্রস্থ জনসংখ্যা
বাংলাদেশ ২০৫০ সাল (ক) ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থা ৭৯ সে.মি. ৬৫সে:মি: ১৪৪ সে.মি. ১৬ ভাগ ১৩ ভাগ
(খ) বেশি ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থা ৭৯ সে.মি. ১৩০ সে.মি. ২০৯ সে.মি. ১৮ ভাগ ১৫ ভাগ
বাংলাদেশে ২১০০ সাল (ক) ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থা ২১৭ সে.মি. ১১৫ সে.মি. ৩৩২ সে.মি. ২৬ ভাগ ২৭ ভাগ
(খ) বেশি ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থা ২১৭ সে.মি. ২০০ সে.মি. ৪৪৭ সে.মি. ৩৪ ভাগ ৩৫ ভাগ
ঝড়ৎপব : ডড়ৎষফ ডধঃপয চধঢ়বৎ, ৮৬ ঘড়াবসনবৎ ১৯৯১ চ.৩৪
উপরের সারনি থেকে দেখা যায় ২০৫০ সালে বিশ^ব্যাপী সমুদ্র পৃষ্ঠের পানি যখন গ্রীন হাউস প্রভাবে ৭৯ সে.মি. বৃদ্ধি পাবে, বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে পানি তখন বাড়বে ১৪৪ থেকে ২০৯ সে.মি.। এতে ১৬ থেকে ১৮ ভাগ জমি তলিয়ে যাবে এবং ১৩-১৫ ভাগ লোক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অপরদিকে ২১০০ সালে গ্রীন হাউস প্রভাবে বিশ^ব্যাপী সমুদ্র পৃষ্ঠের পানি যখন ২১৭ সে.মি. বৃদ্ধি পাবে, বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের পানি তখন ৩৩২ থেকে ৪৪৭ সেন্টিমিটার বেড়ে যাবে। শতকরা ২৬ থেকে ৩৪ ভাগ লোকের বসতবাড়ি জলমগ্ন হবে এবং ২৭ থেকে ৩৫ ভাগ লোক বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছেন প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ফসিহ উদ্দিন মাহতাব। তাঁর মতে, বাংলাদেশে সমুদ্রতল বৃদ্ধির সম্ভাব্য পরিমান ৩০ সেন্টিমিটার থেকে ১.৫ মিটার হতে পারে। তাঁর গবেষণা অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে পানির উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশর ১৩.৭৪% আবাদি জমি, ২৮.২৯ শতাংশ বনভূমি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাতে করে প্রায় ১কোটি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়বে।
এছাড়াও তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টির মওসুম পাল্টে যাবে। সুন্দরবনের ১০টি প্রজাতির গাছের মধ্যে সুন্দরী ও গেওয়া গাছ বিনষ্ট হয়ে যাবে। বর্তমানে প্রায় ১৪ লক্ষ হেক্টর জমি লবনাক্ত পানির জোয়ার ভাটায় বছরের বেশি সময় বা সর্বক্ষণ ডুবে থাকে। আগামীতে লবণাক্ত জমির পরিমান আরো বাড়বে। শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও দেখা দেবে অনিশ্চয়তা। শস্যের ¯^াভাবিক ফলন কমে যাবে। পরিবর্তন আসবে ইকো সিস্টেমেও। এছাড়াও পানির স্তর বৃদ্ধির ফলে নদী-খাল গুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে। ফলে সুপেয় পানির সংকট বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও সুন্দরবন হচ্ছে মাছেদের ডিম দেয়া ও ফুটানোর একটি অন্যতম অঞ্চল। সমুদ্রে পানি বৃদ্ধি পেলে মাছের ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে আমাদের দেশের ৩৫লক্ষ পরিবার; যারা এই মাছের উপর তাদের জীবিকা নির্বাহ করে তারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পুঁজিবাদ
ভাবতে অবাক লাগে যে পৃথিবীর পরিবেশ বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছালে ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড় সব দেশই আক্রান্ত হবে। কারণ একই বায়ুমণ্ডলের নিচে আমরা বাস করি। ধরিত্রীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে তার কুফল সবাইকেই তো ভোগ করতে হবে। তাহলে ছোট-বড় দেশের মধ্যে এই পার্থক্য কেন?
ইতিহাস থেকে লক্ষ্য করা যায় ২০০১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ কিয়াটো প্রটোকল থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের মাধ্যমে গোটা বিশে^র ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক অনিশচয়তার দিকে ঠেলে দেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭সালের ২জুন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও সদ্য চুক্তিকৃত ‘প্যারিস সমঝোতা’ হতে নিজেদের নাম প্রত্যাহারের মাধ্যমে ঘোষণা দেন ঐ দিনটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। আবারও প্রতারিত হল বিশ্ব মানবতা। অথচ চুক্তি অনুয়ায়ী ২০২০ সালের পূর্বে কোন রাষ্ট্রই নিজেদেরকে ‘প্যারিস প্রটোকল’ থেকে প্রত্যাহারের কোন সুযোগ নেই। অ্যারিজোনা বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিভাগের পরিচালক ডায়না লিভারম্যান বলেছেন “তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে এ সম্মেলনকে বাহবা দেওয়ার উপায় নেই। কেননা এই সম্মেলনের চুক্তিতে বলা হয়েছে ২০১৮ সাল নাগাদ বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে। কিন্তু তা এখনো শুরু হয়নি।
সারা পৃথিবী কয়লা, পেট্রোল, গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার করে (গাড়িতে ও কলকারখানায় ব্যবহার হচ্ছে) বাতাসে যে কার্বণ নিঃসরণ করছে, তা কিছুটা বাতাসে, কিছুটা সমুদ্রে, সামাণ্য কিছু মাটিতে চলে যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় তাপমাত্রা শুধু বাড়ছেই না; মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এমনকি পৃথিবীতে মানুষ ও প্রাণিজগতের অস্তিত্বকেও বিপন্ন করে ফেলতে পারে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এমকত। তবু রাষ্ট্রনায়করা কেন কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে একমত হতে পারছেন না? এটি একটি বড় প্রশ্ন। অ·ফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক এরিক বেইনকার ও মাইলস অ্যালেন ভূ-বিজ্ঞান ও অর্থনিতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন যে, কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। প্রাক শিল্পযুগের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। অথচ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি, দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে বৃদ্ধির হার রাখতেও ধনী দেশগুলো সম্মত নয় কেন সেটাই আলোচনার বিষয়।
কারণ যেসব পুজিঁবাদী কর্পোরেশন কার্বন নিঃসরণকারী জিনিস যথা গাড়ি ইত্যাদি তৈরি করে, তারা এই ব্যবসা কমিয়ে এনে মুনাফা হ্রাস করতে রাজি নয়। তারা আপাতত লাভটিকেই প্রধান করে দেখছে। তাদেরই ভবিষ্যত বংশধরদের কী হবে, তা নিয়েও তারা ভাবে না। একমাত্র তাৎক্ষনিক সর্ব্বোচ মুনাফাই তাদের আরাধ্য দেবতা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ধনী দেশগুলোর জনগণও যে ধরণের জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে, তাতে তারা ব্যক্তিগত গাড়ি ইত্যাদির ব্যবহার পরিত্যাগ করতে রাজি নয়। ফলে কর্পোরেট পুঁজির ¯^ার্থে এবং পাশ্চাত্যের জনগণেরও মনোভাবের কারণে পশ্চিমা ধনী দেশের রাষ্ট্রনায়করা কার্বন নিঃসরণকে যথেষ্ট কমিয়ে আনতে রাজি নন। তাঁরা প্রাচ্যের দেশকে বলছেন, তোমরা কমাও। কিন্তু প্রাচ্যের দেশগুলো, উন্নয়শীল দেশগুলো এবং চীন-ভারতের মতো দেশ যারা এখন নতুন করে শিল্পায়ন করছে, তাদের দ্রুত শিল্পায়নের জন্য গ্যাস, তেল, কয়লার অর্থাৎ জীবাশ্ম জ¦ালানির বেশি প্রয়োজন হয়েছে পড়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ু নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধের মূলে রয়েছে এই দ্বন্ধ। আমরা প্রধানত পাশ্চাত্যের করপোরেট পুজিঁবাদকেই পরিবেশ বিপযর্য়ের জন্য দায়ী করতে পারি। সেজন্য তাদের নৈতিক দায়িত্ব ক্ষতিগ্রস্থ ও অনুন্নত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। তাতেও তারা রাজি নয়। পরিবেশের সংকট তাই রাজনীতির সংকটে পরিনত হয়েছে।
কোথায় যাচ্ছে মানবতা
মানুষ বাদে অন্যান্য প্রানী প্রকৃতি থেকে খাদ্য আহরণ করে। মানুষ প্রকৃতির বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে। প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়েছে, শুধু খাদ্যের জন্যই নয়, জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনেও, কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সর্ম্পক রেখেই তা করা দরকার। প্রকৃতিকে অতিরিক্ত শোষণ করতে চাইলে প্রকৃতি পাল্টা শোধ নিতে পারে।
আধুনিক পুঁজিবাদ মাটি, বাতাস, পানি, সমুদ্র, গাছপালা জীবজন্তু সব কিছুকে নির্মমভাবে শোষণ করছে। প্রথম দিকে কম পরিমানে থাকলেও বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া ভালোভাবেই প্রকাশিত হতে থাকে। প্রধানত অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অ·াইড ও অন্যান্য গ্যাস নিঃসরণের ফলে এবং অকাতরে অরণ্য ধ্বংসের কারণে প্রকৃতিতে কতগুলো পরিবর্তন দেখা গেল।
১. অ¯^াভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি (যাকে বলা হয় এৎববহ ঐড়ঁংব ঊভভবপঃ) এর পরিনামে সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাবে এবং অন্যান্য ক্ষতির প্রভাব দেখা দেবে এমনকি পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
২. বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরে ছিদ্র। বিশেষ কিছু গ্যাস নিঃসরণের পরিনামে ওজোন স্তরে যে বিরাট ফাঁকা দেখা দিয়েছে তার পরিনাম হবে ভয়াবহ। কারণ ওজোন স্তর পৃথিবীর মহাকাশের অনেক ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করে। ফলে ওজোন স্তরের ফাঁক প্রানিজগতের অস্তিত্বের জন্যও মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩. গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বন কেটে সাফ করে দেওয়া হয়েছে। এতে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে। আরো অন্যান্য কিছু কারণেও জলবায়ূ ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যেমন এসিড বৃষ্টি ইত্যাদি।
প্রকৃতির এসব পরিবর্তনের জন্য যে মানুষের ক্রিয়াকর্মও দায়ী, এই ¯^ীকৃতি প্রথম মিলল ১৯৯৫ সালে জাতিংসঘের ওহঃবৎমড়াবৎহসবহঃধষ চধহবষ ঙহ ঈষরসধঃব ঈযধহমব- এর রিপোর্টে। সেখানে বলা হলো, যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর অনেক জায়গা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আর গোর একটি বই লিখলেন, ঊধৎঃয রহ ঃযব ইধষধহপব, ঊপড়ষড়ষড়মু ধহফ ঃযব ঐঁসধহ ঝঢ়রৎরঃ যেখানে তিনি ধনী দেশগুলোকে সমš^য় করে পদক্ষেপ নিতে আহবান জানান পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য। জাতিসংঘের রিপোর্ট অথবা গোরের বই কোনটিই কিন্তু সংকটের মূলে যায়নি। অর্থ্যাৎ আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুজিঁর সীমাহীন লালসাকে চিহ্নিত করতে পারেনি।
১৯৯৭ সালে কিয়াটো প্রটোকল ¯^াক্ষরিত হয়েছিল এটাও এক ধরণের ফাঁকা বুলি ছিল। যেখানে বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে পরিবর্তী ১০০ বছরে কার্বন-ডাই-অ·াইড নিঃসরণ পরিপূর্ণ হ্রাস দরকার, যেখানে ১৯৯৭ সালের কিয়াটো প্রটোকলে বলা হয়েছিল ২০১২ সালের মধ্যে ১৯৯০ এ যে পর্যায়ে ছিল তার চেয়ে ৫.২ শতাংশ কমানো হবে। ২০০১ সালের মার্চ মাসের যুক্তরাষ্ট্র কিয়াটো প্রটোকল থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ২০০০ সালে হেগে অনুষ্ঠিত বিশ^ জলবায়ু সম্মেলনে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছিল। এছাড়া সম্প্রতি গৃহীত প্যারিস সমঝোতা ২০১৫ থেকে একইভাবে নির্লজ্জের মত যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে পুনারায় পৃথিবীকে ফেলে দেয় এক অনিশ্চিত গন্তব্যে। এখানে উল্লেখ্য যে, বিশ^ব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের এক পঞ্চমাংশের জন্য দায়ী একাই যুক্তরাষ্ট্র। আর সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলো অর্থাৎ ধনী দেশগুলো একত্রে ধরলে তারা দুই তৃতীয়াংশ গ্যাস নিঃসরণ করে। আর বিশ^ জনসংখ্যার সবচে’ গরিব এক পঞ্চমাংশের গ্যাস নিঃসরণের ভাগ হলো মাত্র দুই শতাংশ।
পরিবেশ নিয়ে রাজনৈতিক মত পাথর্ক্যরে কারণ এখানেই নিহিত আছে। কিন্তু তাৎক্ষনিক সুবিধা ত্যাগ না করলে এবং করপোরেট পুঁজি তার আজকের মুনাফার লোভ পরিত্যাগ না করলে এই ধরণীতে মানুষ কেন কোন প্রানের অস্তিত্বই কল্পনা করা যাবে না।
জলবায়ু পরিবর্তন ও ইসলামের ভাবনা
বর্তমান যুগ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কার উদ্ভাবনের দিক দিয়ে মানব ইতিহাসের প্রগসর যুগ হিসেবে পরিচিত এবং তার এই বৈশিষ্ট্যের কারণে সে ¯^াভাবিকভাবেই এই দাবি করতে পারে, তাকে আবিষ্কার, উদ্ভাবন, বিদ্যুৎ ও ইস্পাত যুগ হিসাবে অভিহিত করা হবে। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে, এসব আবিষ্কার উদ্ভাবনের লক্ষ্য কি এবং তা আপন লক্ষ্য অর্জনে কতটা সফল হয়েছে এবং দুনিয়ার জন্য এসব আবিষ্কার উদ্ভাবন কতটা কল্যাণকর ও বরকতময় প্রমানিত হয়েছে। নাকি সেগুলো পৃথিবীর সমস্যা সংকট ও দুঃখ-কষ্ট কিছুটা বৃদ্ধিই করেছে।
প্রকৃত পক্ষে এসব তাত্তি¡ক গবেষণা ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কার উদ্ভাবনের সঠিক লক্ষ্য হলো, মানুষকে জীবনের ¯^াভাবিক চলার পথে নিজের অজ্ঞতা ও দূর্বলতার কারণে যেসব বাধা বিপত্তির সম্মখীন হতে হয় সেগুলোকে নিয়ন্ত্রনে আনা এবং সঠিক ও বিশুদ্ধ লক্ষ্যের আওতাধীন (যার মধ্যে, পৃথিবীর বুকে মাথা উচুঁ করা ও ফেতনা-ফাসাদ অন্তুর্ভূক্ত নয়) আল্লাহর অপার কুদরতের সেই সব শক্তি ও সম্পদ থেকে উপকৃত ও লাভবান হওয়া যা এই বিশ^ জগতে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
আল্লাহ বলেন, “আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি। স্থলে ও সমুদ্রে চলাচলের বাহন দিয়েছি; ওদেরকে উত্তম রিযিক দান করেছি এবং আমি যা কিছু সৃষ্টি করেছি তার অনেক কিছুর ওপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।” (আল কুরআন ১৭:৭০)
“যিনি যুগলসমূহের প্রতিটিকে সৃষ্টি করেন এবং যিনি তাদের জন্য সৃষ্টি করেন এমন নৌযান ও আন’আম যাতে তোমরা আরোহন কর, যাতে তোমরা ওদের পৃষ্ঠে স্থির হয়ে বসতে পার, তারপর তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তোমরা ওর ওপর স্থির হয়ে বস এবং বল, পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি এদেরকে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যদিও আমরা সমর্থ ছিলাম না এদেরকে বশীভূত করতে। আমরা আমাদের প্রতিপালকের কাছে অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব।” (আল কুরআন ৪৩:১২-১৪)
হযরত সুলায়মান আ.-এর ওপর আপন অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, “আমি সুলায়মানের অধীন করেছিলাম বায়ুকে, যার প্রভাবে এক মাসের পথ অতিক্রম করত এবং সন্ধ্যায় এক মাসের পথ অতিক্রম করত।” (আল কুরআন ৩৪:১২)
“তখন আমি তার অধীন করে দিলাম বায়ুকে, যা তার আদেশে, সে যেখানে ইচ্ছা করত, সেখানে মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহিত হতো।” (আল কুরআন ৩৮:৩৬)
কিন্তু এইসব নেয়ামত ও আরামপ্রদ সুযোগ-সুবিধা থেকে ফায়দা হাসিলের জ্ঞাত ও আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞ লোকের মন-মানসিকতার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। একজন মুমিন ও বিশ^াসী বান্দাকে এর জন্য হেদায়েত দেওয়া হয়েছে এবং তার কাছে আশা করা হয়েছে নেয়ামত থেকে উপকৃত হবার সময় একথা সবসময় ও সদা-সর্বদা মনে রাখার এ শুধুই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত পুরস্কার ও তার দান।
অনন্তর সহীহ শুদ্ধ দ¦ীন তাই যা আল্লাহর পরিচয় ও আল্লাহর ভয়ভীতি সৃষ্টি করে, যা গোটা সৃষ্টি জগতের আসল ¯্রষ্টা এবং বিশ^জাহানের প্রকৃত শাসকের পরিচয় জ্ঞাপন করে এবং বলে, মানুষ ঐসব শক্তি ও সম্পদের আমানতদার মাত্র। তাকে তাঁর সামনে হাজির হতে হবে এবং এসব শক্তি ও সম্পদ সে কোথায় ব্যয় করেছে যে সম্পর্ক তাকে জওয়াব দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন,
“আমি লোহা দিয়েছি, যাতে প্রচন্ড শক্তি রয়েছে এবং মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ। এজন্য যে, আল্লাহ প্রকাশ করে দেবেন কে প্রত্যক্ষ না করেও তাঁকে ও তাঁর রসূলকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিমান পরাক্রমশালী।” (আল কুরআন ৫৭:২৫)
ধর্ম তথা দীন তো তাই যা মানুষকে শক্তির নেশায় মত্ত আপন ক্ষমতা ও এখতিয়ারাধীন শক্তিদৃষ্টে আত্মহারা হতে দেয় না। দীন তো তাই যা ঐসব বস্তু সামগ্রীকে বৈধ, অনুমোদিত ও যথাযথ স্থানে ব্যবহার ও নিয়োগের রাস্তা বাতলে দেয়। সে ঐসব জিনিসকে কার্যকর, মানব জাতির জন্য উপকারী এবং দুনিয়ার অনুকূলে কল্যাণ ও বরকতের হেতু বানায়। দীন তো তাই যা মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি, তার শক্তি ও তার আখলাকের মধ্যে ভারসাম্য কায়েক রাখে। একমাত্র দীন তথা ধর্মই মানুষের ব্যক্তিগত উপকারিতা ও কল্যান চিন্তাকে সমষ্টিগত উপকারিতা ও কল্যানচিন্তার সম্পর্কযুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ন রাখে। ধর্মই মানুষের মধ্যে আপন শক্তি ও এখতিয়ারসমূহকে পর্যবেক্ষণ ও অনুভবের সময় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যপূর্ণ এবং গর্ব ও অহংকারের পরিবর্তে ন¤্রতা, বিনয়, বান্দাসুলভ শান সৃষ্টি করে। কুরআনে এ ব্যাপারে উল্লেখ আছে, হযরত ইউসুফ আ. ঠিক ক্ষমতার মসনদে পরিপূর্ণ দাপটের সঙ্গে আসীন থাকাকালে বলেছিলেন,
“হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে রাজ্য দান করেছ এবং ¯^প্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছ। হে আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীর ¯্রষ্টা! তুমিই হইলোক ও পরলোকে আমার অভিভাবক। তুমি আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দাও এবং আমাকে সৎ কর্মপরায়নদের অন্তুর্ভূক্ত কর।” (আল কুরআন ১২:১০১)
উল্লেখ্য বিষয়বস্তু থেকে এটা অনুধাবনীয় যে, পুঁজিবাদ মানুষকে লাগমহীন লালসায় আবিষ্ট করে ধনীকে আরও ধনী বানাচ্ছে আর দরিদ্রকে আরও দ্ররিদ্রতর করে তাকে নিঃ¯^ করে দিচ্ছে। আর এ কারণেই পুঁজিবাদের ধারক বাহকরা প্রকৃতির ওপর যখন যেমন খুশি আচরণ করছে একমাত্র মুনাফার জন্য। আজ দেখা যায় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র বার বার তাদের কমিটমেন্টের জায়গা থেকে সরে গিয়ে শুধুমাত্র নিজেদের কথা চিন্তা করছে আর এতে অন্যান্য জাতি, প্রানীর অস্তিত্ব কী হবে এ ব্যাপারে তাদের ভ্রæক্ষেপ নেই। আজ কার্পোরেট পুঁজিবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ সরিয়ে পৃথিবীতে শান্তি, সামঞ্জস্যতা ফিরিয়ে আনার একমাত্র বিকল্প পন্থা হলো ইসলাম। কারণ ইসলাম আমাদেরকে রবুবিয়াত ও তাওহীদবাদের শিক্ষা দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প এবং নীতি নৈতিকতা ও মানবতার মাঝে যে বিরাট ব্যবধান বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যাতা সৃষ্টি করে দিয়েছে এ থেকে উত্তরণের বিকল্প ধারাটি পুনরায় ফিরিয়ে আনতে দ্বীনের বিকল্প নেই।
পাশ্চাত্য জাতিগুলো দীর্ঘকাল থেকে এই বিশ^াস পোষণ করে আসছে, আনন্দ ফুর্তি, আরাম আয়েশ, বস্তুগত সুযোগ সুবিধা ভোগ, মাথা উচুঁ করে চলা ও অন্যের উপর প্রাধান্য লাভ করা ছাড়া পৃথিবীর বুকে মানুষের আর কোন অর্জন্যযোগ্য লক্ষ্য নেই। ফলে ¯^াভাবিক ভাবেই তারা নিজেদের সমগ্র শক্তি ও মেধা এসব লক্ষ্য অর্জনে ব্যয় করেছে এবং এমন সব যন্ত্রপাতি ও উপায় উপকরন আবিষ্কার করেছে যা দিয়ে এসব লক্ষ্য খুব সহজেও দ্রুততার সঙ্গে অর্জন করা যায়। ক্রমাš^য়ে উপকরনগুলো নিজেই একদিন লক্ষ্যে পরিনত হয়ে গেল এবং আবিষ্কার উদ্ভাবন আপন জায়গায় নিজেই বিরাট ও মহান লক্ষ্যহিসাবে অভিহিত হলো। পাশ্চাত্যের মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটতে লাগল। মানদন্ড বদলে গেল। কিছুকাল আগে তাদের এই ধারনা ছিল, আরামের নামই হলো সভ্যতা আর আমার তথা প্রশান্তি ছিল তাদের সবচাইতে বড় আর্দশ। অতঃপর বিভিন্ন কার্যকারণের উপর ভিত্তি করে এবং কিছুটা আরাম ও প্রশান্তি লাভের নিমিত্তে দ্রুততা ও দ্রুত গামিতার প্রয়াস গ্রহণ করা হয় এবং জীবনের সকল শাখায় দ্রুততা ও গতি সৃষ্টির প্রতিযোগীতা সৃষ্টি হয়। এভাবেই তারা ক্রমাš^য়ে মনে করতে থাকে দ্রুততার নামই হলো সভ্যতা। এখন দ্রুততা তথা গতিই তাদের জীবনের আর্দশে পরিনত হয়েছে। এই আর্দশকে চিরস্থায়ী রূপ দেয়ার অন্যতম পন্থাই হলো পুজিঁবাদ।
পরিশেষে এই বলা যায়, পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে উন্নত বিশে^র কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায় নি। ফলে বিংশ শতাব্দীতে পরিবেশ বিপর্যয় বেড়েছিল। একুশ শতকে এসে পরিবেশ দূষনের ব্যাপারে জনসচেতনতা বেড়েছে। বিশে^র উষ্ণতা আরো বাড়ছে। আর প্রতিনিয়ত ক্ষমতার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে মানবতা। জলবায়ু পরিবর্তন রোধকল্পে পুনঃনবায়নযোগ্য জ¦ালানী, সৌরশক্তি ইত্যাদির ব্যবহারই হতে পারে বিকল্প পদ্ধতি এমনটাই মতামত বিশেষজ্ঞদের। আর এই কর্পোরেট পুঁজি ও তাৎক্ষনিক মুনাফার হাত থেকে ধরিত্রীকে রক্ষা করতে হলে তওহীদবাদ ও রবুবিয়াতের মর্মবানী পৌঁছে দিতে হবে সর্বত্র।
তথ্যসূত্র :
১. অক্সফাম : বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি ও খেসারত- ২০০৭।
২. Tragedy of Commons- Garrett Hardin.
৩. অক্সফাম : জলবায়ু পরিবর্তন- মার্চ ২০১৪।
৪. Al Gore, ÔEarth in the Balance,Ecology and the Human Spirit’ New York 1992.
৫. Nazli Choucri, ed; Global Accord; Environmental Challenges and International Responses, Cam Bridge 1993
৬. মুসলমানদের পতনে বিশ^ কী হারালো? -সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী
৭. বিশ^ রাজনীতির ১০০ বছর- তারেক শামসুর রেহমান
৮. উইকিপিডিয়া (উন্মুক্ত বিশ্বকোষ)
লেখক : এমএম শোযাইব